ইসলামই চিরন্তন প্রগতিবাদ
ভূমিকা : সারা বিশ্বে প্রগতিবাদের লু হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। সকল প্রগতিশীলদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই। আর তা হ’ল আমাদের সমাজটা পরিবর্তন করা উচিৎ। সেকেলে সমাজ ব্যবস্থায় সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। বিধায় প্রগতিশীল প্রতিক্রিয়ার উপস্থিতি সমাজে আশু প্রয়োজন। আর প্রগতিশীল প্রতিক্রিয়া সেই দর্শন বা মতবাদ যা মানুষের ইতিহাসকে ক্রমে অবনতিশীল মনে করে। মানুষ ও সভ্যতা ক্রমেই অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কেউ চিন্তা করেন, মূলত প্রগতির ধারণা মতে বর্তমান অতীতের চেয়ে শ্রেয় এবং ভবিষ্যৎ আরো ভালো হ’তে পারে এবং হবে। পক্ষান্তরে কেউ চিন্তা করেন, প্রাচীন যুগ আধুনিক যুগের চাইতে শ্রেয়, অর্থাৎ সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের অবস্থার ততই অবনতি ঘটছে। আধুনিক যুগে মানুষের পার্থিব ও মানসিক অগ্রগতি ঘটেছে বটে কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক বন্ধন, সহমর্মিতা, পারিবারিক সুসম্পর্ক সহ যাবতীয় প্রণয়ের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতার অবনতি ঘটেছে।
প্রগতিবাদের সংজ্ঞা : প্রগতি এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Progress শব্দটি, ল্যাটিন শব্দ Prograde থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ অগ্রগতি, উৎকর্ষতা, জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। প্রগতির আভিধানিক অর্থ সকলের কাছে প্রায় একই। তবে পারিভাষিক অর্থে যত মতানৈক্য। এই মতপার্থক্য মূলত আদর্শিকভাবে হয়েছে। তাই প্রগতি বলতে বোঝায় এমন একটি নির্দিষ্ট অগ্রগতি অভিষ্ট লক্ষ্যেকে কেন্দ্র করে এমন উচ্চতায় পোঁছানো যা অবিরামভাবে সম্মুখপানে অগ্রসর হয়। আবার বর্তমান প্রগতিশীল ব্যক্তিগণের বক্তব্য হলো প্রগতি মানেই সকল ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহ যাবতীয় বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর।
প্রগতিবাদের সূচনা : তথাকথিত আধুনিক ধ্বজাধারী প্রগতিবাদ আন্দোলন আঠারো শতকের দিকে ইংল্যান্ডের হব্স, লক এবং ফ্রান্সের ভল্টেয়ার, রুশো, মন্টেস্কু প্রমুখ চিন্তাবিদগণ ধর্মের বিরুদ্ধবাদী চেতনায় বারি সিঞ্চন করেন। তার কিছু পরে ডারউইনবাদ আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত The Origin of Species বা ‘প্রজাতির উৎস’ বইটিতে চার্লস ডারউইন (Charles Darwin) যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চান যে, এ বিশ্ব-প্রকৃতি ও মাখলূক্বাত সবই আপনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এর কোন বিচক্ষণ সৃষ্টিকর্তা বা পালনকর্তা নেই। পরকাল বলে কিছু নেই। প্রাণীর জন্ম, যৌবন ও লয় সবকিছুই তার স্বাভাবিক বিবর্তনের ফল। যদিও ডারউইনের এই বিবর্তনবাদ বা Theory of Evolution তার জীবদ্দশাতেই বিজ্ঞানীগণ কেউই পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। এমনকি এই মতবাদের বড় প্রবক্তা হাক্সলে (Huxley) পর্যন্ত এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেননি। কিন্তু স্রেফ আল্লাহদ্রোহী প্রবণতার স্বপক্ষে হওয়ার কারণে এ মতবাদকে গ্রহণ করা হ’ল।[1]
