• free web stats
  • At-Tahreek
    তারবিয়াত

    সন্তান প্রতিপালন

    (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

    একজন আদর্শ পিতার দায়িত্ব ও কর্তব্য :

    সুস্থ মা, সুস্থ সন্তান ও সুস্থ জাতি সকল দায়িত্বশীল পিতারই কাম্য। সন্তানের মঙ্গলের জন্যই গর্ভধারিণী মাতার স্বাস্থ্য রক্ষা, সুস্থ দেহ, মন-মানসিকতা দিকে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে পিতাকে। কেননা মা সুস্থ সবল না থাকলে, সুস্থ সবল সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। সুস্থ, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার ব্যবস্থা, পুষ্টিকর ও ভিটামিনযুক্ত খাবার সরবরাহ করা ও ইসলামী ভাবধারা সম্বলিত পুস্তকাদি সরবরাহ করা একজন পিতার একান্ত যরূরী। পাশাপাশি মায়ের দৈহিক পরিশ্রম লাঘবের জন্যে পিতাকে গৃহস্থালী কাজে সহায়তা করতে হবে। সর্বোপরি সর্বাঙ্গীন সুন্দর সন্তান প্রাপ্তির আশায় মায়ের জন্য সবাইকে যাবতীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে একজন অনাগত সন্তান সুস্থ ও সুন্দরভাবে পৃথিবীতে আসার জন্য এ সমস্ত বিষয় একজন আদর্শ পিতার প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর জন্মদাতা পিতার দায়িত্ব হ’ল ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রসূতি মায়েদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা (বাক্বারাহ ২/২৩৩)

    নবজাতকের বাড়তি যত্ন :

    পৃথিবীতে সবাই স্নেহ-ভালবাসা চাই। সন্তান পেটে থাকাকালীন অবস্থায় যে জগতে ছিল এখন সে অন্য জগতে পদার্পণ করেছে। এজন্য সে বার বার কাঁদে আর বুঝাতে থাকে যে, তার জন্য অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তাই সন্তান মায়ের হৃদয়ের দরদ ও পরম স্নেহ-যত্নের দাবীদার। মা কোন  প্রকার  ঘৃণা  না  করে আন্তরিক ভালবাসা দিয়ে সন্তানের  পরিচর্যা  করবে।  আদর-স্নেহ  হ’তে  বঞ্চিত সন্তানদের স্বভাব-চরিত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে থাকে। স্নেহের পরশে প্রতিপালনকারী মা আল্লাহর অনুগ্রহের অংশীদারিণী হয়ে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একবার হাসান বিন আলী (রাঃ)-কে স্বস্নেহে চুম্বন করেন। আকরা বিন হাবিস আত-তামিমী (রাঃ) এ দৃশ্য দেখে বললেন, إِنَّ لِىْ مِنَ الْوَلَدِ عَشَرَةً مَا قَبَّلْتُ أَحَدًا مِِّنْهُمْ. ‘আমার দশটি সন্তান আছে, আমি তাদের কাউকেই কোন দিন চুম্বন করিনি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, إِنَّهُ مَنْ لاَ يَرْحَمْ لاَ يُرْحَمْ ‘যে দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না’ । [1]

    অন্য আরেকটি হাদীছে এসেছে,

    عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : قَدِمَ نَاسٌ مِّنَ الْأَعْرَابِ عَلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالُوْا : أَتُقَبِّلُوْنَ صِبْيَاَكُمْ؟ قَالُوْا : نَعَمْ، فَقَالُوْا لَكِنَّا وَاللهِ! مَانُقَبِّلُ فَقََالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَمْلِكُ أَنْ كَانَ اللهُ قَدْ نَزَعَ مِنْكُمُ الرَّحْمَةَ-

    আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদল বেদুঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, তোমরা কি তোমাদের সন্তানদেরকে চুমু দাও? উপস্থিত সবাই বলল, হ্যাঁ। তখন তারা বলল, কিন্তু আল্লাহর কসম! আমরা তাদেরকে চুমু দেই না। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের অন্তর থেকে মায়া-মমতা তুলে নিলে আমি কী করতে পারি’।[2] সন্তান জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে মায়ের নিকট অধিক সময় থাকে। তাই মায়ের যথেষ্ট স্নেহের পরশ না পেলে সে নিজেকে অসহায় মনে করবে। মনরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অসহায়ত্বের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এমন রূপ ধারণ করবে যা সারা জীবন খেসারত দিয়েও পরিশোধ করা যাবে না।

    খাৎনা করানো :

    পিতা যথাসময়ে সন্তানের খাৎনা (পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের বাড়তি চামড়া কেটে ফেলা) করাবেন। খাৎনা করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ ও ইসলামের উত্তম পন্থা, বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত কাজ। এটি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত ও শারঈ বিধান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাদীছে একে ইসলামের ফিৎরাত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে'। [3] এটি কুরবানীর ন্যায় ইবরাহীম (আঃ)-এর অন্যতম সুন্নাত। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ইবরাহীম (আঃ) ৮০ বছর বয়সে বাইশ (কুড়াল) দ্বারা খাৎনা করেছিলেন’।[4]  হাদীছে বাইশ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ধারালো অস্ত্র। আলী বিন রাবাহ বলেন, ইবরাহীম (আঃ) কে খাৎনা করার নির্দেশ দেওয়া হ’লে তিনি কুড়াল দ্বারা খাৎনা করেন। এতে তার জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। তখন আল্লাহ তাঁর কাছে অহী করে বলেন যে, আমি আপনাকে ধারালো যন্ত্র দ্বারা খাৎনা করার নির্দেশ দেওয়ার পূবেই আপনি তাড়াহুড়া করেছেন। তখন ইবরাহীম (আঃ) বলেন, হে আমার রব! আমি আপনার নির্দেশ বাস্তবায়নে বিলম্ব করতে অপসন্দ করলাম (ফাতহুল বারী ৬/৩৯০)। ইবনু আববাস (রাঃ) এর গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেন,  الأَقْلَفُ لاَ تَجُوزُ شَهَادَتُهُ ، وَلاَ تُقْبَلُ لَهُ صَلاَةٌ ، وَلاَ تُؤْكَلُ لَهُ ذَبِيحَةٌ.  ‘খাৎনাবিহীন লোকের সাক্ষ্য জায়েয নয়, তার ছালাত কবুল হবে না এবং তার যবেহ করা পশু খাওয়া যাবে না। অন্য বর্ণনায় আছে, তার হজ্জ নাই’।[5] এর দ্বারা তিনি খাৎনার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। জনৈক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَلْقِ عَنْكَ شَعَرَ الْكُفْرِ وَاخْتَتِنْ ‘তুমি তোমার থেকে কুফরীর চুল দূরিভুত কর এবং খাৎনা কর’। [6] প্রকাশ থাকে যে, নবী (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগের খাৎনা ব্যতীত কোন অনুষ্ঠান করার প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং খাৎনা কার্যে বাড়াবাড়ি বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘স্বভাব সম্মত কাজ পাঁচটি। তন্মধ্যে মধ্যে খাৎনা একটি’।[7] খাৎনা আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত ও সর্বজনস্বীকৃত।

    সন্তানদের প্রতি সমতা স্থাপন করা :

    সন্তানসন্ততি পিতারমাতার স্নেহে-আদরের অর্জিত সম্পদ ও সৌন্দর্য । সর্বক্ষেত্রে পিতামাতকে উভয়ের মাঝে সমতা স্থাপন করতে হবে। সন্তান পুত্র হৌক বা কন্যা হৌক আচরণের ক্ষেত্রে এ দু’য়ের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ অসম আচরণে সন্তানদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। একে অপরের প্রতি দুঃখ, ভালবাসার স্থলে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মনোভাব স্থান পায়, পরস্পরের মধ্যে ঐক্যের স্থলে সৃষ্টি হয় বিবাদ ও বিসম্বাদ।[8] তাই এহেন পক্ষপাতমূলক কাজ হ’তে পিতাকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

