জীবনে সফলতার জন্য চাই একনিষ্ঠতা
পৃথিবীতে যারা সফলতার সর্বশিখরে আরোহণ করেছেন, তাদের প্রত্যেকের মাঝে সাধারণ যে গুণ বা বৈশিষ্ট্যটি সর্বাধিক লক্ষ্যণীয় তা হ’ল একনিষ্ঠতা। যারা যে কাজে একনিষ্ঠ ও সৎ থেকেছেন, বিশ্বস্ততার সাথে নিজের কর্তব্য সমাধা করেছেন, তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে আবশ্যকভাবে সফলতার মুকুট পরেছেন। যদিওবা কেউ জীবদ্দশায় সফল হননি, তবুও পরবর্তী প্রজন্ম তার ফসল যুগ যুগ ধরে ভোগ করে গেছে। অপরপক্ষে কোন কাজ যদি সৎ নিয়ত, সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতার সাথে না করা হয়, তবে যত বড় কাজই হোক না কেন, তাতে সফলতা আসতে পারে না। সাময়িকভাবে তা কখনও রঙ চড়ালেও এক সময় তা বুদবুদের মতই হারিয়ে যায়।
আধুনিক তরুণ সমাজে অন্যতম যে সমস্যাটি প্রকটভাবে ফুটে উঠছে তা হল, খ্যাতি বা আত্মপ্রচারের নেশা। যার অনিবার্য ফলাফল হ’ল ইখলাছের ঘাটতি, সফলতার জন্য শর্টকাট রাস্তা খোঁজা, কপটতা এবং শেষমেষ ব্যর্থতা ও হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হওয়া। তথ্যপ্রযুক্তি এবং নিত্য-নতুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসার এতে যোগ করেছে অবক্ষয়ের এক নতুন অধ্যায়। জীবনে বড় স্বপ্ন থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের যদি কোন বিশেষ লক্ষ্য না থাকে, মহৎ কিছুর স্বপ্ন না থাকে তবে সে জীবন সৃজনশীল ও সার্থক হয়ে গড়ে ওঠে না। সুতরাং তারুণ্যের স্বপ্নজগতের সীমা-পরিসীমা আকাশছোঁয়া থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত। এপিজে আবুল কালাম যথার্থই বলেছেন, ‘স্বপ্ন তা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে দেখ, বরং স্বপ্ন তা-ই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না’। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, স্বপ্ন হবে বাস্তবতাবিবর্জিত, স্বপ্ন ছোঁয়ার পথ ও পদ্ধতি হবে কোন শর্টকাট রাস্তায় কিংবা অসদুপায় অবলম্বন করে। আত্মপ্রচার, আত্মপ্রশংসা, সমাজে নাম-ডাক, প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভের গোপন প্রত্যাশা কখনই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ নয়।
কোন মহৎ স্বপ্ন অর্জন করতে গেলে তার পিছনে অবশ্যই দীর্ঘ সময় দিতে হয়, একাধারে তার পিছনে লেগে থাকতে হয়, তার প্রতি সৎ এবং বিশ্বস্ত থাকতে হয়। সর্বোপরি আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা এবং তাঁর রহমতে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং কোন স্বপ্ন অর্জনে বিশুদ্ধ নিয়ত এবং সঠিক কর্মপদ্ধতির কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীর সকল মনীষীই এক বাক্যে বলেছেন, জীবনে সফল হওয়ার জন্য কোন শর্টকাট পথ নেই।
ইখলাছহীন কর্ম যেমন দুনিয়াবী জীবনে সফল হয় না, তেমনি পরকালীন জীবনেও তার কোন মূল্য থাকে না। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের আমলই গ্রহণ করে থাকেন’ (মায়েদা ৫/২৭)। রাসূল (ছাঃ)-কে একদিন এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করল, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কী বলবেন যে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে নেকীও লাভ করতে চায় আবার মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধিও অর্জন করতে চায়? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তার জন্য কিছুই নেই। সেই ব্যক্তি তিনবার একই প্রশ্ন করল, রাসূল (ছাঃ) একই জবাব দিলেন। অতঃপর বললেন, আল্লাহ সেই আমল ব্যতীত কোন আমল কবুল করেন না, যে আমল কেবল তাঁরই উদ্দেশ্যে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায় করা হয় (নাসাঈ হা/৩১৪০, সনদ ছহীহ)। সুতরাং ইখলাছহীন আমল যে কত ভয়ংকর, তা এই হাদীছ থেকে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
একজন পশ্চিমা লেখক সত্যিই বলেছেন, Sincerity makes the very least person to be of more value than the most talented hypocrite অর্থাৎ ‘ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা একজন অতি সামান্য ব্যক্তিকেও ‘সর্বোচ্চ প্রতিভাধর, অথচ কপট’-এমন ব্যক্তির চেয়ে অধিকতর মূল্যবান করে তোলে’। সুতরাং তরুণ সমাজ যারা আপন মেধা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তাদের প্রতি একান্ত অনুরোধ, আত্মপরতা, আত্মপ্রচার, সমাজে নাম-ডাক লাভের আকাংখা প্রভৃতি আত্মবিনাশী রোগ যেন আমাদের কোনমতেই গ্রাস না করে ফেলে। মেধার সাথে সততা ও আমানতদারিতা যদি যুক্ত না হয়, তবে সেই মেধা কখনই জাতির উপকারে আসবে না। খ্যাতির সাময়িক রঙিন জগত হয়ত পুলক যোগাবে, কিন্তু আদতে তা দুনিয়া ও আখেরাতে কোথাও সফলতার মুখ দেখবে না। এটাই আল্লাহর রীতি। সুতরাং সফলতা অর্জন করতে হলে অবশ্যই নিজের অন্তর্জগতকে পরিশুদ্ধ রাখতে হবে, উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সৎ থাকতে হবে এবং আমানতদারিতার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। সর্বোপরি লক্ষ্যে অটুট থাকতে হবে। তবেই তাতে আল্লাহর রহমত নেমে আসবে এবং জাতি ও সমাজের জন্য তা একদিন কল্যাণময় পথের দিশারী হবে ইনশাল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন!