• free web stats
  • At-Tahreek
    সম্পাদকীয়

    লক্ষ্যপূর্ণ জীবনের পথে

     

    আল্লাহ রাববুল আলামীন পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের চলার পথ ভিন্ন ভিন্ন রাখলেও সকলের গন্তব্য একই নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমাদের জীবনের অবস্থানগত দিক হাযারো বৈচিত্রে ভরপুর থাকলেও পরিসমাপ্তির জায়গাটা সকলের জন্য এক। আমরা প্রত্যেকেই জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে একটি সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছি। এমনকি মহাকালের জীব-জড় সকল প্রাণী ও বস্ত্তই সেই একক মহাগন্তব্যের পথে ধাবমান। এসব কিছু থেকে সুস্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, আমাদের জীবনটা কিছুতেই লক্ষ্যহীন নয়। প্রতিবার মৃতজনের অনন্তযাত্রার সংবাদপ্রাপ্তিতে ‘ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেঊন’ (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন) যে শব্দবন্ধটি আমাদের মুখ থেকে বের হয়, তা আমাদেরকে জীবনের সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা গভীর উপলব্ধির সাথে স্মরণ করিয়ে দেয়।

    মানবজীবন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। আল্লাহর দাসত্বের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করাই হ’ল এ জীবনের মূল লক্ষ্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই বাস্তব জীবনে এসে এই মহাসত্যটি ভুলে যায়। জীবনের ঊষালগ্নে নবীন কিশোরের চোখের দ্যুতিতে পিতামাতা ও অভিভাবকগণ যে রঙিন স্বপ্নের ঝিলিক এঁকে দেন সযতনে, তা জাগতিক প্রয়োজনে কিংবা সামাজিক বলয়ে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থানের জানান দেয়ার তাড়নায় বড় সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে ধরা দেয় বটে; কিন্তু জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের পথে সেটি নিছক একটি নিমিত্ত ভিন্ন কিছুই নয়। তবুও জৈবিক স্বপ্ন পূরণের সাধনাই পরিশেষে আমাদের  অধিকাংশের জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্যে পরিণত হয়। যার অনিবার্য ফলস্বরূপ দুনিয়াবী প্রাপ্তির গর্ব অথবা অপ্রাপ্তির বেদনা আমাদের ভাবনাজগতকে সর্বদা বেসামাল করে রাখে। অথচ জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে কোন অবস্থাতেই এসব ক্ষণস্থায়ী লোভনীয় বস্ত্ততে প্রতারিত হাওয়ার কথা ছিল না।

    আল্লাহ রাববুল আলামীন প্রয়োজন ব্যতিরেকে পৃথিবীতে কোন কিছুই সৃষ্টি করেননি। পৃথিবী পরিচালনার জন্য তিনি বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন মেধা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত এই মেধা ব্যবহারের মাধ্যমে পার্থিব জীবনকে নানা মাত্রায় সুষমামন্ডিত করে মানবসভ্যতাকে অগ্রযাত্রার পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতার কোন ছেদ ঘটবে না। সুতরাং সমাজের প্রত্যেকে আলেমে দ্বীন হবে, কিংবা চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী হবে; এমন কোন বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। বরং যার যার মেধা ও আগ্রহ অনুযায়ী মানুষ পেশা বেছে নিতে পারে। তবে চূড়ান্ত বিচারে প্রতিটি কর্মের লক্ষ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি; এটাই হ’ল ইসলামী জীবনদর্শনের মূলকথা।

    জীবনের মূল লক্ষ্যের এই তাৎপর্য অনুধাবন না করতে পারার কারণে অনেক দ্বীনদার ভাইকেও কখনও এমন হতাশায় নিক্ষিপ্ত দেখা যায় যে, তিনি ক্যারিয়ারের পিছনে সময় দিতে গিয়ে দ্বীনের কাজে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। অথচ এটাই সত্য যে, তিনি যে হালাল ‘ক্যারিয়ার’ গঠনে সময় দিচ্ছেন এবং এর মাধ্যমে জনগণের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন, সেটিই তার জন্য ‘ইবাদত’ হ’তে পারে, যদি এর মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানবতার সেবার সংকল্প করে থাকেন। অপরদিকে যে ব্যক্তি দ্বীনের খেদমতে ব্যস্ত রয়েছেন, অথচ তার লক্ষ্য হল দুনিয়া; তার দ্বীনের খেদমত আর ‘ইবাদত’ থাকে না। কেননা আল্লাহকে খুশী করা তার মূল লক্ষ্য নয়। তেমনিভাবে একজন ব্যক্তি যদি সর্বশ্রেষ্ট ইবাদত ছালাতও আদায় করে; অথচ ছালাতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে সচেতন নয়, কেবল মানুষের দেখাদেখি ছালাত আদায় করে; তার ছালাত আর ‘ইবাদত’ থাকে না; বরং ‘আদাত’ বা নিছক অভ্যাসগত কর্মে পরিণত হয়। এই লক্ষ্যহীন ছালাতে তার কোন ছওয়াব হয় না, চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনেও কোন উপকারে আসে না। মোদ্দাকথা, জীবনের মহান লক্ষ্যকে সামনে রাখতে পারলে মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপই অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে লক্ষ্য সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ও ঈমান না থাকলে অনেক সৎআমলও পরিশেষে অর্থহীন হয়ে যায়।

    সুতরাং লক্ষ্যপূর্ণ জীবনই অর্থপূর্ণ জীবন। প্রতিটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির খালেছ নিয়তে করার প্রতিজ্ঞাকে সামনে রেখে যদি আমরা জীবন পরিচালনা করতে পারি কিংবা বহুল আলোচিত ‘ক্যারিয়ার’ গঠন করতে পারি, তবে কর্মক্ষেত্র যেখানেই হোক না কেন, পেশা যা-ই হোক না কেন, আমাদের জীবন প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের পথেই ধাবিত হবে ইনশাআল্লাহ। আর এই লক্ষ্যকে বুকে ধারণ করা এবং সেই মোতাবেক নিজেকে পরিচালনা করতে পারা এবং না পারার মধ্যেই একজন মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করছে।    

    রামাযান মাস সমাগত। লক্ষ্যপূর্ণ জীবন গঠনের সবচেয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের সময় এই বরকতময় মাস। সাধ্যমত এই মাসের হক যেন আদায় করা সম্ভব হয়, সে লক্ষ্যে প্রস্ত্ততি নিতে হবে এখন থেকেই। মহান আল্লাহ আমাদের সকল ভাই-বোনকে প্রতিটি কাজ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা এবং প্রতিটি কাজে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনকে মূল লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণের তাওফীক দান করুন। এবং এর মাধ্যমে পরকালীন জীবনে চিরসুখময় জান্নাতের অধিকারী হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন- আমীন।

     


    HTML Comment Box is loading comments...