ইতিবাচকতা
আমেরিকান শিক্ষাবিদ স্টিফেন কভেই (১৯৩২-২০১২) বলেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ১০% বিষয় থাকে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু বাকি ৯০% বিষয় হল কোন ক্রিয়াকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রতিক্রিয়ার ফলাফল। এটি তার ‘৯০/১০ থিউরী’ নামে পরিচিত। তিনি উদাহরণ দেন, যেমন আপনি সকালে নাশতার টেবিলে বসলেন। এ সময় আপনার সন্তানের হাতে লেগে কফির কাপটি আপনার জামায় উল্টে পড়ল। এ বিষয়টির উপর না আপনার কোন নিয়ন্ত্রণ বা হাত ছিল, আর না আপনার সন্তানের। এটি একটি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা। কিন্তু এর পরবর্তীতে যা ঘটবে তা আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন। কীভাবে? যদি আপনি এ ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখান, রাগান্বিত হন এবং আপনার সন্তানকে ধিক্কার দেন; তাহ’লে সন্তান কাঁদবে। আপনি হয়ত আপনার স্ত্রীকেও ধমক দেবেন কফির কাপটি টেবিলের কিনারে রাখার জন্য। হয়ত মৌখিক তর্ক হবে দু’জনের মাঝে। তারপর আপনি ঘরে গিয়ে দ্রুত জামাটি পাল্টিয়ে নতুন জামা পরে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হবেন। কিন্তু আপনার সন্তানটি তখনও কাঁদছে এবং স্কুলের বাস মিস করেছে। আপনি তাকে নিজের গাড়িতে করে স্কুলে নিয়ে গেলেন দ্রুতগতিতে। ফলে আপনাকে ট্রাফিক আইন লংঘনের দায়ে জরিমানা দিতে হ’ল। অতঃপর আপনি ২০ মিনিট দেরীতে অফিসে পৌঁছে দেখলেন তাড়াহুড়োর মধ্যে আপনার ব্রিফকেসটি বাড়ীতে রেখে এসেছেন। এভাবে আপনার সকালটা ভয়ংকরভাবে শুরু হ’ল। দিন শেষে যখন বাড়ি এলেন, তখনও আপনার সন্তান এবং স্ত্রী আপনার সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলবে না, আপনার সকালের রুক্ষ আচরণের কারণে।
এবার ভাবুন, কেন আপনার দিনটা মন্দভাবে গেল? কফির কারণে? আপনার সন্তানের কারণে? আপনার স্ত্রীর কারণে? ট্রাফিক পুলিশের কারণে? না এর কোনটাই না, বরং এর কারণ আপনি নিজেই। যদি সকালে মাত্র ৫ সেকেন্ডের ঐ অনাকাংখিত আচরণটি না করতেন, তাহ’লে পুরো দিনটি আপনার এমন নিরানন্দ হওয়ার কথা ছিল না। এর বদলে যদি আপনি ঐ পরিস্থিতি সঠিকভাবে সামাল দিতে পারতেন সন্তানকে এরূপ কথা বলে যে, ‘কোন সমস্যা নেই বাবা, তবে পরবর্তীতে তোমাকে আরও সতর্ক থাকতে হবে’। তাহলে পুরো চিত্রটি ভিন্ন রকম হ’ত। কোন জটিলতার অবকাশ থাকত না। একটি সঠিক প্রতিক্রিয়া এভাবে বহু জটিলতা থেকে আমাদেরকে রেহাই দেয়, আবার ভুল প্রতিক্রিয়া তৈরী করে নানান অশান্তি এবং বিশৃংখলা।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত ঘটনার মত জীবনে আমাদেরকে ছোট-বড় বহু ধরণের সংকট অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু প্রায়ই সেসব ঘটনায় আমরা অনর্থক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বিষয়গুলো অসম্ভব জটিল করে তুলি। অথচ ইতিবাচক দৃষ্টিতে তার মোকাবিলা করতে পারলে জীবনের স্বচ্ছ-সরল গতিধারায় তেমন কোন ছেদ পড়ত না। আপনার বাস বা ট্রেন নির্ধারিত সময়ে ছাড়েনি? সময়টা অন্য কাজে লাগান। বই পড়ুন। কোন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হন। আপনার চাকুরী চলে গেছে? নতুন কোন চাকুরী খুঁজুন। কেন হতাশায়, বিরক্তিতে নিমজ্জিত হবেন? তাতে কী লাভ? সেই সময়টা বরং জীবনের নতুন কোন বৈচিত্রের জায়গা অনুসন্ধানে ব্যয় করুন। এভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটিয়ে সহজেই আমরা জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারি। নিজেকে সযতনে দূরে রাখতে পারি অনর্থক ঝামেলা আর বিবাদ-বিসম্বাদ থেকে। কোন বিষয়কে কঠিন করে তুলে নিজের উপর যুলুম চাপিয়ে দেবেন, নাকি তার সরল সমাধান খুঁজে নিজেকে প্রশান্ত রাখবেন, এ সিদ্ধান্তটা একান্তই আপনার নিজের।
বিশেষ করে যারা আমরা আখেরাতে বিশ্বাসী এবং পরকালীন সঞ্চয়ই জীবনের একমাত্র মিশন ও ভিশন হিসেবে নিয়েছি; তাদের জন্য দুনিয়াবী জটিলতা ও স্বার্থহানি কখনই এতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না যে, তা আমাদের স্বাভাবিক মানবিকতা ও নৈতিকতাবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, আমরা এমন অনেক ধার্মিক মানুষকেও দেখি যারা জীবনের কোন সংকট মুহূর্তে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি; বরং অবিবেচক ও ধৈর্যহীনভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। যার খেসারত তাদেরকে সারাজীবন ধরে দিতে হয়েছে প্রচন্ড হতাশাগ্রস্ততা, বিপন্নবোধ এবং অন্তর্জ্বালা নিয়ে। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে এক অপচিত জীবন নিয়ে তারা ধুঁকতে থাকে আমৃত্যু। অথচ সময়মত একটুখানি ধৈর্যধারণ হয়ত এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারত।
প্রিয় পাঠক, নেতিবাচক মানসিকতা, প্রতিক্রিয়া এবং কর্মকান্ড যেমন মানুষের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে, তেমনি বিপরীতক্রমে ইতিবাচকতার ফলাফল হয় অতীব মধুর। ইসলামে ছবর বা ধৈর্যের ব্যাপারে এ জন্যই এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেননা ধৈর্য মানুষকে সবসময় ইতিবাচক রাখে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়, সংকটের সময় সঠিক সমাধানের পথ বাতলে দেয়; সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে দৃঢ় রাখে। এমন গুণসম্পন্ন মানুষের হাতে সমাজ কখনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। বরং পরার্থপরতা, সহমর্মিতা ও সহনশীলতাই হয় তাদের জীবনের মূলমন্ত্র। আল্লাহ রাববুল আলামীন কত চমৎকারভাবে না মানবজাতিকে ইতিবাচকতার পথ দেখিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘ভাল এবং মন্দ এক নয়, (হে রাসূল!) আপনি (মন্দের) প্রতিরোধ করুন সর্বোৎকৃষ্ট দ্বারা, তাহলে দেখবেন যে ব্যক্তির সাথে আপনার শত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এমন (মহৎ) চরিত্র কেবল তারাই লাভ করে যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং এই চরিত্রের অধিকারী তারাই হয়, যারা মহা সৌভাগ্যবান (ফুছছিলাত ৩৪,৩৫)। তিনি আরও বলেন, নিশ্চয়ই কঠিনের সাথে রয়েছে সহজতা (ইনশিরাহ ৬)। ইসলাম শেখায়, বিপদের প্রারম্ভকালেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা ব্যক্তি হ’ল প্রকৃত ধৈর্যশীল। রাসূল (ছাঃ) বলেন, শুরুতে ধৈর্য ধারণই হ’ল প্রকৃত ধৈর্য (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৭২৮)।
বস্ত্ততঃ মানবজীবন হ’ল পরীক্ষার জীবন। ফলে যে কোন সময় অনাকাঙখিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন কে কর্মে ও আচরণে অধিক উত্তম। সুতরাং যদি এ সময়ে অধৈর্য না হয়ে আল্লাহর উপর প্রগাঢ় ভরসা রাখা যায় এবং বলা যায়, ‘হয়তবা আল্লাহ আমাদেরকে অধিকতর উত্তম বদলা দেবেন, নিশ্চয়ই আমরা আমাদের পালনকর্তার কাছে আশাবাদী’ (কলম ৩২), তাহলে বহু পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃংখলার হাত থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। আর একজন মুমিনের জন্য আল্লাহ-নির্ভরতাই তো পরমার্থ। আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন! আল্লাহই তোমাদেরকে (ভয়-ভীতি) থেকে মুক্তি দেন এবং সকল দুঃখ-বিপদ থেকে’ (আনআম ৬৪)। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য মুক্তির পথ খুলে দেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক দেন, যা সে চিন্তাও করে নি। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তিনি তার জন্য যথেষ্ট’ (তালাক ২-৩)। সুতরাং কথায়-কাজে, চলনে-বলনে যথাসাধ্য ইতিবাচকতা বজায় রাখাই আমাদের কর্তব্য। জীবনকে নির্ঝঞ্ঝাট ও লক্ষ্যপূর্ণ রাখতে চাইলে এই শক্তিশালী মূলমন্ত্রটি কখনও হাতছাড়া করা যাবে না। জীবনের প্রতি পদে মনে রাখুন রাসূল (ছাঃ)-এর এই চিরন্তন উপদেশ, ‘মুমিনের ব্যাপারটি বড়ই বিস্ময়কর, তার সমস্ত বিষয়টিই কল্যাণময়। মুমিন ব্যতীত আর কারো জন্য এরূপ নেই। যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে শুকরিয়া আদায় করে। ফলে এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে ছবর করে, ধৈর্য ধরে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’ (মুসলিম হা/২৯৯৯)। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকল ভাই-বোনকে দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী যিন্দেগীকে স্রেফ পরকালীন উপার্জনের নিমিত্ত মনে করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্মুখপানে অগ্রসর হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!