• free web stats
  • At-Tahreek
    তারবিয়াত

    পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের করণীয়

    (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

    ভূমিকা :

    এ পৃথিবীতে পিতা-মাতার সম্মান ও মর্যাদা নিঃসন্দেহে সবার উপরে। মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্ববাসীর একমাত্র উপাস্য ও অভিভাবক, পিতা-মাতা হ’ল সন্তানদের ইহকালীন জীবনের সাময়িক অভিভাবক। সুতরাং সন্তানদের কাজ হ’ল, আল্লাহ তা‘আলার যাবতীয় হুকুম-আহকাম মানার সাথে সাথে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা। সন্তান জন্মের পর বাল্যকাল থেকে শুরু করে কৈশোর পর্যন্ত পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানেই থাকে এবং সম্পূর্ণ অনুগত থাকে। অতঃপর যৌবনে বা সংসার জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে পিতা-মাতার সঙ্গে তার সন্তানদের মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে, এটা স্বাভাবিক। সেজন্য মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা পিতা-মাতার সঙ্গে তার সন্তানদের বাল্য জীবনের ভালবাসার ন্যায়ই সারা জীবন তা মযবূত ও বহাল রাখার আদেশ দিয়েছেন। নিম্নে এ বিষয়ে সবিস্তারে আলোকপাত করা হ’ল।

    আল্লাহর পরেই পিতা-মাতার মর্যাদা :

    মানব সৃষ্টির ইতিহাসে আদম ও হাওয়া ব্যতীত সকল সৃষ্টিই পিতা-মাতার মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির পরিকল্পনা পিতামাতার মাধ্যমে সমাধান করেন। আর এজন্য তার ইবাদত পালনের পরপরই পিতামাতার সাথে সদাচারণ করা আবশ্যক করে দিয়েছেন। তাদের আদেশ-নিষেধ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে না হ’লে তা মান্য করে চলতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

    وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُلْ لَّهُمَا أُفٍّ وَّلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيْماً- وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْراً-

    ‘আর তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারু উপাসনা করো না এবং তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তুমি তাদের প্রতি উহ শব্দটিও করো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে নরমভাবে কথা বল। আর তাদের প্রতি মমতাবশে নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি দয়া কর যেমন তারা আমাকে ছোটকালে দয়াবশে প্রতিপালন করেছিলেন’ (বনী ইসরাঈল ১৭/ ২৩- ২৪)

    অন্যত্র তিনি বলেন,

    وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَاناً حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهاً وَّوَضَعَتْهُ كُرْهاً وَّحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلاَثُوْنَ شَهْراً حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِيْ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحاً تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِيْ إِنِّيْ تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.

    ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার দুধ ছাড়াতে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থ্যের বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌঁছেছে, তখন বলতে লাগল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকাজ করি। আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর, আমি তোমারই অভিমুখী হ’লাম এবং আমি আজ্ঞাবহদের অন্যতম’ (আহক্বাফ ৪৬/১৫)। অত্র আয়াতে চল্লিশ বছর বয়স উল্লেখ করার কারণ হ’ল- যে সন্তান এ বয়স পর্যন্ত মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণ করে তারা এর পরের বয়সে সাধারণত মাতা-পিতার অবাধ্য হয় না। তাদের চিন্তা থাকে তারা মাতা-পিতার সাথে খারাপ আচরণ করলে তাদের সন্তানেরাও তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবে।

    এ বিষয়ে আল্লাহ আরও বলেন, وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَّفِصَالُهُ فِيْ عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِيْ وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيْرُ. ‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে’ (লোক্বমান ৩১/ ১৪)

    পবিত্র  কুরআনের  বাণীগুলোকে  পরম  শ্রদ্ধা ও বিনয়াবনত হৃদয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এখানে কোন দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণ করা হ’তে বিরত থাকতে হবে। আয়াতগুলোতে সাধারণভাবে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি অবিচল থাকা ও সাথে সাথে পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, তাদের সেবা-যত্ন ও আনুগত্যের নির্দেশও দান করা হয়েছে। আয়াতের প্রারম্ভেই পিতা-মাতা উভয়ের সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মাতার কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। গর্ভ ধারণের সময় কষ্ট, প্রসব বেদনার কষ্ট ও দুধ পানের সময় কষ্ট সব সন্তানের ক্ষেত্রে মা’কেই সহ্য করতে হয়।

    অতঃপর সকল আত্মীয়-স্বজন, আপনজন ও সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বাগ্রে পিতা-মাতার হক সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

    وَاعْبُدُوْا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً وَبِذِيْ الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِيْنِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالاً فَخُوْراً.

