একজন আদর্শবান ব্যক্তির গুণাবলী
(২য় কিস্তি)
(৫) বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকা :
ইত্তেবায়ে সুন্নাতের বিপরীত বিষয়টি হ’ল বিদ‘আত। যার অর্থ দ্বীনের মধ্যে নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন ও প্রচলন। এটি এমন একটি ভয়াবহ ও জঘন্যতম পাপ যা মানুষের ইবাদত কবুলের পথ বন্ধ করে দেয়। সেজন্য এই ভয়াবহ পাপ হ’তে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। এখন আমরা মহা সংবিধান আল-কুরআনের আলোকে বিদ‘আত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا- ‘সুপথ স্পষ্ট হওয়ার পর যে ব্যক্তি রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের বিপরীত পথে চলে, আমরা তাকে ঐদিকেই ফিরিয়ে দেই যেদিকে সে যেতে চায় এবং তাকে আমরা জাহান্নামে প্রবেশ করাই। আর সেটা হল নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল (নিসা ৪/১১৫)।
উপরোল্লিখিত আয়াতের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, যে ব্যক্তি শরী‘আতের বিপরীত পথে চলে, যে স্পষ্ট দলীল-প্রমাণাদি দেখার পরও রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধাচারণ করেছে এবং মুসলমানদের সরল-সঠিক পথ হ’তে সরে পড়েছে। আল্লাহ তাকে ঐ বক্র ও খারাপ পথেই ফিরিয়ে দেবেন। ফলে ঐ খারাপ পথই তার নিকট ভাল বলে মনে হবে। অতঃপর সে জাহান্নামে যাবে।
মুসলমানদের পথ ছেড়ে অন্য পথ অনুসন্ধান করাই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধাচারণ করা। কিন্তু কখনো হয়তো রাসূল (ছাঃ)-এর স্পষ্ট কথারই বিপরীত হয় আবার কখনো কখনো ঐ জিনিসের বিপরীত হয় যার উপর মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মত সবাই একমত হয়েছে। তাদের ভদ্রতা ও নম্রতার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভুল হ’তে রক্ষা করেছেন। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ ‘সত্য সেটাই যা তোমার পালনকর্তার নিকট থেকে আসে। অতএব তুমি অবশ্যই সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/১৪৭)। অপর এক আয়াতে উল্লেখ আছে, فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘অতএব যদি তারা বিশ্বাস স্থাপন করে যেরূপ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তাহ’লে তারা সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা নিশ্চয়ই যিদের মধ্যে রয়েছে। এমতাবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/১৩৭)।
অত্র আয়াতে তোমরা যেমন ঈমান এনেছ বলে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামদের বুঝানো হয়েছে। আয়াতে তাদের ঈমানকে আদর্শ ঈমানের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর কাছে স্বীকৃত ও গ্রাহণযোগ্য ঈমান হচ্ছে সে রকম ঈমান যা রাসূল (ছাঃ) এর ছাহাবায়ে কেরামগণ অবলম্বন করেছেন। যে ঈমান ও বিশ্বাস এ থেকে পরিমাণ ও ভিন্ন তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
অর্থাৎ যে সব বিষয়ের উপর তাঁরা ঈমান এনেছেন তাতে হ্রাস-বৃদ্ধি হ’তে পারবে না। তাঁরা যেরূপ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে ঈমান এনেছেন তাতে প্রভেদ থাকতে পারবে না। নিষ্ঠার পার্থক্য হ’লে তা নিফাকে তথা কপট বিশ্বাসে পর্যবসিত হবে। আল্লাহর সত্তা, গুনাবলী ফেরেশতা, নবী-রাসূল, আল্লাহর কিতাব ও এসবের শিক্ষা সম্বন্ধে যে ঈমান ও বিশ্বাস রাসূল (ছাঃ) অবলম্বন করেছেন একমাত্র তা-ই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য। এ সবের বিপরীত ব্যাখ্যা করা ও ভিন্ন অর্থ নেওয়া আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
