• free web stats
  • At-Tahreek
    মনীষীদের লেখনী থেকে

    ফুতূহাত-ই-ফীরূজশাহী

     

    [দিল্লীর তুঘলক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াছুদ্দীন তুঘলকের (রাজত্বকাল : ১৩২০-১৩২৫ খ্রিঃ) কনিষ্ঠ ভ্রাতা রজবের পুত্র ফীরোয শাহ তুঘলক ৭০৬ হিজরী সনে (১৩০৬-০৭ খ্রি.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্যনাম ছিল কামালুদ্দীন। পরে তিনি সুলতান ফীরোয শাহ তুঘলক নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। সাত বছর বয়সে তিনি ইয়াতীম হন। বাল্যকালে ধর্মীয় ও অন্যান্য বিষয়ে সুশিক্ষা লাভ করেন। মুহাম্মাদ বিন তুঘলক (১৩২৫-৫১ খ্রিঃ) তাঁকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তাঁর স্নেহের ছায়াতলে তিনি যুদ্ধ-বিদ্যা এবং রাজ্যশাসন সম্পর্কে উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করেন। ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে মার্চ মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের আকস্মিক মৃত্যুতে আলেম-ওলামা, সেনাপতি ও আমীর-ওমারাদের অনুরোধে এবং সাম্রাজ্যে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত করার নিমিত্তে তিনি ৭৫২ হিজরীর ২৪শে মুহাররম মুতাবেক ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে মার্চ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মভীরু শাসক ছিলেন। শিরক-বিদ‘আত ও শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার। উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের অবক্ষয় যুগে (৩৭৫-১১১৪ হিঃ) যে সকল মহান শাসক ইলমে হাদীছের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সুলতান ফীরোয শাহ (দাওয়াত ও জিহাদ, পৃঃ ১৭)। এই তাওহীদবাদী শাসক রচিত (আনুমানিক ৭৫৪/৭৫৫ হিঃ) ‘ফুতূহাতে ফীরোযশাহী’  সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান একটি গ্রন্থ। ফার্সী ভাষায় রচিত এর মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা পঁচিশ (২৫)। গ্রন্থটির শাব্দিক অর্থ ‘ফীরোযশাহের বিজয় সমূহ’। কিন্তু এই পুস্তকে বিজয় অভিযান বা যুদ্ধ-বিগ্রহের কোন বিবরণ নেই। তাই বিষয়বস্ত্ত হিসাবে এর অর্থ করা যায় ‘নৈতিক বিজয়’ বা ‘কৃতিত্বের কাহিনী’। এতে তাঁর শাসননীতি, সমাজ সংস্কার, শরী‘আতের বিধি-বিধান বাস্তবায়ন, বিভিন্ন ভ্রান্ত মতাদর্শীদের কঠোর হস্তে দমন, জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আব্দুল করীম। অনুবাদকের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাখ্যা এবং জ্ঞানগর্ভ টীকা-টিপ্পনী গ্রন্থটিকে আরো অর্থবহ ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ফলে এর কলেবর হয়েছে ১৪৪ পৃষ্ঠা। তিনি গ্রন্থটির মূল ফার্সী পাঠও গ্রন্থের শেষে সংযোজিত করে দিয়েছেন। ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় আমরা ‘তাওহীদের ডাক’ পাঠকদের উদ্দেশ্যে গ্রন্থটির চৌম্বক অংশসমূহ পত্রস্থ করলাম।-সম্পাদক)]

    ইয়াফত্তাহু-হে বিজয়দানকারী!

    পরম করুণাময় আল্লাহতালার নামে (আরম্ভ করছি)।

    অসীম প্রশংসা এবং অশেষ কৃতজ্ঞতা সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহতালার) প্রতি, যিনি ক্ষমাশীল এবং কৃতজ্ঞতা পাওয়ার উপযুক্ত। আমি রজবের পুত্র ফীরূজ এবং তুঘলক শাহর পুত্র মুহাম্মদ শাহর ভৃত্য একজন অধম দরিদ্র (লোক)। তিনি (আল্লাহতালা) আমাকে সমুজ্জ্বল সুন্নাতসমূহ পুনর্জীবিত করা, বিদআতের মূলোৎপাটন করা, নিষিদ্ধ ও অশালীন কাজে বাঁধা দেওয়া, ফরয ও ওয়াজিব সমূহ সম্পাদনে উৎসাহ দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সৃষ্টির সেরা (হযরত মুহাম্মদ দঃ) এর উপর অসংখ্য দরূদ বর্ষিত হোক যিনি কুসংস্কার এবং প্রচলিত আচার আচরণকে (কুসংস্কারকে) দূরীভূত করার জন্য প্রেরিত হয়েছেন এবং তাঁর সাহাবী ও বংশধরদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক; যাদের উত্তম প্রচেষ্টায় অন্ধকার যুগের কুসংস্কারসমূহ দূরীভূত হয়েছে। আল্লাহতালার সন্তুষ্টি তাঁদের উপর বর্ষিত হোক। 