এই প্রগতির ছোঁয়া লাগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তরণের লক্ষ্যে শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে। সত্তর দশকে প্রগতির ধারণাকে উজ্জীবিত করেছে আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সাথে সাথে শিল্পবিপ্লব ইউরোপে অর্থনৈতিক অগ্রগতি প্রগতির ধারণাকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। সামাজিক বিবর্তনের ধারণা সামাজিক প্রগতির সঙ্গে জড়িত ও সংযুক্ত। আবার সামাজিক প্রগতির ধারণা ইতিবাচক দর্শনের সঙ্গেই যুক্ত। অগাস্ট কোঁত বলেন, সামাজিক প্রগতিকে মানুষের চিন্তাধারার প্রগতির সঙ্গে সমার্থক বলে বিবেচনা করেছেন। মনোজগতে মানুষের প্রগতির মানব সমাজের প্রগতির মাপকাঠি। জার্মান দার্শনিক হেগেন বলেন, ‘আত্মোপলব্ধিই মনুষ্যত্বের অগ্রগতি প্রকাশের প্রণালী। তিনি গুরুত্ব দিতেন মানুষের ব্যক্তিগত উপলব্ধির ওপর। কালমার্কসের মতে, সমাজের একটি স্তর থেকে অন্য স্তরে পৌঁছতে উৎপাদন কৌশলের যে পরিবর্তন তাই প্রগতি। প্রগতি হলো এমন একটি সামাজিক পরিবর্তন, যা অনুপ্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, প্রগতি হলো মানুষ যে সামাজিক ও নৈতিক গুণগুলোকে মূল্য দেয় সমাজের মানুষের জীবনে সে গুণগুলোর অধিকার, প্রকাশ, বিকাশ ও স্থায়ীভাবে রূপান্তরিত হওয়া। মোটকথা, প্রগতি হচ্ছে বিবর্তন ও সামাজিক পরিবর্তনের পরিচালক।
একদল সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে। রবার্ট নিসবেট মনে করেন যে, সমাজবিজ্ঞানীরা প্রগতির ধারণার জনক। আবার ঐতিহাসিক কার্ল বেকার বিশ্বাস করেন যে, প্রগতির ধারনার উদ্ভাবক হ’ল ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলনের লেখকরা। তাঁরা কেউ দার্শনিক ছিলেন না; কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, আধুনিক কালে মানুষের ইতিহাসে নব যুগের সূচনা হয়েছে এবং মানুষের সভ্যতা উত্তরোত্তর প্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। প্রথমদিকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী এ মতবাদের বিরোধিতা করেছেন, তবে পরবর্তীকালে সমাজবিজ্ঞানীরাই প্রগতির সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান।
সারা পৃথিবীর মুসলমানদেরকে প্রগতির নামে সুকৌশলে বস্ত্তবাদী, পুঁজিবাদী, সুদী অর্থনীতি চালু ও ধর্মনিরোপেক্ষতাবাদ প্রচার করে চলেছে। প্রগতি ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ও সম্পূরক আদর্শ মাত্র। অথচ ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ একটি নিরেট কুফরী মতবাদ। ইসলামের সাথে এর আপোষ করার কোন সুযোগ নেই। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষকে ইসলামী আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে।
‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ঐ মতাদর্শকে বলা হয়, যা কোন ধর্মের অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ যে মতাদর্শের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’-কে ইংরেজীতে ‘সেক্যুলারিজম’ (Secularism) ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘সেক্যুলারাইট’ (Secularite) বলা হয়। কিন্তু আরবীতে নিয়ম বিরুদ্ধভাবে ‘ইলমা-নিয়াহ’ (العِلْمانية ) বলা হয় । কেননা এই শব্দটির সাথে ‘ইলম’ (العلم )-এর কোন সম্পর্ক নেই। আরবী ‘ইলম’ শব্দটি ইংরেজী ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় Science বা ‘বিজ্ঞান’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এরপরে তার সাথে ان যোগ করা হয়েছে মূল অর্থকে জোরদার করার জন্য। যেমন রূহানীয়্যাহ, রববানীয়্যাহ, জিসমানীয়্যাহ, নূরানীয়্যাহ ইত্যাদি। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে Secularism-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Any movement in society directed away from otherworldliness to life on earth... ‘এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম, যা মানুষকে আখেরাতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র পার্থিব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করায়’। অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে বলা হয়েছে, The belief that religion should not be involved in the organization of society, education etc. ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ এমন একটি বিশ্বাস যে, ধর্মকে কোনরূপ সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রভৃতি বিষয়ে যুক্ত হওয়া উচিত নয়’।
এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলন, যাতে মানুষ আখেরাতকে ভুলে কেবলমাত্র দুনিয়াবী জীবনের দিকে পরিচালিত হ’তে উদ্বুদ্ধ হয়। তবে এটি ধর্মীয় বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা, নারী-পুরুষ সমাধিকার ধর্মকে উপেক্ষা করে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে পরিগ্রহণ করে। বস্ত্ততঃ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রথমে মুসলমানকে তাওহীদের গন্ডীমুক্ত করে তাগুতের পথে পরিচালিত করে। কিন্তু কেন? ইসলাম কি প্রগতির অন্তরায়? না, ইসলাম কখনোই প্রগতির অন্তরায় নয়। আমাদের যদি সুস্থ চিন্তা-চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থাকে তবে আমরাই প্রগতিশীল। আর যদি নিঁচু ও অসুস্থ মন-মানসিকতা থাকে তবে আমরা প্রগতির নামে অপব্যাখ্যা করে প্রহসনে নিমগ্ন। ইসলাম প্রগতির অন্তরায় নয়, বরং ইসলামের অপব্যাখ্যা ও ধর্ম বিবর্জিত জীবনই প্রগতির অন্তরায়। সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে ধর্মকে বিতাড়িত করে সেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত ও পশুত্ব সমুন্নত করার অপপ্রয়াসমাত্র। যার শেষ পরিণতি হ’ল দুনিয়াতে ধ্বংস আখেরাতে শাস্তি অনিবার্য।
ইসলামী প্রগতিবাদ : যারা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদকে উপেক্ষা করেন তারা মনে করেন প্রগতি হলো, ১৪০০ বছর পূর্বের সেই আইয়্যামে জাহিলিয়াতের তমসাচ্ছন্ন ঘোর অন্ধকার থেকে উত্তরণের নাম। এই সংজ্ঞা মতে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষ করে ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে যাবতীয় সংকীর্ণতা পিছনে ফেলে হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত আদর্শের অগ্রগতিকেই প্রগতি বলে, যা চিরন্তন ও সার্বজনীন। যার আদি বাহক পিতা হযরত আদম (আঃ)। যুগে যুগে প্রয়োজন বোধে মহান আল্লাহ দ্বীন ইসলামকে প্রগতিশীল করার উদ্দেশ্যে মানব জাতির মধ্য থেকে নবী-রাসূল নির্বাচিত করে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। তন্মধ্যে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেছেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) এবং মহান আল্লাহ দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করতে সর্বশেষ হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে প্রগতির চিরন্তন ও সার্বজনীন ভিত্তি স্থাপন করেছেন। আর দ্বীন ইসলামই শাশ্বত, অপরিবর্তীত সাম্যের ধর্ম ও আসল প্রগতিবাদ।
ক. ইসলামী প্রগতিবাদের গুরুত্ব : আমাদেরকে ভাবতে হবে আমরা প্রকৃতপক্ষে কোনটিকে গ্রহণ করব, ইসলামী প্রগতিবাদ না’কি বর্তমানের কাল্পনিক আধুনিক প্রগতিবাদ? ইসলামী প্রগতিবাদ চিরন্তন, সার্বজনীন ও আধুনিকতার কোন প্রকার কমতি নেই, ইহা শ্বাশত অত্যাধুনিক। পক্ষান্তরে তথাকথিত আধুনিক প্রগতিবাদ পরিবর্তনশীল ভঙ্গুর বিজাতীয় মতবাদ। ইসলামী প্রগতিবাদ গ্রহণ করলে দু’ভাবে লাভবান হওয়া যাবে।