    ‘উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে, পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম-মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী সংঙ্গী-সাথী, মুসাফির এবং দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পসন্দ করেন না দাম্ভিক-অহংকারীকে’ (নিসা ৪/৩৬)

    অন্যত্র আল্লাহ নিজের অবদানের পাশাপাশি মায়ের অবদান সন্তানদের স্মরণ করিয়ে বলেন, وَاللهُ أَخْرَجَكُم مِّنْ بُطُوْنِ أُمَّهَاتِكُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ الْسَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ. ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর’ (নাহল ১৬/৭৮)

    পবিত্র কুরআনে পিতা-মাতার হক সমূহকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে বান্দা তার জীবদ্দশায় সতর্কতা বজায় রেখে অকৃত্রিমভাবে পিতা-মাতার ন্যায়সঙ্গত অধিকার পূর্ণ করতে সক্ষম হয়।

    আল্লাহর অবাধ্যতায় মাতা-পিতার আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করা : পিতামাতা তার সন্তানকে শরী‘আত বিরোধী কোন কাজের আদেশ করলে, সন্তান তা প্রত্যাখ্যান করলেও কোন দোষ হবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কালামে বলেছেন,

    وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِيْ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوْفاً وَاتَّبِعْ سَبِيْلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُوْنَ.

    ‘পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই। তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে অবগত করব’ (লোক্বমান ৩১/১৫)

    এখানে শিরক বলতে আল্লাহর সত্তার সঙ্গে অন্য কিছুকে শরীক করা। একইভাবে আল্লাহর বিধানের সাথে অন্যের বিধানকে শরীক করা বুঝায়। ধর্মের নামে ও রাষ্ট্রের নামে মানুষের মনগড়া সকল বিধান এর মধ্যে শামিল। অতএব পিতা-মাতা যদি সন্তানকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বাইরে অন্য কিছু করতে চাপ প্রয়োগ করেন, তবে সেটি মানতে সন্তান বাধ্য হবে না। কিন্তু অন্য সকল বিষয়ে সদাচরণ করবে।

    মুছ‘আব বিন সা‘দ তার পিতা সা‘দ বিন খাওলা হ’তে বর্ণনা করেন যে, আমার মা একদিন আমাকে কসম দিয়ে বলেন, আল্লাহ কি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেননি? فَوَاللهِ لاَ أَطْعَمُ طَعَاماً وَلاَ أَشْرَبُ شَرَاباً حَتَّى أَمُوتَ أَوْ تَكْفُرَ بِمُحَمَّدٍ ‘অতএব আল্লাহর কসম! আমি কিছুই খাবো না ও পান করবো না, যতক্ষণ না মৃত্যুবরণ করব অথবা তুমি মুহাম্মাদের প্রতি ঈমান পরিত্যাগ করবে’।[1]  ফলে যখন তারা তাকে খাওয়াতেন, তখন গালের মধ্যে লাঠি ভরে দিয়ে ফাঁক করতেন ও তরল খাদ্য দিতেন। এভাবে তিন দিন যাওয়ার পর যখন মায়ের মৃত্যুর উপক্রম হ’ল, তখন সূরা আনকাবূত ৮ আয়াত নাযিল হ’ল,وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلاَ تُطِعْهُمَا إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ- ‘আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা পিতা-মাতার সাথে (কথায় ও কাজে) উত্তম ব্যবহার করে। তবে যদি তারা তোমাকে এমন কিছুর সাথে শরীক করার জন্য চাপ দেয়, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে তুমি তাদের কথা মান্য করো না। আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল। অতঃপর আমি তোমাদের জানিয়ে দেব যেসব কাজ তোমরা করতে’।[2]

    অন্য বর্ণনায় এসেছে, মা বললেন, তুমি অবশ্যই তোমার দ্বীন ছাড়বে। নইলে আমি খাবনা ও পান করব না, এভাবেই মরে যাব। তখন তোমাকে লোকেরা তিরষ্কার করে বলবে, يَا قَاتِلَ أُمِّهِ ‘হে মায়ের হত্যাকারী’! আমি বললাম, يَا أُمَّاهُ! لَوْ كَانَتْ لَكِ مِائَةُ نَفْسٍ، فَخَرَجَتْ نَفْسًا نَفْسًا مَا تَرَكْتُ دِينِي هَذَا فَإِنْ شِئْتِ فَكُلِي، وَإِنْ شِئْتِ فَلَا تَأْكُلِي ‘হে মা! যদি তোমার একশ’টি জীবন হয়, আর এক একটি করে এভাবে বের হয়, তবুও আমি আমার এই দ্বীন ছাড়ব না। এখন তুমি চাইলে খাও, চাইলে না খাও! অতঃপর আমার এই দৃঢ় অবস্থান দেখে তিনি খেলেন। তখন অত্র আয়াত নাযিল হ’ল’।[3] বস্ত্ততঃ এমন ঘটনা সকল যুগে ঘটতে পারে। তখন মুমিনকে অবশ্যই দুনিয়ার বদলে দ্বীনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