    অতঃপর; প্রকৃত দানকারীর (আল্লাহতালার) দানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত; দানের আলোচনা করাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। আদম (আঃ)-এর সন্তানদের সেরা (হযরত মুহাম্মদ দঃ) দানের আলোচনা করার জন্য আদিষ্ট হয়েছেন, ‘‘অবশ্যই তোমার প্রভুর দানের আলোচনা কর’’ (যোহা ১১)। আমার মত নগণ্য অধমকে আল্লাহতালা অশেষ নেয়ামত দান করেছেন। তাই আমি চাই যে আমার প্রতি দেওয়া কিছু কিছু আল্লাহর দানের আলোচনা করে মানুষের সাধ্যানুযায়ী তাঁর (আল্লাহর) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, যেন দানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীদের মধ্যে আমি অন্তর্ভুক্ত হই। জীবিকা দানকারী মহান সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহতালার) দানসমূহের মধ্যে একটি এই যে যখন অনেক বিদআত ও শরা বিরোধী অশালীন কাজসমূহ হিন্দুস্থানে প্রসার লাভ করেছে এবং ঐগুলি মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং উজ্জ্বল সুন্নত থেকে মানুষ বিমুখ হয়ে গেছে, তখন তিনি (আল্লাহতালা) তাঁর এই অধম বান্দাকে বিদআতে বাধা দেওয়া, নিষিদ্ধ কাজগুলি দমন করা এবং শরা বিরোধী অশালীন কাজগুলি দূরীভূত করা আমার অবশ্য করণীয় কাজরূপে ধারণা করার সুযোগ দিয়েছেন (অর্থাৎ আমি অবশ্য কর্তব্য রূপে মনে করি)। এই জন্য আমি অনেক চেষ্টা করি, ফলে আল্লাহর সাহায্যে এবং অনুগ্রহে বর্জনীয় কুসংস্কারসমূহ এবং ধর্মবিরোধী প্রচলিত প্রথাসমূহ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত করা হয় এবং বাতেল থেকে সত্য পৃথক হয়ে যায়।

    প্রথম এই। অতীত কালে মুসলমানদের অনেক রক্তপাত করা হত এবং বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার করা হত, যথা-হাত, পা, নাক, কান কেটে দেওয়া; চোখ উপড়ানো; বিগলিত সীসা গলার ভিতর ঢেলে দেওয়া; মুগুর দ্বারা হাত ও পায়ের হাঁড় চূর্ণ করে দেওয়া; আগুনে দেহ ঝলসে দেওয়া; হাত, পা এবং বুকে লোহার পেরেক ঠুকে দেওয়া; চামড়া ছিলে ফেলা; লোহার ছড়ি দ্বারা পিটান; পায়ের গোড়ালি কেটে দেওয়া; করাত দিয়ে দু’টুকরা করা এবং মানব শরীরকে বিকৃত করার মত বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া। মহামহিমাময় এবং মহাদয়ালু (আল্লাহতালা) তাঁর দয়ার ভিখারী এই অধমের মনে সাহস দান করেন যেন আমি দৃঢ় প্রত্যয়ে আত্মনিয়োগ করি যাতে অনর্থক কোন মুসলমানের রক্তপাত না হয় এবং উপরোক্ত কোন শাস্তি না দেওয়া হয় এবং লোকের দেহ বিকৃত করা না হয়।

    এই সকল কাজ (উপরে বর্ণিত অত্যাচারসমূহ) এই কারণে করা হত যেন মানুষের মনে ভয়-ভীতির সঞ্চার হয়, তাদের মনে ভয় বাসা বাঁধে এবং সুলতানের কার্যাবলী (শাসন) সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় (পৃঃ ৬৯-৭০)

    এই অধমের প্রতি আল্লাহর অশেষ দয়ায় ঐ সকল কঠোরতা এবং সন্ত্রাস, কোমলতা, দয়া এবং ভালবাসায় পরিবর্তিত হয়েছে। ভয় এবং শ্রদ্ধা অভিজাত এবং সাধারণ লোক সকলের মনে বেশিরভাগ স্থান করে নিয়েছে। এর জন্য হত্যা, জোর যুলুম, মারধর এবং কঠোরতার আশ্রয় নিতে হয়নি। এই সাফল্য প্রতিপালকের (আল্লাহর) সাহায্য ও দান ছাড়া অর্জিত হয়নি (পৃঃ ৭০)

    আল্লাহর সাহায্যে আমার মনে এটা স্থির হল (আমি মনস্থ করলাম) যে মুসলমানদের রক্ত এবং মোমিনদের মান-মর্যাদার (বা বিষয়-সম্পত্তির) সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। যে কেউ ধর্মের বিধানের প্রতি বিমুখ হবে, কিতাবের নির্দেশে এবং কাযীর বিচার অনুসারে তাকে উচিত শাস্তি পেতে হবে। আমাকে সুযোগ দানের সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই।

