মাওলানা আববাস আলী : জীবন ও কর্ম
ভূমিকা :
বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক গতিশীল ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। বর্তমান যুগে মানুষ সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল তথা হক্বের দাওযাত ঘরে বসে অতি সহজেই পেয়ে যাচ্ছে। বিশেষতঃ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাংগঠনিকভাবে দাওয়াত ও তাবলীগের কারণে সারা দেশে আহলেহাদীছের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। দিন যত সামনে ধাবিত হচ্ছে নতুন নতুন অঞ্চলের মানুষ ‘আন্দোলন’-এর দাওয়াত কবুল করে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক জীবন গঠনের এই সংগঠন শামিল হচ্ছে। সে অর্থে বাংলাদেশের একটি বড় অংশের মানুষ ‘আহলেহাদীছ’ আক্বীদার অনুসারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফালিল্লাহিল হামদ।
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ভিত্তিহীন কোন ভূঁইফোড় আন্দোলন নয়। এ আন্দোলনের রয়েছে গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্য ও ইতিহাস। যে ইতিহাসে শামিল আছেন রাসূলে করীম (ছাঃ)-এর সাহচর্য লাভে ধন্য ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের সঙ্গী-সাথী তাবেঈনে এযাম হ’তে শুরু করে যুগ-যুগান্তরের অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী মহামনিষীগণ। পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনে এই আন্দোলনের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। যে ইতিহাস এক দিনে এমনিতেই সৃষ্টি হয়নি। অসংখ্য আলেম-ওলামার জ্ঞান সাধনা, কৃষক-প্রজার অকৃপণ দান, গাযী ও শহীদের রক্ত ঝরা আত্মদান, বালাকোট ময়দান, বাঁশের কেল্লা, সিত্তানা, মুলকা, আম্বেলা, আসমাস্ত ও আন্দামানের রক্তাক্ত স্মৃতি, জেল-যুলুম, ফাঁসি, দীপান্তর ও কালাপানির নির্যাতন আহলেহাদীছদের রক্তে মাখা অমলিন ছাপ হয়ে ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে রেখেছে।
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত সহ’ শীর্ষক অমূল্য গবেষণা অভিসন্দর্ভে গবেষক পাক ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর অবিস্মরণীয় অবদান, ইতিবৃত্ত ও ইতিহাস বিরল প্রমাণ-পঞ্জীসহ জাতির সামনে পেশ করে খ্যাতি ও কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। উক্ত গবেষণাগ্রন্থে বাংলাদেশের ‘আহলেহাদীছ’ নেতৃস্থানীয় উলামা, উল্লেখযোগ্য এলাকা ও ব্যক্তিত্বদের নাম ও পরিচিতি সংক্ষিপ্তাকারে বিধৃত হয়েছে। উল্লেখিত প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনকথা সংগৃহীত ও সংকলিত হলে ‘বাংলাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর ইতিহাস পূর্ণতা লাভ করবে বলে মনে করি। অবিভক্ত বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় আলেম মাওলানা আববাস আলীর সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।-
পরিচয় : মাওলানা আববাস আলী পরাধীন ভারতবর্ষে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে আহলেহাদীছ জামা‘আতের অন্যতম নেতৃস্থানীয় আলেম ছিলেন। তিনি পত্রিকা প্রকাশনা, গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনা, পূর্ণাঙ্গ কুরআনের অনুবাদ ও প্রকাশনা, ওয়ায়েযীন এবং সমাজ হিতৈষী রূপে খ্যাতিমান ছিলেন।
