পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন ও তা থেকে মুক্তির উপায়
ভূমিকা :
বর্তমান প্রযুক্তির যুগ। দিন দিন তার চরম উন্নতি সাধিত হচ্ছে। যার মাধ্যমে গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَالْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ ‘তোমাদের আরোহণ ও শোভা বর্ধনের জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন এমন বহু কিছ,ু যা তোমরা অবগত নও’ (নাহল ১৬/৮)। আজ প্রযুক্তির যুগে টিভি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, ভাইভার, ইমো ইত্যাদি মানুষ ব্যবহার করছে। এগুলি সম্পর্কে পূর্বের মানুষ কিছুই জানত না। আগামীতে কি আবিষ্কার হবে তা আজকের যুগের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। মূলত এগুলি সবই আল্লাহর সৃষ্টি। এ মর্মে তিনি বলেন, وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ ‘অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে এবং যা কিছু তোমরা কর সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৬)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছু’(বাক্বারাহ ২/২৯)। প্রযুক্তির মাধ্যমগুলি আল্লাহ মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করলেও আজ বিশেষভাবে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী ঐগুলির অপব্যবহার করে ধ্বংসের অতল তলে হারিয়ে যাচ্ছে। ঐগুলির অপব্যবহার দিন দিন তুফানের গতিতে বেড়ে চলেছে। যার ফলে নীতি-নৈতিকতায় ধস নামছে। লেখাপড়া, পরিবারের কাজ পশ্চাতে রেখে এবং আল্লাহকে ভুলে অধিকাংশ মানুষ টিভি, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউবের অপব্যবহারে মেতে উঠেছে। কবির ভাষায়,
‘তথ্য প্রযুক্তি যখন এগিয়ে চলেছে তখনো আমরা পিছে,
চলচ্চিত্র আর পর্ণোগ্রাফী আমরা ধরেছি কষে’।
আজ আমরা এমন একটা যুগে পৌঁছেছি, যে যুগে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা দেদারছে বেড়ে চলছে। অশ্লীলতার অন্যতম জগত হ’ল মিডিয়া জগত। যার স্রোতে ভাসছে লক্ষ-কোটি যুবক-যুবতী। পর্নোগ্রাফি আজ লক্ষ কোটি যুবক- যুবতীকে কুঁরেকুঁরে নিঃশেষ করছে। নষ্ট করছে উন্নত মন-মানসিকতা তৈরী করছে উদাসীন যৌন বিকারগ্রস্ত মানুষে। কলুষিত করছে নৈতিক চরিত্রকে। ইসলামের শত্রুরা নীরব এ যুদ্ধের মাধ্যমে ধ্বংস করছে পরিবার, রাষ্ট্র ও গোটা বিশ্ব। এরই মাধ্যমে খুলছে হাযারও পাপের রাস্তা। যে রাস্তা ধরে শত শত যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী চলছে জাহান্নামের পথে। ফলে নোংরামী, অশ্লীলতা, পর্ণোগ্রাফী জাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা প্রত্যেক জাতির জন্য যুবসমাজ হ’ল আশার আলো। তারা যদি ধ্বংস হ’য়ে যায় তাহ’লে জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। তাই আমরা মুসলিম যুবক-যুবতীর উদ্দেশ্যে অশ্লীল পর্ণোগ্রাফীর ক্ষতিকর দিক ও তা থেকে বাঁচার উপায় পথ তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাল্লাহ।
পর্ণোগ্রাফী কি :
Pornography শব্দটি ইংরেজী। যা গ্রিক শব্দ ‘পর্নোগ্রিফয়া’ থেকে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হ’ল রচনা, ছবি ইত্যাদিতে অশ্লীল বিষয়ের অবতারণা ও পরিচর্যা, অশ্লীল চিত্র, অশ্লীলবৃত্তি, অশ্লীল সামগ্রী।[1] এটা সংক্ষেপে ‘পর্ণো’ হিসাবে ব্যবহার হয় ।
পর্ণোগ্রাফী বলতে বুঝায়, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য। যা চলচ্চিত্র, স্থির চিত্র, গ্রাফি∙ যার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই।[2]