    অতঃপর আমার প্রতি মহান আল্লাহর দ্বিতীয় দয়া ও অনুগ্রহ এই। অতীতের সুলতানদের উপাধি যা জুমা ও ঈদের খুতবা সমূহ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল (তা পুনরায় চালু করা)। ঐ সকল বাদশাহর নামে যাদের সাহস এবং দৃঢ়তার গুণে কাফেরদের রাজ্যসমূহ বিজিত হয়, যাঁদের বিজয় পতাকা বিভিন্ন দেশে উডডীন হয়, মন্দিরের মূর্তি ধ্বংস হয়, মসজিদ এবং মিম্বর তৈরি হয় এবং মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়, কলেমা তৈয়েবা প্রচারিত হয়, ইসলামের ধারকরা (মুসলমানেরা) শক্তিশালী হয় এবং (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধকারীরা যিম্মিতে পরিণত হয়, তাদের নাম সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাওয়া হয়। আমি আদেশ দিই যে তাঁদের রাজত্বকালের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে উপাধি ও গুণাবলীসহ তাঁদের নাম খুতবায় পাঠ করা হোক এবং তাঁদের মাগফেরাত কামনা করা হোক (পৃঃ ৭১)

    (কবিতা)

    যদি তুমি চাও যে, তোমার নাম অক্ষয় থাকুক,

    বুজুর্গ লোকের সুখ্যাতি ঢেকে রেখ না।

    অতঃপর পথ-প্রদর্শকের (আল্লাহতালার), তাঁর নাম সম্মানিত হোক, দানসমূহের মধ্যে অন্যতম এই। অতীতকালে শরা বিরোধী ও নিষিদ্ধ করসমূহ বায়তুল-মাল-এ জমা করা হত, যেমন মন্ডী-বরগ, দেলালত-ই-বাজারহা, জযযারী, আমীর-ই তরব, গুল-ফরোশী, জিযিয়া, সিভিল, চোঙ্গি গেল্লা, কিতারি, বিলগারী, মাহী ফরোশী, নদ্দাফী, সাবোনগরী, রিসমান ফরোশী, রওগন গরী, নখোদ বিরয়ান, তিহ-বাজারী, ওজিবা, কিমার খানা, দাদ-বেগী, কোতওয়ালী, ইহাতিসাবী, করহী, চরাই, মুসাদি-রাত।[1] আমি আদেশ দিই যে এইগুলি দীওয়ান-এর হিসাবের বই থেকে বাদ দেওয়া হোক। রাজ্যের কোন আমিল (রাজস্ব বিভাগীয় কর্মকর্তা) যদি জনগণের নিকট থেকে এইগুলি আদায় করে এবং জমা করে তবে তাকে তার অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে হবে।

    (কবিতা)

    বন্ধুদের মনের শান্তি সম্পদের চেয়ে ভাল,

    মানুষের মনোকষ্ট থেকে শূন্য কোষাগার ভাল।

     যে সম্পদ বায়তুল মাল-এ জমা হয়, তা এমন করের মাধ্যমে হবে, যেগুলি মুস্তফা (হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা, তাঁর প্রতি আল্লাহর শান্তি ও দরূদ বর্ষিত হোক) প্রবর্তিত শরা (বা ধর্মীয় বিধান) দ্বারা অনুমোদিত হবে এবং যা ধর্মীয় পুস্তকসমূহে বর্ণিত আছে। (এইরূপ করসমূহ এই) ১ম-ভূমি রাজস্ব ও উসুর এবং যাকাত; ২য়- হিন্দু এবং অন্য অবিশ্বাসীদের উপর আরোপিত জিযিয়া কর; তারপর গনিমতের মাল ও খনিজ দ্রব্যের এক-পঞ্চমাংশ। ঐ সকল কর যা কিতাব দ্বারা অনুমোদিত নয়, সেগুলি কোন অবস্থাতেই বায়তুল মাল-এ জমা করা হবে না।

    পরবর্তী দান এই। ইতিপূর্বে বিদআতের প্রসারে, প্রচলিত কুসংস্কার এবং আচার আচরণ এরূপ ছিল যে গনিমতের চার-পঞ্চমাংশ দীওয়ান-এ জমা করা হত এবং এক পঞ্চামংশ গাজীদের দেওয়া হত। কিন্তু শরার বিধান হল এক-পঞ্চমাংশ রাজ-কোষাগারে জমা হবে, এবং চার-পঞ্চমাংশ গাজীদের মধ্যে বিলি করা হবে। কিন্তু তৎকালীন আইনে এর সম্পূর্ণ বিপরীত নীতি অনুপ্রবেশ করেছিল। এটা বন্ধ করার জন্য আমি আদেশ দিলাম যেন এক-পঞ্চমাংশ রাজকোষাগারে জমা হয় এবং চার-পঞ্চমাংশ গাজীদের দেওয়া হয় (পৃঃ ৭২)