বাংলাদেশ অঞ্চলে বিভিন্ন কর্মতৎপরতার মাধ্যমে আহলেহাদীছ আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চবিবশ পরগনা যেলার বশিরাহাট মহকুমার চন্ডিপুর গ্রামে ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দ মোতাবেক বাংলা ১২৬৬ সনে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম তমীযুদ্দীন ও চাচার নাম মাওলানা মুনীরুদ্দীন।
শিক্ষাজীবন : মাওলানা আববাস আলীর জন্মভূমি চন্ডিপুর ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাদপদ অজপাড়াগাঁ। তারপরও সেখানে ছিল গ্রামীণ পাঠশালা। সেই গ্রাম্য পাঠশালাতেই তিনি বাল্য শিক্ষা লাভ করেন। চাচা মাওলানা মুনীরুদ্দীন ছিলেন আহলেহাদীছ সমাজের বিখ্যাত ওয়ায়েযীন ও খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ। চাচার নিকট আববাস আলী প্রাথমিক আরবী, উর্দূ ও ফার্সী ভাষা শিক্ষা করেন। অতঃপর বিভিন্ন মাদরাসায় তিনি শিক্ষা লাভ করেন। পরিশেষে মাটির মায়া মমতা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে আসেন একেবারে ভাটির দেশ পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ। বিষয়টি তাঁর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী বলে মনে হয়। কারণ সে আমলে পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রগণ দ্বীনী শিক্ষার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মাদরাসাগুলোতে পাড়ি জমাতো। কিন্তু কি কারণে মাওলানা আববাস আলী পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন তার বিবরণ জানা যায়নি। যাহোক, সে সময় ভাটির দেশ ময়মনসিংহ যেলার টাঙ্গাইল মহকুমার দেলদুয়ার নামক স্থানে এক বিখ্যাত মুসলমান জমিদার বাড়ী ছিল। জমিদার আবার ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। জমিদার বাড়ীতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিখ্যাত মুহাদ্দিছ, আরবী ভাষায় সুপন্ডিত ও ‘আহলেহাদীছ’ আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান কান্দাহারী উক্ত মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আববাস আলী উক্ত দেলদুয়ার মাদরাসায় ভর্তি হন। মাওলানা আব্দুর রহমান কান্দাহারীর নিকট তিনি ১৫ বছর যাবত আরবী সাহিত্য, তাফসীর ও হাদীছ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এখানেই তাঁর শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে’।[1]
কর্মজীবন : শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর উক্ত দেলদুয়ার মাদরাসায় শিক্ষক হিসাবে মাওলানা আববাস আলী কর্ম জীবন শুরু করেন। সেখানেই তিনি দারস ও তাদরীসে জীবনের পনেরটি বছর অতিবাহিত করেন। অতঃপর প্রায় ত্রিশ বছর পূর্ববঙ্গে কাটানোর পর নাড়ির টানে মাতৃভূমি চন্ডিপুর গ্রামে মাওলানা আববাস আলী ফিরে যান।
গ্রামীন জীবনে ফিরে গিয়ে তিনি দেখতে পান, এলাকার মুসলমানরা নানা প্রকার সামাজিক কুসংস্কারের জালে আটকা পড়ে আছে। আল্লাহর দাসত্ব ভুলে মানুষ যিন্দাপীর ও মৃত পীর-ফকিরের গোলামী করছে। ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে মুসলিম সমাজ অবক্ষয়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। পথভ্রষ্ট দেশবাসীকে প্রথমেই তিনি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার দিকে আহবান করেন। তাঁর সুন্দর ব্যবহার ও দরদমাখা আহবানে মানুষ আকৃষ্ট হয়ে উঠে। উত্তর ২৪ পরগনা যেলা ও তৎসংলগ্ন কয়েক যেলায় তিনি দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করেন। তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে বহু মুসলিম ‘আহলেহাদীছ’ হয়ে তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন।