    عَنْ أَنَسٍ قَالَ كَانَ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ فَجَاءَ ابْنٌ لَهُ فَقَبَّلَهُ وَأَجْلَسَهُ عَلَى فَخِذِهِ ثُمَّ جَاءَتْ بِنْتٌ لَهُ فَأَجْلَسَهَا إِلَى جَنْبِهِ قَالَ: فَهَلَّا عَدَلْتَ بَيْنَهُمَا؟

    আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে একজন লোক বসেছিল। অতঃপর তার একটি ছেলে সন্তান (তার নিকট) আসলে সে তাকে চুমু দিয়ে রানের উপর বসালো। অতঃপর তার একটি কন্যা সন্তান আগমন করলে তাকে পাশে বসালো। তিনি বললেন, তুমি উভয়ের মাঝে ইনছাফ করলে না কেন? [9] এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আদর-স্নেহ, ধন-সম্পদ যাবতীয় বিষয়ে সন্তানদের মাঝে সমতা স্থাপন করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন,

    عَنْ عَامِرٍ قَالَ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ  رضى الله عنهما وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ يَقُولُ أَعْطَانِى أَبِى عَطِيَّةً، فَقَالَتْ عَمْرَةُ بِنْتُ رَوَاحَةَ لاَ أَرْضَى حَتَّى تُشْهِدَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم. فَأَتَى رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ :إِنِّى أَعْطَيْتُ ابْنِى مِنْ عَمْرَةَ بِنْتِ رَوَاحَةَ عَطِيَّةً ، فَأَمَرَتْنِى أَنْ أُشْهِدَكَ يَا رَسُولَ اللهِ . قَالَ: أَعْطَيْتَ سَائِرَ وَلَدِكَ مِثْلَ هَذَا؟ قَالَ : لاَ . قَالَ : فَاتَّقُوا اللهَ، وَاعْدِلُوا بَيْنَ أَوْلاَدِكُمْ . قَالَ فَرَجَعَ فَرَدَّ عَطِيَّتَهُ-

    আমের (রহঃ) হ’তে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছি যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মাতা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সাক্ষী রাখা ব্যতীত সম্মত নয় । তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আম্রা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম দিয়েছ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। ছাহাবী নু‘মান (রাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে  গেলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন।[10] অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, অন্য কাউকে সাক্ষী রাখ। কারণ আমি অন্যায় কাজের সাক্ষী থাকি না’।[11]  আবুবকর (রাঃ) স্বীয় কন্যা আয়েশা (রাঃ)- কে বিশ ওয়াসাক সম্পত্তি দান করেন। মৃত্যুর সময় হ’লে তিনি মেয়েকে ডেকে বলেন, আমি পৃথিবীতে তোমার  সর্বাধিক ঐশ্বর্য কামনা করি। কিন্তু ঐ সম্পদগুলো এখন তোমার ও তোমার ভাই-বোনদের। তাদের মধ্যে তুমি সেগুলো আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বণ্টন করে দিবে'।[12] এ সকল হাদীছ ও আছার থেকে বুঝা যায় যে, সন্তানদের প্রতি সর্বক্ষেত্রে সমতা স্থাপন করা পিতা-মাতার গুরুদায়িত্ব। তবে বাবা-মা’র মৃত্যুর পর পরিত্যাক্ত সম্পদ এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান-এর ভিত্তিতে বণ্টিত হবে (নিসা ৩/১১)

    সমাজে কিছু লোক আছে যারা সন্তানদের উপর কৃত সদ্ব্যবহার ও অনুকম্পার প্রেক্ষিতে তাদের কোন কোন সন্তানকে অন্যদের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর এ কারণেই যদি পিতা-মাতা তাকে দান-অনুদান এবং পারিতোষিক প্রদান করেন, তা হ’লে সেটা কখনো সঠিক হবে না। অর্থাৎ কারো সদ্ব্যবহার অথবা পুণ্যবান হওয়ার কারণে তার বিনিময়ে কিছু দেয়া জায়েয হবে না। কেননা, নেক কাজের পরিণাম ও ফলাফল আল্লাহর কাছেই রয়েছে। তাছাড়া কোনো সৎস্বভাব বিশিষ্ট সন্তানকে যদি অনুরূপভাবে অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে বেশী দান করা হয়, তাহ’লে সে মনে মনে গর্বিত ও আত্মতুষ্ট না হয়ে পারে না এবং সে সব সময়ই তার একটি (বাড়তি) মর্যাদা আছে বলে ধরে নেবে, যার ফলে অন্যরা পিতা-মাতাকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করবে এবং তাদের ওপর যুলুম চালিয়ে যেতে থাকবে। অপর দিকে ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা আদৌ কিছু জানি না। এমনও তো হ’তে পারে যে, এখন যে অবস্থাটা কারো ব্যাপারে বিদ্যমান রয়েছে, তার আমূল পরিবর্তন হ’তে পারে। আর এ ভাবেই একজন অনুগত ও পুণ্যাত্মা আগামী দিনগুলোতে বিদ্রোহী ও অত্যাচারী হয়ে যেতে পারে এবং একজন বিদ্রোহীও পুণ্যাত্মায় পরিণত হতে পারে। মানুষের অন্তর সমূহ আল্লাহর হাতেই নিবদ্ধ-তিনি যেদিকে চান সে দিকেই তা ঘুরাতে সক্ষম।

    বিবাহ দেওয়া :

    পিতা-মাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হ’ল ছেলে-মেয়ে উপযুক্ত বয়সে পদার্পণ করলে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَنْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَائِكُمْ إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তোমরা তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল তাদেরও। যদি তারা নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন’ (নূর ২৪/৩২)। রাসূল (ছাঃ)  বলেছেন,  يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ  ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা উহা লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে এবং চক্ষুকে অবনত রাখে। আর যে সামর্থ্য রাখে না সে যেন ছিয়াম পালন করে। কারণ ছিয়াম হ’ল তার জন্য ঢাল স্বরূপ’। [13] তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিবাহ করল সে যেন দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করল। অতএব বাকী অর্ধেকের ব্যাপারে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে’।[14] নিজেকে ব্যভিচার থেকে হেফাযতের উদ্দেশ্যে বিবাহকারীকে আল্লাহ সাহায্য করেন’।[15] তবে পাত্র বা পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ধন-সম্পদ নয় বরং দ্বীনকে প্রাধান্য দিতে হবে। অন্যথায় ইহকাল ও পরকাল উভয় বিনষ্ট হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِذَا خَطَبَ إِلَيْكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوهُ إِلاَّ تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِى الأَرْضِ وَفَسَادٌ عَرِيضٌ  ‘যদি তোমাদের কাছে এমন কেউ বিবাহের প্রস্তাব দেয় যার দ্বীন ও চরিত্র তোমাদের নিকট পসন্দনীয় তবে তাকে বিয়ে দিয়ে দাও। যদি এরূপ না কর তবে পৃথিবীতে ফিৎনা ও বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে’।[16] তিনি আরো বলেন, تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لأَرْبَعٍ لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا ، فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاكَ ‘সাধারণতঃ মেয়েদের চারটি গুণ দেখে বিবাহ করা হয়- তার ধন-সম্পদ, বংশ-মর্যাদা, সৌন্দর্য এবং ধর্ম। তোমরা ধার্মিক মেয়েকে অগ্রাধিকার দাও। অন্যথায় তোমাদের উভয় হস্ত অবশ্যই ধূলায় ধূসরিত হবে’।[17] পাত্র-পাত্রীর ক্ষেত্রে তার দ্বীনদারী এবং উত্তম আচরণের দিকে লক্ষ্য করতে হবে। অবশ্যই যৌতুক বর্জন করতে হবে। মেয়েরা অবশ্যই অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে বিবাহ করবে। অন্যথায় সে বিবাহ বাতিল বলে গণ্য হবে।

    বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে আশ্রয় দান :

    কোন কারণে কন্যা যদি স্বামী কর্তৃক পরিত্যাক্তা হয় কিংবা বিধবা বা অসহায় হয়ে পড়ে, তখন পিতা সেই ভাগ্যাহতা কন্যাকে সাদরে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, আশ্রয় ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবেন। কোন অবস্থাতেই পিতা তার ব্যাপারে বিমুখ হবেন না। সন্তানের এ অধিকার পিতার নিকট প্রাপ্য। হাদীছে এসেছে,

    عَن عَن أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَحْسِبُهُ قَالَ يَشُكُّ كَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ وَكَالصَّائِمِ لَا يُفْطِرُ-

    আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, বিধবা ও মিসকীনের লালন-পালনকারী আল্লাহর রাস্তায় প্রচেষ্টাকারীর ন্যায়। রাবী বলেন, আমার মনে হয়, তিনি একথাও বলেছেন যে, ঐ ব্যক্তি আলস্যহীন ছালাত আদায়কারী ও বিরতিহীন ছিয়াম পালনকারীর ন্যায়’। [18]

    মায়ের জন্য সন্তানকে দুধপান করানো :

    গাছের শাখা যেমন মূলের মুখাপেক্ষী, তেমনি শিশু জন্মের পর মায়ের উপর নির্ভরশীল। শিশুর স্বাস্থ্য, মন-মানসিকতা, চরিত্র ও রুচি গঠনে মায়ের দুধের ভূমিকা যথেষ্ট। শিশুর জন্মের সাথে সাথে আল্লাহর রহমতে মাতৃস্তনে দুধের সৃষ্টি হয়। মা যতবার শিশুকে দুধ পান করাবে ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানযুক্ত আল্লাহ প্রদত্ত এমন তৈরী খাবার, যা শিশু সহজেই হজম করতে পারে এবং তা শিশুর শরীরের বৃদ্ধি ঘটাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিশুর শরীরের খাদ্য চাহিদার যে পরিবর্তন ঘটে, মায়ের বুকের দুধ প্রতিনিয়ত টনিকের কাজ করে। শিশুর দেহ যে পরিমাণ তাপমাত্রা হ’লে দুধ তার দেহে কাজে লাগতে পারে, সেরূপ তাপমাত্রা মায়ের বুকের দুধে বিদ্যমান থাকে। শিশুকে সুস্থ-সুন্দর করে গড়ে তুলতে হ’লে মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই। মায়ের বুকের দুধে বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধক উপাদান থাকে। যেমন- আই.জি.এ ল্যাকটোফেরিন এবং লাইসোজাইম। এছাড়াও মায়ের বুকের দুধে প্রচুর শ্বেত রক্তকণিকা থাকে যেগুলো আবার আই.জি.এ ল্যাকটোফেরিন, লাইসোজাইম, ইন্টারফেরন তৈরী করে। বাইফিজস ফ্যাকটর নামে আরও একটি পদার্থ মাতৃদুগ্ধে পাওয়া যায়। এগুলো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করে। যার ফলে বাচ্চার দেহে ডায়রিয়া, কান পাকা, শ্বাসনালীর রোগ কম হয়।

    এছাড়া মাতৃদুগ্ধ পানে হৃৎপিন্ডের, করোনারী, খাদ্যনালীর রোগ প্রভৃতি প্রতিরোধ করে। মায়ের দুধ পান শিশুর চেহারার লাবণ্য সৃষ্টি করে, বাকশক্তি ও সাধারণ বুদ্ধি বিকাশে সাহায্য করে। বিশেষ কারণ বশতঃ কোন শিশুকে আপন মা ব্যতীত অন্য মহিলার দুধ পান করানোর প্রয়োজন হয়ে পড়লে, সেক্ষেত্রে দুশ্চরিত্রা ও অসুস্থ মহিলার দুধ পান করানো হ’তে বিরত রাখতে হবে। সন্তানকে দুধপান করানোর কারণে আল্লাহ মায়েদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সন্তানকে দুধপান করানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন,  وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلاَدَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُُّتِمَّ الرَّضَاعَةَ-   ‘যে সকল জননী সন্তানদের পুরো সময় পর্যন্ত দুগ্ধ দান করতে ইচ্ছা রাখে, তারা নিজেদের শিশুদেরকে পুরো দু’বছর ধরে দুগ্ধ পান করাবে’ (বাক্বারাহ ২/২৩৩)

    সুতরাং পৃথিবীতে কোন মা যেন বিশেষ কারণ ছাড়া স্বীয় দুধপান থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করে শিশুর অধিকার হরণ না করেন। বিশেষ কারণ ছাড়া কোন মা শিশুকে দুধ পান হ’তে বঞ্চিত করে যে ক্ষতি সাধন করে, তা অপূরণীয়। কারণ স্তন্যদান মায়ের মধ্যে সৃষ্টি করে শিশুর প্রতি এক বিশেষ স্নেহ প্রবণতা ও আবেগ-অনুভূতি। যে সকল মহিলা তাদের চাকচিক্য ও রূপ-লাবণ্য নষ্ট হবার ভয়ে শিশুকে বুকের দুধ পান করানো হ’তে বিরত থাকে, তাদের এ হীন মানসিকতা এক্ষুনি পরিত্যাগ করা উচিত। যে মা তার সন্তানকে দুধ পান থেকে বঞ্চিত করবে সে মা পরবর্তীতে সন্তানের ভালবাসা পাবে না। যে মা সন্তানকে দুধ পান করাবে না কিয়ামতের দিন বিষধর সাপ সে মায়ের স্তনে মুখ লাগিয়ে দুধ পান করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম একদল নারীর পায়ের গোছায় রশি বেঁধে নীচের দিকে মাথা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর সাপ তাদের স্তন দংশন করছে। জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? উত্তরে তারা বললেন, এরা ঐ সকল মহিলা, যারা (শারীরিক সৌন্দর্য অটুট রাখার জন্য) নিজ সন্তানদের দুধ পান থেকে বঞ্চিত করেছিল’। [19]

    সন্তানদের যেভাবে আদর্শবান করা যায় :

    (ক) সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া :