    তাছাড়া শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা, যাদেরকে রাফেযী বলা হয়, জনগণকে শিয়া রফয মতবাদের প্রতি আহবান জানাত। তারা এই সম্প্রদায় সম্পর্কে পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করে এবং এগুলি পঠন-পাঠনকে পেশায় পরিণত করে। তারা শায়খাইনদের অর্থাৎ হযরত আবু বকর ও উমর (রঃ)-এর (তাদের প্রতি আল্লাহতালা সন্তুষ্ট থাকুক) প্রতি প্রকাশ্যে গালিগালাজ কটূক্তি করত। আমি তাদের সকলকে গ্রেফতার করি। তাদের বিরুদ্ধে ভ্রান্তি এবং অপরকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তাদের গোঁড়াদের শাসন করলাম এবং অন্যদের তিরস্কার এবং ভীতি প্রদর্শন করলাম এবং কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলাম।

    তাছাড়া মুলহিদ (নাস্তিক) এবং ইবাহতীরাও দল বেঁধে ছিল এবং জনগণকে ইহলাদ ও ইবাহতের দিকে আহবান জানাত। তারা নির্দিষ্ট রাতে নির্দিষ্ট স্থানে মাহরম এবং গায়ের মাহরম এবং মদ ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে একত্রিত হত এবং তারা বলত যে এটাই ইবাদত। তারা একটি ছবি (মূর্তি) স্থাপন করে জনগণকে এমন কাজে উদ্ধুদ্ধ করত যেন তারা এর সামনে সেজদা করে। তাদের স্ত্রীরা, মা ও বোনেরাও রাত্রে একত্রিত হত। এদের মধ্যে যার কাপড় যে কারও হাতে লাগত, সে তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হত। আমি তাদের প্রবীণদের শিরচ্ছেদ করি এবং অন্যদের বন্দী করা, বহিষ্কার করা এবং তিরস্কার করার আদেশ দিই। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের সকল অপকর্ম দূরীভূত হয়।

    আরও কয়েকটি দল ছিল দাহরিয়া (প্রকৃতিপূজক), তরক্ (বৈরাগী) এবং তজরীদ (কৌমার্যব্রত অবলম্বনকারী) এর পোশাকে জনগণকে বিপথগামী করত, শিষ্য বানাত এবং কুফরী কথা বলত। আহমদ বিহারী নামে এই বিপধগামীদের একজন মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শনকারী ছিল। সে শহরে বাস করত এবং বিহারী দলের লোকেরা তাকে ‘খোদা বলত’। ঐ দলকে শৃঙ্খলিত করে আমার নিকট নিয়ে আসা হল। (আমাকে বলা হল যে) সে নবী (সা.) কে গালি দিত এবং বলত যে লোকের নয়জন স্ত্রী ছিল তার নবুওতের কি মর্যাদা থাকতে পারে? তার একজন শিষ্যের দ্বারা এরূপ কথা তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়। আমি তাদের উভয়কে শৃঙ্খলিত করার (জেলে দেওয়ার) আদেশ দিলাম; অন্যদের তওবা করে সার্বিক পথে ফিরে আসার আদেশ দিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে বিভিন্ন শহরে নির্বাসন দেওয়ার আদেশ দিলাম। ফলে এই দলে কুকীর্তি বন্ধ হয়ে যায় (পৃঃ ৭৩)

    দিল্লী শহরে মাহদী উপাধিধারী রুকন নামক একজন লোক বলত যে ‘‘আমিই শেষ যুগের মাহদী’’। ‘‘ইলম-ই-লদুনী’’ আমার অর্জিত হয়েছে এবং আমি অন্য কারও নিকট শিক্ষা লাভ করিনি এবং আমি সমস্ত সৃষ্টির নাম জানি, যা হযরত আদম নবী (তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) ব্যতীত অন্য কোন পয়গম্বরেরও জানা ছিল না। শব্দ বিজ্ঞানের রহস্য যা কারও নিকট জ্ঞাত নয়, তা আমার কাছে জ্ঞাত। তার এই দাবীর সমর্থনে সে বই পুস্তক রচনা করে এবং জনগণকে ভুল পথে আহবান জানায় এবং বলে যে ‘‘আমি রুকন-উদ-দীন রসূলুল্লাহ’’ (আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ)

