• free web stats
  • At-Tahreek
    আক্বীদা

    মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে প্রচলিত জাল হাদীছের পর্যালোচনা

     

    ভূমিকা : জ্ঞান এবং অজ্ঞতা পরস্পরবিরোধী দু’টি শব্দ। জ্ঞান মানুষকে সত্য ও আলোর পথ দেখায়। আর অজ্ঞতা মানুষকে বিভ্রান্ত ও ধ্বংস করে। সব অজ্ঞতা মেনে নেয়া যায়, কিন্তু স্বয়ং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে যখন মুসলিম জাতির একটি বিরাট অংশ চরম অজ্ঞতা প্রসূত আক্বীদা পোষণ করে তখন কষ্ট চেপে রাখা বড় কঠিন হয়ে যায়। নিম্নে আমরা রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে প্রচারিত মিথ্যা কিছু হাদীছ পর্যালোচনা করতে চাই, যেন সমাজে গেঁড়ে বসে থাকা অজ্ঞতার প্রহেলিকা কিছুটা হলেও অপসারণ করা সম্ভব হয়। আল্লাহুল মুসতাআন।

    হাদীছ-১ : আল্লাহ আদম (আঃ)-কে বললেন, ولولا محمد ما خلقتُك ‘মুহাম্মাদ যদি না হ’ত তবে তোমাকে সৃষ্টি করতাম না’।[1]

    পর্যালোচনা : এটা একটি বানোয়াট হাদীছ।

    হাদীছ-২ : لولاك لما خلقت الأفلاك ‘আপনাকে প্রেরণের উদ্দেশ্য না হ’লে আমি বিশ্বমন্ডল সৃষ্টি করতাম না’।

    পর্যালোচনা : হাদীছটি বানোয়াট। এই বিষয়ে ইমামদের পর্যালোচনামূলক উক্তিগুলি তুলে ধরা হ’ল-

    (১) ইমাম ছাগানী (রহঃ) বলেন, হাদীছটি জাল।[2]

    (২) ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেছেন, مَوْضُوع بِلَا شكّ (এটা) নিঃসন্দেহে বানোয়াট।[3]

    (৩) শায়খ জামালুদ্দীন ক্বাসেমী (রহঃ) বলেছেন, والأحاديث التي وضعها المطرون الغلاة كحديث: "لولاك ما خلقت الأفلاك ‘চরমপন্থীরা যে সকল হাদীছ বানিয়েছে তন্মধ্যে একটি হ’ল- ‘যদি আপনি না হ’তেন তবে বিশ্বমন্ডল কিছুই সৃষ্টি করতাম না’।[4]

    (৪) একটি বিশ্ববিখ্যাত আক্বীদার গ্রন্থে লেখা হয়েছে, لولاك..لما خلقت الأفلاك وهو غلو فاحش يجب التوبة منه ‘আপনাকে প্রেরণের উদ্দেশ্য না হ’লে আমি বিশ্বমন্ডল সৃষ্টি করতাম না’-(এই ধরণের কথা বলা) মারাত্মক বাড়াবাড়ি। এ থেকে তাওবা করা ওয়াজিব’।[5]

    (৫) শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এ হাদীছটিকে মাওযূ‘ তথা বানোয়াট বলেছেন। যেমনটা ইমাম ছাগানী ‘আল-আহাদীছুল মাওযূ‘আহ’ গ্রন্থে (পৃঃ ৭) বলেছেন। তবে শায়খ (মোল্লা আলী) আল-ক্বারীর উক্তি (৬৭, ৬৮)- ‘কিন্তু এর অর্থটি ছহীহ’, এটা দায়লামী ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে মারফূ‘ হিসাবে (নিমেণাক্ত ভাষায়) বর্ণনা করেছেন- ‘আমার কাছে জিবরীল আসলেন। এরপর বললেন, يا محمد لولاك لما خلقت الجنة، ولولاك ما خلقت النار ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি না হ’তেন তাহ’লে জান্নাত সৃষ্টি করতাম না এবং আপনি যদি না হ’তেন তবে জাহান্নাম সৃষ্টি করতাম না। ইবনে আসাকিরের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, لولاك ما خلقت الدنيا ‘আপনি যদি না হ’তেন তাহ’লে দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না’।