এ ব্যাখ্যার ফলে কতিপয় ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের ঈমানের ত্রুটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা ঈমানের দাবীদার কিন্তু ঈমানের স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, فَذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمُ الْحَقُّ فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ অতএব তিনিই আল্লাহ; তোমাদের প্রকৃত পালনকর্তা। এক্ষণে সত্যের পরে ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কি বাকী থাকে? অতঃপর তোমরা কোন দিকে ফিরে যাচ্ছ? (ইউনুস ১০/৩২)।
অপর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দেবে। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা (ভ্রান্ত পথ সমূহ থেকে) বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।
হাদীছে এসেছে, عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ- হযরত আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমাদের এ দ্বীনের মধ্যে যে লোক এমন সব নতুন বিষয় প্রবর্তন করে যা তার অর্ন্তভুক্ত ছিল না; তা প্রত্যাখ্যাত’।[1] রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ ‘কোন লোক এমন কোন কাজ করল যাতে আমাদের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[2]
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا خَطَبَ احْمَرَّتْ عَيْنَاهُ وَعَلاَ صَوْتُهُ وَاشْتَدَّ غَضَبُهُ حَتَّى كَأَنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ يَقُولُ صَبَّحَكُمْ وَمَسَّاكُمْ. وَيَقُولُ بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةَ كَهَاتَيْنِ. وَيَقْرُنُ بَيْنَ إِصْبَعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى وَيَقُولُ أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ. ثُمَّ يَقُولُ أَنَا أَوْلَى بِكُلِّ مُؤْمِنٍ مِنْ نَفْسِهِ مَنْ تَرَكَ مَالاً فَلأَهْلِهِ وَمَنْ تَرَكَ دَيْنًا أَوْ ضَيَاعًا فَإِلَىَّ وَعَلَىَّ- হযরত জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) যখন ভাষণ দিতেন তখন তাঁর চোখ লাল হয়ে যেত; তার কন্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেত এবং তাঁর রাগ বৃদ্ধি পেত। যেন কোন সেনাবাহিনীকে তিনি সতর্ক করছেন। তিনি বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে সকাল সন্ধায় ভাল রাখুন। তিনি আরো বলতেন, কিয়ামত সহ আমাকে এভাবে পাঠানো হয়েছে। একথা বলে তিনি তাঁর মধ্যমা ও তর্জনী আঙ্গুল মিলাতেন। তিনি আরো বলতেন, তারপর সব চেয়ে উত্তম কথা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং সবচেয়ে উত্তম পথ হচ্ছে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পথ। ইসলামের ব্যাপারে নতুন বিষয় তৈরী করা সবচেয়ে খারাপ এবং সকল বিদ‘আত তথা (দ্বীনে নতুন বিষয়)ই পথভ্রষ্টতা। তারপর তিনি বলতেন, প্রত্যেক মুমিনের জন্য আমি তার নিজের চেয়ে অধিক নিকটতম। যে লোক কোন সম্পদ রেখে যায় তা তার পরিবারের জন্য আর যে লোক কোন ঋণ অথবা (ছোট ইয়াতীম) সন্তানরা রেখে যায় তার দায়িত্ব আমারই উপর’।[3]
(৬) ছবর বা ধৈর্য :
ধৈর্য মানবজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও একান্ত যরূরী বিষয়। আদর্শ মানব জীবন গঠন করতে এর কোন বিকল্প নেই। ধৈর্যহীন মানুষ কোন কাজেই সফলতা অর্জন করতে পারে না। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতার মূল চাবিকাঠি ছবর তথা ধৈর্যের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল।