    ‘নীতিহীন মানুষ পশুর তুল্য’ একথাটি সবাই জানলেও নিজের অজান্তে অনেকে নীতিহীন কর্মে জড়িয়ে পড়ে। সন্তান নৈতিকতা নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভকারী প্রত্যেকটি শিশুই ‘ফিতরাতের’ (স্বভাবধর্ম) উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর পিতা মাতা তাকে ইহূদী অথবা খ্রিষ্টান কিংবা অগ্নিপূজক বানায়’।[20] তিনি আরো বলেন, ‘আমার প্রভু বলেন, আমার বান্দাদেরকে একনিষ্ঠ সত্যাশ্রয়ী করে সৃষ্টি করেছি। তারপর শয়তান তাদেরকে দ্বীন থেকে বিভ্রান্ত করে দেয়’।[21] পরে পিতা-মাতা সন্তানকে নীতিবান বা নীতিহীন বানিয়ে দেয়। সন্তান পিতা-মাতার কর্ম থেকে অনেক কিছুই শেখে। পিতা-মাতা ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ও লম্পট হ’লে সন্তান সেভাবেই গড়ে উঠে। নৈতিক শিক্ষা দেয়ার পদক্ষেপ শিশুকাল থেকে নিতে হবে। চরিত্র গঠন ও উন্নত জীবনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করার কোন বিকল্প নেই। এতে করে শিশুর মনে যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়, তা তাকে যে কোন খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। বাবা-মাকে সম্মান করা, প্রতিবেশীকে শ্রদ্ধা করা, সৎপথে চলা, ন্যায়ের প্রতি ভালোবাসা, অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলো একটি শিশুর জীবনকে সুন্দর করে তোলে। আর নৈতিক অবক্ষয় থেকে শিশুকে বাঁচানোর একমাত্র পথ তার হৃদয়ে গভীর ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। আজ ইউরোপ-আমেরিকাতেও একটা স্লোগান বেশী শোনা যাচ্ছে, তা হ’ল ‘ধর্মের দিকে ফিরে এসো’ পাশ্চাত্যের একজন মনীষী তাই বলেছিলেন, ধর্ম বাদে অন্য কোন শিক্ষাই সৎ মানুষ গড়ার জন্য পরিপূর্ণ শিক্ষা নয়।

    (খ) শিশুর আত্মমর্যাদাবোধ সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা :

    পিতা-মাতা চান বাচ্চারা সম্মান ও মর্যাদাবোধ নিয়ে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে উঠুক। কিন্তু তাদেরকে উপরে উঠাতে গিয়ে না বুঝে নিচে টেনে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের বড় করতে গিয়ে ছোট করা হচ্ছে। যেমন কোন আত্মীয়ের সামনে নিজের সন্তানকে বলা হচ্ছে, ‘তোমার খালাতো ভাই কত বুদ্ধিমান! কত সুন্দর করে কথা বলে! ব্যবহার কত ভালো, এদের দেখে শিখো। কিছুতো পারো না’। এতে সবার সামনে তার মর্যাদায় আঘাত দেয়া হ’ল। আরও বলা হ’ল, ‘অমুক ছেলে পড়াশোনায়, খেলাধূলায় জিনিয়াস, তুমি কি করো! তুমি তো একটা গাধা! এতে কি ছেলেকে উৎসাহিত করা হ’ল না নিরুৎসাহিত করা হ’ল?

    একটি দু’বছরের শিশুকে তাচ্ছিল্য করলেও সে মন খারাপ করে। সেখানে কিশোর বয়সী সন্তানকে সবার সামনে ছোট করে তাকে কিভাবে বড় করা যাবে? তার আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস নষ্ট হ’তে হ’তে এক সময় তার মনে হবে, সত্যিই আমি গাধা আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। একটি কথা ভাবতে হবে যে, প্রত্যেকের একটি ব্যক্তিগত জীবন আছে এবং প্রত্যেকের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিভা আছে। সন্তান ভালো কিছু করলে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। খারাপ কিছু করলে খারাপকে এড়িয়ে সুন্দর উপদেশ দিতে হবে। তার ভেতরের অফুরন্ত সম্ভবনাকে নষ্ট করা করা যাবে না।

    (গ) সন্তানের বিপদে তার মনে শক্তি জোগাতে হবে :

    বয়ঃসন্ধির সময়টিতে সন্তানদের প্রতি মা-বাবার বিশেষ যত্ন, ভালবাসা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাদের সাথে সম্পর্ক আরও বাড়াতে হবে। সে যেন মনে করে তার বাবা-মা তার সর্বাধিক কাছের মানুষ। সন্তান যেন বাবা-মা'কে বন্ধু মনে করে। তার সকল সুখ-দুঃখের কথা যেন বলতে পারে। এক্ষেত্রে বাবা-মা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক কাজটি করতে ব্যর্থ হন। যেমন- সন্তান কোন ক্ষেত্রে ভুল বা অন্যায় করে ফেলেছে, যাতে সে বিব্রত ও লজ্জিত। সে অপরাধবোধ, সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে হতাশায় ভুগছে। এই নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে তাকে উদ্ধার করে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসার শক্তি জোগাবে তার জীবনের সবচেয়ে আপনজন তার পিতা-মাতা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পিতা-মাতা সঠিক পরামর্শ বা সান্ত্বনা না দিয়ে বকাবকি, অপমান বা অত্যাচার করেন। যার কারণে তার মধ্যে যতটুকু ইতিবাচক মনোভাব ছিল সেটাও ধূলায় মিশিয়ে যায়। অথচ এমতাবস্থায় তার আবেগীয় ভুলগুলো আলোচনা করে তার ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তির গভীরে গিয়ে তার চিন্তাধারার পরিবর্তন করলেই তার জীবনধারা বদলে যাবে।

    (ঘ) সন্তানকে উপযুক্ত সময় দেওয়া :

    সফল  মাতা-পিতা  হবার  গুরুত্বপূর্ণ  একটি  কর্তব্য  হ’ল সন্তানদের সময় দেয়া। কার্যকর সময় দেয়া মানে সন্তানের সাথে ভাব বিনিময় করা, সন্তানের সাথে পড়াশোনা, ধর্মীয় আলোচনা, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া, গল্প করা, পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া ও এবিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করা। এতে সন্তানদের দায়িত্ববোধ, গুরুত্ববোধ, সৃজনশীলতা  বৃদ্ধি  পায়।  পিতা-মাতার সাথে আন্তরিকতা, মুক্তমনে আলোচনার সম্পর্ক ঠিক থাকে। তখন জমে থাকা অনেক কথা, যে কোন পরামর্শ খোলা-মেলাভাবে পিতা-মাতার সাথে শেয়ার করতে পারে। এতে বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সন্তানরা মুক্ত থাকে। বিপদাপন্ন সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে। অথচ অধিকাংশ পরিবারে দেখা যায়, বাচ্চাদের সাথে তেমন কথা-বার্তা বলা প্রয়োজনবোধ করেন না অভিভাবকরা। অতি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কথা বলেন না। তারা মনে করেন খাওয়া-পরা, স্কুল-কলেজে পড়ানো, প্রাইভেট টিউটর, পোশাক-পরিচ্ছদ, কম্পিউটার,  মোবাইল সব কিছুই তো দেয়া হচ্ছে। যা চাচ্ছে সবই তো পাচ্ছে। অপূর্ণ তো কিছু রাখা হয়নি। অথচ সন্তান যতই বড় হৌক তারা চায় পিতা-মাতার আন্তরিক সান্নিধ্য, সাহচর্য, চায় তাদের সাথে প্রাণখুলে কথা বলতে, চায় অন্তরখোলা ভালবাসা। আল্লাহ বলেন, সন্তানের কল্যাণ বিষয়ে তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ কর (তালাক ৬৫/৬)  এমনটি না করলে সন্তান যেমন বিপদগামী হবে তেমনি সন্তানের কারণে পিতা-মাতকে বিপদে পড়তে হবে।

    (ঙ) শিশুর সামনে কথা-বার্তায় সতর্কতা অবলম্বন করা :