    আমি (আলবানী) বলছি : দায়লামীতে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা বিশুদ্ধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত (হাদীছটির অর্থ সঠিক) এ মর্মে দৃঢ়চিত্ত হওয়া যাবে না। আর আমি কাউকে দেখছি না যিনি এ মর্মে বর্ণনা করেছেন। যদিও আমি এর সনদটি সম্পর্কে অবহিত হইনি, তবুও হাদীছটি যে দুর্বল এ মর্মে কোন দ্বিধা বোধ করছি না।

    আর দায়লামী কর্তৃক এককভাবে বর্ণিত হওয়াটাই হাদীছটির দুর্বলতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। অতঃপর আমি এর যঈফ, বরং অত্যন্ত যঈফ হওয়ার পক্ষে জোর দিলাম যখন (দায়লামীর) ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে (১/৪১/২) হাদীছটির সনদ সম্পর্কে অবহিত হ’লাম। (হাদীছটি) উবায়দুল্লাহ বিন মূসা আল-কুরাশীর সনদে বর্ণিত...। আমার দৃষ্টিতে এটির সমস্যা হ’ল সনদের রাবী ‘আব্দুছ ছামাদ’। উক্বায়লী বলেছেন, حديثه غير محفوظ، ولا يعرف إلا به ‘তার হাদীছ সংরক্ষিত নয় এবং তার মাধ্যম ব্যতীত (হাদীছটি অন্য কোন মাধ্যমে বা সনদে) জানা যায় না’... আর ইবনে আসাকিরের বর্ণনাটি ইবনুল জাওযীও তার ‘আল-মাওযূআত’ গ্রন্থে (১/২৮৮-২৮৯) একটি দীর্ঘ হাদীছের মধ্যে ‘সালমান’ হতে মারফূরূপে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, إنه موضوع নিশ্চয়ই এটা (হাদীছটি) বানোয়াট। সুয়ূত্বী ‘আল-আলী আল-মাছনুআহ’ গ্রন্থে (১/২৭২) তা (ইবনুল জাওযীর বক্তব্য) সমর্থন করেছেন। অতঃপর আমি আনাস (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীছ পেয়েছি। অচিরেই আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ’।[6]

    (৬) শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ) বলেছেন, কতিপয় লোক এটা বলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,لولاك لما خلقت الأفلاك ‘হে নবী! যদি আপনি না হতেন তবে আমি আকাশ (ও যমীন) সৃষ্টি করতাম না’।-এই কথাটির কোন প্রমাণই হাদীছের কোন গ্রন্থে সনদের সাথে বিদ্যমান নেই। এই সনদবিহীন বাক্যটিকে শায়খ হাসান বিন মুহাম্মাদ ছাগানী (৬৮০ হিঃ) ‘موضوع’ অর্থাৎ মনগড়া বলেছেন’।[7]

    জ্ঞাতব্য : আজলূনী ও মোল্লা আলী ক্বারী ‘হাসান আছ-ছাগানী’ হ’তে এই বাক্যটির موضوع (বানোয়াট) হওয়া বর্ণনা করার পর লিখেছেন, ‘معناه صحيح’ অর্থাৎ এই (বানোয়াট বর্ণনাটির) অর্থটি বিশুদ্ধ বা ছহীহ। বিষয় হ’ল যে, যখন এই রেওয়ায়াতটি বাতিল, মনগড়া এবং আল্লাহ ও রাসূলের উপর মিথ্যাচার, তখন কোন দলীলের ভিত্তিতে এর অর্থ বা মর্মকে ছহীহ বলা হয়েছে?

    মোল্লা আলী ক্বারী লিখেছেন যে, দায়লামী ইবনে আববাস হ’তে মারফূ হিসাবে বর্ণনা করেছেন যে,أتاني جبريل فقال: يا محمد لولاك ما خلقت الجنة، ولولاك لما خلقت النار ‘জিবরীল আমার নিকটে আসলেন ও বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি না হ’তেন তাহ’লে জান্নাত সৃষ্টি হত না। আপনি যদি না হ’তেন তবে জাহান্নাম সৃষ্টি হত না’।[8]

    এই রেওয়ায়াতটি ‘কানযুল উম্মাল’[9] ও ‘কাশফুল খফা’[10] গ্রন্থে দায়লামীর উদ্ধৃতিতে ‘ইবনে আববাস (ইবনে ওমর) হতে’ সনদে বর্ণিত আছে। দায়লামীর (মৃঃ ৫০৯ হিঃ) ‘ফিরদাউসুল আখবার’ গ্রন্থে এই রেওয়ায়াতটি সনদবিহীন ও উদ্ধৃতি ব্যতিরেকে উল্লেখ আছে।[11]