১. ইহকালীন শান্তি শৃঙ্খলার মধ্যে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করা। ২. পরকালীন মুক্তি এবং এর সুফল অনন্তকাল ভোগ করা। কিন্তু যদি আধুনিক প্রগতি গ্রহণ করি, তবে এর বিপরীত হবে। কেননা আমরা যদি দ্বীন ইসলামকে বাদ দিয়ে প্রগতিশীল হ’তে চাই তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلاَمِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَু ‘আর যে ব্যক্তি ‘ইসলাম’ ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করে, তার নিকট থেকে তা কখনোই কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে মানুষকে আহবান করে, সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত। যদিও সে ছিয়াম পালন করে, ছালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে সে একজন মুসলিম’।[2] মুসলমান প্রগতির নামে বিজাতীয় মতবাদকে মেনে নিতে পারে না। কেননা ইহা জাহান্নামে যাবার অসীলা হ’তে পারে। সুতরাং তাদের কোন মতামত ও সাদৃশ্য মুসলমানদের সমাজে থাকতে পারে না। এ মর্মে রাসূল (ছা:) বলেন, যে ব্যক্তি যে কওমের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি (ক্বিয়ামতের দিন) তাদেরই দলভুক্ত হবে’। [3]
খ. ইসলামী প্রগতিবাদ অপরিবর্তনশীল : আমাদের সমাজে এক শ্রেণির কিছু মানুষ আছে যারা ইসলামকে চিরন্তন প্রগতিশীল মনে করেন, তবে ইসলামের যোজন-বিয়োজনের প্রয়োজনও অনুভব করেন। আর তা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ভুল অর্থ ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে কিয়াস করে থাকেন। আবার তারা বিজাতীয় মতবাদকে সরাসরি গ্রহণ না করে ঘুরিয়ে তা গ্রহণ করেন। তাদের মতে যুগের সাথে বা সামাজিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। অথচ দ্বীন ইসলামকে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلاَمُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম’ (আলে-ইমরান ৩/১৯)। আর এই দ্বীনের মধ্যে কোন প্রকার রদ-বদল বা যোজন-বিয়োজন করার প্রশ্নই আসে না। দ্বীন ইসলাম চিরস্থায়ী পূর্ণাঙ্গ ও সংযোজন-বিয়োজন মুক্ত সার্বজনীন প্রগতিশীল। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا- ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)।
অথচ তাদের প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতা উল্টো দিক থেকে পরিচালিত। তারা মনে করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়নের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব, আর তা হ’ল গণতন্ত্রের ব্যালটের মাধ্যমে। আবার অনেকে মনে করেন জিহাদের নামে যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে রাতারাতি বোমা ফাটিয়ে, গুলি চালিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত্র করে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও আদালতের আইন বদলে দিতে হবে। সারা পৃথিবীতে থাকবে ইসলামী খেলাফত। একই দিনে ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি পালন করতে হবে। এরা ইসলামে উগ্রপন্থী। তারা রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) এর আদর্শ ও ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। অথচ আমাদের যে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে চলতে হবে। লোক্বমান তাঁর পুত্রকে মধ্যপন্থা অবলম্বনের উপদেশ দিয়ে বলেন, وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ ‘আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ’ (লুক্বমান ৩১/ ১৯)। মধ্যম পন্থায় চলাফেরার কারণে মানুষ সম্মানিত হয়। অন্য আরেক দল যারা পীর ও কবর পূজারী। তারা ইসলামের সাথে হিন্দুদের চৈতন্য মতবাদ, শী’আ, সূফী মতবাদের সংমিশ্রনে গড়ে তোলেছেন পীরতন্ত্র। এরা তাদের পীরতন্ত্রকে প্রগতিশীল করেছে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতকে বাদ দিয়েছে সুকৌশলে। তারা কিছু মানুষের মগজ ধোলাই দিয়ে তাদের কাছ থেকে ঈমান, সম্পদ আহরণ করে চলেছে। আবার আরেক দল রয়েছে, একজন বুজুর্গানেদ্বীনের মতামতকে প্রধান্য দিয়ে তাদের গণনা করা কোটি কোটি, মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন পর্যন্ত ছওয়াব অনুসারীদের মাঝে আনুগত্যের ভিত্তিতে প্রদান করেন। অবশ্য এখন তারা বিপদের মধ্যে, মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। সকলের হাতে হাতে ইন্টারনেট পোঁছানোর সুবাদে সকলে কুরআন ও হাদীছগুলো যাচাই বাছাই করার সুযোগ পেয়েছেন। আর গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখেন, যারা ছওয়াব গণনা করেন তারা বাতিলপন্থী। এরা ইসলামের নামে মানুষকে সুকৌশলে হক্বের পথ থেকে বাতিলের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এদের আচরণ আর মদীনার মুনাফিকদের আচরণ অবিকল।