পত্রিকা প্রকাশ : পরাধীন ভারতবর্ষে বাংলার মুসলিম সমাজ শিক্ষা-দীক্ষা, তাহযীব-তমুদ্দন সর্বদিক দিয়েই ছিল পশ্চাৎপদ। হিন্দু সমাজ ছিল সর্বক্ষেত্রেই অগ্রসরমান। হিন্দু সমাজের মুখপত্র হিসাবে সে সময় অনেকগুলি বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তন্মধ্যে সাহিত্য পত্রিকা ‘বঙ্গবাসী’ ব্রাহ্ম ধর্মের মুখপত্র ‘প্রবাসী’ কালী প্রসন্ন কাব্য বিশারদ সম্পাদিত ‘হিতবাদী’ কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জিবনী’ উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্য ও সাময়িক প্রসঙ্গ ছাড়াও এসব পত্রিকায় প্রতিবেশী মুসলিম সমাজকে ‘ম্লেচ্ছ’, ‘যবন’, মুসলমানের ব্যাটা’ ইত্যাকার আখ্যা দিয়ে প্রবন্ধাদি ছাপা হতো। অপর পক্ষে ‘মোসলেম হিতৈষী’ ও ‘মিহির সুধাকর’ নামে মাত্র দু’টি মাসিক পত্রিকা মুসলমান সমাজ কর্তৃক প্রকাশ হ’ত।
মুসলিম সাংবাদিকতার জনক আহলেহাদীছ সমাজের গৌরব মাওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) এবং তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ও মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা মুসলিম জাগরণে ও ‘আযাদী আন্দোলন’-এ যে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে, জাতীয় ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার সূচনা ও পরিচালনার সঙ্গে আরও তিনজন ‘আহলেহাদীছ’ মহৎপ্রাণ ব্যক্তি যুক্ত ও জড়িত ছিলেন। তাঁরা হলেন মৌলভী কাযী আব্দুল খালেক, হাজী আব্দুল্লাহ ও মাওলানা আববাস আলী।
যতদূর জানা যায়, ১৮৭৭ সালের ৪ঠা কিংবা ৭ই জুন তারিখ মৌলভী কাযী আব্দুল খালেক কলিকাতা অথবা উত্তর শিয়ালদা পল্লী থেকে সর্বপ্রথম ‘আখবার-এ মোহাম্মদী’ নামে একখানি অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৭৮ সালের ২৯ মার্চ থেকে সাপ্তাহিক হিসাবে পত্রিকাখানা প্রকাশ পেতে থাকে। ৮৬ সংখ্যা প্রকাশ পাওয়ার পর পত্রিকাটি অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়।[2] কাযী ছাহেব ‘আখবার-এ মোহাম্মদী’র ফাইলপত্র তৎপরবর্তীতে মাওলানা আকরম খাঁ-কে স্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ প্রদান করেন (প্রাগুক্ত, পৃ. ২০২)।
তৎকালে কলিকাতার তাঁতী বাগানে হাজী আব্দুল্লাহ নামক একজন ধর্মপরায়ণ, মহৎপ্রাণ, আহলেহাদীছ ব্যবসায়ী বাস করতেন। তিনি ব্যবসায়িক কারণ ছাড়াও ধর্মীয় বই-পত্র প্রকাশনার স্বার্থে কলিকাতার নূর আলী লেনে ‘আলতাফী প্রেস’ নামে একখানি ছাপাখানা স্থাপন করেন। হাজী আব্দুল্লাহ ছাহেব এ সময় প্রেস পরিচালনায় মাওলানা আববাস আলীর পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করেন। ওদিকে মাওলানা আববাস আলীও তখন বই-পত্র প্রকাশের জন্য কলিকাতায় গিয়ে হাজী আব্দুল্লাহ ছাহেবের সাহচর্য পেয়ে ধন্য হন। মাওলানা আববাস আলী বহু বছর ধরে ‘আলতাফী প্রেস’-এর কর্মসচিব ছিলেন। উক্ত ‘আলতাফী প্রেস’ হ’তে ১৯০১ সালে মাওলানা আববাস আলী দুই পাতা বিশিষ্ট ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিছুদিন পর পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ও কলেবর বৃদ্ধি পায়। প্রথমে তা ‘পাক্ষিক’ ও পরে ‘সাপ্তাহিক’-এ রূপান্তরিত হয়’।[3] সম্ভবতঃ ১৯০৩ সাল থেকে মাওলানা আববাস আলী, মাওলানা আকরম খাঁর উপর ‘মোহাম্মদী’ সম্পাদনার দায়িত্বভার অর্পণ করেন’।[4]