    প্রবীণ লোকেরা এই সম্বন্ধে আমার নিকট সাক্ষ্য দেন যে সে এরূপ কথা বলেছে এবং আমরা তাঁর নিকট এরূপ কথা শুনেছি’। যখন তাকে আমার সম্মুখে আনা হল, তখন জনগণকে পথভ্রষ্ট করার কার্যকলাপ সম্পর্কে আমি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। সে এই বিদআত এবং (জনগণকে) পথ ভ্রষ্ট করার কথা স্বীকার করে। ধর্মীয় আলিমরা বললেন যে সে কাফের হয়ে গেছে এবং মৃত্যুদন্ড পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে। কেননা তার শয়তানীর দ্বারা ইসলাম ধর্মে ও সুন্নতের অনুসারীদের মধ্যে দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের সৃষ্টি হয়েছে। যদি তা দমনে দেরী করা হয়, তবে, আল্লাহ না করুন, এ কুফল এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে অনেক মুসলমান পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে; তারা ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত হবে; এবং তার দ্বারা এমন দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে যে অনেক লোক ঐ কারণে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি আদেশ দিলাম যে তার ঐ শয়তানী ও পথভ্রষ্টতার কথা আলিমসমাজের নিকট জানিয়ে দেওয়া হোক এবং উচ্চ-নীচ সকল শ্রেণীর লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হোক। ওলামা-ই-দীন ও শরীয়তের ইমামদের ফতোয়ার বিধান মতে তার যে শাস্তি পাওয়া উচিত, তা কার্যকর করা হোক। তাকে তার মতাবলম্বী শিষ্য ও অনুচরদের সঙ্গে হত্যা করা হয়। উচ্চ-নীচ সকল শ্রেণীর লোক এসে তার মাংস, চামড়া ও হাড় টুকরা টুকরা করে ফেলে। তার দুষ্কর্ম এভাবে দমন করা হল যেন মানুষের মধ্যে (ধর্ম-বিষয়ে) সচেতনতা আসে।

    মহান আল্লাহতালা আমার মত একজন অধমকে বিভিন্ন প্রকার কুকর্ম এবং অনুরূপ অন্যান্য বিদআত দমন করার ক্ষমতা দান করেছেন এবং সুন্নত পুনর্জীবিত করার সুযোগ দিয়েছেন। (তা বর্ণনা করার) উদ্দেশ্যে প্রভুর (আল্লাহতালার) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যাতে এই নিষিদ্ধ কার্যাবলীর কথা শুনে ও পাঠ করে যার স্বীয় ধর্ম সংস্কার করার ইচ্ছা হয়, সে (আমার) এই নীতিতে পরিচালিত হয়,  যেন সে পুণ্যলাভ করতে পারে। আমি এই সৎ কাজের পথ প্রদর্শন করে পুণ্য অর্জনের আশা রাখি। মহান আল্লাহই সুযোগদানকারী (পৃঃ ৭৩-৭৪)

    তাছাড়া আরছা (প্রশাসনিক বিভাগ) গুজরাটে আইন মাহরু নামক অঞ্চলে মোল্লা বংশের এক ব্যক্তি নিজেকে শায়খ বা পীর রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। সে একদল লোককে মুরীদ করে নিজেকে ‘আনল-হক’ (বা আমি আল্লাহ) বলত। সে মুরীদদের বলত, ‘আমি যখন ‘আনল-হক’[2] বলব তোমরা তখন বলবে ‘তুমিই ত’, ‘তুমিই ত’। সে আরও বলে, ‘আমি মৃত্যুহীন রাজা’। সে একটি পুস্তিকা লিখে যাতে কুফরী (অবিশ্বাসের বা ধর্ম-ত্যাগের) কথাবার্তা ছিল। তাকে শৃঙ্খলিত করে আমার সামনে নিয়ে আসা হল। এটা (তার দোষ) তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত হল। আমি তার শাস্তির আদেশ দিলাম এবং সে যে পুস্তিকা রচনা করেছিল তা পুড়িয়ে দিলাম। ফলে তৌহিদবাদী মুসলমানদের মধ্য হতে এই অপকর্মও দূরীভূত হয়

    তাছাড়া কিছু অভ্যাস এবং কুপ্রথা মুসলমানদের শহরে দেখা যায়, যা ইসলাম ধর্মে বিধিসম্মত নয়। মহিলারা পবিত্র দিনে দলে দলে পালকী, গরুর গাড়ী বা ঢুলীতে চড়ে অথবা ঘোড়া বা খচ্চরে চড়ে, অথবা দলে দলে পায়ে হেঁটে হর্ষ উল্লাস করে শহর থেকে বেরিয়ে আসত এবং মাযার সমূহে যাতায়াত করত। মহিলাদের এইরূপ চলাফেরায় যে সুযোগ সৃষ্টি হয়, দুষ্ট এবং লম্পট লোকেরা তার সদ্ব্যবহার করে হৈ হুল্লোড় এবং হট্টগোল করে অপকর্মে লিপ্ত হত। মহিলাদের বাইরে যাওয়া শরীয়ত নিষিদ্ধ। আমি আদেশ দিলাম যে কোন মহিলা মাযারে যাবে না, যারা যাবে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। বর্তমানে মহান আল্লাহর অনুগ্রহে কোন মুসলমান ভদ্র মহিলার সাধ্য নেই যে তারা ঘরের বাইরে যাবে এবং মাযার যেয়ারতে যাবে। এই বিদআতও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়েছে (পৃঃ ৭৪-৭৫)

