দাদীর ভালোবাসা
-তোদের বংশ হইছে আকাট মূর্খ! এই বংশের পোলার হইব পড়ালেহা। হইব না। এই আমি কইয়া রাখলাম। তোরা করবি হালচাষ। গোয়ালভর্তি গোবর সাফ করবি।
ফোর ফাইভে পড়া আমার তখন পড়ালেখায় তীব্র অনীহা। আমাকে লক্ষ্য করে তাই আম্মার এমন বাণী বর্ষণ ছিল নিত্যকার ঘটনা। আমার কারণে আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার! রেহাই নেই। এই বংশের ওপর আম্মার তীব্র ক্ষোভ। বিয়ের সময় ঘটকের ডাহা সব মিথ্যা কথায় আমার নানা-নানী বিভ্রান্ত হয়েছিলেন বলেই এমন গোয়ার-গোবিন্দ, বকলম, মূর্খ বংশে আম্মাকে আসতে হয়েছে বলে আম্মার আফসোসের সীমা নেই। ঘটনা যেহেতু ঘটেই গেছে, এখন কি আর করা! ছেলে দুইটাকে পড়াশোনা করিয়ে এই বংশের ধুলা-বালি, কাদা-জল মুক্ত করতে পারলেই শান্তি! কিন্তু আম্মার সেই প্রচেষ্টা প্রায়শই সীমহীন শংকার মুখে পড়ে। পড়াশোনা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। বরং খাঁখাঁ রোদের দুপুর বেলায় যখন চাষিরা ক্ষেতের আলে বসে কাজের অবসরে কাঁচা লংকা দিয়ে গপগপ করে ভাত খায়, আমার কাছে এ ঢের লোভনীয়!
আম্মার অবশ্য চেষ্টার অন্ত নেই। বাবা-সোনা-মানিক বলে বোঝানো থেকে শুরু করে চটের বস্তার সাথে চকচকে ধারালো দা-বটি নিয়ে কল্লা কেটে সেই বস্তায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার হুমকী পর্যন্ত! কোন চেষ্টাই আম্মা কখনো বাদ রাখেন নি। কিন্তু বিশেষ এক প্রাণীর লেজ যেমন কখনো সোজা হয় না, তেমনি এই বংশের পোলাপানের পড়ালেখার স্বপ্ন দেখাও বৃথা! আম্মার চেষ্টা, আফসোস এবং বকাঝকা তাই চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তেই থাকে!
সেদিন ভোরে ঘুমঘুম চোখে বাড়ি থেকে বের হয়েছি মক্তবে যাব। কিন্তু গেছি ফকিরদের জঙ্গলে। সেখানে আরও কয়েকজনের সাথে বিশাল মার্বেল খেলার ম্যাচ। আমাদের সকলের বগলের তলে আমপারা আর রেহাল। মাথায় টুপি। আমরা মার্বেল খেলার উত্তেজনায় নিমগ্ন। দিন-দুনিয়ার কোন খেয়াল নেই। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কারো শক্ত হাতের বজ্র আঁটুনি আর পিঠের উপর কাঁচা ডালের শপাং শব্দে ফিরে তাকাই!
আম্মা! সাক্ষাৎ যমদূত হলেও বোধহয় এর চেয়ে ঢের ভালো ছিল!
ঘরের দরোজা আটকে মনের সুখে পিটিয়ে, দুনিয়ার যত গালমন্দ করে, চিৎকার করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেও যখন আমার কাছ থেকে কোন ধরনের বিদ্যাসাগর হওয়া সংক্রান্ত আশ্বাস পেলেন না, তখন সেই দা-বটি আর বস্তা থেরাপি শুরু। আজ আমার কল্লা কেটে বস্তায় ভরে যদি নদীতে না ভাসাচ্ছেন, তাহলে তিনি সর্দার বংশের মেয়েই না।
দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ঢের ভালো!
আমার কান তখন শেয়ালের মত উৎকর্ণ! বু কই? বু! এখনো আসেনা কেন! ত্রাতা! আমরা আমাদের দাদীকে বু বলে ডাকি। আমার হাতভর্তি তখন বড় বড় ঘামাচি। সেই ঘামাচি মনের সুখে গায়ের জোরে চুলকালে ঘামাচির মাথা ফেটে টলটলে রক্তফোঁটা বের হয়। বু কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলেন। কেবলমাত্র বাড়িতে ঢুকেছেন। তার গায়ের গন্ধ শুকে আমি বলে দিতে পারি। আমি সমানে আমার হাতের ঘামাচিগুলো চুলকাতে লাগলাম। আম্মা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন, ঘটনা কি? কি করে এ? করে কি?