    সুতরাং এই রেওয়ায়াতটিও সনদবিহীন ও উদ্ধৃতিবিহীন হওয়ার কারণে বানোয়াট ও প্রত্যাখ্যাত।

    মুহাদ্দিছ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ  বিন হারূন বিন ইয়াযীদ আল-খাল্লাল (মৃঃ ৩১১ হিঃ) কোন সনদ ও উদ্ধৃতি ব্যতিরেকেই বর্ণনা করেছেন যে, يَا مُحَمَّدُ، لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ آدَم ‘হে মুহাম্মাদ! যদি আপনি না হ’তেন তবে আদমকে সৃষ্টি করতাম না’।[12] এই রেওয়ায়াতটিও সনদবিহীন হওয়ার কারণে বানোয়াট ও প্রত্যাখ্যাত। মোল্লা আলী ক্বারী ইবনে আসাকির হ’তে বর্ণনা করেছেন যে, لولاك ما خلقت الدنيا ‘যদি আপনি না হ’তেন তবে দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না’।[13]

    ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়াতটি ‘তারীখে দিমাশক্ব’ (৩/২৯৬, ২৯৭), ইবনুল জাওযীর ‘কিতাবুল মাওযূ‘আত’ (১/২৮৮, ২৮৯) এবং সুয়ূত্বীর ‘আল-আলী আল-মাছনূআহ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আ’ (১/২৭২) গ্রন্থসমূহে মওজূদ আছে। ইবনে জাওযী বলেছেন, এটা বানোয়াট হাদীছ। এতে কোন সন্দেহ নেই। এর সনদে দু’জন মাজহূল রাবী ও যঈফ রাবী রয়েছেন। যঈফ রাবীদের মধ্যে আবুস সুকাইন ও ইবরাহীম ইবনুল ইয়াসা অন্যতম। দারাকুৎনী বলেছেন, أَبُو السكين ضَعِيف আবুস সুকাইন যঈফ রাবী। আর ইবরাহীম ও ইয়াহইয়া বছরী উভয়ই মাতরূক বা প্রত্যাখ্যাত রাবী। আহমাদ বিন হাম্বল বলেছেন, حرقنا حَدِيث يَحْيَى الْبَصْرِيّ ‘আমরা ইয়াহইয়া আল-বছরী বর্ণিত হাদীছ জ্বালিয়ে দিয়েছি। আর ফাল্লাস বলেছেন, كَانَ كذابا يحدث أَحَادِيث مَوْضُوعَة ‘তিনি মহামিথ্যুক ছিলেন। দারাকুৎনী বলেছেন, مَتْرُوك তিনি মাতরূক বা পরিত্যাক্ত’।[14]

    অর্থাৎ (ইবনে জাওযীর নিকটে) এই হাদীছটি সন্দেহাতীতভাবে বানোয়াট। আর এর তিনজন রাবী আবুস সুকাইন, ইবরাহীম ইবনুল ইয়াসা ও ইয়াহইয়া আল-বাছরীও সমালোচিত।

    সুয়ূত্বী বলেছেন, موضوع ‘এটা বানোয়াট’।[15] এর রাবী খলীল বিন মুর্রাও অত্যন্ত যঈফ’।[16] সাইয়েদুনা ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি মারফূ‘ হাদীছে লেখা হয়েছে যে, لولا محمد ما خلقتك (হে আদম!) যদি মুহাম্মাদ না হত তবে আপনাকে সৃষ্টি করতাম না’।[17]

    যদিও এই রেওয়ায়াতটিকে হাকেম ‘ছহীহুল ইসনাদ’ বলেছেন; কিন্তু এই রেওয়ায়েতটি কতিপয় কারণে বানোয়াট-

    (ক) হাফেয যাহাবী বলেছেন, بل هو موضوع وعبد الرحمن واه ‘বরং এটা বানোয়াট। সনদে আব্দুর রহমান (বিন যায়েদ  বিন আসলাম) অত্যন্ত দুর্বল’।[18]

