আন্দোলন অথবা ধ্বংস
আন্দোলন ব্যতীত বেঁচে থাকার আশা প্রাণ ব্যতীত প্রাণীর কল্পনা করার ন্যায়। প্রাণহীন অসাড় দেহের যেমন কোন মূল্য নেই, আন্দোলন বিহীন কিংবা আন্দোলন বিমুখ ব্যক্তি বা জাতির তেমনি কোন মূল্য নেই। আন্দোলন উন্নয়নমুখী হৌক আর অধোমুখী হৌক, আন্দোলন আপনাকে করে যেতেই হবে। যখনি আপনি নিজেকে একজন জীবন্ত মানুষ ভাবছেন, তখনি আপনাকে নিজেকে একজন আন্দোলনকারী হিসাবে ভাবতে হবে। ঠিক একটি স্রোতস্বিনী নদীর মত। তাকে নদী হিসাবে গণ্য করতে গেলেই সেখানে জোয়ার ও ভাটার অথবা নিম্নমুখী স্রোতের কল্পনা করতেই হবে। নইলে তাকে নদী না বলে পুকুর বা হরদ বলতে হবে। যেখানে শেওলা বা ময়লা জমতে বাধ্য।
স্রষ্টার ঐকান্তিক অনুগ্রহে এ দুনিয়াতে আমরা গরু-ছাগল না হয়ে মানুষের ঘরে জন্মেছি। তিনি মেহেরবানী করে দুনিয়ার সকল বস্ত্তকে আমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। সূর্যের কিরণমালা, চন্দ্রের জ্যোতিবিভাস, ঋতুচক্রের আবর্তন- বিবর্তন, বাতাসের হিল্লোল, নদীর কল্লোল, পানির জীবনীশক্তি, ভূমির উর্বরাশক্তি সকলে মিলে একটা মানব শিশুকে লালন করছে।
বিরাট দেহধারী ঐ বন্যহস্তী, জঙ্গলের ঐ হিংস্র সিংহ, অতলান্তিক সমুদ্রের ঐ বিশাল পানিরাশি, মহাশূন্যের ঐ গ্রহরাজি, বিপুল শক্তিধর ঐ পারমাণবিক বিদ্যুৎ সবকিছুই আজ মানুষের তাবেদার। মানুষ সৃষ্টির সেরা।
কিন্তু মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব কি জন্য? দৈহিক সৌন্দর্যের কারণে? তাহ’লে জানালা খুলে মুগ্ধ নয়নে আপনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন কেন? সুন্দর সুরেলা কণ্ঠের জন্য? তাহ’লে কোকিলের কুহুতানে আপনার মনটা উদাস হয়ে যায় কেন? সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের কারণে? তাহ’লে একবার তাকিয়ে দেখুন ঐ এক ঝাঁক মৌমাছির দিকে। আপনার শৈল্পিক গুণের জন্য? তাহ’লে একবার গভীরভাবে মনোনিবেশ করুন ঐ মৌচাকটির দিকে অথবা তালগাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির ঐ ছোট্ট বাসাটির দিকে। ভাবছেন প্রেম ভালোবাসা ও ভক্তি শ্রদ্ধার কারণে? তাহ’লে একটু তাকান আপনার সামনে দিয়ে উড়ে যাওয়া ঐ কপোত-কপোতীর দিকে অথবা ঘরের ঐ পোষা কুকুরটির দিকে। তাহ’লে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব কোন কারণে? সেটি অন্য কিছুই নয়, কেবলমাত্র জ্ঞান-বিবেক ও ভালমন্দ বিচারবুদ্ধির কারণে। আল্লাহ মানুষের জ্ঞানের হিসাব নেবেন। অবোধ শিশু বা নির্বোধ পাগলের কোন হিসাব নেই।
ভাবছেন পশু-পক্ষীরও তো যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। নইলে তারা অত সুন্দর বাসা বাঁধে কেমন করে? কথা ঠিক, কিন্তু ঐ সুন্দর শিল্পগুণের অধিকারী বাবুই পাখি, চড়ুই পাখি কিংবা মাছরাঙার বাসা তৈরী করতে পারে না। এজন্যেই পারে না যে, তার স্বাধীন বিচারবুদ্ধি নেই। পক্ষান্তরে মানুষ তার স্রষ্টা প্রদত্ত স্বাধীন বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে আকাশের ঐ বিদ্যুৎকে বেঁধে রেখে নিজের ঘরে স্বাধীনভাবে পাখা ঘুরাচ্ছে, কারখানার মেশিন চালাচ্ছে, এক্সরে মেশিনে নিজের দেহের মধ্যের সবকিছুর ফটো তুলে নিচ্ছে। আবার পারমাণবিক বোমা বানিয়ে দুনিয়া ধ্বংস করে দেবার কথা ভাবছে। মানুষের এই জ্ঞানী প্রতিভা ও স্বাধীন বিচারবুদ্ধি যখন সুস্থ পথে পরিচালিত হয়, তখন সে হয় খাঁটি মানুষ। আর যখনি সে শয়তানী উত্তেজনায় প্ররোচিত হয়ে সুষ্ঠু বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে, তখনি তার দ্বারা সবকিছু সম্ভব হয়। পশুর চাইতেও সে নীচে নেমে যায়। বলাবাহুল্য মানুষকে সুষ্ঠুপথে পরিচালিত করার জন্যই আল্লাহ মেহেরবানী করে যুগে যুগে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সমাজের বুকে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করে তাঁরা সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। পক্ষান্তরে শয়তানের তাবেদারগণ এই আন্দোলনকে চাপা দেওয়ার জন্য তাদের যাবতীয় শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। লোভনীয় স্লোগান, মোহনীয় ঐশ্বর্য-বিলাস সবকিছুকেই তারা এজন্য ব্যবহার করেছে। অবশেষে মিথ্যা অপবাদ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। যেমন হযরত নূহ (আঃ)-এর বিরুদ্ধে তাঁর কওমের একদল লোক অপবাদ দিয়ে বলেছিল ‘নূহ আসলে আমাদের উপরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়’ (মুমিনূন ২৩/২৪)। এমনিভাবে আমাদের নবীকেও ঐ একই অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে যে, (কাফের) নেতারা নিজ কওমকে বলেছিল, وَاصْبِرُوا عَلَى آلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ- مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي الْمِلَّةِ الْآخِرَةِ إِنْ هَذَا إِلَّا اخْتِلَاقٌ তোমরা তোমাদের দেবতাগুলির ব্যাপারে অনড় থাকো। নিশ্চয়ই নবীর এই দাওয়াতের মধ্যে কোন দূরভিসন্ধি আছে। নইলে আমরা আমাদের পূর্ববর্তী লোকদের নিকট তো এমন কথা কখনো শুনিনি। অতএব এগুলি মনগড়া উক্তি ছাড়া কিছুই নয় (ছোয়াদ ৩৮/৬-৭)। তাই বর্তমান যুগেও দ্বীনের কোন খালেছ আন্দোলনকারীকে যদি কেউ এমন অপবাদ দেয়, তবে সেটাকে বরং আশীর্বাদ মনে করা উচিত।
দুনিয়ায় চিরদিন দু’ধরনের আন্দোলন চলে আসছে। একটি আন্দোলন সমাজের বুকে আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠা দেখতে চেয়েছে। মানুষকে স্বাধীন মানুষে পরিণত করতে চেয়েছে। মানবিক মূল্যবোধ সমূহকে বিকশিত করে সমাজে সত্যিকারের শান্তি ও কল্যাণ কায়েম করতে চেয়েছে। বলা বাহুল্য আল্লাহর নবীগণ ও তাঁদের সঙ্গী-সাথীগণই এ আন্দোলন পরিচালনা করে গেছেন। অন্য আন্দোলনটি ছিল এর বিরোধী। যারা সমাজের বুকে ইবলীসী আইন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। স্বাধীন মানুষকে এর গোলাম বানিয়ে নিষ্ঠুর উল্লাসে ইচ্ছামত তাদেরকে ভোগ করেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ-নিষ্পেষণে জর্জরিত করেছে। নিজেদের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তিকে আল্লাহ বানিয়ে নিরীহ জনগণের উপরে চরম স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েছে। যেমন আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ ‘তুমি কি দেখেছ ওদেরকে, যারা স্ব স্ব প্রবৃত্তিকে নিজেদের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে’? (ফুরক্বান ২৫/৪৩)। বলা বাহুল্য নমরূদ, ফেরাঊন, হামান, ক্বারূণ প্রভৃতি ইবলীসের শিখন্ডীরাই এ আন্দোলনের বিশ্বনেতা। এদের বিরুদ্ধে হযরত ইবরাহীম (আঃ), মূসা (আঃ) প্রমুখ নবী-রাসূলদের আন্দোলন সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি।