মহান আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর। পরস্পরে দৃঢ় থাক (আলে ইমরান ৩/২০০)। তিনি আরো বলেন, وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ ‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন ও প্রাণের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ফল-শস্যাদি বিনষ্টের মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫)। তিনি অন্যত্র বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/১৫৩)। তিনি আরো বলেন, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘নিঃসন্দেহে ধৈর্যশীলগণ তাদের পুরষ্কার পাবে অপরিমিতভাবে’ (যুমার ৩৯/১০)। মানুষের দুঃখ, কষ্ট, যাবতীয় প্রয়োজন ও সমস্ত সংকট মোকাবেলায় প্রতিশোধক দু’টি বিষয়ের মাঝেই নিহিত রয়েছে। একটি ছবর তথা ধৈর্য্য অপরটি ছালাত।
ছবর-এর তাৎপর্য :
صبر শব্দের অর্থ হ’ল সংযম অবলম্বন ও নফসের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করা। ছবরের তিনটি শাখা রয়েছে। ১. নফসকে হারাম এবং যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ হ’তে বিরত রাখা। ২. ইবাদত ও আনুগত্য বাধ্য থাকা। ৩. যে কোন বিপদ ও সংকটে ধৈর্য ধারণ করা। যে সকল বিপদ-আপদ এসে উপস্থিত হয় সেগুলিকে আল্লাহর বিধান মনে করে মেনে নেয়া এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা।
সাধারণ মানুষের ধারণায় সাধারণত তৃতীয় শাখাকেই ছবর হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রথম দু’টি শাখা যে এ ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে মোটেও লক্ষ করা হয় না। এমনটি এ দু’টি বিষয়ও যে ছবরের অর্ন্তভুক্ত তা অনেকে জানেই না। পবিত্র কুরআন ও হাদীছের পরিভাষায় ধৈর্যধারণ কারী ঐ সকল লোককেই বলা হয যারা উপরোক্ত তিন প্রকারেই ধৈর্য্য অবলম্বন করে।
ছবরের মর্যাদা এত বেশী যে, ছবরকারীদের পুণ্য মেপে দেয়া হবে না। তাদেরকে অগনিত পুণ্য দেয়া হবে। কুরতুবী বলেন, الصَّابِرُونَ শব্দকে অন্য শব্দের সাথে যুক্ত না করে ব্যবহার করলে তার অর্থ হয় পাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার কষ্ট সহ্যকারী (মা‘আরেফুল কুরআন পৃ. ৭৮)।
হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى مَالِكٍ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلأُ الْمِيزَانَ. وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلآنِ أَوْ تَمْلأُ مَا بَيْنَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَالصَّلاَةُ نُورٌ وَالصَّدَقَةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا- আবু মালিক বিন আশ‘আরী (রাঃ) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক। আল-হামদুলিল্লাহ (নেকীর) পাল্লা পূর্ণ করে। সুবহানাল্লাহ ও আল-হামদুলিল্লাহ পৃথিবী ও আকাশমন্ডলী ভরে দেয়। ছালাত হ’ল নূর, ছাদাক্বা হ’ল দলীল, ধৈর্য হ’ল আলোকমালা এবং কুরআন হ’ল তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষের প্রমাণ। প্রত্যেক মানুষ ভোরে উপনীত হয়ে নিজেকে বিক্রয় করে, এতে সে হয় তাকে মুক্ত করে অথবা ধ্বংস করে’।[4]
অন্যত্র এসেছে, عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ رضى الله عنه أَنَّ نَاسًا مِنَ الأَنْصَارِ سَأَلُوا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَأَعْطَاهُمْ، ثُمَّ سَأَلُوهُ فَأَعْطَاهُمْ، حَتَّى نَفِدَ مَا عِنْدَهُ فَقَالَ مَا يَكُونُ عِنْدِى مِنْ خَيْرٍ فَلَنْ أَدَّخِرَهُ عَنْكُمْ، وَمَنْ يَسْتَعْفِفْ يُعِفَّهُ اللَّهُ ، وَمَنْ يَسْتَغْنِ يُغْنِهِ اللَّهُ، وَمَنْ يَتَصَبَّرْ يُصَبِّرْهُ اللَّهُ، وَمَا أُعْطِىَ أَحَدٌ عَطَاءً خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنَ الصَّبْر-ِ আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে কিছু