‘মাসিক মোহাম্মদী’ প্রকাশনায় মাওলানা আববাস আলী যে যুক্ত ছিলেন তা মাওলানা আকরম খাঁর জীবনী গ্রন্থ থেকেও প্রমাণিত হয়। যেমন বলা হচ্ছে- ‘তৎকালে তিনি (মও. আকরম খাঁ) মাওলানা মোহাম্মাদ আববাস আলী সাহেবের যথেষ্ট সাহায্য প্রাপ্ত হন। মাওলানা আববাস আলী সাহেবও মাঝে মধ্যে চীনা বাজারে গিয়ে নিজের মাথায় করে পত্রিকা ছাপার জন্য কাগজ আনতেন।[5]
গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনা : ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে বাংলা ভাষায় লিখিত ধর্মীয় বই-পুস্তকের খুবই অভাব ছিল। বিশেষভাবে আহলেহাদীছ সমাজে লেখক ও সাহিত্য কর্ম ছিল খুবই অপ্রতুল। সমাজের এই অভাব পূরণার্থে গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনা ক্ষেত্রে মাওলানা আববাস আলী যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হন। তৎকালীন অনগ্রসর যুগে তাঁর সেই পদক্ষেপ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। নিম্নে তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থরাজির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করা হ’ল :
১. দৈনন্দিন জীবনে হাদীছের আলোকে মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষার জন্য তিনি রচনা করেন ‘মাসায়েলে জরূরীয়া’। জানা যায়, মুহাম্মদী বা আহলেহাদীছ জনসাধারণের মধ্যে এই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।[6]
২। সমাজে প্রচলিত শির্কের বিরুদ্ধে এবং নির্ভেজাল তাওহীদ শিক্ষা দিবার জন্য তিনি রচনা করেন ‘বারকুল মুওয়াহহিদীন’।
৩। হানাফী মাযহাব অনুসারীদের উদ্দেশ্যে এবং তাদের হিতসাধনের জন্য রচনা করেন, ‘মুফীদুল আহনাফ’।
৪। ‘মহরম উৎসব’- আশুরায়ে মুহাররমের উপর রচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বই।
৫। হক্ব ও না হক্ব পথ চেনার জন্য হেদায়েতমূলক তাঁর রচিত অন্যতম বই ‘কষ্টি পাথর’।
৬। পবিত্র কুরআন ও হাদীছের আলোকে জুম‘আর খতীবদের জন্য তিনি লিখেন- ‘জুমআর খুৎবা’।
এছাড়াও মুসলিম সমাজে জিহাদের জাযবা সৃষ্টির লক্ষে তিনি ইতিহাস খ্যাত সিরিয়া, মিশর, পারস্য প্রভৃতি বিজয়ের ঐতিহ্য ও গৌরবগাঁথার উপর ভিত্তি করে আরো তিনখানি পুস্তক রচনা করেন’।[7]
কঠোর পরিশ্রম করে এ সকল বই-পুস্তক রচনা করেই মাওলানা ক্ষান্ত হননি। কালো কালির অক্ষরে শৃংখলিত পান্ডুলিপি যেন মুদ্রিত আকারে বাইরের আলো বাতাসের সহিত পরিচিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে; সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে তিনি কাল বিলম্ব করেননি। হাজী আব্দুল্লাহ ছাহেব-এর ‘আলতাফী প্রেস’-এ দিন-রাত অবিরাম মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম করে নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে তিনি পুস্তকগুলি প্রকাশ করেন।
এতদ্ব্যতীত একজন সমাজহিতৈষী প্রকাশক হিসাবে মাওলানা, তাঁর চাচা ও প্রখ্যাত ওয়ায়েযীন মাওলানা মুনীরুদ্দীন কর্তৃক দোভাষী পয়ারছন্দে লিখিত ‘মুনীরুল হোদা’- নামক পুঁথি কাব্যগ্রন্থটি উক্ত প্রেস থেকে প্রকাশ করে সমাজে সমাদৃত হন।