    অতীত কালে এই প্রথা প্রচলিত ছিল যে খাবার টেবিলে সোনা ও রূপার বাসন-পত্র ব্যবহার কর হত। লোকজন তরবারির খাপ  ও ধনু সোনা ও মণিমুক্তায় মুড়িয়ে রাখত। আমি তা নিষেধ করে শিকারের হাড় আমার অস্ত্রে-শস্ত্রে ব্যবহারের আদেশ দিলাম এবং যে সকল বাসন-পত্র ব্যবহার শরীয়ত সিদ্ধ তা (তার ব্যবহার) অভ্যাসে পরিণত করলাম (পৃঃ ৭৬)

    অতীত কালে রঙিন জামাকাপড় ব্যবহারের অভ্যাস এবং প্রথাও প্রচলিত ছিল এবং সুলতানদের দরবার থেকে মানুষকে সম্মানিত করার উদ্দেশ্যে পরিয়ে দেওয়া হত। অনুরূপভাবে লাগাম, যীন, গলাবন্ধ, ধূপ-ধুনার পাত্র; পেয়ালা, পিরিচ, বাসন-পত্র, চিলমচি, তাঁবু, পরদা, চৌকি, কেদারা এবং বিভিন্ন জিনিষপত্রে ছবি এবং নকশা অাঁকা হত। আমার প্রভুর (আল্লাহতালার) সত্য পথ প্রাপ্ত হয়ে এবং মহান আল্লাহর অনুগ্রহে আমি বললাম যে সকল ছবি ও নকশা এই সকল জিনিষ থেকে দূরীভূত করা হোক এবং যা শরার নিষিদ্ধ নয় এবং যা অনুমোদিত ও স্বীকৃত তা স্থাপন কার হোক। আমি আদেশ দিলাম যে দরজা, দেয়াল ও প্রাসাদে যে সকল ছবি অাঁকা আছে তাও মুছে ফেলা হোক (পৃঃ ৭৬-৭৭)

    অতীতে অভিজাত লোকেরা প্রায়ই জরি ও রেশমের পোষাক পরিধান করত, যা শরীয়ত বিরুদ্ধ। মহান আল্লাহতালা আমাকে সুযোগ দেন যাতে নবী (সা.)-এর শরীয়ত অনুমোদিত পোষাক প্রচলন করা হয়। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই।

    আল্লাহতালা এই অধমকে সৎকাজের প্রতিষ্ঠান (কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান) নির্মাণের সুযোগ দিয়েছেন। আমি অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা (স্কুল বা কলেজ) ও খানকাহ তৈরী করেছি। ওলামা, মশায়েখ, যাহেদ, এবং আবেদরা ঐ সকল স্থানে আল্লাহর উপাসনা করেন এবং এই সকল সৎ প্রতিষ্ঠানের নির্মাতার জন্য দোয়া করে সাহায্য করবেন। খাল খনন, গাছ-পালা রোপণ এবং ভূ-সম্পদ ওয়াকফ করাও শরীয়ত অনুমোদিত। ইসলাম ধর্মের শরীয়তের আলিমরা এই বিষয়ে একমত এবং এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

    অতঃপর, আল্লাহর আর একটি দান এই। অতীতের সুলতান এবং আমীরদের নির্মিত ইমারতাদি যা কালের গ্রাসে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে, সেগুলি মেরামত ও সংস্কারের কাজকে আমার নিজের ইমারত নির্মাণের চেয়ে অগ্রাধিকার দিলাম। যেমন : দিল্লীর প্রাচীন জামে মসজিদ; এটা সুলতান মুইযয-উদ-দীন সাম (মুহাম্মাদ ঘোরী) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এর ভিত্তি পুরাতন হওয়ায় তা মেরামত ও সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এটি এইভাবে মেরামত করা হয় যে নতুনের মত মজবুত হয়

    তাছাড়া হাউজ-ই-শামসীতে[3] পানি আসার উৎস কিছু অসৎ লোক বন্ধ করে দেয়, ফলে পানি আসায় বাধার সৃষ্টি হয়। আমি এ অবাধ্য লোকগুলিকে শাস্তি দিলাম এবং পানি আসার বন্ধ পথ খুলে দিলাম (পৃঃ ৭৮)

    তাছাড়া হাউজ-ই-আলাই[4] ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি শূন্য হয়ে পড়ে। শহরের জনগণ এতে চাষবাস করতে থাকে এবং এতে কূপ খনন করে এবং কূপ থেকে পানি বিক্রি করতে থাকে। একযুগ পরে আমি তা পুনঃখনন করলাম যাতে ঐ বিরাট দীঘিটায় বছরের পর বছর পানি থাকে।

    একইভাবে সুলতান শামস-উদ-দীন ইলতুতমিশের মাদ্রাসার কক্ষসমূহ নষ্ট হয়েছিল। আমি তা পুনর্নির্মাণ করে এতে চন্দন কাঠের দরজা করে দিলাম।