    (খ) আব্দুর রহমান বিন যায়েদ সম্পর্কে হাকেম স্বয়ং লিখেছেন, عبد الرَّحْمَن بن زيد بن أسلم روى عَن أَبِيه أَحَادِيث مَوْضُوعَة لَا يخفى على من تأملها من أهل الصَّنْعَة أَن الْحمل فِيهَا عَلَيْهِ  ‘আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম তার পিতা হ’তে বানোয়াট হাদীছসমূহ বর্ণনা করতেন। আহলে ইলমদের মধ্যে গোপনীয় নয় যে, অত্র বানোয়াট হাদীছটি ইনিই (আব্দুর রহমান বিন যায়দ বিন আসলাম) রটনা করেছেন’।[19] অর্থাৎ তিনি তার পিতার নামে মিথ্যা বলে হাদীছ বানাতেন।

    জ্ঞাতব্য : মুসতাদরাক হাকেমের রেওয়ায়াতটিও আব্দুর রহমান বিন যায়দ বিন আসলাম বিশুদ্ধতার শর্ত মোতাবেক স্বীয় পিতা হ’তেই বর্ণনা করেছেন।

    (গ) আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম আল-ফাহরী অজ্ঞাত পরিচয় রাবী। অথবা তিনি হচ্ছেন আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন রশীদ (প্রসিদ্ধ মহামিথ্যুক)’।[20] সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, এই বানোয়াট  বর্ণনাটিকে হাকেমের ‘ছহীহুল ইসনাদ’ বলা ভুল।

    মুসতাদরাকের অন্য আরেকটি রেওয়ায়াতের মধ্যে ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, فَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آدَمَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَا النَّار ‘যদি মুহাম্মাদ না হ’তেন তবে আমি আদমকে সৃষ্টি করতাম না। যদি মুহাম্মাদ না হ’তেন তবে আমি জান্নাতও সৃষ্টি করতাম না জাহান্নামও সৃষ্টি করতাম না’।[21] এই রেওয়ায়াতটি কতিপয় কারণে বানোয়াট ও প্রত্যাখ্যাত-

    (ক) হাফেয যাহাবী বলেছেন, أظنه موضوعا على سعيد আমি অনুধাবন করছি যে, এটা সাঈদ (বিন আবী আরূবাহ)-এর উপরে মিথ্যাস্বরূপ সম্বন্ধিত করা হয়েছে’।[22]

    (খ) আমর বিন আওস মাজহূল রাবী’।[23]

    (গ) সাঈদ বিন আবী আরূবাহ ‘মুখতালিত্ব’ রাবী’।[24]

    (ঘ) সাঈদ বিন আবী আরূবাহ ও ক্বাতাদা উভয়ই মুদাল্লিস রাবী। যদি এই রেওয়ায়াতটি উভয়ের থেকে প্রমাণিতও হয় তবুও তা প্রত্যাখ্যাতই ছিল।

    (ঙ) আবুশ শায়খ ইস্পাহানীর ‘ত্বাবাক্বাত’ (হা/৪৯৪, ৩/২৮৭) গ্রন্থে জানদাল বিন ওয়ালিক্ব-এর সনদ হ’তে এই রেওয়ায়াতটি ثنا محمد بن عمر المحاربي عن سعيد بن اوس الانصاري عن سعيد بن ابي عروبة সনদে বর্ণিত আছে। এতে মুহাম্মাদ বিন ওমর নামক অজ্ঞাত পরিচয় রাবী রয়েছেন। যিনি ‘আমর বিন আওস’কে ‘সাঈদ বিন আওস’ দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন।

    সারকথা : ‘لولاك ما خلقت الافلاك’ এবং এই মর্মের সকল রেওয়ায়াতই বানোয়াট ও বাতিল। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি’।

    (৭) মুফতী মুবাশ্বির আহমাদ রববানী বলেছেন, এই রেওয়ায়াতটি বানোয়াট.....। মির্যা গোলাম আহমাদ ক্বাদিয়ানী এই হাদীছটিকে চুরি করে স্বীয় গ্রন্থ ‘হাক্বীতুল ওহী’[25] গ্রন্থে লিখেছেন এবং দাবী  করেছেন যে, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে এই বাক্যের দ্বারা সম্বোধন করেছেন, لولاك ما  خلقت الافلاك  যদি আপনি না হ’তেন তবে আসমান-যমীন সৃষ্টি করতাম না’।[26] অর্থাৎ ব্রেলভীরা বলে যে, এর দ্বারা নবীকে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ক্বাদিয়ানীরা বলছেন যে এর দ্বারা গোলাম আহমাদ ক্বাদিয়ানীকে বুঝানো হয়!