আবার আরেক দল বিশ্বাস করেন যে, এই ইসলামী প্রগতি অতীব চিরন্তন ও সার্বজনীন। এই প্রগতির প্রতিষ্ঠাতা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মাদ (ছা:)। তাঁর রেখে যাওয়া মানদন্ড পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা অনুমোদিত, তার সাথে কোনভাবে সাংঘর্ষিক নয় অথচ তা সংগতিপূর্ণ যার মাধ্যমে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের মান অক্ষুণ্ণ থাকে, কেবল তাকেই তারা প্রগতিবাদ বলে গ্রহণ করেন। তাদের প্রগতিশীল চিন্তা চেতনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সম্ভব নয়। মানুষের আক্বীদাগত দিকগুলো পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজে, ও পর্যায়ক্রমে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যেমনটি করেছিলেন আমাদের প্রিয় নবী (ছাঃ)। যখন তিনি প্রথম নবুওয়াত লাভ করেন, তখন সর্বপ্রথম নিজে ও তাঁর পরিবারকে তাওহীদের দাওয়াত দেন। ধীরে ধীরে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, আগন্তুক, গোত্রনেতা, রাষ্ট্রনেতাদের ক্রমান্বয়ে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের দাওয়াত দিতে থাকে। এভাবে তিনি প্রয়োজনবোধে এবং বাতিলের তাগুতী শক্তি প্রতিরোধে মহান আল্লাহর নির্দেশেই জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন। আর মক্কা বিজয় হলো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মক্কার যে কাফেরেরা নবীজীর প্রাণনাশের অপচেষ্টা করেছিলেন, দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, তাদেরকে বিনা যুদ্ধে পরাস্থ করে সর্বত্র ক্ষমা করে দিলেন। কায়েম করলেন ইসলামী রাষ্ট্র। তাঁর পরবর্তী সময়ে চার খলীফার আমলেও অনুরূপ। এভাবেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের সমন্বয়ে গঠিত চিরন্তন ও সার্বজনীন প্রগতির প্রতিষ্ঠা করেছেন।
গ. ইসলামী প্রগতিবাদ গ্রহণকারীরাই শ্রেষ্ঠজাতি : ইসলামী প্রগতিবাদীদেরকে মুসলিম হিসাবে অভিহিত করা হয়। মহান আল্লাহ এদেরকে মুসলিম বলে সম্বোধন করেছেন। এমর্মে মহান আল্লাহ বলেন, وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ ‘আর তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর যথার্থ জিহাদ। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন। আর তিনি তোমাদের উপর দ্বীনের মধ্যে কোনরূপ সংকীর্ণতা রাখেননি। তোমাদের পিতা ইবরাহীমের ধর্মের উপর তোমরা কায়েম থাক। তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’ হিসাবে ইতিপূর্বে এবং এই কিতাবে। যাতে রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষ্যদাতা হন এবং তোমরা সাক্ষদাতা হও মানব জাতির উপরে। অতএব তোমরা ছালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং আল্লাহকে মযবুতভাবে ধারণ কর। তিনিই তোমাদের অভিভাবক। কতই না উত্তম অভিভাবক তিনি এবং কতই না উত্তম সাহায্যকারী তিনি’ (হাজ্জ ২২/৭৮)। আর ইসলামের অনুশীলনের মাধ্যমে রাসূল (ছা:) অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহেলী যুগকে প্রগতিশীল স্বর্ণযুগে পরিণত করেছিলেন। সেই যুগের মানুষই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তারা ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণ করেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ- ‘তোমরাই হ’লে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِيْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ- ‘আমার যুগের মানুষই সর্বোত্তম মানুষ। অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ, অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ’।[4]