পবিত্র কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক : এদেশের অধিকাংশ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে যে, কুরআন মাজীদ প্রথম বঙ্গানুবাদ করেন শ্রী গিরীশচন্দ্র সেন। কথাটি সর্বাংশে সঠিক নয়। কেননা বাংলায় কুরআন অনুবাদের ইতিহাস অনেকখানি প্রাচীন ও ভিন্ন রকম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রাক্তন প্রফেসর ড. মুজীবুর রহমান তাঁর ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা, শীর্ষক গবেষণামূলক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
বাংলা ভাষায় কুরআনের প্রথম অনুবাদক ছিলেন একজন মুসলিম। তাঁর নাম ছিল আমীর উদ্দীন বসুনিয়া। তিনি ছিলেন রংপুর যেলার গঙ্গাচড়া থানাধীন চিনাখাল মটুকপুর গ্রামের অধিবাসী। তিনি মুসলমানী বাংলা তথা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় কুরআনের আমপারার কাব্যানুবাদ করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘জনাব আমীরউদ্দীন বসুনিয়ার এই সরল বাংলা কাব্যানুবাদ খানী ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল’।[8] বলা যায়, আমীরউদ্দীন বসুনিয়া কুরআনের প্রথম অনুবাদক হলেও তা ছিল কেবলমাত্র ৩০তম পারার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
অতঃপর নরসিংদী যেলার পাঁচদোনা গ্রামের অধিবাসী বাবু গিরীশচন্দ্র সেন (১৮৩৪-১৯১০ খ্রীঃ) ১৮৮১ সালের ১২ই ডিসেম্বর কুরআনের প্রথম পারা অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। ১৮৮৬ সালে তিনি সম্পূর্ণ কুরআনের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করতে সক্ষম হন। কিন্তু গিরীশচন্দ্র সেন কর্তৃক অনূদিত কুরআন ভুল-ভ্রান্তিতে ভরা ছিল। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ব্রাক্ষ্ম ধর্মালম্বী অমুসলিম গিরীশ বাবু কুরআনের অনেক শব্দের ভুল অর্থ করেছেন। ইসলামী পরিভাষা ত্যাগ করে সংস্কৃত শব্দের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। যেমন- ইশ্বর, নরক, সাধুমজ্জন প্রভৃতি আক্ষরিক অর্থ করা ছাড়াও অনেক ব্যক্তিগত অভিমত ও ব্রাক্ষ্ম ধর্মের অন্তর্নিহিত ভাব ব্যক্ত করেছেন। কলিকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকার ২য় বর্ষে ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর সংখ্যায় ৯ পৃষ্টায় গিরীশ বাবুর বঙ্গানুবাদে ভ্রম শীর্ষক একটি প্রতিবাদসূচক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।[9]
সর্বপেক্ষা বড় কথা এই অনুবাদ গ্রন্থে মূল আরবী ইবারত পরিত্যক্ত ছিল। যেসব কারণে মুসলিম সমাজে তার অনূদিত কুরআন সমাদৃত হয়নি। বরং একে ভ্রমহীন পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ গ্রন্থ বলে মেনে নেওয়াটাই বিতর্কিত ব্যাপার।
ঠিক এই যুগে গিরীশ চন্দ্র সেনের আগে ও পরে বাংলা অঞ্চলে কতিপয় হিন্দু ও খ্রীষ্টান ধর্মালম্বী মিশনারী পাদ্রী কুরআন ও হাদীছের বাণী বিকৃত করে অসৎ উদ্দেশ্যে সাধনের নিমিত্তে এগুলির বঙ্গানুবাদ করতে থাকে। এসব মিশনারী অপতৎপরতার আভাস পাওয়া যায় ড. মুজীবুর রহমান রচিত বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা গ্রন্থে। যেমন তিনি লিখেছেন, এদেশের পুরোধা ছিলেন রেভারে এইচ জি রাউস (Rouse) এবং তাঁর ‘ফুরকান’ পুস্তিকাটি ছিল তাঁর কর্মতৎপরতার প্রতীক। এতে খুব জোরালোভাবে একথা ব্যক্ত করা হয়েছে যে, কুরআন আল্লাহর অবতারিত গ্রন্থ নয়। বরং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর স্বকপোলকল্পিত।