    (৮) আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) বলেছেন, এই রেওয়ায়াতটি ছহীহ নয়। মুহাদ্দিছগণ একে বানোয়াট বলেছেন। দেখুন : ইমাম শাওকানীর ‘আল-ফাওয়ায়েদুল মাজমূ‘আ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ’ ও মোল্লা আলী ক্বারীর ‘মাওযূ‘আতে কাবীর’ ইত্যাদি। আর হাকেমের কিছু রেওয়ায়াত ‘فَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آدَمَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَا النَّارَ’ ‘যদি মুহাম্মাদ না হ’ত তবে আমি আদমকে সৃষ্টি করতাম না। আর যদি মুহাম্মাদ না হ’ত তবে আমি জান্নাতও সৃষ্টি করতাম না জাহান্নামও সৃষ্টি করতাম না’-হাদীছটিকে এর সমর্থনে পেশ করা হয়েছে যে, হাকেম একে ছহীহ বলেছেন এবং বালক্বীনী তাকে সঠিক বলেছেন; তো এর জবাব এই যে, ইমাম যাহাবী তাকে খন্ডন করেছেন এবং বলেছেন যে, কারো জন্য হালাল নয় যে, ‘মুসতাদরাক হাকেম’-এর উপর নির্ভর করে, যতক্ষণ না সে আমার ‘তালখীছ’ গ্রন্থটি দেখে। আর হাকেমের শৈথিল্যবাদিতা মুহাদ্দিছদের মধ্যে প্রসিদ্ধ। ইমাম যাহাবী (রহঃ) বলেছেন, হাদীছটির মধ্যে আমর বিন আওস রয়েছেন। জানি না তিনি কে’।[27]

    অতঃপর তিনি বলেছেন, ‘এমনই আরেকটি বর্ণনা হাকেম ও ইবনে আসাকির হ’তে সমর্থনস্বরূপ বর্ণনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু সবগুলিই এটি নির্দেশ করছে যে, কোনটিই ছহীহ নয়’।[28]

    উপসংহার : জাল, যঈফ ও এই সমস্ত বানানো হাদীছগুলি সমাজ জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। ধর্মের নামে অধর্মের চোরা গলি দিয়ে ভক্তের পকেট সাফ করা হচ্ছে, নিয়ে যাওয়া  হচ্ছে জাহান্নামে। অতএব জাতি সাবধান! আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন।

    [লেখক : প্রশিক্ষণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, উপযেলা সৈয়দপুর, নীলফামারী]

    [1]. ড. ত্বাহেরুল ক্বাদিরী, মীলাদুন্নবী (ছাঃ) পৃঃ ১৭১। এটা একটা দীর্ঘ হাদীছ। যেখানে বলা হয়েছে- হযরত ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন আদম ভুল করে বসলেন তখন তিনি আল্লাহর দরবারে আরয করলেন যে, হে আমার রব! আমি আপনার কাছে মুহাম্মাদের অসীলায় ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ বললেন, হে আদম! তুমি মুহাম্মাদকে কিভাবে চিনলে? অথচ তাকে আমি (এখনো) সৃষ্টি করিনি? আদম বললেন, আমি এভাবে চিনলাম যে, যখন আপনি আমাকে আপনার হাত দ্বারা সৃষ্টি করলেন ও আপনার পক্ষ হ’তে আমার ভিতরে রূহ ফুঁকে দিলেন; (তখন) আমি মাথা উঠিয়ে আরশের পায়াগুলির উপর এই লেখাটি দেখলাম যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। তখন আমি অবগত হলাম যে, আপনি আপনার নামের সাথে এমন একজন ব্যক্তির নামকে সংযুক্ত রেখেছেন যিনি আপনার নিকটে সমগ্র মাখলূকের চাইতে অধিক পসন্দনীয়। আল্লাহ বললেন, হে আদম! তুমি সত্য বলেছ। প্রকৃতপক্ষেই মুহাম্মাদ আমার কাছে সমস্ত সৃষ্টি হ’তে উত্তম। আর যখন তুমি তার অসীলাতে আমার কাছে আবেদন করলে তখন আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম। আর মুহাম্মাদ যদি না হ’ত তবে তোমাকে সৃষ্টি করতাম না’ (ত্বাবারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৬৫০২ ইত্যাদি)। এটা বানোয়াট হাদীছ।

    [2]. আল-মাওযূ‘আত হা/৭৮, আরবী পাঠ-وَمِنْهَا قَوْلهم: لَوْلاكَ لَمَا خَلَقْتُ الأَفْلاكَ