তাছাড়া তখন যেসকল দেশে ইসলামী আইনের অনুশাসন বিদ্যমান ছিল ঐ সকল দেশ প্রগতীর মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। এখনো যেসব দেশে ইসলামের অনুশাসন যত বেশী সেই সব দেশ তত উন্নত, সভ্য ও প্রগতির উচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। যদি আমরা ইসলামী অনুশাসনের আদলে ইসলামী প্রগতিশীল হই তবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত নাযিল করা হবে এবং প্রবৃদ্ধিতে দেশকে সমৃদ্ধ করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনয়ন করে এবং আল্লাহভীতি অর্জন করে, তবে তাদের প্রতি আসমান-যমীনের যাবতীয় বরকতের পথ উন্মুক্ত করে দিব’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)।
ঘ. জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইসলামী প্রগতির অবদান : প্রগতি যেহেতু অগ্রগামী, সেহেতু ইসলামী শরী‘আহ্ মোতাবেক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাও এর মধ্যে পরিগণিত হয়। বিগত যুগে ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমেই মুসলমানরা বিশ্ব নেতৃত্বে সমাসীন হয়েছিল। অথচ আজ আধুনিক শিক্ষার নামে তাদেরকে কেবল বিদেশীদের লেজুড় হিসাবে তৈরী করা হচ্ছে। নিজের ঘরে খাঁটি সোনা থাকতে তারা অন্যের মেকী সোনার পিছনে ছুটছে। একটি হিসাবে জানা যায় যে, পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন বিষয় সমূহে নিম্নোক্ত আয়াত সমূহ বিদ্যমান রয়েছে। যেমন, (১) মেডিসিনে ৩৫৫টি, (২) বায়োলজি ও বোটানিতে ১০৯টি, (৩) এ্যাস্ট্রোনমি ও এ্যাস্ট্রোফিজিক্সে ৮২টি, (৪) কেমিস্ট্রিতে ৪৩টি, (৫) মেটেরিওলজিতে ৩৪টি, (৬) জিওলজিতে ৩৩টি, (৭) ওসিয়ানোগ্রাফিতে ৩১টি, (৮) জুলোজিতে ২৮টি, (৯) জিওপ্রাফিতে ১৭টি, (১০) আর্কিওলজিতে ৮টি, (১১) এয়ারোনটিক্সে ৮টি এবং (১২) সোশিওলজিতে ৩০০টি, সর্বমোট ৯৪৮টি।
আরেকটি হিসাবে এসেছে যে, কুরআনের শতকরা ১১টি আয়াত বিজ্ঞান বহন করে। প্রকৃত অর্থে কুরআন ও হাদীছের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যই বিজ্ঞান বহন করে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তিগণের নিকটে যা গোপন নয়। কেবল উৎসাহ ও সহযোগিতা দেওয়ার অভাবে এবং যথার্থ গবেষণার অভাবে কুরআন ও হাদীছের কল্যাণ ভান্ডার থেকে মানবজাতি বঞ্চিত রয়েছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানগণ দীর্ঘ ১০০০ বছর যাবৎ বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছে। উইলিয়াম ড্রেপার স্বীয় Intellectual development of Europe গ্রন্থে বলেন, খুবই পরিতাপের বিষয় যে, পাশ্চাত্যের জ্ঞানীগণ বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান ও অগ্রগতিকে ক্রমাগতভাবে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের এই বিদ্বেষ বেশীদিন চাপা থাকেনি। নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরবদের অবদান আকাশের নক্ষত্রের ন্যায় উজ্জ্বল’।[5]