পর্নোগ্রাফি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে। যেমন বই, সাময়িকী, পোষ্টকার্ড, আলোকচিত্র, অঙ্কন, পেইন্টিং, চলচ্চিত্র, ভিডিও, ভিসিআর, টিভি, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট প্রভৃতি।
মোদ্দাকথা হ’ল বই, ম্যাগাজিন, ছবি, ফিল্ম, প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া মারফত যৌন বিষয়ক কোন দৃশ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে যৌন সুড়সুড়ি দেয়া ও যৌন চাহিদা চরিতার্থ করার মানসে যৌন উন্মাদনা সৃষ্টিই হ’ল পর্নোগ্রাফি ।
পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির উদ্দেশ্য :
বিশ্বে ইন্টারনেটের ব্যবহার চালু হয় ১৯৬৯ সালে। বাংলাদেশে চালু হয় ১৯৯৩ সালে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৯৯৬ সালে। ইন্টারনেটের ব্যবহার জনপ্রিয়তা লাভ করছে পর্ণোগ্রাফীর প্রসারতার কারণে। পর্ণোগ্রাফী তৈরীতে এক নম্বরে রয়েছে আমেরিকা এবং দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জার্মানী। ইন্টারনেটে সর্বমোট পর্ণো আছে ৪.৬ মিলিয়ন এবং পর্নো পেইজ রয়েছে ৪৫০ মিলিয়ন। দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পর্ণোগ্রাফী ব্যবহারে বাংলাদেশের জনগণ পিছিয়ে নেই। স্মার্টফোন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট আর স্পিড ডাটা সার্ভিস পর্ণো ভিডিও আদান-প্রদানের বিষয়টিকে সহজ করেছে। ফলে প্রতি ৩২ সেকেন্ডে একটি নতুন পর্ণো খোলা হচ্ছে। অনায়াসে তা স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রী থেকে সিনিয়র কর্পোরেট অফিসার পর্যন্ত সবার কাছে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে। নোংরা, অশ্লীল পর্ণোগ্রাফী এমনই একটি মাল্টি ট্রেড ইন্ডাস্ট্রি যার উদ্দেশ্যই হ’ল সকল শ্রেণীর মানুষ অর্থাৎ নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীর সামনে তাদের নোংরামি, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা, যেনা-ব্যভিচারের দৃশ্য বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ঢং-এ উপস্থাপন করা। ২০০৬ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতি সেকেন্ডে সার্চ ইঞ্জিনে পর্ণো খুঁজছে ৩৭২ জন। এখন তো আরো অনেক অনেক গুণ বেড়েছে।
পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন :
মানুষকে পরিণত করছে অমানুষে :
মহান আল্লাহ মানুষ সম্পর্কে বলেন, وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُم ‘তিনি (আল্লাহ) তোমাদের আকৃতি গঠন করেছেন এবং তোমাদের আকৃতি করেছেন উৎকৃষ্ট’ (মু’মিন ৪০/৬৪)। তিনি আরো বলেন, لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ ‘অবশ্যই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম অবয়বে’ (তীন ৯৫/৪)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ ‘আমরা আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৭০)।
মূলত আল্লাহ সকল সৃষ্টির উপর মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন দু’টি কারণে ১. কামনা-বাসনা ও বুদ্ধি-চেতনার দিক দিয়ে । ২. ঈমান ও সৎকর্মশীলতার দিক দিয়ে।[3] কিন্তু আজ অধিকাংশ মানুষ নোংরামি, অশ্লীলতা, পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসনের শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত ঈমান হারাচ্ছে, সৎকর্মের কথা ভুলে যাচ্ছে এবং পশুর মত আচরণ করছে। পশু যেমন একটা অন্যটাকে ধরে খায়, প্রকাশ্যে যৌনাচারে লিপ্ত হয়, যা ইচ্ছা তাই করে। শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষও দিন দিন অনুরূপ হিংস্র হয়ে উঠছে। সম্পতি রাজধানীর অভিজাত রেইনট্টি হোটেলের ঘটনা এর একটি জ্বলন্ত, উদাহরণ। এমন বৈশিষ্ট্যের মানুষকে আল্লাহ পশু বলেছেন বা তার চেয়ে খারাপ বলেছেন (আ‘রাফ ৭/১৭৯, ফুরক্বান ২৫/৪৪)।
পবিত্র আত্মা নিঃশেষ করছে :
যে মানুষের আত্মা অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে যত বেশী পবিত্র, সে তত বেশী সুখী মানুষ। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلَا وَهِيَ الْقَلْبُ ‘দেহের মধ্যে এমন একটি টুকরা আছে, যা ভালো হ’লে সারা দেহ ভাল হয়। আর যদি তা নষ্ট যায় হয় তাহ’লে সারা দেহ নষ্ট হয়ে যায়। আর তা হ’ল হৃৎপিন্ড বা আত্মা’।[4] অশ্লীল পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন আজ অসংখ্য যুবক-যুবতীর দেহের ঐ টুকরাটিকে অর্থাৎ আত্মাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। যার অন্তরে ন্যূনতম ঈমান আছে তার অন্তর অন্যায়ে লিপ্ত হওয়ার সময়ে কেঁপে ওঠে। আর অন্যায় ও পাপ মানুষের অন্তর-আত্মায় মরিচা ধরিয়ে দেয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘কখনই না। বরং তাদের অপকর্মসমূহ তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে’ (মুত্বাফফেফীন (৮৩/১৪)। দিন দিন অশ্লীল-পর্ণোভোক্তাদের অন্তরে মরিচা অধিক বেড়েই চলেছে। ফলে বহু সংখ্যক পর্ণোভোক্তা এটাকে আর পাপ মনে করছে না। এজন্যই অশ্লীলতা তাদের অন্তর-আত্মাকে অশান্তি, অস্থিরতা, উদাসীনতার সাগরে চুবিয়ে চুবিয়ে নিঃশেষ করছে। আর এর একমাত্র প্রতিষেধক হ’ল প্রকৃত ঈমান ও আল্লাহর যিকর। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ-
‘যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করলে যাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। মনে রেখ, আল্লাহর স্মরণেই কেবল হৃদয় প্রশান্ত হয়’ (রা‘দ ১৩/২৮)।
যৌন বিকার সৃষ্টি :
ইন্টারনেট জগতে ছড়িয়ে আছে লাখ, কোটি যৌন দৃশ্য। যা ইন্টারনেট খুললেই চোখে পড়ে। যা দেখে প্রতিনিয়ত যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী মারাত্মকভাবে যৌনাসক্ত হয়ে পড়ছে। যৌনতা চরিতার্থ করার জন্য তারা বেছে নিচ্ছে অবৈধ পথ। বিবাহ পূর্ব অবৈধ প্রণয়ে ফেঁসে গিয়ে তারা চোখ, হাত, জিহবা ও যৌনাঙ্গের ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে। আবার পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। যা তাদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا الَّذِينَ فَسَقُوا فَمَأْوَاهُمُ النَّارُ ‘পক্ষান্তরে যারা অবাধ্য হয়, তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম’ (সাজদাহ ৩২/২০) ।
যেনা-ব্যভিচারের দ্বার উন্মুক্ত :
পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার একটি নিদর্শন হ’ল ব্যভিচার বৃদ্ধি পাওয়া। ব্যভিচার এমন একটি মারাত্মক অপরাধ যা ব্যক্তির মান-সম্মান, ইয্যত-আব্রুকে ধ্বংস করে। সমাজ কলুষিত করে। মহান আল্লাহ এ অপরাধের দ্বার চিরতরে বন্ধের নির্দেশ দিয়ে বলেন, وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا ‘তোমারা যেনা-ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। কারণ তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৩২)। মহাপাপের মধ্যে অন্যতম পাপ হ’ল ব্যভিচার।[5] আল্লাহ এ পাপ থেকে দূরে থাকতে বললেও অশ্লীল-পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন আজ উক্ত পাপে উৎসাহিত বা প্ররোচিত করছে। ফলে এ পথে জড়িত তরুণ-তরুণীর ও যুবক-যুবতীর জীবনে নেমে আসছে এইডস এর মত সংক্রামক ব্যাধি। পরকালে এ শ্রেণীর মানুষ জ্বলবে জাহান্নামের আগুনে।
বেহায়াপনায় উদ্বুদ্ধ করণ :
টিভিতে, ইন্টারনেটে, ফেসবুকে, ইউটিউবে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলপ©র্ণা ও অমুসলিম নারীদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন এ দেশের শত শত মুসলিম নারীদেরকে নগ্ন-অর্ধনগ্ন, বেহায়া ও নির্লজ্জ হ’তে উদ্বুদ্ধ করছে। অথচ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيحَهَا وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا ‘দু’শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামী। যাদেরকে আমি দেখিনি। তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর হচ্ছে এমন লোক যাদের হাতে থাকবে গরুর লেজের মত লম্বা চাবুক। যা দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে এমন মহিলারা যারা হবে কাপড় পরিহিতা, অথচ উলঙ্গ। অন্যকে আকর্ষণকারিণী এবং নিজেও হবে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট। তাদের মাথা হবে খুরাসানী উটের ঝুলে পড়া কুঁজের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি তার সুগন্ধও পাবে না। অথচ যার সুগন্ধ অনেক অনেক দূর থেকে পাওয়া যাবে’।[6] সুতরাং অশ্লীল, নগ্ন-অর্ধনগ্ন বিভিন্ন মডেলের পোশাক ও পর্ণো আজ নারী জাতিকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ার খপ্পরে পড়ে বা ফ্যাশনের নামে নগ্ন পোশাকে রয়েছে নারী জাতির জন্য প্রজ্জ্বলিত জাহান্নামের দুর্গন্ধ।
বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ড গ্রহণ :
বর্তমান যুগের অধিকাংশ মানুষ ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহার করছে। অসংখ্য যুবক-যুবতী এগুলি ব্যবহার করছে নোংরামি ও অশ্লীলতা দেখে ও অনুকরণের কাজে। যার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সিনেমায় বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ড গ্রহণের দৃশ্য দেখে আজ হাযার হাযার যুবক গ্রহণ করছে এক বা একাধিক গার্লফ্রেন্ড। অনুরূপভাবে যুবতীরাও গ্রহণ করছে এক বা একাধিক বয়ফ্রেন্ড। স্ত্রী থাকার পরেও নাকি গার্লফ্রেন্ড গ্রহণ করা যুগের ফ্যাশন। ধিক! শত ধিক! উক্ত ফ্যাশনকে। শরী‘আতের দৃষ্টিতে এটি মারাত্মক পাপের কাজ। কারণ এর মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় নানা পাপ। ধ্বংস হয় যুব চরিত্র। যদিও মুক্তমনা যুবক-যুবতীর কাছে এ পাপ কোন পাপই নয়। তাই ধর্মের এ বাণী তাদের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। তবে একথাও চূড়ান্ত সত্য যে, এ পাপই তাদেরকে আর্থিক, শারীরিক ও মানসকিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে এবং পরকালে তো ক্ষতিগ্রস্ত করবেই।
অশ্লীল Apps-এর ব্যবহার :
রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَا كَانَ الْفُحْشُ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلا شَانَهُ ، وَلا كَانَ الْحَيَاءُ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلا زَانَهُ ‘কোন বিষয়ের মধ্যে অশ্লীলতা বা নোংরামি থাকলে তাকে নোংরা করে তোলে’। আর কোন বিষয়ের মধ্যে লজ্জা থাকলে সে তা তাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে’।[7] আধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে হাতের মুঠো ফোনে, কম্পিউটারে, ল্যাপটপে শত-শত যুবক-যুবতী অশ্লীল নোংরা Apps- সেভ করে রেখে নিজের ইচ্ছামত নির্জনে তা দেখে দেখে নিজের জীবন, যৌবন ও মেধা শেষ করছে। এটা কুঁরেকুঁরে খাচ্ছে তাদের মগজকে।
ঘরে ঘরে ফিতনা সৃষ্টি :
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (ছাঃ) ইরশাদ করেন, فَإِنَّهُ لَا يَأْتِي عَلَيْكُمْ زَمَانٌ إِلَّا الَّذِي بَعْدَهُ شَرٌّ مِنْهُ حَتَّى تَلْقَوْا رَبَّكُمْ ‘সামনে যতদিন আসবে তা পূর্বের চাইতে আরো (বেশী) খারাপ হবে যতক্ষণ না তোমরা নিজ প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করবে।[8] উম্মে সালামা (রাঃ) ইরশাদ করেন, একদা তিনি রাত্রি বেলায় ভয়ে ও আতঙ্কে ঘুম থেকে জেগে গিয়ে বললেন, আশ্চর্য! কতই-না ফিৎনা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন।[9] আবু মুসা আশ‘আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) ইরশাদ করেন, إِنَّ بَيْنَ يَدَىِ السَّاعَةِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ ‘কিয়ামতের পূর্বে অন্ধকার রাতের মতো বহু ফিৎনা দেখা দিবে।[10] অত্র হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় দুনিয়া নিঃশেষ হওয়ার পূর্বে অন্ধকার যেমন সব কিছুকে আচ্ছান্ন করে ফেলবে ঠিক তেমনি ফিৎনাও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। আজ আমরা উন্নত প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি। যে যুগে ক্যাবলের মাধ্যমে শহরে-গ্রামে সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে অশ্লীল পর্ণোগ্রাফীর বিষ বাষ্প বা ফিৎনা। এরই কারণে আজ গ্রামে, শহরে প্রত্যেকটি বাড়ীতে, চায়ের স্টলে, হাতের মুঠোফোনে পর্ণোগ্রাফীর ফিৎনা রমরমা হয়ে উঠছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে পারিবারিক ভালবাসার বন্ধন। পরিবারের প্রতিটি সদস্য বেড়ে উঠছে ভিনদেশীদের চিন্তা-চেতনা ও কালচারে। এর প্রভাবে ইসলামী শিষ্টাচারে ছেলে মেয়ে গড়ে না ওঠার কারণে পিতা-মাতা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের প্রাপ্ত অধিকার থেকে। এমনি কি সন্তান-সন্ততির হাতে তারা হচ্ছে নির্যাতিত।
ঈমান বিনষ্ট :
রাসূল(ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ الْحَيَاءَ وَالْعَفَافَ ... مِنَ الإِيمَانِ وَإِنَّ الشُّحَّ والفُحشَ وَالْبَذَاءَ مِنَ النِّفَاقِ ...
‘নিশ্চয় লজ্জাশীলতা ও চারিত্রিক পবিত্রতা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত এবং কৃপণতা, নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা নিফাকের অন্তর্ভুক্ত।[11] অত্র হাদীছ থেকে বুঝা যায় যৌন পবিত্রতা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। অথচ আজ পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসন প্রতিনিয়ত এদেশের লাখো যুবক-যুবতীকে ব্যভিচার সহ নানা অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে উদ্বুদ্ধ করছে। এর ফলে অনেক মানুষ ঈমান হারা হচ্ছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
لاَ يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ ، وَلاَ يَسْرِقُ السَّارِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ ، وَلاَ يَشْرَبُ الخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَالتَّوْبَةُ مَعْرُوضَةٌ بَعْدُ-
‘ব্যভিচারী যখন ব্যভিচার করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। চোর যখন চুরি করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। মদ পানকারী যখন মদ পান করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। তবুও তাদেরকে তওবা করার সুযোগ দেওয়া হয়’।[12]
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, إِذَا زَنَى الرَّجُلُ خَرَجَ مِنْهُ الإِيمَانُ ، كَانَ عَلَيْهِ كَالظُّلَّةِ ، فَإِذَا انْقَطَعَ رَجَعَ إِلَيْهِ الإِيمَانُ ‘যখন কোন পুরুষ ব্যভিচার করে, তখন তার ঈমান তার অন্তর থেকে বের হয়ে মেঘের ন্যায় তার উপর অবস্থান করে। অতঃপর যখন সে তা থেকে নিবৃত্ত হয় তখন তার ঈমান আবার তার নিকট ফিরে আসে’।[13] অতএব ঈমান বাঁচানোর স্বার্থে, পূত-পবিত্র থাকতে ব্যভিচারের সকল রাস্তাবন্ধ করা আবশ্যক।
চরিত্র বিনষ্ট হওয়া :
মানব জাতির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হ’ল চরিত্র। যার গুণে একজন মুসলমান রাত্রে নফল ছলাত আদায়কারী এবং দিনে ছিয়াম পালনাকারীর মত ছওয়াব পায়।[14] কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, পর্ণোগ্রাফীর আগ্রাসনে আজ-অধিকাংশ মানুষের চরিত্র কলুষিত হচ্ছে, নীতিবোধ বিনষ্ট হচ্ছে, মেজাজ হচ্ছে খিটখিটে, যার দরুন সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সমস্যা। এভাবে পর্ণোগ্রাফী আজ নীরবঘাতকে পরিণত হয়েছে। মুসলিম বিদ্বেষীরা মিডিয়ার নোংরা পথ বেছে নিয়েছে মুসলিম চরিত্রকে ধ্বংস করার জন্য। তারা প্রতিদিন ২৬৬টি নতুন পর্ণো তৈরী করছে। যার ফাঁদে আটকা পড়েছে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী।
শয়তানের বাসনা পূরণ :
শয়তানের কামনা-বাসনা হ’ল মানুষের পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে খান-খান হয়ে যাক, অন্যায়, নোংরামি, বদমায়েশী, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা ও যৌনতায় দুনিয়া ভরে যাক। আর শয়তানের এই মনোবাসনা পূরণে পর্ণোগ্রাফী জোরালো ভূমিকা পালন করছে। মহান আল্লাহ বলেন, الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ ‘শয়তান তোমাদেরকে গরীব হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায় এবং অশ্লীল, নোংরামি ও নির্লজ্জ বিষয়ের নির্দেশ দেয়’ (বাক্বারাহ ২/২৬৮)। শয়তানের অশ্লীলতার এ নির্দেশ শুধু আজকে দিচ্ছে তা নয়। বরং মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই সে এ অপতৎপরতা চালিয়ে আসছে। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآَتِهِمَا ‘অতঃপর শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল উভয়ের লজ্জাস্থান প্রকাশ করার জন্য যা তাদের পরস্পরের নিকট গোপন রাখা হয়েছিল’ (আ‘রাফ ৭/২০)। ‘এক পর্যায়ে সে তাদের থেকে তাদের পোষাক খুলে নিয়েছিল যাতে সে তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখাতে পারে’ (আ‘রাফ ৭/২৭)। আজ সেই শয়তানই অশ্লীল মিডিয়া ও পর্ণোগ্রাফীকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে লাখো মা-বোনকে নগ্ন-অর্ধনগ্ন, উলঙ্গ করে চলেছে। মহান আল্লাহ আরো বলেন, اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنْسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ أُولَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ ‘শয়তান তাদের উপর প্রভাব খাটিয়ে বসেছে, আর তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল। জেনে রেখ শয়তানের দল বড় ক্ষতিগ্রস্ত’ (মুজাদালাহ ৫৮/১৯)। তাই শয়তানের এই খপ্পর থেকে সাবধান।
(চলবে)
[লেখক : ৪র্থ বর্ষ, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]
[1] . Bangla Academy English-Bengali Dictionary, Reprint, January, 2004, Page: 593
[2]. বাংলাদেশের আইন কানুন প্রতিবেদন, ৬ জুন, ২০১৫।
[3] . মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ‘তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা’ পৃ. ৩৬৮।
[4] .বুখারী হা/৫২; মুসলিম হা/৪১৭৮।
[5] .বুখারী হা/৪৪৭৭; ৪৭৬১; মুসলিম হা/৮৬।
[6]. মুসলিম হা/২১২৮।
[7]. আহমাদ হা/১২৬৮৯; তিরমিযী হা/১৬০৭; ইবনু মাজাহ হা/৪১৮৫৮।
[8]. বুখারী হা/৭০৬৪।
[9]. বুখারী হা/৭০৬৯।
[10]. আহমাদ হা/১৫৭৯১; মিশকাত হা/৫৩৯৯।
[11]. দারেমী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৮১; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৬৩০।
[12]. আবুদাউদ হা/৪৬৮৯; ইবনু মাজাহ হা/৪০০৭।
[13]. আবুদাউদ হা/৪৬৯০।
[14]. আবু দাউদ হা/৭৪৯৮; মিশকাত হা/৫০৮২।