    শিশুরা অনুসরণ প্রিয়। তাই তাদের সামনে কথা বলা বা কোন কাজ করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শিশুরা ৫ মাস বয়স থেকেই ভাব প্রকাশের চেষ্টা করে ও কথাবার্তা বুঝতে শুরু করে। পিতা-মাতা খারাপ আচরণ করলে শিশুর উপর প্রভাব পড়ে। এসময় বাচ্চারা অনুকরণের চেষ্টা করে। মা জোরে কথা বললে শিশুও জোরে কথা বলতে শিখে। বাবা-মা ঝগড়া করলে সেও ঝগড়াটে হয়। মা সবসময় ধমকা-ধমকি করলে শিশু বদমেজাজী হয়ে ওঠে। এমনকি শিশুকে মারধর করলে সে পরে বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মারমুখো আচরণ করে। তাই বাবা-মাকে শিশুর সামনে কথাবার্তা ও ব্যবহারে খুব সাবধানী হ’তে হবে। আর বাবা যদি বদমেজাজী হন, তাহ’লে ঝগড়ার সময় মাকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। শিশু বড় হয়ে বুঝতে শুরু করলে সে মায়ের সহনশীলতা ও ধৈর্যশীলতায় মুগ্ধ হবে। তখন মায়ের ঐ গুণগুলো সে নিজেও অর্জন করতে সক্ষম হবে।

    (চ) পিতা-মাতার দূরদর্শী হওয়া :

    শিশুর মনের অবস্থা বুঝতে হবে। সে কাঁদলেই মা নাচিয়ে, দুলিয়ে, ধমকিয়ে, ভয় দেখিয়ে, কখনও চড়-থাপ্পড় মেরে শান্ত করার চেষ্টা করেন। অথচ শিশু কি চাই? কেন সে কাঁদছে? সেটি বুঝে উঠতে পারেন না। একটু খোঁজ করলেই তার সমস্যার কারণ মা বের করতে পারেন। মা'তো তার সর্বসময়ের সাথী। এজন্য মাকে বিচক্ষণ হ’তে হবে। মোটকথা শিশুর সামনে রাগ দেখানো, মারধর, জোরে চিৎকার অযথা ধমকানো থেকে বিরত থেকে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। উন্নত জীবন গড়ার জন্য সন্তানের মনোভাব বোঝাটাও একান্ত যরূরী। তাই শৈশব কাল থেকে সন্তানের মনোভাব বুঝে তার আগ্রহের বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে।

    (ছ) সন্তানের সঙ্গী নির্বাচনে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে :

    একটি প্রবাদ আছে, ‘সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ সন্তান কোন ধরণের ছেলে-মেয়েদের সাথে উঠা-বসা করছে এদিকে পিতা-মাতকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ পড়ার সাথী বা খেলার সাথীরা খারাপ হলে আপনার সোনার টুকরো সন্তানটিকে নষ্ট হতে বেশী সময় লাগবে না। স্কুল-কলেজে পড়া অবস্থাতেই অনেক ছাত্রের মধ্যে নেশা করার প্রবণতা দেখা দেয়। নেশাখোর ছাত্ররা অন্য ভালো ছাত্রদেরও নেশা করায় উদ্বুদ্ধ করে। মা-বাবাকে এ ব্যাপারে সন্তানকে স্কুলে ভর্তির সময় থেকে সাবধান ও সচেতন করতে হবে। অনেক ছাত্র দল বেঁধে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে। আবার অনেকে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি, সন্ত্রাস, ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকে এসব অপকর্মের বিষয়ে সচেতন করার দায়িত্ব পিতা-মাতার। আর সব ছাত্র-ছাত্রীই খারাপ নয়। তাই যেসব ছাত্র লেখাপড়ায় ভালো, নিয়মিত ক্লাস করে, মেধাবী, আচার-আচরণে ভালো, উচ্চ নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন, লেখাপড়ার পাশাপাশি সমাজ সচেতনতামূলক কার্যক্রমে জড়িত, এমন ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তাদের মিশতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিদিন সন্তানের খোঁজ-খবর নিতে সপ্তাহে একবার করে হ’লেও প্রতিষ্ঠানে যেতে হবে। পিতা-মাতা বুঝবেন তার সন্তানের প্রকৃত অবস্থা। বস্ত্ততঃ প্রথম থেকেই সন্তানের আদর্শ মনোভাব গড়ার দায়িত্ব পিতা-মাতার।

    (জ) শিশুর সামনে আদর্শ মডেল তুলে ধরতে হবে :

    কেবল কথা বলে বা উপদেশ দিয়ে শিশুকে বোঝানো কষ্টসাধ্য। তাই তার সামনে চরিত্র গঠনের বিষয়গুলো কাহিনী অবলম্বনে শোনালে তা তার মনে সহজে রেখাপাত করবে। আজকাল অনেকে বাচ্চাদের হাতে ঠাকুর মা’র ঝুলির মত আজগুবি ভূতের গল্প ও কল্পকাহিনী জাতীয় বই তুলে  দেয়া হচ্ছে। এসব বইয়ের গল্পগুলো অবাস্তব, অসত্য ও অলীক। যা শিশুদের সত্য গ্রহণ ও তা জীবনে বাস্তবায়ন থেকে দূরে রাখে। বাজারে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সত্য কাহিনী ও গল্পের মাধ্যমে জ্ঞান নামে বিভিন্ন বই পাওয়া যায়। এছাড়া মনীষীদের জীবনকাহিনী, তাদের ধৈর্য, ব্যাপক অধ্যাবসায় ও উন্নত চরিত্রের গল্প ইত্যাদি শিক্ষণীয় বইপত্র তাদেরকে পড়ে শুনান বা পড়তে বলে তাদের নিকট শুনার ব্যবস্থা করা যায়। এতে শিশু সুস্থ মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে।

    (ঝ) ছোট থেকে ইতিবাচক শিক্ষায় গড়ে তোলা :

    শিশু কিছু বোঝে না একথা কখনই মনে করা ঠিক নয়, ও ঠিকই বোঝে, ক্ষেত্র বিশেষে ও পিতা-মাতার চাইতে দ্রুত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে। সে অনেকটা কাদামাটির ন্যায়, যেভাবে গড়া হবে সেভাবেই গড়ে উঠবে। পিতা-মাতা, বাড়িতে থাকা ভাই-বোনরাই তার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক। শিশুরা দেখে শেখে, শুনে শেখে, করে শেখে। তাদের ব্রেনের সফটওয়ার এসময় সম্পূর্ণ খালি থাকে। ফলে যা দেখবে, শুনবে, অনুভব করবে, তাই ব্রেনে দ্রুত রেকর্ড হয়ে যাবে। যেমন কোন শিশু ঘরের ভেতর দৌড়াতে গিয়ে কোন জিনিসে আঘাত পেয়ে কাঁদতে শুরু করল, তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে উক্ত বস্ত্ততে আঘাত করে বাচ্চাকে বুঝানো হ’ল সেটিকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। বাচ্চার কান্না থেমে গেল। এতে সন্তানকে শেখানো হ’ল যে কষ্ট দেয় তাকে মারতে হয়। ফলে ঐ শিশু ছোট থেকেই প্রতিশোধ পরায়ণতা শিখল।

    আরো উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সন্তানকে যে টিফিন দেয়া হয়, সেটা অধিকাংশ সময় সে তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে খায়। একদিন সন্তানকে বলা হ’ল, ‘তোমার টিফিন বন্ধুদের নিয়ে খাও কেন? তুমি বোকা, না গাধা? নিজের স্বার্থ বুঝ না? আজ থেকে তোমার টিফিন বন্ধুরা যেন না খায়’। এভাবে বলার মাধ্যমে সন্তানকে স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা শিখানো হ’ল। ঐ সন্তান হয়ত পরবর্তীতে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে দেখবে না। কারণ সে ছোট বেলা থেকেই স্বার্থপরতা শিখে এসেছে। সে শিখেছে, নিজেরটা আগে দেখো। অথচ এক্ষেত্রে শিখানো উচিত ছিল বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে খেয়ো, সে খেয়েছে কি-না? মিলে-মিশে খেয়ো।

    (ঞ) সন্তানকে উপদেশ দেওয়া :