আনছারী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে কিছু চাইলেন। তিনি তাদেরকে দিলেন। পুনরায় তার দাবী করল ফলে তিনি আবার দিলেন। এমনকি যা তাঁর কাছে ছিল তা সব শেষ হয়ে গেল। অতঃপর যখন তিনি সমস্ত জিনিস নিজ হাতে দান করলেন। তখন তিনি বললেন, আমার কাছে যা কিছু আসে তা আমি তোমাদের না দিয়ে জমা করে রাখিনা। (তবে মনে রাখবে) যে ব্যক্তি চাওয়া হ’তে পবিত্র থাকার চেষ্টা করবে আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখবেন। আর যে ব্যক্তি অমুখাপেক্ষিতা অবলম্বন করবে। আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করবেন। যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণের চেষ্টা করবে আল্লাহ তাকে ধৈর্যধারণের ক্ষমতা দিবেন। আর কোন ব্যক্তিকে এমন কোন দান দেয়া হয়নি, যা ধৈর্য অপেক্ষা উত্তম ও বিস্তর হ’তে পারে’।[5]
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِى لَيْلَى عَنْ صُهَيْبٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ- আব্দুর রহমান বিন আবী লায়লা ছুহাইব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, মুমিনের ব্যাপারটাই আশ্চর্যজনক। তার প্রতিটি কাজে তার জন্য কল্যাণ রয়েছে। এটা মুমিন ব্যতীত অন্য কারো ক্ষেত্রে হয় না। যখন তাকে সুখ স্পর্শ করে, তখন সে আল্লাহর শুকরিয়া প্রকাশ করে, ফলে এটা তার জন্য মঙ্গলময় হয়। আর যখন তাকে দুঃখ স্পর্শ করে, তখন সে ধৈর্যধারণ করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’।[6]
অন্যত্র এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى مَا لِعَبْدِى الْمُؤْمِنِ عِنْدِى جَزَاءٌ ، إِذَا قَبَضْتُ صَفِيَّهُ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا ، ثُمَّ احْتَسَبَهُ إِلاَّ الْجَنَّةُ - আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার মুমিন বান্দার জন্য আমার নিকট জান্নাত ব্যতীত অন্য কোন পুরস্কার নেই। যখন আমি তার দুনিয়ার প্রিয়তম কাউকে কেড়ে নেই এবং সে ছওয়াবের নিয়তে ছবর করে’।[7] অন্যত্র এসেছে, عَنْ عَائِشَة رضى الله عنها زَوْجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الطَّاعُونِ، فَأَخْبَرَنِى أَنَّهُ عَذَابٌ يَبْعَثُهُ اللَّهُ عَلَى مَنْ يَشَاءُ، وَأَنَّ اللَّهَ جَعَلَهُ رَحْمَةً لِلْمُؤْمِنِينَ، لَيْسَ مِنْ أَحَدٍ يَقَعُ الطَّاعُونُ فَيَمْكُثُ فِى بَلَدِهِ صَابِرًا مُحْتَسِبًا ، يَعْلَمُ أَنَّهُ لاَ يُصِيبُهُ إِلاَّ مَا كَتَبَ اللَّهُ لَهُ، إِلاَّ كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ شَهِيدٍ - হযরত আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি তাকে বললেন, এটা আযাব। আল্লাহ যার প্রতি ইচ্ছা করেন এটা প্রেরণ করেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এটি মুমিনের জন্য রহমত বানিয়ে দিলেন। ফলে যে ব্যক্তি প্লেগ রোগে আক্রান্ত হবে এবং ধৈর্যসহ নেকীর নিয়তে নিজ দেশে অবস্থান করবে, সে জানবে যে, তার কাছে তা-ই পৌঁছাবে যা আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য লিখে দিয়েছেন। তাহ’লে তার জন্য শহীদের মত পুরস্কার আছে’।[8]
অন্যত্র এসেছে, عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ إِنَّ اللَّهَ قَالَ إِذَا ابْتَلَيْتُ عَبْدِى بِحَبِيبَتَيْهِ فَصَبَرَ عَوَّضْتُهُ مِنْهُمَا الْجَنَّةَ. يُرِيدُ عَيْنَيْهِ- আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যখন আমি আমার বান্দাকে তার প্রিয়তম জিনিস দ্বারা (চক্ষু অন্ধ করে) পরীক্ষা করি আর সে তাতে ধৈর্য ধারণ করে আমি তাকে এ দু’টির বিনিময়ে জান্নাত প্রদান করব’।[9] হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ وَعَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا ، إِلاَّ كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ - আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী (ছাঃ) বলেছেন, মুসলিমকে কোন ক্লান্তি, অসুখ, চিন্তা, শোক এমনকি (পায়ে) কাঁটাও লাগে, তাহলে আল্লাহ এর মাধ্যমে তার পাপসমূহ ক্ষমা করে দেন, যদি সে তাতে ধৈর্যধারণ করে’।[10]