আমার হাতের কনুই থেকে কব্জি অবধি তখন ফোঁটা ফোঁটা রক্তে সয়লাব। আচমকা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করলাম আমি, ও বু... বু রে... ও বু... আম্মায় আমারে মাইরা বটি দিয়া হাত কাইটটা ফালাইছে। ও বু... রক্ত বুউউউ... খালি রক্ত! ও বু!
রক্ত...'
ঘরের দরজায় দড়াম দড়াম লাথি! আম্মার অবাক চোখ জড়সড়। দরোজা খুলতেই বু শক্ত হাতে আম্মার চুলের মুঠি ধরে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার, দাসীর ঘরের দাসী, তোর এত্তবড় সাহস! তুই আমার নাতীর গায় হাত দেস! তোর এত্তবড় সাহস। তোর হাত যদি আমি আইজ না কাটছিতো... তুই আমার নাতির গায় হাত দিছস, আমার নাতির গায়... !!
আমি দৌড়ে গিয়ে বুর আঁচলের তলায় লুকাই। কান্নার ভান করতে করতে সুযোগ বুঝে আম্মার ভীতসন্ত্রস্ত, হতভম্ব চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই ভেংচি কেটে দেই, 'বুঝছ মজা! আর মারবা!!'
বু আমাকে তার ঈষৎ কুঁজো শরীরে আদরে মমতায় থই থই কোলটাতে তুলে নেয়। তারপর তার চিড়া মোয়ার টিনের কৌটা খুলে খেতে দেন। তারপর আমাকে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হন। আমার মা তখন ঘরের দাওয়ায় আঁচলে মুখ লুকিয়ে আক্ষেপে, হতাশায় তার যক্ষ্মের ধন, স্বপ্নের চাবিকাঠি পুত্রধনের তার দাদীর লাই পেয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া দেখে নীরবে চোখের জল ফেলেন।
এই বংশে বিয়ে করে তার জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেলো।
বু তার বৃদ্ধ-কোঁচকানো হাতে আমার তুলতুলে কচি হাতখানা শক্ত করে ধরে উঠানের কোনা দিয়ে রাস্তায় নামেন, আর আম্মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, এহ আইছে! লন্ডন পাস পন্ডিতের ঝী পন্ডিত! তোর লন্ডন পাশের খেতা পুড়ি। আমার নাতীর শইলে আর একটা হাত দিলে হাত কুচিকুচি কইরা কাইটটা হাঁস-মুরগীরে খাওয়ামু। তোর এত্ত বড় সাহস! তুই আমার নাতীর শইলে হাত দ্যাস। আমার নাতীর শইলে হাত দিলে সেই ব্যাথা আমার শইলে লাগে! তুই বুঝস দাসীর ঘরের দাসী! আমার নাতীর পড়ালেখার দরকার নাই। আমার নাতীরে চাইরখান গরু কিন্না দিমু, সে হালচাষ কইরা খাইব! তোর কি? আমার নাতীরে মাইরা জজ বেরিস্টার বানাবি? তোর জজ ব্যারিস্টার আমি পাও দিয়াও পুছি না। থুঃ থুঃ মারি... থুঃ থুঃ...
আমি বুর অপার মমতা মাখা পানের গন্ধ ভরা আঁচলের ভেতর আরও খানিকটা ঢুকে যাই। বু তার দাঁতবিহীন ফোকলা মুখে হাসেন। তার মুখভর্তি পান। পানের রসে টুকটুকে লাল ঠোঁট। আমি বুর গলা জড়িয়ে ধরে খুব সাবধানে, বুর চোখ এড়িয়ে, বিজয়ীর ভঙ্গীতে আম্মার দিকে তাকিয়ে আরেকবার ভেংচি কাটি।
বু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পৃথিবীর সব স্নেহ, সব আদর, সব মমতা, সব ভালোবাসা মেখে চুমু খান। সেই চুমু তার রক্তের, তার আত্মার।
আমি বুর গায়ের গন্ধে ঘুমিয়ে পড়ি। বু ঘুমন্ত আমাকে কোলে নিয়ে পাড়ার আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে হাঁটতে থাকেন। আর সেই ঘুমন্ত আমার সাথেই কথা বলতে থাকেন, হোন ভাই, মায়ের লগে বেদ্দপি করতে অয়না, মায়ের কথা শোনতে অয়। মায় কি আর খারাপ কিছু কয়?
সেই কথা শোনার সময় কই আমার? আমি তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মমতা আর ভালোবাসার গন্ধে মাখামাখি হয়ে স্বপ্নের দেশে।