    মানব জাতিকে এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর শ্রেষ্ঠত্বের এই মর্যাদা রক্ষায় তাকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি দান করা হয়েছে। কিন্তু মানবজাতির শত্রু ইবলীস ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে সন্তানকে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে শয়তানের অনুগত কোন মুশরিক পিতা-মাতা পিতৃত্বের দাবী নিয়ে নিজ সন্তানদের শিরক স্থাপনে বাধ্য করতে না পারে। কারণ শিরক হ’ল অমার্জনীয় পাপ। এখানে মহান আল্লাহর পক্ষ হ’তে অধিকার প্রাপ্ত পিতা-মাতা ও সন্তান উভয়কেই শিরকমুক্ত থেকে ইসলামের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিগ্রহণের কঠোর নির্দেশ রয়েছে।

    পবিত্র কুরআনে লিপিবদ্ধ ইবরাহীম (আঃ)-এর কাহিনী অবলম্বনে পিতা কর্তৃক পুত্রকে শিরকের পথে আহবান এবং পুত্র কর্তৃক পিতাকে সত্যের পথে আহবানের দলীল পাওয়া যায়। ইবরাহীম (আঃ)-এর পিতা মূর্তিপূজক তথা মুশরিক। অথচ ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন সুপথপ্রাপ্ত। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ لأَبِيْهِ آزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَاماً آلِهَةً إِنِّيْ أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ. ‘স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম পিতা আযরকে বললেন, তুমি কি প্রতিমাসমূহকে উপাস্য মনে কর? আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ও তোমার সম্প্রদায় প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় রয়েছ’ (আন‘আম ৭৪)

    অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

    وَلَقَدْ آتَيْنَا إِبْرَاهِيْمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِه عَالِمِيْنَ، إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيْلُ الَّتِيْ أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُوْنَ، قَالُوْا وَجَدْنَا آبَاءَنَا لَهَا عَابِدِيْنَ، قَالَ لَقَدْ كُنْتُمْ أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ.

    ‘ইতিপূর্বে আমরা ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দান করেছিলাম। আর আমরা তার সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলাম। যখন তিনি তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বললেন, এই মূর্তিগুলি কী, যাদের পূজায় তোমরা রত আছ? তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এদের পূজারী হিসাবে পেয়েছি। তিনি বললেন, তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছ’ (আম্বিয়া ২১/ ৫১-৫৪)। ইবরাহীম (আঃ) পিতা কর্তৃক শিরকের আহবানে সাড়া দেননি। কারণ তাঁর পিতা আল্লাহর বিরুদ্ধে আহবান করেছিল। আর রাসূল (ছাঃ) সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, لا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيةِ الخَالِقِ ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই’। [4]

    জীবিত থাকা অবস্থায় পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের ফযীলত :

    মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার জিহাদ অপেক্ষা উত্তম :

    দ্বীন রক্ষার জন্য অনেক সময় জিহাদে যেতে হয়। আর আল্লাহর পথে জিহাদের ফযীলত কত বেশী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এই ফযীলতপূর্ণ আমলের উপর মাতা-পিতার সেবা করাকে অগ্রধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন হাদীছে এসেছে-

    عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رضى الله عنهما  يَقُولُ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَاسْتَأْذَنَهُ فِى الْجِهَادِ، فَقَالَ : أَحَىٌّ وَالِدَاكَ ؟ . قَالَ : نَعَمْ . قَالَ: فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ-

    আব্দুল্লাহ বিন আমর হতে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসে জিহাদে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করল। তখন তিনি বললেন, তোমার পিতামাতা জীবিত আছেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। নবী (ছাঃ) বললেন, তবে তাঁদের খিদমতের চেষ্টা কর’।[5]

    হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হ’ল- ‘তোমার পিতা মাতা জীবিত থাকলে তাদের সেবা ও খিদমতে সর্বোচ্চ চেষ্টা ব্যয় কর। কারণ এটি জিহাদের স্থলাভিষিক্ত হবে’ (ফাৎহুল বারী ১০/৪০৩)। অন্য হাদীছে এসেছে,

    عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ أَقْبَلَ رَجُلٌ إِلَى نَبِىِّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: أُبَايِعُكَ عَلَى الْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ أَبْتَغِى الأَجْرَ مِنَ اللَّهِ. قَالَ : فَهَلْ مِنْ وَالِدَيْكَ أَحَدٌ حَىٌّ ؟ قَالَ نَعَمْ، بَلْ كِلاَهُمَا. قَالَ : فَتَبْتَغِى الأَجْرَ مِنَ اللَّهِ. قَالَ : نَعَمْ. قَالَ : فَارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا-

    আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আ‘ছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমি আপনার হাতে হিজরত ও জিহাদের জন্য বায়‘আত গ্রহণ করব। এতে আমি আল্লাহর কাছে পুরস্কার ও বিনিময় আশা করি। তিনি বললেন, তোমার মাতা-পিতার মধ্যে কেউ জীবিত আছেন কি? সে বলল, হ্যাঁ, বরং উভয়ে জীবিত আছেন। তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি আল্লাহর কাছে বিনিময় আকাঙ্খা করছ? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের দু'জনের সঙ্গে সদাচরণপূর্ণ জীবন যাপন কর’।[6]

    অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আমি তাদের উভয়কে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এরপরেও তুমি আল্লাহর নিকট পুরস্কার আশা কর?। লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার পিতা-মাতার নিকট ফিরে যাও ও সর্বোত্তম সাহচর্য দান কর এবং তাদের কাছেই (খিদমতে) জিহাদ কর’।[7] তিনি আরও বলেন,فَارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَأَضْحِكْهُمَا كَمَا أَبْكَيْتَهُمَا، وَأَبَى أَنْ يُبَايِعَهُ ‘তুমি তাদের কাছে ফিরে যাও। অতঃপর তাদেরকে হাসাও, যেমন তুমি তাদেরকে কাঁদিয়েছ। অতঃপর তিনি তার বায়‘আত নিতে অস্বীকার করলেন’।[8] অন্যহাদীছে এসেছে,

    عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ : أَنَّ رَجُلاً هَاجَرَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الْيَمَنِ فَقَالَ: هَلْ لَكَ أَحَدٌ بِالْيَمَنِ؟ قَالَ : أَبَوَاىَ. قَالَ : أَذِنَا لَكَ ؟. قَالَ : لاَ. قَالَ : ارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَاسْتَأْذِنْهُمَا فَإِنْ أَذِنَا لَكَ فَجَاهِدْ وَإِلاَّ فَبِرَّهُمَا-

    আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি ইয়ামন থেকে হিজরত করে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট চলে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ামনে তোমার কেউ আছে? সে বলল, আমার মাতা-পিতা আছেন। তিনি বললেন, তারা তোমাকে অনুমতি দিয়েছে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি তাদের নিকট ফিরে গিয়ে তাদের কাছে অনুমতি প্রার্থনা কর। তারা অনুমতি নিয়ে জিহাদে যাও। অন্যথায় তাদের সাথে সদাচরণে লিপ্ত থাক’।[9]

    এর দ্বারা বুঝা যায় যে, পিতা-মাতার সেবা কখনো কখনো জিহাদের চেয়ে উত্তম হয়ে থাকে। জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে সন্তানের উপর জিহাদে যাওয়া হারাম হবে, যদি তাদের মুসলিম পিতা-মাতা উভয়ে কিংবা কোন একজন জিহাদে যেতে নিষেধ করেন। কেননা তাদের সেবা করা সন্তানের জন্য ‘ফরযে ‘আইন’। পক্ষান্তরে জিহাদ করা তার জন্য ‘ফরযে কিফায়াহ’। যা সে না করলেও অন্য কেউ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের আমীরের হুকুমে’। [10]

    সর্বোত্তম আমল :

    বিভিন্ন হাদীছে বিভিন্ন আমলকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। কতগুলো ইবাদত রয়েছে আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট। আবার কতগুলো ইবাদত রয়েছে যা বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট। বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট ইবাদতগুলোর মধ্যে পিতামাতার সাথে সুন্দর আচরণ করা সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। যেমন হাদীছে এসেছে-

    عَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ سَأَلْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم  أَىُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ؟ قَالَ: الصَّلاَةُ عَلَى وَقْتِهَا. قَالَ:  ثُمَّ أَىُّ قَالَ : ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ . قَالَ : ثُمَّ أَىُّ قَالَ: الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ. قَالَ حَدَّثَنِى بِهِنَّ وَلَوِ اسْتَزَدْتُهُ لَزَادَنِى-

    আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন কাজ সর্বোত্তম? তিনি বললেন, সময় মত ছালাত আদায় করা। আমি বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বলেন, অতঃপর পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করা। আমি বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে আমি চুপ রইলাম। আমি যদি আরো বলতাম, তবে তিনি আরও অধিক বলতেন’।[11] উল্লেখ যে, আল্লাহর নিকট প্রিয় কাজের স্থানে কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, এমন আমল যা জান্নাতের নিকটবর্তী কারী, বা শ্রেষ্ঠ আমলের কথা বলা হয়েছে।[12] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা’।[13] এর দ্বারা বুঝা যায় যে, পিতা-মাতার সেবা করার স্থান ছালাতের পরে এবং জিহাদে গমন করার উপরে।

    আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায় :

    মায়ের যেমন সন্তানের নিকট বিশেষ মর্যাদা রয়েছে তেমনি পিতারও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পিতা যদি কোন বৈধ কারণে সন্তানের উপর অসন্তুষ্ট থাকেন, তাহ’লে আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যান। কারণ একজন সন্তানকে আদর্শবান হিসাবে গড়ে তুলতে পিতার আর্থিক ও মানসিক অবদান রয়েছে। যেমন হাদীছে এসেছে,

    عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : رِضَا الرَّبِّ فِى رِضَا الْوَالِدِ وَسَخَطُ الرَّبِّ فِى سَخَطِ الْوَالِدِ-

    আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি নবী (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,  ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহ তা'আলার অসন্তুষ্টি রয়েছে’।[14] অন্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, طَاعَةُ الله طَاعَةُ الْوَالِدِ وَمَعْصِيَةُ الله مَعْصِيَةُ الوَالِدِ ‘পিতার আনুগত্যে আল্লাহর আনুগত্য রয়েছে এবং পিতার অবাধ্যতায় আল্লাহর অবাধ্যতা রয়েছে’।[15] এই হাদীছের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী বলেন, মাতাও এর মধ্যে শামিল। বরং মায়ের বিষয়টি আরো গুরুত্ববহ। যেমন অন্য বর্ণনায় এসেছে- رِضَا اَللَّهِ فِي رِضَا اَلْوَالِدَيْنِ, وَسَخَطُ اَللَّهِ فِي سَخَطِ اَلْوَالِدَيْنِ ‘পিতামাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতামাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহ তা'আলার অসন্তুষ্টি রয়েছে’।[16] আল্লামা মানাবী বলেন, কেননা আল্লাহ সন্তানকে পিতার আনুগত্য ও তাকে সম্মান করতে আদেশ করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করল, সে বস্ত্ততঃ আল্লাহর সাথে সুন্দর আচরণ করল এবং তাঁকে সম্মান ও মর্যাদা দান করল। এতে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার আদেশকে অমান্য করবে তিনি তার প্রতি রাগান্বিত হবেন’ ।[17]

    জান্নাত লাভের উপায় :

    পিতামাতার আদেশ-নিষেধ পালন করলে এবং তাদের আদেশকে যথাযথভাবে হিফাযত করলে জান্নাত লাভ করা যায়। কারণ তারা সন্তানের জন্য জান্নাতে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। যেমন হাদীছে এসেছে-

    عَنْ أَبِى الدَّرْدَاءِ أَنَّ رَجُلاً أَتَاهُ فَقَالَ : إِنَّ لِى امْرَأَةً وَإِنَّ أُمِّى تَأْمُرُنِى بِطَلاَقِهَا. قَالَ أَبُو الدَّرْدَاءِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : الْوَالِدُ أَوْسَطُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ فَإِنْ شِئْتَ فَأَضِعْ ذَلِكَ الْبَابَ أَوِ احْفَظْهُ-

    আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি তার নিকটে এসে বলল, আমার স্ত্রী আছে। আর আমার মা আমার স্ত্রীকে তালাক দানের নির্দেশ দিচ্ছেন। এমতাবস্থায় আমি কি করব? জবাবে আবুদ্দারদা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে শুনেছি। তিনি বলেছেন, ‘পিতা হ’লেন জান্নাতের উত্তম দরজা। এক্ষণে তুমি তা রেখে দিতে পার অথবা বিনষ্ট করতে পার’।[18] অত্র হাদীছে পিতা দ্বারা জিনস তথা মাতা-পিতা উভয়কে বুঝানো হয়েছে’।[19]

    বয়স ও রিযিক বৃদ্ধি :

    পিতামাতার সাথে সদাচরণ করলে আল্লাহ বেশী বেশী সৎ আমল করার সুয়োগ দেন এবং আয়-রোজগারে বরকত দান করেন। যেমন হাদীছে এসেছে-

    عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُمَدَّ لَهُ فِى عُمْرِهِ وَأَنْ يُزَادَ لَهُ فِى رِزْقِهِ فَلْيَبَرَّ وَالِدَيْهِ وَلْيَصِلْ رَحِمَهُ