[10] কুরআন অনুবাদে চার্চ মিশনারীদের অপতৎপরতা ও খৃষ্টধর্ম প্রচারের অসৎ পরিকল্পনা প্রতিরোধকল্পে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে সে সময় বাংলার যমীনে যশোরের মুন্সী মেহেরুল্লাহ, নদীয়ার শেখ জমীর উদ্দীন, মানিকগঞ্জের আনিসউদ্দীন প্রমূখ মনীষী এবং সে যুগের প্রথম জাতীয় সংবাদ সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ এর প্রচেষ্টায় সর্বাগ্রামেচ্ছু মিশনারী দল অনেকখানী সংকুচিত হয় এবং বাংলার মুসলিম সমাজ ধর্মান্তকরণের হাত থেকে রক্ষা পায়।[11]
মাওলানা আববাস উদ্দীন কর্তৃক পূর্ণাঙ্গ কুরআন অনুবাদের পূর্বে আরও দু’জন মুসলিম অনুবাদক কুরআনের অনুবাদ বিস্তারিত তাফসীরসহ লিখে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে টাঙ্গাইলের মাওলানা নঈমুদ্দীন কুরআনের অনুবাদসহ তাফসীর প্রকাশ করেন। কিন্তু তা প্রথম হ’তে তের (১৩) পারার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তদ্রুপ খ্যাতনামা ‘আহলেহাদীছ’ আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ আকরাম খাঁ সর্বপ্রথম সূরা ফাতিহার তরজমা ও তাফসীর লিখে প্রকাশ করেন ১৭ই আগষ্ট, ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে।[12] এদিক থেকে এই উভয় অনুবাদককে পূর্ণাঙ্গ কুরআনের অনুবাদক বলা যায় না।
বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের ক্রমধারায় সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে আমরা মাওলানা আববাস আলীকেই বাংলা ভাষায় কুরআনের পূর্ণাঙ্গ ত্রিশ পারার প্রথম অনুবাদক হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি। বাঙ্গালী মুসলমান হিসাবে মাওলানা আববাস আলীর এই অনুবাদকর্ম ছিল সর্বপেক্ষা কৃতিত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর অনূদিত কুরআনের ৩০তম পারা বা আমপারার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই অক্টোবরে। পৃষ্টা সংখ্যা ২৮, মূল্য চার আনা। মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন মুনশী কারীম বখশ, ৩৩ নং বেনেপুকুর লেন, কলিকাতা।[13]
অতঃপর ১৯০৮ সাল থেকে ধারবাহিকভাবে বঙ্গানুবাদ কুরআন প্রকাশ করতে শুরু করেন মাওলানা আববাস আলী কলিকাতাস্থ ‘আলতাফী প্রেস’ থেকে। পূর্ণাঙ্গ কুরআনের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে। তাঁর অনুদিত কুরআনের মোট পাঁটটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। সংস্করণের আধিক্য থেকে এ অনুবাদ গ্রন্থের জনপ্রিয়তা ও গুরুত্ব উপলদ্ধি করা যায়।
এ অনুবাদ গ্রন্থখানির বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, মূল আরবী আয়াতের নীচে রয়েছে প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ শাহ রফীউদ্দীন দেহলভীর (১৭৫০-১৮১৮ খৃঃ) উর্দূ তরজমা এবং তার নীচে মাওলানা আববাস আলী ছাহেবের সরল বাংলা অনুবাদ। এই অনুবাদের ভাষা শাহ রফীউদ্দীন কৃত উর্দূর মতই মূলের অনুসারী। এর প্রত্যেক পৃষ্ঠার বর্ডার আকর্ষণীয় ও কারুকার্যময়। এই বর্ডারের দুই পার্শ্বে নম্বরসহ সংযোজিত হয়েছে মাওলানা বাবর আলী (১৮৭৪-১৯৪৬ খৃঃ) কর্তৃক হাদীছ ভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।[14]