    সন্তানকে বেশী বেশী উপদেশ দিতে হবে। উপদেশ দানের কারণে সন্তানেরা উপকৃত হবে। এর মাধ্যমে তারা সঠিক পথে টিকে থাকতে পারবে। রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণকে কখনো ব্যক্তিগতভাবে আবার কখনো সামগ্রিকভাবে উপদেশ দিতেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِينَ ‘এবং উপদেশ দিতে থাক, কারণ উপদেশ মু’মিনদের উপকারে আসে (যারি’আত ৫১/৫৫)।        

    عَنْ مُعَاذٍ قَالَ أَوْصَانِى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِعَشْرِ كَلِمَاتٍ. قَالَ : لاَ تُشْرِكْ بِاللَّهِ شَيْئاً وَإِنْ قُتِلْتَ وَحُرِّقْتَ وَلاَ تَعُقَّنَّ وَالِدَيْكَ وَإِنْ أَمَرَاكَ أَنْ تَخْرُجَ مِنْ أَهْلِكَ وَمَالِكَ وَلاَ تَتْرُكَنَّ صَلاَةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّداً فَإِنَّ مَنْ تَرَكَ صَلاَةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّداً فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللَّهِ وَلاَ تَشْرَبَنَّ خَمْراً فَإِنَّهُ رَأْسُ كُلِّ فَاحِشَةٍ وَإِيَّاكَ وَالْمَعْصِيَةَ فَإِنَّ بِالْمَعْصِيَةِ حَلَّ سَخَطُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَإِيَّاكَ وَالْفِرَارَ مِنَ الزَّحْفِ وَإِنْ هَلَكَ النَّاسُ وَإِذَا أَصَابَ النَّاسَ مُوتَانٌ وَأَنْتَ فِيهِمْ فَاثْبُتْ وَأَنْفِقْ عَلَى عِيَالِكَ مِنْ طَوْلِكَ وَلاَ تَرْفَعْ عَنْهُمْ عَصَاكَ أَدَباً وَأَخِفْهُمْ فِى اللَّهِ-

    মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে ১০টি বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, (১) আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না। যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় বা আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় (২) তুমি তোমার পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না। যদিও তারা তোমাকে তোমার পরিবার ও মাল-সম্পদ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেন (৩) ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো ফরয ছালাত ত্যাগ করবে না।  যে ব্যক্তি তা ত্যাগ করবে। তার পক্ষে আল্লাহর যিম্মাদারী উঠে যাবে (৪) কখনোই মাদক সেবন করবে না। কেননা এটিই হ’ল সকল অশ্লীলতার মূল (৫) সর্বদা গোনাহ থেকে দূরে থাকবে। কেননা গোনাহের মাধ্যমে আল্লাহর ক্রোধ আপতিত হয় (৬) সাবধান! জিহাদের ময়দান হতে পলায়ন করবে না। যদিও সকল লোক ধ্বংস হয়ে যায়। (৭) যদি কোথাও মহামারী দেখা দেয়, এমতাবস্থায় তুমি যদি সেখানে থাক, তাহলে তুমি সেখানে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করবে (মৃত্যুর ভয়ে পালাবে না)। (৮) তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী তোমার পরিবারের জন্য ব্যয় করবে (অযথা কৃপণতা করে তাদের কষ্ট দিবে না)। (৯) তাদের উপর থেকে শাসনের লাঠি তুলে নিবে না এবং (১০) তাদেরকে সর্বদা আল্লাহর ভয় দেখাবে’।[22]

    عَنْ عَمْرِو بْنِ مَيْمُونٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُهُ : اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ ، وَصِحَتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ –

    আমর ইবনে মায়নূন আওদী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে নছীহতস্বরূপ বললেন, ‘পাঁচটি জিনিস আসার পূর্বে পাঁচটি কাজ করাকে বিরাট সম্পদ মনে কর। (১) তোমার বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে। (২) রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে সুস্বাস্থ্যকে। (৩) দরিদ্রতার পূর্বে অভাবমুক্ত থাকাকে। (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে হায়াতকে’। [23]

    পূর্ববর্তী নবী-রাসূল ও আল্লাহর নেক বান্দাগণ তাদের সন্তানদের বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে সন্তানকে উদ্দেশ্য করে লুক্বমান (আঃ)-এর উপদেশাবলী তুলে ধরা হ’ল। কারণ, লুক্বমান (আঃ) তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা এতই সুন্দর ও গ্রহনযোগ্য যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তা কুরআনে উল্লেখ করে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মতের জন্য তিলাওয়াতের উপযোগী করে দিয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্তের জন্য তা আদর্শ করে রেখেছেন। লুক্বমান (আঃ) তার ছেলেকে যে উপদেশ দেন তা নিম্নরূপ: মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ ‘আর স্মরণ কর, যখন লুক্বমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন’ (লুক্বমান ৩১/১৩)। এ উপদেশগুলো ছিল অত্যন্ত উপকারী, যে কারণে মহান আল্লাহ তা‘আলা আল কুরআনুল কারীমে লুক্বমান (আঃ)-এর পক্ষ থেকে উল্লেখ করেন।

    প্রথম উপদেশ : তিনি তার ছেলেকে বলেন, يَابُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ- ‘ হে প্রিয় বৎস! তুমি আল্লাহর সাথে কাউকে শিরক কর না, নিশ্চয় শিরক বড় যুলুম’ (লুক্বমান ৩১/১৩)

    এখানে লক্ষণীয় যে, প্রথমে তিনি তার ছেলেকে শিরক হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। একজন সন্তান তাকে অবশ্যই জীবনের শুরু থেকেই আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাসী হতে হবে। কারণ, তাওহীদই হ’ল যাবতীয় কর্মকান্ডের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার একমাত্র মাপকাঠি। তাই তিনি তার ছেলেকে প্রথমেই বলেন, আল্লাহর সাথে ইবাদতে কাউকে শরিক করা হতে বেচে থাক। যেমন, মৃত ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করা অথবা অনুপস্থিত ও অক্ষম লোকের নিকট সাহায্য চাওয়া বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। এছাড়াও এ ধরনের আরও অনেক কাজ আছে, যেগুলো শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

    দ্বিতীয় উপদেশ : মহান আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,

    وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ ‘আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে, তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন-তো আমার কাছেই’ (লুক্বমান ৩১/ ১৪)। তিনি তার ছেলেকে কেবলই আল্লাহর ইবাদত করা ও তার সাথে ইবাদতে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করার সাথে সাথে মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করার উপদেশ দেন। কারণ, মাতা-পিতার অধিকার সন্তানের উপর অনেক বেশী। মা তাকে গর্ভধারণ, দুধ-পান ও ছোট বেলা লালন-পালন

    করতে গিয়ে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট সইতে হয়েছে। তারপর তার পিতাও লালন-পালনের খরচাদি, পড়া-লেখা ও ইত্যাদির দায়িত্ব নিয়ে তাকে বড় করছে এবং মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে। তাই তারা উভয় সন্তানের পক্ষ হতে সদাচার ও খিদমত পাওয়ার অধিকার রাখে।