ঙ. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও অপসংস্কৃতি ইসলামী প্রগতিবাদ নয় : জ্ঞান-বিজ্ঞান যদি তা ধর্ম নিরপেক্ষতা মতবাদের আলোকে পরিচালিত হয়, তা প্রগতি নয়; বরং তা হ’ল প্রগতির নামে প্রহসন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আধুনিক ধ্বজাধারী বাণিজ্যিক যে প্রগতি, তার একমাত্র বাঁধা ধর্মীয় মতবাদ। আর তা অন্য কোন ধর্মের নয় একমাত্র দ্বীন ইসলামই হ’ল আধুনিক প্রগতির প্রতিবন্ধকতা। আজ সারা বিশ্বে সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ এই প্রগতিবাদের নামের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিষবৃক্ষটি। প্রগতির নামে অসামাজিক অনৈতিক কর্মকান্ড নিদ্বির্ধায় ঘটে চলেছে। যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নামে ধর্মহীনতা ও নৈতিকতা বিরোধী মতবাদ চাপিয়ে দিতে চায় সাধারণ মানুষের ঘাড়ে তাদের উপলব্ধি করা উচিৎ বিগত ইসলাম বিরোধী শক্তি ও অপচেষ্টা থেকে। প্রগতির নামে ইসলাম বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে সমাজের বুকে চাপিয়ে দেয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে, সবাইকে অনৈতিকতা ও অপসংস্কৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত করে আমাদের ঈমানী শক্তি অপহরণ করে চলেছে। তবে সমাজের অতি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা ইসলামকে বাদ দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কুটকৌশল অবলম্বন করছে। তাদের মতে সমাজে অপসংস্কৃতির নামে অনৈতিক অশ্লীলতা বেহায়া বেলেল্লাপনা ছড়িয়ে দেয়া। মান সম্মত শিক্ষার নামে ইসলামী শিক্ষা বর্জিত করে নাস্তিকতাপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ কারিকুলাম প্রনয়ণ। যার ফলে শিক্ষার হার গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মান জ্যামিতিক হারে হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন দিবসের নামে যুবক যুবতীদের মিলন মেলায় অংশগ্রহণ ও বেহাপনায় উদ্বুদ্ধ করণ। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক ছিন্ন করণসহ সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট করার সর্বাত্মক অপচেষ্টা করে চলেছে। তারা নিজেদেরকে সভ্য ভাবেন, পাশ্চাত্যের অনুকরণে উন্নত সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেন তাদের সামনে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ বড় ধরণের বাঁধা বলেই ধারণা করেন। আজ সারা বিশ্বের অস্থিরতা ও অশান্তির ধোঁয়া চারিদিক থেকে ক্রমে ক্রমে আমাদের চারপাশে ছেয়ে যাচ্ছে তার মূল চিন্তা শক্তি প্রগতির নামে যত সব প্রহসনের প্রতিক্রিয়া মাত্র।
বর্তমান বিশ্বে তথাকথিত সুশিক্ষিত সুসভ্য জাতি ও প্রগতির ধ্বজাধারীরা ইসলামে অশ্লীলতা বিস্ফোরণ। যার ফলে নানা ধরণের অপরাধ প্রবণতা বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিঘ্নিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তা। প্রকটভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রগতির নামে নারী অশ্লীলতা । নারীদেরকে সিনেমা, টেলিভিশন, থিয়েটার, বিজ্ঞাপন, পত্র-পত্রিকায় নগ্ন-অর্ধনগ্ন অবস্থায় উপস্থাপন করা হচ্ছে। নায়ক নায়িকাদের যৌন আবেদন মূলক অশালীন, অশোভন অভিনয়, নাচ-গান, বেহায়াপনা, স্পর্শকাতর গোপন অঙ্গ প্রত্যঙ্গসহ উত্তেজনা সৃষ্টিকারী দেহ প্রদর্শন করে যুবসামজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নারী জাতির এ বেহাল অবস্থা দর্শন করে সর্বস্তরের জনসাধারণ হারিয়ে ফেলেছে নারীদেরকে মা বোনদের মত সম্মান করার মন মানসিকতা, তারা হারাতে বাধ্য হয়েছে তাদের হৃদয়ের পবিত্রতা। মানুষ কত নীচে নামতে পারে এবং তাদের নগ্নতা ও অশ্লীলতা কিভাবে দুনিয়ার সামনে উপস্থাপন করা যায় তার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। প্রগতির নামে অশ্লীলতা দেশ ও জাতিকে ক্রমশঃ চরম অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যার সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন হ’ল আকাশ সংস্কৃতি। টিভি, সিডি, ভিসিয়ার, সিনেমা, নাটক, আর ডিস এন্টেনার মাধ্যমে সমাজ জীবন প্রতিনিয়ত কলুষিত হচ্ছে। তবে ইন্টারনেট সকল অপসংস্কৃতির মূল চাবিকাঠি, যেমন ফেসবুক, স্কাইপি, ট্যাংগু, উইচ্যাট, গুগলটক, ইউটিউব, ইউপর্ণ, অশস্নীল