হাদীছে এসেছে, قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُصِبْ مِنْهُ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ যার মঙ্গল চান তাকে দুঃখ কষ্টে ফেলেন’।[11]
অন্যত্র এসেছে, عَنْ سَهْلِ بْنِ مُعَاذِ بْنِ أَنَسٍ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ يَقْدِرُ عَلَى أَنْ يُنَفِّذَهُ دَعَاهُ اللَّهُ عَلَى رُءُوسِ الْخَلاَئِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ فِى أَىِّ الْحُورِ شَاءَ- মুআয বিন আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্রোধ সংবরণ করবে অথচ সে তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টির সামনে ডেকে ইখতিয়ার দিবেন যে, সে যে কোন হুরকে নিজের জন্য পছন্দ করে’।[12]
অন্যত্র এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَا يَزَالُ الْبَلاَءُ بِالْمُؤْمِنِ وَالْمُؤْمِنَةِ فِى نَفْسِهِ وَوَلَدِهِ وَمَالِهِ حَتَّى يَلْقَى اللَّهَ وَمَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, মু‘মিন পুরুষ ও নারীর জান, সন্তান, সম্পদ ইত্যাদি পরীক্ষা হ’তে থাকে (বিপদ -আপদের মাধ্যমে) সুতরাং সে এতে ধৈর্যধারণ করবে। পরিশেষে সে নিষ্পাপ হয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে’।[13]
(৭) উত্তম কাজে প্রতিযোগিতা করা :
একজন আদর্শ মানুষ হ’তে হলে ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করা বা তাড়াতাড়ি তা সম্পাদন করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ ‘কাজেই দ্রুত সৎকর্ম সমূহের দিকে এগিয়ে যাও (অর্থাৎ কা‘বামুখী হও)’ (বাক্বারাহ ২/১৪৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ লাভের জন্য সৎকাজের প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে তাদের পুরস্কারের বর্ণনাও দিচ্ছেন। তিনি বলেন, মুত্তাকীদের পুরস্কার হিসেবে যে জান্নাত প্রদান করা হবে, তার প্রস্থ আসমান ও যমীন সমপরিমাণ। সুবহানাল্লাহ! তাহ’লে পাঠক চিন্তা করুন প্রস্থ যদি আসমান ও দুনিয়াব্যাপী হয় তাহ’লে এর দৈর্ঘ্য কত হতে পারে? এটি কল্পনা করাও অসম্ভব। সুতরাং এত বড় পুরস্কার পেয়েও কি মানুষ সৎ ও উত্তম কাজে পরস্পর প্রতিযোগতিা করবে না। অবশ্যই করতে হবে। যদি আমরা আদর্শ মানুষ হ’তে চাই। আসুন! এবার ছহীহ হাদীছ দ্বারা জেনে নিই এই উত্তম কাজে প্রতিযোগিতার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কি বলেছেন?
হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা আঁধার রাতের টুকরা সমূহের মত (অবারিত ধারায় আসতে থাকা) ফিৎনাসমূহ আসার পূর্বেই নেকীর কাজ দ্রুত করে ফেল। মানুষ সে সময় সকলে মুমিন থাকবে এবং সন্ধ্যায় কাফির হবে কিংবা সন্ধ্যায় মুমিন থাকবে এবং সকালে কাফির হয়ে যাবে। নিজের দ্বীনকে দুনিয়ার সম্পদের বিনিময়ে বিক্রি করবে’।[14]