    তৃতীয় উপদেশ : মাতা-পিতা সন্তানকে শিরক বা কুফরের নির্দেশ দিলে সন্তানের করণীয় কী হবে সে বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন, وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ‘আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না। তবে দুনিয়ায় তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে। আর অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার প্রতি অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে’(লুক্বমান ৩১/ ১৫)। আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ) আয়াতের তাফসীরে বলেন, যদি তারা উভয়ে তোমাকে পরি-পূর্ণরূপে তাদের দ্বীনের আনুগত্য করতে বাধ্য করে, তাহলে তুমি তাদের কথা শুনবে না এবং তাদের নির্দেশ মানবে না। তবে তারা যদি দ্বীন কবুল না করে, তারপরও তুমি তাদের সাথে কোন প্রকার অশালীন আচরণ করবে না। তাদের দ্বীন কবুল না করা তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করাতে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। তুমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহারই করবে। আর মুমিনদের পথের অনুসারী হবে, তাতে কোন অসুবিধা নাই (তাফসীরে ইবনু কাছীর ৬/৩৩৭, অত্র আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)। আবুবকর (রাঃ)-এর মেয়ে আসমা (রাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার মুশরিক মা আমার নিকট আসেন, তিনি ইসলামে অনাগ্রহী। আমি কি তার সাথে সদাচরণ করব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ কর’। [24]

    চতুর্থ উপদেশ : লুক্বমান (আঃ) তার ছেলেকে কোন প্রকার অন্যায় অপরাধ করতে নিষেধ করেন। তিনি এ বিষয়ে তার ছেলেকে যে উপদেশ দেন, মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তার বর্ণনা দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    يَابُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَاوَاتِ أَوْ فِي الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِير-ٌ

    ‘হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষা দানার পরিমাণও হয়, অত:পর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমান সমূহে বা জমিনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ’ (লুক্বমান ৩১/ ১৫)। আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন, অন্যায় বা অপরাধ যতই ছোট হোক না কেন, এমনকি যদি তা শস্য-দানার সমপরিমাণও হয়, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তা‘আলা তা উপস্থিত করবেন এবং মীযানে ওজন করা হবে। যদি তা ভালো হয়, তাহলে তাকে ভালো প্রতিদান দেয়া হবে। আর যদি খারাপ কাজ হয়, তাহলে তাকে খারাপ প্রতিদান দেয়া হবে (তাফসীরে ইবনু কাছীর ৬/৩৩৮, অত্র আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)

    পঞ্চম উপদেশ : লুক্বমান (আঃ) তার ছেলেকে ছালাত কায়েমের উপদেশ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,  يَابُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ‘হে আমার প্রিয় বৎস! ছালাত কায়েম কর’ (লুক্বমান ৩১/ ১৬)। তুমি ছালাতকে তার ওয়াজিবসমূহ ও রোকনসমূহ সহ আদায় কর (তাফসীরে ইবনু কাছীর ৬/৩৩৮, অত্র আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)

    ষষ্ঠ উপদেশ : আল্লাহ মুসলমানদের উপর যে মৌলিক দায়িত্ব দিয়েছেন তা লুক্বমান (আঃ) তার সন্তানকে উপদেশ দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ ‘তুমি ভালো কাজের আদেশ দাও এবং মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ কর’(লুক্বমান ৩১/ ১৭) । বিনম্র ভাষায় তাদের দাওয়াত দাও, যাদের তুমি দাওয়াত দেবে তাদের সাথে কোন প্রকার কঠোরতা করবে না।

    ষষ্ঠ উপদেশ : মানুষকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিশেষ করতে গেলে বিভিন্ন বিপদ-আপদে পড়তে হতে পারে। আর এরূপ পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করে এর মুকাবেলা করতে হবে। লুক্বমান (আঃ) তার সন্তানকে বলেন,  وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ  ‘যে তোমাকে কষ্ট দেয় তার উপর তুমি ধৈর্য ধারণ কর । নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় প্রত্যয়ের কাজ’ (লুক্বমান ৩১/ ১৭)। অর্থাৎ, মানুষ তোমাকে যে কষ্ট দেয়, তার উপর ধৈর্য ধারণ করা অন্যতম দৃঢ় প্রত্যয়ের কাজ। আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, যারা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ ও মন্দ কাজ হতে মানুষকে নিষেধ করবে তাকে অবশ্যই কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে এবং অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। যখন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে তখন তোমার করণীয় হ’ল, ধৈর্যধারণ করা ও ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া।

    রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ الَّذِى يُخَالِطُ النَّاسَ وَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ أَعْظَمُ أَجْرًا مِنَ الْمُؤْمِنِ الَّذِى لاَ يُخَالِطُ النَّاسَ وَلاَ يَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُمْ   ‘যে ঈমানদার মানুষের সাথে উঠা-বসা ও লেনদেন করে এবং তারা যে সব কষ্ট দেয়. তার উপর ধৈর্য ধারণ করে, সে যে মুমিন মানুষের সাথে উঠা-বসা বা লেনদেন করে না এবং কোন কষ্ট বা পরীক্ষার সম্মুখীন হয় না তার থেকে উত্তম’।[25]

    সপ্তম উপদেশ : মানুষ কষ্ট দিলে দাওয়াতী কাজ বন্ধ করা যাবে না। বরং চরম ঘাত-প্রতিঘাতে ধৈর্য ধারণ করে সে কাজ অব্যহত রাখতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা লুক্বমান (আঃ) সেই উপদেশ উদ্ধৃতি করে বলেন, وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না’ (লুক্বমান ৩১/ ১৭)। আল্লামা ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, যখন তুমি কথা বল অথবা তোমার সাথে মানুষ কথা বলে, তখন তুমি মানুষকে ঘৃণা করে অথবা তাদের উপর অহংকার করে, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে না। তাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে কথা বলবে। তাদের জন্য উদার হবে এবং তাদের প্রতি বিনয়ী হবে (তাফসীরে ইবনু কাছীর ৬/৩৩৮, অত্র আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)। কারণ, রাসূল (ছাঃ) বলেন, تَبَسُّمُكَ فِى وَجْهِ أَخِيكَ لَكَ صَدَقَةٌ ‘তোমার অপর ভাইয়ের সম্মুখে তুমি মুচকি হাসি দিলে, তাও ছাদাক্বাহ হিসেবে পরিগণিত হবে’। [26]

    অষ্টম উপদেশ : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

    وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ  ‘অহংকার ও হঠকারিতা প্রদর্শন করে জমিনে হাটা-চলা করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না’ (লুক্বমান ৩১/ ১৮)।’’ কারণ, এ ধরনের কাজের কারণে আল্লাহ তোমাকে অপছন্দ করবে। যারা নিজেকে বড় মনে করে এবং অন্যদের উপর বড়াই করে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তাদের পছন্দ করে না। আল্লাহ আরো বলেন, পৃথিবীতে দম্ভভরে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই তুমি ভূ-পৃষ্ঠকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনো পাহাড় সমান হতে পারবে না’ (ইসরা ১৪/৩৭)

    নবম উপদেশ : নমনীয় হয়ে হাটা চলা করা। মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে বলেন: وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ ‘আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর(লুক্বমান ৩১/ ১৮)। তুমি তোমার চলাচলে স্বাভাবিক চলাচল কর। খুব দ্রুত হাঁটবে না আবার একেবারে মন্থর গতিতেও না। মধ্যম পন্থায় চলাচল করবে। তোমার চলাচলে যেন কোন প্রকার সীমালঙ্ঘন না হয়। আল্লাহ তা‘আলা লুক্বমান (আঃ)-এর উপদেশকে সমর্থন দিয়ে বলেন,وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا ‘রহমান’ (দয়াময়)-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অন্ধ লোকেরা (বাজে) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে ‘সালাম’(ফুরকান ২৫/৬৩)