    মহান আল্লাহতালা আমাকে যোগ্যতা দান করেন যেন আমি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করি, যাতে উচ্চ-নীচ সকল রোগীকে সেখানে আনা হয় এবং অসুস্থ লোকেরা সেখানে আসে। চিকিৎসকেরা সেখানে উপস্থিত থাকেন, তাঁরা রোগ নির্ণয় করেন, রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করেন, পথ্য নির্ধারণ করেন এবং ঔষধ দেন। ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে ঔষধ ও পথ্যের খরচ বহন করা হয়। অসুস্থ স্থায়ী বাসিন্দা, মুসাফির, উচ্চ-নীচ সকল লোক, স্বাধীন এবং ক্রীতদাস সকলে সেখানে আসে এবং তাদের রোগের চিকিৎসা করা হয় এবং আল্লাহর অনুগ্রহে তারা আরোগ্য লাভ করে (পৃঃ ৭৯)

    আল্লার আর একটি দান এই। অনেক পুরাতন স্বত্বভোগী গ্রাম ও ভূসম্পত্তি অতীতের রাজাদের সময়ে কেড়ে নেওয়া হয় এবং দীওয়ানের দখলে নেওয়া হয় (খাস করা হয়)। আমি বললাম যে (খাস করা) সম্পত্তির উপর যাদের আইনগত দাবী আছে তারা যেন তাদের দাবী দীওয়ান-ই-শরীয়ত-এ পেশ করে। তাদের দাবী প্রমাণিত হলে গ্রাম, জমি বা যে কোন সম্পত্তি হোক তা তাদের ফেরত দেওয়া হোক। আল্লাহর প্রতি প্রশংসা, তাঁর অনুগ্রহে আমি এই সৎ কাজে ব্রতী হই এবং ন্যায্য পাওনাদারদের পাওনা তাদের নিকট পৌঁছে।

    আমি যিম্মিদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করার সুযোগ পেলাম। আমি ঘোষণা করি যে কাফিরদের (অবিশ্বাসীদের) মধ্যে যে কেউ কলেমা তৌহীদ পড়বে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে, যেমন মুস্তফার (হযরত মুহাম্মদ দঃ, তাঁর প্রতি শান্তি ও দয়া বর্ষিত হোক) ধর্মে পাওয়া যায়, আমি তাদের জিযিয়া মাফ করে দিলাম। এই কথা জনসাধারণের কানে গেলে, হিন্দুরা দলে দলে আসতে লাগল এবং ইসলাম গ্রহণ করার সম্মান অর্জন করল। এইরূপে অদ্যাবধি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে (হিন্দুরা) আসছে এবং ঈমান আনছে, (ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে)। জিযিয়া মাফ করা হয়েছে। তাদের পুরস্কৃত করা হল এবং বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হল। বিশ্বজগতের প্রভু আল্লাহতালারই সকল প্রশংসা।

    আল্লাহর আরও একটি দান এই। আমার রাজত্বকালে আল্লাহর বান্দাদের মান-সম্মান ও ধন-সম্পদ নিরাপদ ও সংরক্ষিত হয়েছে। কোন ব্যক্তির নিজস্ব সম্পত্তির অতি ক্ষুদ্র অংশও কেড়ে না নেওয়া হয়, সেদিকে আমি বণিকের মতো লক্ষ্য রাখি। অনেক দুষ্ট প্রকৃতির লোক আমাদের নিকট অভিযোগ করে যে অমুক নিকট কয়েক লাখ এবং অমুক আমিরের নিকট কয়েক লাখ (টাকা) রয়েছে। আমি এই মিথ্যা অভিযোগ কারীদের কঠোর শাস্তি দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছি, যেন এই শ্রেণীর লোকের অনিষ্ট থেকে জনগণ নিরাপত্তা পায়। এই সহৃদয়তার ফলে সকলে একান্তভাবে আমার প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন হয় (পৃঃ ৮০)

    (কবিতা)

    সুনাম অন্বেষণ কর, কেননা উদারতার সুনাম

    সম্পদের সুনাম থেকে শতগুণে ভাল।

    গাধা বোঝাই সম্পদের চেয়ে একটু সুনাম ভাল,

    একটু দোয়া একশত গাধা বোঝাই সম্পদের চেয়ে ভাল।

    অতঃপর কোন রাজকর্মচারী জীবনের শেষ সীমায় পৌঁছে বৃদ্ধ হয়ে পড়লে, তাঁর জীবিকার ব্যবস্থা করে তাঁকে (অবসর নেওয়ার) অনুমতি দান করি। তাঁকে উপদেশ দিই যেন তিনি পরকালের জন্য তৈরী হওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং যৌবনে ধর্ম ও শরা বিরেধী যে কাজ করেছেন তার জন্য অনুতপ্ত হন। তিনি যেন দুনিয়া থেকে বিরত হয়ে পরকালের কাজ-কর্মে মনোনিবেশ করেন।