বস্নগ, লাইক পেজ প্রভৃতি নামের কিছু ওয়বে সাইট। এই সাইট ও লাইপেজগুলো অকল্পনীয় অশ্লীলতা প্রচার ও প্রসার করে চলেছে। আর একারণে ধ্বংস করছে মানুষের ঈমান-আক্বীদা, চরিত্র ও মেধা। প্রকাশ্যে বাড়ীতে, বৈঠকখানায়, দোকানে, বাসে, রাস্তা-ঘাটে সর্বত্র চলছে লজ্জা-শরম বিধ্বংসী কার্যকলাপ। শিক্ষা সাংস্কৃতির নামে অনৈসলামিক কার্যক্রমের সবার্তমক উত্থান। মুক্ত মনা জাতিই না’কি প্রগতিশীল। আর এরাই না’কি মুক্ত মনা আধুনিক প্রগতিশীল নতুন প্রজন্ম। এই প্রগতির প্রতিচ্ছায়ায় আজ আত্মীয়তার সুসম্পর্কের বন্ধন ধীরে ধীরে ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রগতিবাদীরা ধীরে আইয়ামে জাহিলিয়াতে ঘোর অন্ধকারের দিকে ফিরে যাবার জন্য সর্বাত্মক অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। বলা যায় এরা জন্ম দিতে চায় ‘মডার্ণ আইয়্যামে জাহেলিয়াত’। আসলেই আমরা নারী প্রগতির নামে তাদেরকে ঘর থেকে বের করে ভুল ভাল বুঝিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত ভোগ করা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ পরিহার করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টার নামই আধুনিক প্রগতি মাত্র।
বিধর্মীরা মুসলমানদের চিরশত্রু। যতক্ষণ পর্যন্ত না মুসলমানরা তাদের আচার-আচরণকে অনুকরণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মুসলমানের শত্রু ভাবাপন্ন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করনা। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’ (মায়েদা-৫/৫১)। ‘আর ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্ম অনুসরণ করেন’ (বাক্বারাহ ২/১২০) এবং আপনি সব মানুষের চাইতে মুসলমানদের অধিক শত্রু ইহুদী ও মুশরেকদেরকে পাবেন (মায়েদা ৫/৮২)। আর ইহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে এক শ্রেণীর মুসলমানরা এমন ভাবে অনুসরণ করে চলেছে যে, তারা বিপদের আশংকা আছে জেনেও এমন গুহাতে প্রবেশ করতেও দ্বিধাবোধ করেনা। ঐ সকল লোকদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে এমন ভাবে অনুসরণ করবে যে, এক বিঘত পরিমাণও ব্যবধান হবে না। এমনকি তারা যদি গুই সাপের গর্তেও প্রবেশ করে থাকে, তোমরাও তাতে প্রবেশ করতে শংকিত হবে না। ছাহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তারা কি ইহুদী ও খ্রীষ্টান ? তিনি বললেন, তবে আর কে ? [6] অন্যত্র বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতীর সঙ্গে সাদৃশ রাখে, সে ঐ জাতির মধ্যে গণ্য হবে’।[7]
শেষকথা :
মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে দ্বীন ইসলামকে প্রোগ্রেস বা প্রগতিশীল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রেক্ষাপটে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর অহীভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় ফুলপ্রুফড প্রগতিবাদ হ’ল ইসলাম। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন।
[1]. প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, (রাজশাহী : ২য় সংস্করণ, প্রকাশ ২০১৬) পৃ. ২।
[2]. আহমাদ হা/১৭২০৯; তিরমিযী হা/২৮৬৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪।
[3]. আবুদাঊদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭ ‘পোষাক’ অধ্যায়; বঙ্গানুবাদ হা/৪১৫৩; ছহীহুল জামে‘ হা/২৮৩১।
[4]. বুখারী, হা/২৬৫২; মুসলিম, হা/২৫৩৩।
[5]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, (দরসে হাদীছ - ইসলামী শিক্ষা -আত-তাহরীক (১৮তম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা) জুন ২০১৫)।
[6]. বুখারী হা ৩/৩১৯৮ (কিতাবুল আম্বিয়া অধ্যায়)।
[7]. আবুদাউদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭।