• free web stats
  • At-Tahreek
    তাজদীদে মিল্লাত

    সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ : কিছু পরামর্শ

    ভূমিকা :

    ইসলাম শান্তির ধর্ম, সহনশীলতা ও পরম সহিষ্ণুতার ধর্ম। সন্ত্রাস, হানাহানি, জবরদখল, অনাচার, হত্যা, নির্যাতন ইত্যাদির সাথে ইসলামের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। বর্তমান বিশ্বের জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ভয়াবহ আতঙ্কের সাথে স্মরণীয় এক ভয়ংকর নাম। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন নামে বেনামে সন্ত্রাসীরা তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীরা তালেবান, আল-কায়েদা, জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম আইএস ইত্যাদি নামে পরিচিত। ধর্মের নামে জান্নাতে যাওয়ার মিথ্যা প্রলোভনে নিরীহ ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে সমাজের ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষতি সাধন করছে। যা ইসলামে হারাম ও নিষিদ্ধ। এদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। বর্তমান সময়ে উল্লেখিত সংগঠনের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের ফলে চরমভাবে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। মুসলিম হিসাবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সম্মিলিতভাবে এদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

    সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কারণ :

    সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন, সঠিক ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশের অভাব,  অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব এবং পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া , সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতির সয়লাব, বুদ্ধিবৃত্তিক সঠিক জ্ঞানের অভাব, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অবৈধ শক্তির বাড়াবাড়ি বা চরমপন্থা গ্রহণ, ক্ষতিকর ও ভ্রান্তচিন্তার মনস্তাত্ত্বিক কারণ, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অস্থিরতা ইত্যাদি।

    সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়সমূহ :

    (১) মসজিদের ইমাম, খত্বীব ও বক্তাদের ভূমিকা :

    ইমাম, খত্বীব ও বক্তাগণ সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তারা সমাজ সংস্কারে অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রশিক্ষক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সকল শ্রেণী পেশার শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই আলেম সমাজকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও মর্যাদার চোখে দেখেন এবং তাঁদের কথা অনুসরণে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে প্রতি সপ্তাহে জুম‘আর দিন নিয়মিতভাবে একটি এলাকার সকল মুসলিম জুম‘আর মসজিদে উপস্থিত হন। প্রতি বছর ৫২দিন এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। এই জুম‘আর খুৎবায় ইসলামের সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সকলকে সচেতন করা খুবই সহজ ও সুন্দর একটি ব্যবস্থা। যারা দেশে-বিদেশে ইসলামের নামে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তা অবশ্যই হারাম ও নিষিদ্ধ। এই হত্যাকান্ডের পরিণাম সম্পর্কে আমরা কি কেউ গভীরভাবে চিন্তা করেছি? এর মাধ্যমে স্ত্রীকে স্বামীহারা, পিতা-মাতাকে সন্তানহারা, সন্তানকে ইয়াতীম করছে, বোনকে ভাই হারা করছে এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিকে হত্যা করে গোটা পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যারা এ ধরনের নিরীহ ও সাধারণ মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করছে তারা অবশ্যই সমাজ, দেশ ও মানবজাতির দুশমন।  যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করে তাকে কোন খোড়া যুক্তিতে হত্যা করা যাবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের তরীক্বায় ছালাত আদায় করে, আমাদের কেবলাকে কেবলা বলে গ্রহণ করে এবং আমাদের যবেহ করা পশুর গোশত খায় সে ব্যক্তি মুসলিম। তার প্রতি (জান, মাল ও ইয্যত রক্ষার জন্য) আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর দায়িত্ব রয়েছে। অতএব তোমরা আল্লাহর দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করো না’।[1]  

    ইসলাম প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের নীতিকে সর্বদা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সমাজে ও দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গী কার্যক্রম সংঘটিত হওয়ার সকল সুযোগ ও সম্ভাবনাকে পূর্বেই বন্ধ করার সর্বাত্মাক চেষ্টা চালাতে হবে। কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে অন্তরের পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত পূর্ব যুগের অবাধ্য ও সন্ত্রাসী জাতির শোচনীয় পরিণতি এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সন্ত্রাসের পরিণাম সম্পর্কে ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিভিত্তিক বক্তৃতা, প্রতিবেদন, বই-পুস্তক লেখার মাধ্যমে, প্রেস, মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপনা করতে হবে। ইমামদের সাথে একত্রিত হয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কাজ করা আমাদের মানবিক ও ঈমানী দায়িত্ব।

    (২) পিতা-মাতা ও পরিবারকে সন্তান প্রতিপালনে যথাযথ দায়িত্ব পালন করা :

    পিতা-মাতা ও পরিবারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে যথাযথভাবে সন্তান প্রতিপালন করা। মহান আল্লাহ বলেন,

    يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا-

    ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও স্বীয় পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন হ’তে বাঁচাও’ (তাহরীম ৬৬/০৬)।

    রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি তোমার পরিবারের জন্য উপার্জিত সম্পদ হ’তে সমর্থ অনুসারে ব্যয় কর। পরিবার-পরিজনকে শিষ্টাচার শিক্ষাদানের ব্যাপারে শাসন থেকে বিরত থেকো না। আর মহান আল্লাহর ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদেরকে ভীতি প্রদর্শন কর’[2]

    সন্তান প্রতিপালনের প্রথম ধাপ হ’ল পরিবার। শিশু-কিশোরদের ব্যক্তিত্বগঠন ও সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবারই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সন্তানের দৈহিক, আর্থিক, বস্ত্তগত প্রয়োজন মিটায় তার পরিবার। যথা সময়ে সন্তান স্কুলে যাচ্ছে কি-না তার মেয়ে বন্ধু বা গার্লফ্রেন্ড আছে কি-না, অবসরে ও আড্ডাবাজীতে সন্তানেরা কোথায় কি করে, কখন কোথায় যায় এবং কখন বাসায় ফিরে, কোচিং ও প্রাইভেটের নাম করে অন্য কোথাও যায় কি-না, মাদরাসা ও স্কুলে কার্যকলাপের কোন পরিবর্তন হয়েছে কি-না ইত্যাদি সার্বিকভাবে তদারকি করা পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। পিতামাতা ও অভিভাবক যদি প্রকৃত ইসলামের সনিষ্ঠ অনুসারী হয় তাহ’লে সন্তানেরাও আদর্শ, সৎ ও সুন্দর চরিত্রের হবে ইনশাআল্লাহ। প্রাইভেট টিউটর, মাদরাসা ও স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ ফোন ও মোবাইল নাম্বার পিতামাতার সংগ্রহে রেখে প্রয়োজনে বিশেষ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সন্তানের প্রথম স্কুল তার পরিবার। পরিবার থেকে সন্তানের আচার-আচরণ, নিয়ম-কানূন, চরিত্র-মাধুর্য ও জীবন যাত্রার ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরিবারের প্রভাব তাই সুদূর প্রসারী। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য। পিতামাতা কর্মজীবী হওয়ায় অনেক পরিবারে সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব পড়ে গৃহপরিচারকা বা কাজের মেয়ে বা অন্য কারোও উপরে। ফলে সন্তান বঞ্চিত হয় পিতামাতার কাঙ্ক্ষিত আদর-সেণহ, ভালোবাসা ও মায়া-মমতা হ’তে। ফলে ছেলে-মেয়েরা নির্দয় ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়। দিনের অধিকাংশ সময় অন্যদের সাথে মিশে মারামারি, হানাহানি ও সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়। তাই সময়মত তাদের শিক্ষা ও শাসন না করলে সন্তান পিতামাতার অবাধ্য হয়ে সহিংস ঘটনা ঘটাবে এটাই স্বাভাবিক।

    তারা খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে নেশায় বুদ হয়ে এক সময় নেশার টাকা জোগাড় করতে ছিনতাই, রাহাজানির পথ বেছে নেয়। চাকু থেকে শুরু করে আগেয়াস্ত্রের ব্যবহার শেখে দিনে দিনে। এক সময় সে শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়। পিতামাতা ও পরিবারের বিশেষ নযরদারীর মাধ্যমেই সঠিক পথে সন্তানকে পরিচালনা করলে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। 

    (৩) সামাজিক সম্প্রীতি ও কাউন্সিলিং-এর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন :

    সন্ত্রাস সৃষ্টিতে সামাজিক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বর্তমান সমাজে অন্যায়-অত্যাচার, অশান্তি, যুলুম-নির্যাতন, অপহরণ, গুম-খুন-হত্যা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সামাজিক রীতিনীতির জটিলতা, অস্থিরতা ও মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদির কারণে হতাশ হয়ে অথবা নেশার কারণে অনেক কিশোর ও যুবক সন্ত্রাসী কাজে উৎসাহিত হয়। সামাজিক অনুশাসন ও শৃঙ্খলা দ্রুতবেগে বিলুপ্ত হচ্ছে। সমাজে সুখ-শান্তির সুনির্মল পরিবেশ দিনের পর দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অশান্তির অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দাউ দাউ করে জ্বলছে। সমাজের শান্তিকামী মানুষের হৃদয়ে হাহাকার করছে নির্যাতিত মানবতার নিষ্পিষ্ট আত্মা। অর্থনীতির নামে সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদের হিংস্র ছোবলে মানুষ আয়-রোযগারের প্রকৃত বরকত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মত ও মতবাদের অন্ধ অনুকরণ ও রাজনৈতিক হানাহানিতে সমাজ আজ কলুষিত। মানুষ সাধারণত অনুকরণ প্রিয়। সমাজের প্রভাবশালীদের আচার-আচরণ, রুচি ফ্যাশনের প্রতি মানুষের মন সাধারণত আকৃষ্ট হয়। ফলে এই উচ্চাভিলাষ বাস্তাবায়নের অর্থ যোগাড় করতে সন্ত্রাসী হ’তে হয়। একটি এলাকার ধনী-গরীব, ছোট-বড়, পুরুষ-নারী সবাইকে নিয়ে সমাজ গঠিত হয়। আমরা এমন একটি সুন্দর সমাজ করতে চাই, যেখানে থাকবে না কোন হিংসাত্মক মনোভাব, থাকবে না মারামারি, হানাহানি, হবে না ভয়ংকর আক্রমণ। সম্মান, শ্রদ্ধা, সেণহ, ভালবাসা ও স্বতঃস্ফুর্ত আনুগত্যের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানই আমাদের কাম্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হবে’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। সমাজে বসবাসরত সকলে পরস্পর ভাই ভাই। এই কুরআনের আদর্শে আদর্শিত হয়ে দূষিত ও অশান্ত এই সমাজ শান্তির ফুল্গুধারা প্রবাহের জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অতি যরূরী। এতে সামাজিক শান্তি যেমন ফিরে আসবে। সেই সাথে সমাজ থেকে  সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দূর করা সম্ভব হবে। 

    (৪) সকলস্তরে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা চালু করা :

    শিক্ষা মানুষকে প্রকৃত মানুষ বানায়। বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানী, অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ হিসাবে তৈরী করে। শিক্ষা একজন মানুষকে পরিবার ও সমাজে নৈতিকতাপূর্ণ ও বিবেকসম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে। প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের সকল স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা এবং প্রকৃত ইসলামী আদর্শ ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের প্রথম নাযিল কৃত শব্দ ইক্বরা অর্থ তুমি পড়। জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের উন্নতি, অগ্রগতি ও সফলতার জন্য নৈতিকতাপূর্ণ ও আদর্শভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ - ‘শিক্ষা অর্জন করা সকল মুসলিমের জন্য ফরয’।[3] বর্তমান সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি সারা বিশ্ব চরম হুমকির মুখে। এটা একটি চরম দুর্যোগ। যার উৎপত্তি চরমপন্থী মতাদর্শ ও ভুল শিক্ষা থেকে। আমাদের সমাজের কেউ কেউ ইসলামের অপব্যাখ্যা ও ভুল শিক্ষার মাধ্যমে যেমন পীরের দরগা ও মাযারে গিয়ে সিজদা ও মানত করে, তাবীজ, কড়ি ও সুতা গলায় ঝুলিয়ে শিরকে লিপ্ত হয়। আবার কেউ কেউ কুরআন হাদীছের ভুল ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার নামে সাধারণ ও নিরীহ মুসলমানদের রক্ত ঝরায় ও বাড়ী-ঘর ধ্বংস করে । এটা চরম অন্যায় ও মানবতা বিরোধী অপরাধ।

    চিকিৎসা বিজ্ঞান একজন ছাত্রকে ডাক্তার বানায় আর প্রকৌশল শাস্ত্র একজন ছাত্রকে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গড়ে তোলে। অনুরূপভাবে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বানায়। যেমন, হাফেয, ক্বারী, মুফতি, মুহাদ্দিছ, মুফাসি্সর ইত্যাদি। ডাক্তার যেমন ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করতে পারে না, ঠিক তেমনি ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তারের কাজ করতে পারে না। প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে সঠিক আলেম হওয়া যায় না। সঠিক ইসলামী জ্ঞান না থাকায় অপব্যাখ্যা করে মানুষকে ভিন্নপথে পরিচালিত করে অথচ শিক্ষা মানুষকে ভালোবাসা মায়া-মমতা ও সহমর্মিতা শেখায়। ইসলামী শিক্ষা Tit for tat ‘আঘাতের পরিবর্তে আঘাত নয়’  Marcy for tat  ‘আঘাতের পরিবর্তে ক্ষমা’ করতে শেখায়। ইহুদী গোলাম নবী করীম (ছাঃ)-কে সেবা করেছে। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) কখনো তাকে ইসলাম কবুলের জন্য চাপ দেননি।[4]

    যে ছাত্র কৈশোর ও যৌবনের এই সংশয়াচ্ছন্ন বয়সে সঠিক ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশনা পেয়েছে প্রকৃত আদর্শবান মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছে সেই জীবনে সঠিক চলার পথ পেয়েছে।  সেই সৌভাগ্যের অধিকারী। এই শিক্ষাই পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।

    (৫) সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে শিক্ষকদের ভূমিকা :

    বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদালয়ের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু বিপথগামী ছাত্ররা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা ও জান্নাতের মিথ্যা প্রলোভনে বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ হত্যা করছে। যার বদনাম গোটা ছাত্রসমাজের উপর বর্তায়। শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর। একজন আদর্শ শিক্ষা ছাত্রদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশ ও জাতিকে সুউচ্চ আসনে পৌছ দিতে পারে। তাই শিক্ষকদেরকে মুকুটহীন সম্রাট বলা হয়। একজন আদর্শ শিক্ষকের সাহচর্যে এসে ছাত্রছাত্রীরা হবে আচার-ব্যবহারে বিনয়ী, ন্যায় পরায়ণ, মার্জিত সৎ ও চরিত্রবান। তারা কখনও মারামারি, খুন-খারাবী, জঙ্গীবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হ’তে পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[5] বর্তমান বেশীরভাগ শিক্ষকেরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা ভুলে যান। তাঁরা ছুটছেন অর্থের পিছনে প্রাইভেট, কোচিং ও  ব্যাচ নিয়ে ভাবেন। আবার কোন কোন শিক্ষক ছাত্রীদের সাথে অশালীন ও নির্লজ্জ আচরণ করছে যা মাঝে-মধ্যে পত্রিকার পাতায় পাওয়া যায়।

    পূর্বে এদেশের কিছু বুদ্ধিজীবিদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল মাদরাসার ছাত্ররাই জঙ্গী ও সন্ত্রাসী হয়। বর্তমানে এ ধারণা ভুল ও অশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাদরাসার ছাত্রদের আরও বেশী সচেতন হ’তে হবে যেন তারা কোন প্রকার খারাপ কাজে লিপ্ত না হয়।

    শিক্ষদের প্রতি আমার সবিনয় নিবেদন, আপনাদের উপর দেশ ও জাতি গড়ার এ মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আপনারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে আপনাদের দায়িত্ব পালন করুন। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে আপনাদের ভূমিকাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর হবে। আপনাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে। অতএব আপনারা এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখুন। 

    সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ নিরসনে আরও কিছু করণীয় :

    (১) বর্তমান বিশ্বে ওআইসিভুক্ত ৫৭টি মুসলিম দেশ থাকা সত্বেও মুসলিমরা আজ চরম ইমেজ সংকটে। মুসলিমদের সঠিক চেতনা ও ইমেজ সংকটকে ফিরিয়ে আনতে বিশ্বের সকল সাধারণ মুসলিমের কিছু না কিছু দায়িত্ব রয়েছে এবং ওআইসিকে এজন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

    (২) আমাদের দেশ তথা বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমাজের সৎ, যোগ্য, দাঁড়ি-টুপিওয়ালা, কুরআন ও হাদীছে অভিজ্ঞ মানুষগুলো এবং বোরকা ও নেকাব পরা ভদ্র মহিলাগণ সন্দেহের তীরে পরিণত হয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্ট চালাতে হবে। অন্যদিকে অযোগ্য নীতিভ্রষ্ট কিছু আলেম নামধারী ব্যক্তিরা দুনিয়াবী স্বার্থে কুরআন ও হাদীছের অপব্যাখ্যা করে কিছু যুবকদের পথভ্রষ্ট করছে। এর বিরুদ্ধে গোটা যুবসমাজ ও সম্মানিত ওলামাদের এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

    (৩) সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কারণ বহুবিধ ও বহুমাত্রিক। দেশ, জাতি, বর্ণ ও সাংস্কৃতির কবলে পড়ে সময়ে সময়ে এর রূপ বদলায়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। কেননা সব ধর্মীয় মূল্যবোধ সন্ত্রাসকে ঘৃণা করে এবং তাদের শাস্তি কামনা করে। সন্ত্রাস মহা অপরাধ এবং এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সকলকে সচেতন করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকেও তাদের স্ব স্ব ধর্মীয় বিধান শিক্ষাদান ও তা মেনে চলতে উৎসাহিত করতে হবে।

    (৪) সামাজিক সম্প্রীতি ও কাউন্সিলিং-এর মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ থেকে সৎকর্ম করার জন্য উৎসাহিত করণ, অসৎ কর্ম, অপরাধ ও সন্ত্রাসের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির জন্য বিশেষ কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে।

    (৫) বস্তিবাসী দরিদ্র ও অবহেলিত পথশিশুদের যথাযথভাবে প্রতিপালননের ব্যবস্থা করা এবং তাদের সার্বিক কল্যাণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারলে সন্ত্রাস অনেকটা কমে আসবে।

    (৬) গান-বাজনা, নাটক ও মারদাঙ্গা সিনেমার পরিবর্তে সুস্থ, সুন্দর ও নৈতিকতাপূর্ণ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা। ফলে সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি, মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হবে।

    (৭) শিশু-কিশোর, ছাত্র ও যুবকদের সাথে সমাজের সকল উচ্চ পর্যায়ের নেতা, দায়িত্বশীল ও সংগঠকদের সাথে সরাসরি মত বিনিময় ও সৌহাদ্যপূর্ণ আলোচনার প্রেক্ষিতে তাদের হাতাশা কেটে যাবে এবং খারাপ চিন্তা, ধারণা ও মত থেকে ফিরে আসবে।

    (৮) সীমান্তরক্ষীদের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র, বোমা ও বিস্ফোরক তৈরীর সরঞ্জামাদি প্রবেশাধিকারে কঠোর নযরদারীর ব্যবস্থা করলে সন্ত্রাস অনেকাংশে কমে আসবে।

    উপসংহার : ইসলাম শান্তি-মৈত্রী, সম্প্রীত-সম্ভাব, উদারতা, পরমসহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার ধর্ম। ইসলাম শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি ও বিশুদ্ধ চেতনার কারণে মানুষ সৃষ্টির সেরা। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সময় হ’ল কৈশোর ও যৌবন কাল। জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা ভাল-মন্দ, সুশিক্ষা-কুশিক্ষা, আচার-আচরণ ইত্যাদির সূচনালগ্ন ও সঠিক চেতনার উন্মেষ ঘটে এ সময়েই। সন্ত্রাস ও জাঙ্গীবাদে জড়িত বিপথগামী তরুণরা আমাদের এই সমাজের পিতা-মাতার আদরে বেড়ে উঠা সন্তান। তাদেরকে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা আমাদের সকল পরিবার, সমাজ, সংগঠন ও রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। গুটি কয়েক পথভ্রষ্ট তরুণদের নেতিবাচক ঘৃণিত কাজের জন্য মুসলিম জাতি সারা বিশ্বে অপমানিত, লাঞ্চিত ও নির্যাতিত হ’তে পারে না। এসব যুবকদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন (১) সুষ্ঠু পরিবেশ (২) ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ এবং (৩) সুষ্ঠু ও ঝামেলা মুক্ত কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা করা। প্রথমটির জন্য প্রয়োজন যোগ্য পিতা-মাতা, সেণহশীল, পরিবার ও সৎসঙ্গ বা ভাল বন্ধু। আর দ্বিতীয়টির জন্য প্রয়োজন প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার সুব্যবস্থা করা এবং তৃতীয়টির জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু সমাজ ও সুশৃংখল রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যারা মানুষ হত্যা করে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, বোমাবাজি করে, অবরোধ, ভাংচুর ও লুটতরাজ করে তাদের সাথে প্রকৃত ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তারা ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু। যাদের কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবতা।

    সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামল সুন্দর এই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির শনৈঃশনৈ বৃদ্ধি পাক সেজন্য নিজেকে উৎসর্গ করি। এই হৌক আমাদের জীবনের ব্রত। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!

    [লেখক : প্রথম কেন্দ্রীয় পরিচালক, সোনামণি]

    [1]. বুখারী হা/৩৯১; মিশকাত হা/১৩।

    [2]. আহমাদ হা/২২১২৮; আদাবুল মুফরাদ হা/১৮; মিশকাত হা/৬১।

    [3]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮।

    [4]. বুখারী হা/১৩৫৬।

    [5]. বুখারী হা/৮৯৩, মুসলিম হা/৪৮২৮, মিশকাত হা/৩৬৮৫

     

     


    Comments

    Not using Html Comment Box  yet?

    No one has commented yet. Be the first!

    rss