ইহতিসাব বা ছওয়াবের আকাংখা
আল-কুরআনুল কারীম :
1-ِ وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ-
(১) ‘লোকদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে, যে আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল’ (বাক্বারাহ ২/২০৭)।
2- لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا-
(৩) ‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন মঙ্গল নেই। কিন্তু যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)।
3- وَمَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَتَثْبِيتًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍ بِرَبْوَةٍ أَصَابَهَا وَابِلٌ فَآتَتْ أُكُلَهَا ضِعْفَيْنِ فَإِنْ لَمْ يُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ-
(৩) ‘পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও নিজেদের আত্মাকে (অর্থাৎ ছওয়াব পাবার বিশ্বাসকে) দৃঢ়তর করার জন্য ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ সমভূমির ঐ বাগিচার মত, যেখানে প্রবল বৃষ্টিপাত হলে দ্বিগুণ শস্য উৎপাদিত হয়। আর প্রবল বৃষ্টি না হলে হাল্কা বৃষ্টিই যথেষ্ট হয়। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সবই প্রত্যক্ষ করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৬৫)।
4- لَيْسَ عَلَيْكَ هُدَاهُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلِأَنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونٌَ-
(৪) ‘তাদেরকে হেদায়াত করার দায়িত্ব তোমার নয়। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করে থাকেন। আর তোমরা ধন-সম্পদ হ’তে যা ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজেদের জন্যেই করে থাক। আর তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যয় করো না। উত্তম সম্পদ
হ’তে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে, তার পুরস্কার তোমরা পুরাপুরি পেয়ে যাবে। তোমাদের প্রতি কোনরূপ অন্যায় করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৭২)।
5- وَالَّذِينَ صَبَرُوا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً وَيَدْرَءُونَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَ أُولَئِكَ لَهُمْ عُقْبَى الدَّارِ.جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِمْ مِنْ كُلِّ بَابٍ.سَلَامٌ عَلَيْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ-
(৫) ‘আর যারা তাদের প্রতিপালকের চেহারা অন্বেষণের জন্য ধৈর্য ধারণ করে ও ছালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমরা তাদের যে রূযী দান করেছি সেখান থেকে খরচ করে গোপনে ও প্রকাশ্যে। আর যারা ভাল দ্বারা মন্দকে প্রতিরোধ করে, তাদের জন্যই রয়েছে পরকালের গৃহ। তা হল স্থায়ী বসবাসের জান্নাত। তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সৎকর্মশীল বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি। ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে। তারা বলবে, তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ বিধায় তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক! কতই না সুন্দর তোমাদের এই পরিণাম গৃহ’ (রা‘দ ১৩/২২-২৪)।
হাদীছে নববী :
6- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى مَا لِعَبْدِى الْمُؤْمِنِ عِنْدِى جَزَاءٌ، إِذَا قَبَضْتُ صَفِيَّهُ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا، ثُمَّ احْتَسَبَهُ إِلاَّ الْجَنَّةُ-
(৬) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার মুমিন বান্দার জন্য আমার নিকট জান্নাত ব্যতীত অন্য কোন পুরস্কার নেই, যখন আমি তার দুনিয়ার প্রিয়তম কাউকে কেড়ে নেই এবং সে ছওয়াবের নিয়তে ছবর করে’।[1]
7- عَنْ أَبِى مَسْعُودٍ الْبَدْرِىِّ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا أَنْفَقَ عَلَى أَهْلِهِ نَفَقَةً وَهُوَ يَحْتَسِبُهَا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةً.
(৭) আবূ মাস‘উদ আল বাদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মুসলিম ব্যক্তি ছওয়াবের আশায় তার পরিবার-পরিজনের জন্য যা কিছু খরচ করবে, সবই তার জন্য ছাদাক্বা হিসেবে গণ্য হবে’।[2]
8- عَنْ أَبِي أُمَامَة عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَقُولُ اللَّهُ سُبْحَانَهُ:ابْنَ آدَمَ إِنْ صَبَرْتَ وَاحْتَسَبْتَ عِنْدَ الصَّدْمَةِ الْأُولَى، لَمْ أَرْضَ لَكَ ثَوَابًا دُونَ الْجَنَّةِ-
(৮) আবু উমামা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান! যদি তুমি বিপদের প্রথমেই ধৈর্যধারণ কর এবং নেকীর আশা রাখ, তাহ’লে আমি তোমার জন্য জান্নাত ব্যতীত কোন নেকীতে সন্তুষ্ট হব না’।[3]
9- عَنْ عُمَرَ بْنِ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَجَبٌ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أصَابَهُ خَيْرٌ حَمِدَ اللَّهَ وَشَكَرَوَإِنْ أَصَابَتْهُ مُصِيبَةٌ حَمِدَ اللَّهَ وَصَبَرَ، فَالْمُؤْمِنُ يُؤْجَرُ فِي كُلِّ أَمْرِهِ حَتَّى يُؤْجَرَ فِي اللُّقْمَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى فِي امْرَأَتِهِ-
(৯ ওমর ইবনু সা‘দ ইবনু আবু ওয়াক্বক্বাছ তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেন রাসূল (ছাঃ) বলেন, মুমিনদের বিষয় আশ্চর্যজনক, যদি তার প্রতি কোন কল্যাণ বর্তায় সে আল্লাহর প্রশংসা করে ও শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। আর যদি কোন বিপদ আপতিত হয়, তবুও সে আল্লাহর প্রশংসা করে এবং ধৈর্যধারণ করে। সুতরাং মুমিন তার প্রত্যেক কাজেই নেকী অর্জন করে। এমনকি স্ত্রীর মুখে খাদ্যের লোকমা তুলে দিলেও নেকী পায়’।[4]
10- عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لِنِسْوَةٍ مِنَ الأَنْصَارِلاَ يَمُوتُ لإِحْدَاكُنَّ ثَلاَثَةٌ مِنَ الْوَلَدِ فَتَحْتَسِبَهُ إِلاَّ دَخَلَتِ الْجَنَّةَ.فَقَالَتِ امْرَأَةٌ مِنْهُنَّ أَوِ اثْنَيْنِ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ أَوِ اثْنَيْنِ.