    রাজ কর্মচারীদের যে কোন ব্যক্তি মর্যাদার অধিকারী হয়, যখন সে আল্লাহর ইচ্ছায় অহংকারের জগৎ থেকে শান্তির আশ্রমে চলে যায় (অর্থাৎ ইহলোক থেকে পরলোক গমন করে), তখন তাদের মর্যাদায় ও কাজে আমি তাদের পুত্রদের এমনভাবে নিযুক্ত করি, যেন তাদের পিতারা যেরূপ মান-মর্যাদা, ধন-সম্পদ ও জাঁকজমকে অধিষ্ঠিত ছিল, তন্মধ্যে (মান-মর্যাদা, ধন-সম্পদ ও জাঁকমককে) কোন ত্রুটি না হয় (পৃঃ ৮১)

    (কবিতা)

    বাদশাদের চালচলন এই যে,

    তাঁরা বুদ্ধিমানদের ভালবাসেন

    এবং তাঁদের যুগের পরে,

    বুদ্ধিমানদের ছেলেরাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

    তাছাড়া আল্লাহর রসুলের চাচার বংশধরের (আববাসীয়) খিলাফতের আশ্রয়স্থলের প্রতিনিধিত্বের দ্বারা রাজত্ব সুচারুরূপে পরিচালিত হয়। এই দরবারের (খলিফার দরবার) গোলামীর দ্বারা নিজেকে মর্যাদাশীল না করা এবং এই পবিত্র দরবার হতে (অর্থাৎ খলিফার নিকট থেকে) অনুমতি না পাওয়া সঠিক নয়। সুতরাং রাজত্বদানকারী আল্লাহতালা যিনি মহা মর্যাদাবান এবং যাঁর অনুগ্রহ সবার উপর সম্প্রসারিত তা এই যে এই খিলাফতের আশ্রয়স্থলের প্রতি মান্যতা, রাজত্ব ভোগ করা, একাগ্রচিত্ততা এবং আনুগত্যের দরুন আল্লাহতালা আমাকে এর উপর স্থির বিশ্বাস স্থাপন করার সুযোগ দান করেছেন।

    পবিত্র দার-উল-খিলাফতের (খলিফার রাজধানী) দরবার থেকে নিঃশর্ত স্বীকৃতি এবং প্রতিনিধিত্বের সনদ-পত্র আমার প্রতি জারী করা হয়েছে। আমীর-উল-মুমেনীনের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন দরবার থেকে সৈয়দ-উস-সলাতীন (সুলতানদের সরদার বা নেতা) উপাধি দ্বারা মর্যাদাবান হয়েছি। সদাসর্বদা খিলাফতের দরবারের উপহারসমূহ যথা পোষাক, পতাকা, আংটি, তরবারি ও পদচিহ্ন ইত্যাদির সাথে সাথে বিভিন্ন মর্যাদা ও অনুগ্রহ দ্বারা জসৎবাসীদের উপর গৌরবান্বিত হয়েছি।

    এর (এই পুস্তক লেখার) উদ্দেশ্য এই দানসমূহের এবং আল্লাহতালার হাজারও অনেক দানের মধ্যে সামান্য অংশের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাছাড়া কোন ব্যক্তি মঙ্গল ও সৌভাগ্যের অন্বেষণকারী হলে সে যদি তা পড়ে, সে জানতে পারবে যে এই পথই (কৃতজ্ঞা প্রকাশ করাই) সর্বোত্তম। এর অনুসরণ দ্বারা সঠিক পথের সুযোগ না পাওয়া মনুষ্যত্বের কাজ নয়। তারা (এর পাঠকেরা) নিজ কাজের জন্য পুণ্যবান হবে এবং আমি এই সৎ কাজের পথ প্রদর্শনের জন্য পুরস্কৃত হব। সৎ কাজের পথ-প্রদর্শনকারী সৎ কাজ সম্পাদনকারীর মতই (পৃঃ ৮২)

    [অনুবাদক : বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]।

    [1]. এগুলি বিভিন্ন ধরনের কর।

    [2]. ‘আনল-হক’ বলা মানে আল্লাহর সঙ্গে সমকক্ষতা দাবী করা যা ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী। অতএব ‘আনল হক’ বলা মানে ধর্মচ্যুত হওয়া। ইতিহাস বিখ্যাত সূফী মনসুর বিন হাললায (মৃত্যু ৯২২ খ্রি.) আনল-হক দাবী করাতে তাকে হত্যা করা হয়।

    [3]. সুলতান শামস-উদ-দীন ইলতুতমিশ কর্তৃক খননকৃত দীঘি। ইলতুতমিশ ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে একশত একর ভূমির উপর এই দীঘি খনন করেন।

    [4]. সুলতান আলা-উদ-দীন খলজী কর্তৃক খননকৃত দীঘি, তিনি এটি ১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দে খনন করেন। ৭০ একর জমিতে খননকৃত এই দীঘির চতুর্দিকে পাথর দ্বারা পাকা করে দেওয়া হয়েছিল।

     


    HTML Comment Box is loading comments...