অন্যত্র এসেছে, عَنْ عُقْبَةَ قَالَ صَلَّيْتُ وَرَاءَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِالْمَدِينَةِ الْعَصْرَ فَسَلَّمَ ثُمَّ قَامَ مُسْرِعًا، فَتَخَطَّى رِقَابَ النَّاسِ إِلَى بَعْضِ حُجَرِ نِسَائِهِ، فَفَزِعَ النَّاسُ مِنْ سُرْعَتِهِ فَخَرَجَ عَلَيْهِمْ، فَرَأَى أَنَّهُمْ عَجِبُوا مِنْ سُرْعَتِهِ فَقَالَ ذَكَرْتُ شَيْئًا مِنْ تِبْرٍ عِنْدَنَا فَكَرِهْتُ أَنْ يَحْبِسَنِى، فَأَمَرْتُ بِقِسْمَتِهِ. উকবা (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর পিছনে মদীনায় আছরের ছালাত পড়লাম। অতঃপর সালাম ফিরে তিনি দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর লোকদের গর্দান টপকে তাঁর কোন এক স্ত্রীর কামরায় চলে গেলেন। লোকেরা তাঁর তাড়াহুড়া দেখে ঘাবড়ে গেল। অতঃপর তিনি বের হয়ে এসে দেখলেন লোকেরা তাঁর তাড়াহুড়ার কারণে আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। তিনি বললেন, আমার মনে পড়ল যে বাড়ীতে সোনা বা রুপার একটি টুকরা রয়ে গেছে। আমি চাইলাম না যে তা আমাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বাঁধা দিক। যার ফলে আমি (দ্রুত বাড়ী গিয়ে) তা বণ্টন করার আদেশ দিলাম। অন্য বর্ণনায় আছে আমি বাড়ীতে ছাদাক্বার একটি স্বর্ণ খন্ড ছেড়ে এসেছিলাম। অতঃপর আমি তা রাতে নিজ ঘরে রাখা পসনদ করলাম না’।[15]
অন্যত্র এসেছে, حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدٍ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ عَنْ عَمْرٍو سَمِعَ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ رضى الله عنهما قَالَ قَالَ رَجُلٌ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ أُحُدٍ أَرَأَيْتَ إِنْ قُتِلْتُ فَأَيْنَ أَنَا قَالَ فِى الْجَنَّةِ فَأَلْقَى تَمَرَاتٍ فِى يَدِهِ ، ثُمَّ قَاتَلَ حَتَّى قُتِلَ- জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত উহুদ যুদ্ধের দিন এক ছাহাবী নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বলুন! আমি যদি (কাফেরদের হাতে) মারা যাই তাহলে আমি কোথায় যাব? তিনি বললেন, জান্নাতে। একথা শোনামাত্র তিনি হাতের খেজুর ছুড়ে ফেলে দিলেন। তারপর যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করলেন’।[16]
অন্যত্র এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ أَتَى رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَىُّ الصَّدَقَةِ أَعْظَمُ فَقَالَ أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ صَحِيحٌ شَحِيحٌ تَخْشَى الْفَقْرَ وَتَأْمُلُ الْغِنَى وَلاَ تُمْهِلْ حَتَّى إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ قُلْتَ لِفُلاَنٍ كَذَا وَلِفُلاَنٍ كَذَا أَلاَ وَقَدْ كَانَ لِفُلاَنٍ- আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কোন ছাদাক্বা নেকীর দিক দিয়ে বড়? তিনি বললেন, তোমার ঐ সময়ের ছাদাক্বা বড় যখন তুমি সুস্থ থাকবে। সম্পদের লোভ অন্তরে থাকবে তুমি দরিদ্রতার ভয় করবে, ধনী হওয়ার আশা রাখবে। আর তুমি দান করতে দেরী করো না। পরিশেষে যখন তোমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে তখন বলবে অমুকের জন্য এত, অমুকের জন্য এত। অথচ তা অমুকের হয়েই গেছে’।[17]
(৮) ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ করা :
একজন আদর্শবান মানুষ হ’তে হলে অবশ্যই আমাদেরকে পরস্পর ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হ’তে নিষেধ করার গুণটি অর্জন করতে হবে। কেননা একজন আদর্শ মানুষ কখনো শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে পারে না। তাই আমাদের নিজে ভালো কাজ করার পাশাপাশি অন্যকেও ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন,وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম’ (আলে ইমরান ৩/১০৪)।
অত্র আয়াতে সফল ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হলো (১) মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকা। (২) আর ভালো কাজের আদেশ করা ও (৩) মন্দ কাজ হ’তে নিষেধ করা। একজন সকল ব্যক্তিকে অবশ্যই উক্ত তিনটি গুণ অর্জন করতে হবে।