    [3]. তালখীছু কিতাবিল মাওযূ‘আত হা/১৯৫।

    [4]. ক্বাওয়ায়িদুত তাহদীছ পৃঃ ১৫৫।

    [5]. ফিরাকুন মু‘আছিরাহ পৃঃ ৩৫৬।

    [6]. সিলসিলাহ যঈফা হা/২৮২, আরো দেখুন : আলবানী, সিলসিলা যঈফা হা/২৫।

    [7]. দেখুন : মাওযূআত আছ-ছাগানী (হা/৭৮); মুহাম্মাদ ত্বাহের আল-ফাত্তানী আল-হিন্দীর (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ) ‘তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত’  (পৃঃ ৮৬); শাওকানীর আল-ফাওয়ায়েদুল মাজমূআ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আ (পৃঃ ৩২৬); মোল্লা আলী আল-ক্বারী হানাফীর ‘আল-আসরারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাওযূ‘আ (পৃঃ ৩৮৫); আজলূনীর ‘কাশফুল খফা’ (হা/২১২৩) এবং আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌনবীর ‘আল-আছারুল মারফূআহ ফিল আখবারিল মাওযূ‘আ’ (পৃঃ ৪০)।

    [8]. আল-আসরারুল মারফূ‘আহ পৃঃ ২৮৮।

    [9]. হা/৩২০২৫, ১১/৪৩১।

    [10]. হা/৯১, ১/৪৫।

    [11]. হা/৮০৯৫, ৫/৩৩৮।

    [12]. আস-সুন্নাহ হা/২৭৩, পৃঃ ২৩৭।

    [13]. আল-আসরারুল মারফূআহ পৃঃ ২৮৮।

    [14]. কিতাবুল মাওযূ‘আত (তাহক্বীক্বকৃত নুসখা) হা/৫৪৯, ২/১৯, (পুরাতন নুসখা) ১/২৮৯, ২৯০।

    [15]. আল-লাআলী আল-মাছনূআহ ১/২৭২।

    [16]. দেখুন : তাক্বরীবুত তাহযীব, রাবী নং ১৭৫৭।

    [17]. হাকেম, আল-মুসতাদরাক  হা/৪২২৮, ২/৬১৫, তিনি বলেছেন, এই হাদীছটি ‘ছহীহুল ইসনাদ’।

    [18]. তালখীছুল মুসতাদরাক ২/৬৭২।

    [19]. আল-মাদখালু ইলাছ ছহীহ পৃঃ ১৫৪, রাবী নং ৯৭।

    [20]. দেখুন : লিসানুল মীযান ৩/৩৫৯, ৩৬০ (নতুন প্রকাশ) ৪/১৬১, ১৬২।

    [21]. হা/৪২২৭, ২/৬১৫, এবং তিনি বলেছেন, ‘এই হাদীছটি ছহীহুল ইসনাদ’।

    [22]. তালখীছুল মুসতাদরাক ২/৬৭১।

    [23]. দেখুন : মীযানুল ই‘তিদাল  ৩/২৪৬; লিসানুল মীযান ৪/৩৫৪।

    [24]. রাবীর হিফয শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া, বিবেক-বুদ্ধি দুর্বল হয়ে যাওয়া, হাদীছকে সঠিকভাবে মনে রাখতে না পারায় হাদীছের বাক্যে তালগোল পাকিয়ে যাওয়াকে ইখতিলাত্ব বলা হয়। বিভিন্ন কারণে ইখতিলাত্ব হতে পারে। যেমন বয়স বেড়ে যাওয়া, বই-পুস্তক পুড়ে যাওয়া, ধন-সম্পদের ক্ষতি হওয়া কিংবা সন্তান-সন্ততির মৃত্যু ঘটার কারণে মানসিক আঘাত পাওয়া ইত্যাদি (দ্রঃ তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ পৃঃ ১২৫)। এবং যে রাবীর মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায় তাকে ‘মুখতালিত্ব’ রাবী বলা হয়।- লেখক।

    [25]. পৃঃ ৯৯।

    [26]. আহকাম ওয়া মাসায়েল পৃঃ ৫৯, ৬০।

    [27]. ফাতাওয়া ছানাইয়া ১/৩৩৫।

    [28]. ঐ, ১/৩৩৬।

     

     


    HTML Comment Box is loading comments...