    দশম উপদেশ : নরম সূরে কথা বলা। লুক্বমান (আঃ) তার ছেলেকে নরম সূরে কথা বলতে আদেশ দেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ ‘তোমার আওয়াজ নিচু কর। নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হ’ল, গাধার আওয়াজ’(লুক্বমান ৩১/১৯)। আর কথায় কোন তুমি কোন প্রকার বাড়াবাড়ি করবে না। বিনা প্রয়োজনে তুমি তোমার আওয়াজকে উঁচু করো না। আল্লামা মুজাহিদ বলেন, সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হ’ল, গাধার আওয়াজ। অর্থাৎ, মানুষ যখন বিকট আওয়াজে কথা বলে, তখন তার আওয়াজ গাধার আওয়াজের সাদৃশ্য হয়। আর এ ধরনের বিকট আওয়াজ মহান আল্লাহ তাআলার নিকট একেবারেই অপছন্দনীয়। বিকট আওয়াজকে গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করা প্রমাণ করে যে, বিকট শব্দে আওয়াজ করে কথা বলা হারাম। কারণ, মহান আল্লাহ তা‘আলা এর জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন (তাফসীরে ইবনু কাছীর ৬/৩৩৯, অত্র আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)। এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমরা রাতে কুকুর ও গাধার চিৎকার শুনতে পাও, তখন তোমরা আল্লাহর নিকট শয়তান থেকে পরিত্রাণ চাও। কারণ তারা এমন কিছু দেখতে পায়, যা তোমরা দেখতে পাওনা’।[27] তিনি আরো বলেন, ‘মোরগের আওয়াজ শোনে তোমরা আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ কামনা কর, কারণ, সে নিশ্চয় কোন ফেরেশতা দেখেছে। আর গাধার আওয়াজ শোনে তোমরা শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর। কারণ, সে অবশ্যই একজন শয়তান দেখেছে’। [28]

    উপসংহার : ছেলে-মেয়ে উভয়ই সন্তানের মধ্যে গণ্য। সন্তান-সন্ততির অধিকার অনেক। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে শিক্ষা লাভের অধিকার। তবে আল্লাহর দ্বীন এবং চরিত্র গঠনের জন্যই এ শিক্ষা; যাতে তারা তাতে বেশ উৎকর্ষতা লাভ করতে সমর্থ হয়। প্রকৃতপক্ষে ছেলে-মেয়ে হচ্ছে পিতা মাতার এক বিরাট আমানতস্বরূপ। অতএব, কিয়ামতের দিন তাদের উভয়কেই তাদের সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, এমতাবস্থায় পিতা মাতার দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। এরূপ করা হ’লেই তারা ইহকাল এবং আখিরাতে পিতা-মাতার জন্য চোখের শীতলতা তথা শান্তি বয়ে আনবে।

    অনুতাপের বিষয় যে, আমাদের সমাজে অনেক পিতা-মাতাই এই অধিকারটাকে অত্যন্ত সহজ মনে করে নিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে তারা তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন এবং তাদের কথা যেন ভুলেই গেছেন। মনে হয় যেন তাদের ব্যাপারে তাদের ওপর কোন দায়িত্বই নেই। তাদের ছেলে-মেয়েরা কোথায় গেল এবং কখন আসবে, কাদের সাথে তারা চলাফেরা করছে অর্থাৎ তাদের সঙ্গী-সাথী কারা এ সব ব্যাপারে তারা কোন খবরা খবরই রাখে না। এ ছাড়া তাদেরকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ এবং মন্দ কাজ থেকে বিরতও রাখে না।

    আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এসব পিতা-মাতাই তাদের ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার প্রবৃদ্ধির জন্য খুবই আগ্রাহান্বিত থাকেন, সদা জাগরুক থাকেন, অথচ এসব সম্পদ সাধারণত তারা অন্যের জন্যই রেখে যান। অথচ সন্তান-সন্তুতির ব্যাপারে তারা মোটেও যত্নবান নন, যার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হ’লে দুনিয়া ও আখিরাতের সহবস্থানেই তারা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। অনুরূপভাবে পানীয় ও আহার্যের মাধ্যমে ছেলে মেয়েদের শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য খাদ্য দ্রব্যের যোগান দেওয়া, তাদের শরীরকে কাপড় দিয়ে ঢাকা যেমন পিতার উপর ওয়াজিব তেমনি ভাবে পিতার জন্য অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে সন্তানের অন্তরকে ইলম ও ঈমানের মাধ্যমে তরতাজা রাখা এবং তাক্বওয়া ও আল্লাহ্ভীতির লেবাস পরিধান করিয়ে দেওয়া, কেননা তা তাদের জন্য অবশ্যই কল্যাণকর। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিকভাবে সন্তান পালনের মাধ্যমে উভয় জগতের কল্যাণ লাভের তাওফীক দিন- আমীন!

    [1]. বুখারী হা/৫৯৯৫; মিশকাত হা/৪৬৭৮।

    [2]. মুসলিম হা/২৩১৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৬৫।

    [3]. বুখারী ‘গোঁফ কর্তন’ অধ্যায় হা/৫৮৮৯।

    [4]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৭০৩।

    [5]. ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৩৭৯৯, সনদ ছহীহ, আত-তাহজীল ১/০৯।

    [6]. আবুদাউদ হা/৩৫৬; ছহীহাহ হা/২৯৭৭।

    [7]. তিরমিযী হা/২৭৫৬; নাসাঈ হা/৫২২৫, হাদীছ ছহীহ।

    [8]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, ইগাছাতুল লাহফান (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৯২১, ১/৪০২।

    [9]. শারহু মা‘আনিল আছার হা/৫৮৪৭; শু‘আবুল ঈমান হা/১১০২২; ছহীহাহ হা/৩০৯৮।

    [10]. বুখারী হা/২৫৮৭; মুসলিম হা/১৬২৩; মিশকাত হা/৩০১৯।

    [11]. মুসলিম হা/১৬২৩; মিশকাত হা/৩০১৯।

    [12].মুয়াত্তা মালেক হা/২৭৮৩,১৪৩৮; বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/১১৭২৮; ইরওয়া হা/১৬১৯, সনদ ছহীহ।

    [13]. বুখারী হা/৫০৬৫; মুসলিম হা/১৪০০; মিশকাত হা/৩০৮০।

    [14]. বায়হাক্বী, ছহীহাহ হা/৬২৫; মিশকাত হা/৩০৯৬।

    [15]. ছহীহ আত-তারগীব হা/১৯১৭।

    [16]. তিরমিযী হা/১০৮৪; ইবনু মাজাহ হা/১৯৬৭; ছহীহাহ হা/১০২২; মিশকাত হা/৩০৯০।

    [17]. বুখারী হা/৫০৯০; মুসলিম হা/১৪৬৬; মিশকাত হা/৩০৮২, ৩০৯০, ‘বিবাহ’ অধ্যায়।

    [18]. বুখারী হা/৬০০৭; মুসলিম হা/২৯৮২; মিশকাত হা/৪৯৫১ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়।

    [19]. ইবনু খুযায়মা হা/১৯৮৬; হাকেম হা/২৮৩৭; ছহীহাহ হা/৩৯৫১।

    [20]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৯০ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন’ অনুচ্ছেদ।

    [21]. মির‘আতুল মাফাতীহ, ১/১৭৬ পৃঃ।

    [22]. আহমাদ হা/২২১২৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/৫৭০; মিশকাত হা/৬১।

    [23].  হাকেম হা/৭৮৪৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১০৭৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩৩৫৫; মিশকাত হা/৫১৭৪।

    [24].  বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯১৩।

    [25].  আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩৮৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০৩২; মিশকাত হা/৫০৮৭; ছহীহাহ হা/৯৩৯।

    [26]. তিরমিযী হা/১৯৫৬; মিশকাত হা/১৯১১; ছহীহাহ হা/৪৫৪।

    [27]. আল আদাবুল মুফরাদ হা/১২৩৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬২০;  মিশকাত হা/৪৩০২।

    [28]. বুখারী হা/৩৩০৩; মিশকাত হা/২৪১৯।

     


    HTML Comment Box is loading comments...