এটা অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার স্বীয় ক্ষমতা অনুযায়ী হক্ব-এর প্রচার করতে হবে। এটি তার জন্য ফরয। কিন্তু তবুও একটি বিশেষ দল একাজে লিপ্ত থাকা যরূরী।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللَّهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُونَهُ فَلاَ يُسْتَجَابُ لَكُمْ. ‘সে সত্তার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হ’তে নিষেধ করতে থাক। নতুবা সত্বরই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর স্বীয় শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। অতঃপর তোমরা প্রার্থনা করবে কিন্তু তা কবুল করা হবে না’।[18]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে’ (নাহল ১৬/১২৫)।
মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন আল্লাহর মাখলূককে তাঁর পথের দিকে আহবান করেন। হিকমত দ্বারা কালামুল্লাহ ও হাদীছে রাসূল (ছাঃ) উদ্দেশ্য। আর সদুপদেশ দ্বারা ঐ উপদেশকে বুঝানো হয়েছে যার মধ্যে ভয় ও ধমক থাকে। যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে এবং আল্লাহর শাস্তি হ’তে বাঁচার উপায় অবলম্বন করে। তবে হ্যাঁ, এটাও মনে রাখতে হবে যে, যদি কারো সাথে তর্ক করার প্রয়োজন হয় তবে যেন নরম ও উত্তম ভাষায় তা করা হয়। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى مَسْعُودٍ الأَنْصَارِىِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنِّى أُبْدِعَ بِى فَاحْمِلْنِى فَقَالَ مَا عِنْدِى. فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَا أَدُلُّهُ عَلَى مَنْ يَحْمِلُهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِه-ِ আবূ মাসঊদ আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমার সওয়ারী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আমাকে একটি সওয়ারী দিন। তিনি বললেন, আমার কাছে নেই। তা শুনে এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে বলতে পারি যে কিনা তাকে সওয়ারী দিতে পারে। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি কল্যাণের প্রতি পথনির্দেশ করে তার জন্য ঐ কল্যাণ সম্পাদনকারীর সমপরিমাণ ছওয়াব রয়েছে’।[19]
অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি (কাউকে) সৎ পথের দিকে আহবান করে সে তার প্রতি আমলকারীদের সমান নেকী পাবে। এটা তাদের নেকী সমূহ হ'তে কিছুই কম করবে না। আর যে ব্যক্তি (কাউকে) ভ্রষ্টতার দিকে আহবান করবে, তার উপর তার সমস্ত অনুসারীদের গোনাহ চাপবে। এটা তাদের গোনাহ হ’তে কিছুই কম করবে না’।[20] (ক্রমশ:)
[লেখক: সভাপতি, দিনাজপুর সাংগঠনিক যেলা ]
[1]. বুখারী হা/২৬৯৭; মুসলিম হা/৪৫৮৯।
[2]. মুসলিম হা/৪৫৯০।
[3]. মুসলিম হা/২০৪২; আবুদাউদ হা/২৯৫৬।
[4]. মুসলিম হা/৫৫৬; ইবনু মাজাহ হা/২৮০; মিশকাত হা/২৮১।
[5]. বুখারী হা/১৪৬৯; মুসলিম হা/১০৫৩; তিরিমিযী হা/২০২৪; নাসাঈ হা/২৫৮৮; আহমাদ হা/১০৬০৬।
[6]. মুসলিম হা/২৯৯৯; আহমাদ হা/১৮৪৫৫; দারেমী হা/২৭৭৭।
[7]. বুখারী হা/৬৪২৪; মিশকাত হা/১৭৩১ ।
[8]. বুখারী হা/৩৪৭৪; মিশকাত হা/১৫৪৭।
[9]. বুখারী হা/৫৬৫৩।
[10]. বুখারী হা/৫৬৪১।
[11]. বুখারী হা/৫৬৪৫।
[12]. তিরমিযী হা/২৪৯৩।
[13]. তিরমিযী হা/২৩৯৯।
[14]. মুসলিম হা/৩২৮।
[15]. বুখারী হা/৮৫১১২২১; নাসাঈ হা/১৩৬৫; আহমাদ হা/১৫৭১৮।
[16]. বুখারী হা/৪০৪৬; মুসলিম হা/৫০২২।
[17]. বুখারী হা/১৪১৯; মুসলিম হা/২৪২৯।
[18]. তিরমিযী হা/২১৬৯; মিশকাত হা/৫১৪০।
[19]. মুসলিম হা/ ৫০০৭; আবুদাউদ হা/৫১২৯।
[20]. মুসলিম হা/৬৯৮০; মিশকাত হা/১৫৮।