    আনাস ইবনু মারেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার আয়ু বৃদ্ধি কামনা করে ও নিজের জীবিকায় প্রশস্ততা চায় সে যেন তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে ও আত্মীয়দের সাথে উত্তম আচরণ করে’।[20]  সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, لاَ يَرُدُّ الْقَضَاءَ إِلاَّ الدُّعَاءُ وَلاَ يَزِيدُ فِى الْعُمُرِ إِلاَّ الْبِرُّ ‘তাক্বদীর পরিবর্তন হয় না দো‘আ ব্যতীত এবং বয়স বৃদ্ধি হয় না সৎকর্ম ব্যতীত’।[21] অর্থাৎ যে সব বিষয় আল্লাহ দো‘আ ব্যতীত পরিবর্তন করেন না, সেগুলি দো‘আর ফলে পরিবর্তিত হয়। আর ‘সৎকর্মে বয়স বৃদ্ধি পায়’ অর্থ ঐ ব্যক্তির আয়ুতে বরকত বৃদ্ধি পায়। যাতে নির্ধারিত আয়ু সীমার মধ্যে সে বেশী বেশী সৎকাজ করার তাওফীক লাভ করে এবং তা তার আখেরাতে সুফল বয়ে আনে (মিরক্বাত, মির‘আত)। কেননা মানুষের রূযী ও আয়ু আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। যাতে কোন কমবেশী হয় না’।[22]

    পিতামাতার খিদমত করা আল্লাহর পথে জিহাদরত থাকার সমতুল্য :

    মানুষ জীবনে সফল হওয়ার জন্য বিভিন্ন চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে থাকে। কেউ দুনিয়াতে সফল হয়। আবার কেউ ব্যর্থ হয়। কিন্তু পিতামাতার খিদমতে সময় ব্যয় করলে দুনিয়া এবং পরকালে নিশ্চিত সফলতা। তা ছাড়া এটি আল্লাহর পথে জিহাদের সমতুল্য। হাদীছে এসেছে,

    عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوسٌ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا شَابٌّ مِنَ الثَّنِيَّةِ فَلَمَّا رَأَيْنَاهُ بِأَبْصَارِنَا قُلْنَا : لَوْ أَنَّ هَذَا الشَّابَ جَعَلَ شَبَابَهُ وَنَشَاطَهُ وَقُوَّتَهُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ فَسَمِعَ مَقَالَتَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : وَمَا سَبِيلُ اللَّهِ إِلاَّ مَنْ قُتِلَ؟ مَنْ سَعَى عَلَى وَالِدَيْهِ فَفِى سَبِيلِ اللَّهِ، وَمَنْ سَعَى عَلَى عِيَالِهِ فَفِى سَبِيلِ اللَّهِ، وَمَنْ سَعَى عَلَى نَفْسِهِ لِيُعِفَّهَا فَفِى سَبِيلِ اللَّهِ، وَمَنْ سَعَى عَلَى التَّكَاثُرِ فَهُوَ فِى سَبِيلِ الشَّيْطَانِ-

    আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বসা ছিলাম। হঠাৎ করে একজন যুবক ছানিয়া নিম্ন ভূমি থেকে আগমন করল। তাকে গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করে বললাম, যদি এই যুবকটি তার যৌবন, উদ্যম ও শক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করত! বর্ণনাকারী বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদের বক্তব্য শুনে বললেন, কেবল নিহত হলেই কি আল্লাহর পথ? যে ব্যক্তি মাতা-পিতার খিদমতে চেষ্টা করবে সে আল্লাহর পথে। যে পরিবার-পরিজনের জন্য চেষ্টায়রত সে আল্লাহর পথে। যে ব্যক্তি নিজেকে গুনাহ থেকে রক্ষার চেষ্টায়রত সে আল্লাহর পথে। আর যে ব্যক্তি সম্পদের প্রাচুর্যতার চেষ্টায়রত সে শয়তানের পথে’।[23]

    পিতামাতার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলায় জান্নাত লাভ :

    পিতামাতার সাথে এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে তারা কোনভাবেই কষ্ট  না পান। আল্লাহর সৎ বান্দাদের বৈশিষ্ট্য হল তারা বিনয়ের সাথে চলে এবং নম্র্ ও ভদ্র ভাষায় কথা বলে। বিশেষতঃ পিতামাতার সাথে বিনয়ের সাথে কথা বললে জান্নাত লাভ করা যায়। হাদীছে এসছে-