(১০) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একজন আনছার মহিলাকে বলেন, তোমাদের মধ্যে যার তিনটি সন্তান মারা যাবে আর সে ধৈর্যধারণ করবে এবং নেকীর আশা রাখবে নিশ্চয়ই সে জান্নাতে যাবে। এসময় তাদের মধ্যেকার একজন মহিলা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি দুইজন মারা যায়? রাসূল (ছাঃ) বললেন, দু’জন মারা গেলেও সে জান্নাতে যাবে’।[5]
মনীষীদের বক্তব্য :
১. খোবায়েব (রাঃ) বলেন, ‘আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোন পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন্ পার্শ্বে শোয়ানো হচ্ছে’। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খন্ডিত টুকরা সমূহে বরকত দান করতে পারেন’।[6]
২. হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, আমার দেখা, বলা, হাত নড়াচড়া করা, পা উত্তোলন যাবতীয় কর্মকান্ডে খেয়াল করি, সেটিতে নেকী নাকি গোনাহ। যদি নেকী হয় তবে অগ্রসর হয় আর যদি গোনাহ হয় তাহলে পিছিয়ে আসি’।[7]
৩. মু‘আয (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল আর আপনি কিভাবে তিলাওয়াত করেন, হে মু‘আয? উত্তরে তিনি বললেন, আমি রাতের প্রথমাংশে শুয়ে পড়ি এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঘুমিয়ে আমি উঠে পড়ি। এরপর আল্লাহ আমাকে যতটুকু তাওফীক দান করেন তিলাওয়াত করতে থাকি। এতে আমি আমার নিদ্রার অংশকেও (ছওয়াবের বিষয় বলে) মনে করি, যেমন আমার দাঁড়িয়ে তিলাওয়াতকেও আমি (ছওয়াবের বিষয় বলে) মনে করি’।[8]
৪. তাবেঈ বিদ্বান ত্বালক বিন হাবীব বলেন, ফিৎনায় পতিত হ’লে তাক্বওয়া দিয়ে তা নিভিয়ে দাও। লোকেরা বলল, তাক্বওয়া কি? তাক্বওয়া হ’ল- নেকীর আশায় আল্লাহ প্রদর্শিত আলোয় আলোকিত হয়ে তার আনুগত্য করা এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী পাপাচার বর্জন করা।[9]
৫. ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, প্রত্যেকটি আমলের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকা আবশ্যক। আর ঈমান থেকে উৎসারিত না হ’লে কোন আমলই আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নৈকট্য হাছিলের মাধ্যম হ’তে পারে না। সব কাজের প্রেরণাদায়ী হবে ঈমান। অভ্যাস, প্রবৃত্তি পূজা, সুনাম, সম্মান লাভ প্রভৃতি নয়। বরং তার ভিত্তি হবে স্রেফ ঈমান এবং উদ্দেশ্য হবে ছওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।[10]
সারবস্ত্ত :
১. নেকীর আকাংখা নিয়ে সমস্ত ইবাদত সম্পাদন করা প্রত্যেক মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।
২. ইহতিসাব মুমিনের বিশ্বাসগত পূর্ণতার দলীল। এর মাধ্যমে যেমন আল্লাহ খুশী হন, তেমনিভাবে বান্দার চক্ষু শীতল হয় ও আত্মা পরিতৃপ্ত হয়।
৩. যেকোন কর্ম যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে শ্রুতি বা লৌকিকতার উদ্দেশ্যে করা হয়, তবে তা নিশ্চিতভাবেই নেকীর আশাকে নিরাশায় পরিণত করবে।
[1]. বুখারী, মিশকাত হা/১৭৩১; মুসনাদে আহমাদ হা/৯৩৮২।
[2]. মুসলিম হা/২৩৬৯।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/১৫৯৭; মিশকাত হা/১৭৫৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৮১৪৩।
[4]. বায়হাক্বী, মিশকাত হা/১৭৩৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৯৮৬।
[5]. মুসলিম,মিশকাত হা/১৭৩০।
[6]. ইবনু হিশাম ২/১৭৬; বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।
[7] . মাওসূ‘আতে ইবনু আবিদ্দুনিয়া, ১/২৩১ পৃ.।
[8] . বুখারী হা/৪৩৪৪।
[9] . ইবনু রজব, জামেঊল উলূম ওয়াল হিকাম, ১/৪০০।
[10] . ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মুহাজির ইলা রবিবহী ১৩ পৃ.।