উপরোক্ত দু’ধারার আন্দোলন পৃথিবীতে চিরদিন ছিল, আজও আছে, আগামীতেও থাকবে। যখন যে আন্দোলন সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করবে, তখন সেই মোতাবেক সমাজ চলবে। তবে হ্যাঁ, এই আন্দোলনের বাইরেও একটি বিরাট দল থাকে। যারা ইতর জীবের মত কেবল নিজেদের পেট ভরাবার চিন্তায়ই ব্যাকুল থাকে। যখন যে আন্দোলন সমাজে নেতৃত্ব পায়, তখন সেই নেতৃত্বের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়াই তাদের জীবনের একমাত্র ব্রত এবং তারা এজন্য নিজেদেরকে বড় চতুর বলে ভাবে। কিন্তু আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন,أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا ‘তুমি কি ভেবেছ ওদের অধিকাংশ শোনে বা বুঝে? তারা তো চতুষ্পদ জন্তুর মত বরং তার চাইতেও পথভ্রষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৪৪)।
বলা বাহুল্য সমাজে এই ধরনের লোকের সংখ্যাই বেশী। যারা কোন মতে জীবনটা কাটিয়ে যেতে চায় এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করাকে অহেতুক ঝামেলা মনে করে। এরা প্যারালাইসিসের রোগীর মত। যারা সমাজকে কিছু দেয় না। বরং সবার করুণার ভিখারী। তাই এদেরকে নিয়ে কোন মাথাব্যথা না থাকলেও চলবে।
এক্ষণে আমরা যারা আল্লাহর মেহেরবানীতে মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছি, আমাদের আন্দোলন কোন পথে হবে? আমরা কি নবীদের আন্দোলনের অনুসারী হব, না ফেরাউনী আন্দোলনের সাথী হব? না কি কোন দিকেই না গিয়ে চুপচাপ বসে সুযোগের সন্ধানে থাকব ঘূণিত জীবের মত? আমাদেরকে অবশ্যই নবীদের আন্দোলনের অনুসারী হতে হবে। কেননা এই একটিমাত্র শর্তেই তো আমরা মুসলমান হতে পেরেছি। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমরাই হ’লে শ্রেষ্ঠ জাতি। যাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)।
ব্যস! ন্যায়ের পথে আন্দোলন ব্যতীত মুসলমানের জন্য দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই। ন্যায়ের পথ হ’ল আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের পথ। আল্লাহর কুরআন ও মহানবীর জীবনাদর্শই ন্যায়-অন্যায়ের একমাত্র মাপকাঠি। আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর পথে জিহাদে নেমে পড়তে হবে। যেকোন মূল্যে ইবলীসী আন্দোলনকে প্রতিহত করতে হবে। এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই চরম ত্যাগের প্রস্ত্ততি নিতে হবে। দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও তথাকথিত ধর্মীয় ক্ষেত্রের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কোন দিনই আমাদের আন্দোলনকে সুনযরে দেখবে না। বরং তারা সর্বশক্তি দিয়ে আমাদেরকে স্তব্ধ করে দেবার চেষ্টা করবে। যেমন ইতিপূর্বে যুগে যুগে নবীদের আন্দোলনকে তারা স্তব্ধ করার চক্রান্ত করেছিল। অতএব যদি আমরা আজ এ আন্দোলন থেকে পিছিয়ে পড়ি, তবে আমাদেরকে দুনিয়াতেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
তাই আমাদেরকে আজ ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা ইসলামী আন্দোলনের গাযী বা শহীদ হব, না লজ্জাকর ধ্বংস বরণ করে নেব? নিঃসন্দেহে আহলেহাদীছ আন্দোলনই হ’ল প্রকৃত ইসলামী আন্দোলন। যার কোন বিকল্প নেই।
[সাপ্তাহিক আরাফাত ২২ বর্ষ ৩০ সংখ্যা ৬ই অক্টোবর ১৯৮০ পৃ. ২-য়ে প্রকাশিত। মাননীয় লেখকের যাত্রাবাড়ী মাদরাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া (৭৮ উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকার)-তে অবস্থানকালে এটাই ছিল সর্বশেষ লেখনী]