    وَعَنْ طَيْسَلَةَ بْنِ مَيَّاسٍ  قال: كُنْتُ مَعَ النَّجَدَاتِ  فَأَصَبْتُ ذُنُوبًا لاَ أَرَاهَا إِلاَّ مِنَ الْكَبَائِرِ، فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِابْنِ عُمَرَ , قَالَ: مَا هِيَ؟ , قُلْتُ: كَذَا وَكَذَا، قَالَ: لَيْسَتْ هَذِهِ مِنَ الْكَبَائِرِ، هُنَّ تِسْعٌ: الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَقَتْلُ نَسَمَةٍ، وَالْفِرَارُ مِنَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ الْمُحْصَنَةِ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ، وَإِلْحَادٌ فِي الْمَسْجِدِ، وَالَّذِي يَسْتَسْخِرُ  وَبُكَاءُ الْوَالِدَيْنِ مِنَ الْعُقُوقِ , ثُمَّ قَالَ لِي ابْنُ عُمَرَ: أَتَفْرَقُ النَّارَ  وَتُحِبُّ أَنْ تَدْخُلَ الْجَنَّةَ؟ , قُلْتُ: إِي وَاللهِ، قَالَ: أَحَيٌّ وَالِدُكَ؟ , قُلْتُ: عِنْدِي أُمِّي، قَالَ: فَوَاللهِ لَوْ أَلَنْتَ لَهَا الْكَلاَمَ، وَأَطْعَمْتَهَا الطَّعَامَ، لَتَدْخُلَنَّ الْجَنَّةَ , مَا اجْتَنَبْتَ الْكَبَائِرَ-

    তায়সালা ইবনু মাইয়াস (রহঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিলাম। আমি কিছু পাপকাজ করে বসি যা আমার মতে কবীরা গুনাহর শামিল। আমি তা ইবনু ওমর (রাঃ)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তা কি? আমি বললাম, এই এই ব্যাপার। তিনি বলেন, এগুলো কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। কবীরা গুনাহ নয়টি। (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা, (২) নরহত্যা, (৩) জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন, (৪) সতী-সাধ্বী নারীর বিরুদ্ধে যেনার মিথ্যা অপবাদ রটানো, (৫) সূদ খাওয়া, (৬) ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করা, (৭) মসজিদে ধর্মদ্রোহী কাজ করা, (৮) ধর্ম নিয়ে উপহাস করা এবং (৯) সন্তানের অসদাচরণ যা পিতা-মাতার কান্নার কারণ হয়। ইবনে ওমর (রাঃ) আমাকে বলেন, তুমি কি জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে চাও? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ! আমি তাই চাই। তিনি বলেন, তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত আছেন? আমি বললাম, আমার মা জীবিত আছেন। তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! তুমি তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বললে এবং তার ভরণপোষণ করলে তুমি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদি কবীরা গুনাহসমূহ থেকে বিরত থাকো।[24]

    পিতামাতার সেবায় দুনিয়ায় বিপদমুক্তি ও পরকালে জান্নাত লাভ :

    পিতামাতার সেবা করলে বিপদের সময় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। দো‘আ করলে কবুল করেন এবং বিপদে রক্ষা করেন। যেমন বনী ইস্রাঈলের জনৈক ব্যক্তি পিতামাতার সেবা করার কারণে বিপদে সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যেমন হাদীছে এসেছে-

    আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, পূর্ব কালে তিন জন ব্যক্তি সফরে বের হয়। পথিমধ্যে তারা মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে পতিত হয়। তখন তিনজনে একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। হঠাৎ গুহা মুখে একটি বড় পাথর ধসে পড়ে। তাতে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তিন জনে সাধ্যমত চেষ্টা করেও তা সরাতে ব্যর্থ হয়। তখন তারা পরস্পরে বলতে থাকে যে, এই বিপদ থেকে রক্ষার কেউ নেই আল্লাহ ব্যতীত। অতএব তোমরা আল্লাহকে খুশী করার উদ্দেশ্যে জীবনে কোন সৎকর্ম করে থাকলে সেটি সঠিকভাবে বল এবং তার দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর। সম্ভবতঃ তিনি আমাদেরকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।

    তখন একজন বলল, আমার দুই বৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিলেন এবং আমার ছোট ছোট কয়েকটি শিশু সন্তান ছিল। যাদেরকে আমি প্রতিপালন করতাম। আমি মেষপাল চরিয়ে যখন ফিরে আসতাম, তখন সন্তানদের পূর্বে পিতা-মাতাকে দুধ পান করাতাম। একদিন আমার ফিরতে রাত হয়ে যায়। অতঃপর আমি দুগ্ধ দোহন করি। ইতিমধ্যে পিতা-মাতা ঘুমিয়ে যান। তখন আমি তাদের মাথার নিকট দুধের পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, যতক্ষণ না তারা জেগে ওঠেন। এ সময় ক্ষুধায় আমার বাচ্চারা আমার পায়ের নিকট কেঁদে গড়াগড়ি যায়। কিন্তু আমি পিতা-মাতার পূর্বে তাদেরকে পান করাতে চাইনি। এভাবে ফজর হয়ে যায়। অতঃপর তারা ঘুম থেকে উঠেন ও পান করেন। তারপরে বাচ্চাদের পান করাই। اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَفَرِّجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيهِ مِنْ هَذِهِ الصَّخْرَةِ ‘হে আল্লাহ! যদি আমি এটা তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহ’লে তুমি আমাদের থেকে এই পাথর সরিয়ে নাও’! তখন পাথর কিছুটা সরে গেল এবং তারা আকাশ দেখতে পেল।

    অতঃপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ সৎকর্মের কথা উল্লেখ করে বলল, হে আল্লাহ! যদি আমরা এগুলি তোমার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহ’লে তুমি আমাদের থেকে এই পাথর সরিয়ে নাও’! তখন পাথরের বাকীটুকু সরে গেল এবং আল্লাহ তাদেরকে মুক্তি দান করলেন’।[25]

    (ক্রমশঃ)

    [লেখক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ]

    [1]. আহমাদ হা/১৬১৪; তিরমিযী হা/৩১৮৯, সনদ ছহীহ।

    [2]. আনকাবূত ২৯/৮; ইবনু হিববান হা/৬৯৯২; শু‘আবুল ঈমান হা/৭৯৩২; তাফসীরে ইবনু কাছীর ৬/২৬৫, সনদ ছহীহ

    [3]. কুরতুবী হা/৪৮৪৯, ৪৮৫০; তিরমিযী হা/৩১৮৯, হাদীছ ছহীহ; ইবনু কাছীর ৬/৩৩৭।

    [4]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৩৬৬৪ ও ৩৬৯৬।

    [5]. বুখারী হা/৩০০৪; মুসলিম হা/২৫৪৯; মিশকাত হা/৩৮১৭।

    [6]. মুসলিম হা/২৫৪৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৪৮০।

    [7]. মুসলিম হা/২৫৪৯; মিশকাত হা/৩৮১৭ (৫-৬)।

    [8]. আবুদাঊদ হা/২৫২৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৪৮১।

    [9]. আবুদাউদ হা/২৫৩০; আহমাদ হা/১১৭৩৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৮৯২; ছহীহ আত-াতরগীব হা/২৪৮২।

    [10]. ত্বাহাবী, শারহু মুশকিলুল আছার ৫/৫৬৩; খাত্বাবী, মু‘আলিমুস সুনান ৩/৩৭৮।

    [11]. বুখারী হা/২৭৮২; মুসলিম হা/৮৫; মিশকাত হা/৫৬৮।

    [12]. মুসলিম হা/৮৫।

    [13]. তিরমিযী হা/১৭০; আহমাদ হা/২৭১৪৮; মিশকাত হা/৬০৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩৯৯।

    [14]. তিরমিযী হা/১৮৯৯; মিশকাত হা/৪৯২৭; ছহীহাহ হা/৫১৬।

    [15]. তাবারাণী. মু‘জামুল আওসাত্ব হা/২২৫৫; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৩৩৯১; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫০২।

    [16]. শু‘আবুল ঈমান হা/৭৮৩০; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৫০৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫০৩।

    [17]. ফায়যুল বারী হা/৪৪৫৬-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

    [18]. আহমাদ হা/২৭৫৫১; তিরমিযী হা/১৯০০; ইবনু মাজাহ হা/২০৮৯; মিশকাত হা/৪৯২৮; ছহীহাহ হা/৯১৪।

    [19]. মিরকাত ৭/৩০৮৯, ৪৯২৮ হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

    [20]. আহমাদ হা/১৩৪২৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৪৮৮

    [21]. তিরমিযী হা/২১৩৯; মিশকাত হা/২২৩৩; ছহীহাহ হা/১৫৪

    [22]. ক্বামার ৫৪/৫২-৫৩; আ‘রাফ ৭/৩৪; বুখারী হা/৬৫৯৪; মুসলিম হা/২৬৪৩; মিশকাত হা/৮২ ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ

    [23]. মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৪২১৪; শু‘আবুল ঈমান হা/৯৮৯২; ছহীহাহ হা/৩২৪৮

    [24]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/০৮, সনদ ছহীহ

    [25]. বুখারী হা/৫৯৭৪, ২৯৭২; মুসলিম হা/২৭৪৩; মিশকাত হা/৪৯৩৮ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘সৎকর্ম ও সদ্ব্যবহার’ অনুচ্ছেদ

     


    Comments

    Not using Html Comment Box  yet?

    No one has commented yet. Be the first!

    rss