মাওলানা বাবর আলী কৃত এই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগুলি ‘তাফসীরে কাবীর’, ‘কাশশাফ’, ‘ফাতহুল কাদীর’, ‘ফাতহুল বায়ান’, ‘দূররুল মানছূর’ প্রভৃতি মূল তাফসীর গ্রন্থ অবলম্বনে লিখিত। বর্ডারে প্রদত্ত এই সব ব্যাখ্যার কতকগুলি আবার উর্দূ ভাষাতেও লিখিত হয়েছে সঠিক ক্রমিক নম্বরসহ। যার সংখ্যা কম হলেও তার সবগুলিই মূল আরবী গ্রন্থরাজি থেকে সংগৃহীত।[15]
এটি শুধুমাত্র তরজমা গ্রন্থই নয় তাফসীরও বটে। যার শেষ কভার পৃষ্ঠায় অনুবাদকের ‘নিবেদন’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘এই বাংলাদেশের মাটিতে প্রায় চার কোটি মুসলমানের বাস। আর বাংলা ভাষায় টীকা ও তরজমা লিখিত সম্পূর্ণ কুরআন এই একখানা ব্যতীত দু’খান নাই’।[16] অনুবাদক মাওলানা আববাস আলীর এই ‘নিবেদন’ প্রেক্ষিতে গবেষক ড. মুজীবুর রহমান টীকায় মন্তব্য লিখেছেন, ‘তিনি যদি একথা মনে করে থাকেন যে, মূল আরবী ও টীকা টিপ্পনীসহ সম্পূর্ণ কুরআনের তরজমা ও তাফসীর এটাই প্রথম, তবে তাঁর দাবী মত বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। অন্যথায় মূল আরবী ছাড়া পূর্ণাঙ্গ কুরআনের বাংলা তরজমা ও কিছু কিছু টীকা-টিপ্পনী এ সময়ের ২৫/২৬ বছর আগে ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে গিরীশ বাবু কর্তৃক লিখিতও প্রকাশিত হয়েছিল।[17]
অতঃপর গবেষক ড. মুজীবুর রহমান নিজেই অনুবাদক মাওলানা ছাহেবের স্ত্তুতিবাদ করে লিখেছেন, মাওলানা আববাস আলী এক দিকে যেমন ছিলেন উর্দূ থেকে বাংলা অনুবাদকের জনক, অন্যদিকে তেমনি ছিলেন মূল আরবীসহ কুরআন মাজীদের পূর্ণাঙ্গ বাংলা তরজমা ও তাফসীরের প্রথম মুসলিম পথিকৃত। তাঁর আগে হিন্দু-মুসলমান-খৃষ্টান ইত্যাদি মিলে অনেকেই কুরআন করীমের পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক বঙ্গানুবাদ করেছেন বটে কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে মূল আরবীসহ কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ তাঁর আগে কেউ করেন নি। বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য সম্ভার এবং বিশেষত এই কুরআন সাহিত্যের ক্ষেত্রে মাওলানা আববাস আলীর এইসব বিচিত্র অবদানের ফলশ্রুতি হিসাবেই হয়তো তাঁর এ সুনাম-সুখ্যাতি শুধু যে বাংলার ঘরে ঘরেই সীমাবদ্ধ তা নয় বরং বাংলার গন্ডি পেরিয়ে বহির্দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই ‘সাইয়ারা ডাইজেষ্ট’ প্রভৃতি মাসিক উর্দু পত্রিকায় তাঁকে শাহ রফীউদ্দীন মুহাদ্দিস দেহলভী-এর প্রথম অনুবাদক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া হাকীম মাওলানা আব্দুল্লাহ মুহাদ্দিছ ছাপড়াতী রচিত ‘আল-বায়ানিত তারাজিমিল কুরআন’ নামক উর্দূ গ্রন্থেও তাঁর নামোল্লেখ করে প্রশংসা করা হয়েছে। (মাসিক সাইয়ারা ডাইজেষ্ট-বিশেষ কুরআন কিরাতুত তারাজিম’ নামক গ্রন্থেও আববাস আলীর নাম এবং কুরআন সাহিত্যে তাঁর অবদান ও সেবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[18]
মাওলানা আববাস আলী অনূদিত কুরআন ও তার তাফসীর গ্রন্থের সাথে তাঁরই নীরব সহকর্মী সাপ্তাহিক ‘আহলেহাদীছ’ পত্রিকার সম্পাদক যশস্বী আলেম মাওলানা বাবর আলী ছাহেবের নাম বিশেষভাবে বিজড়িত রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ কুরআন তরজমা ও তাফসীর প্রকাশনা এ উভয় আলেমের যুক্ত প্রচেষ্টা ও সাধনার ফলশ্রুতি বলাই যুক্তিসঙ্গত। তথাপি মাওলানা আববাস আলী এক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তা অকপটে বলা যায়। পরাধীন ভারতে দূর্দশাগ্রস্ত অনগ্রসর মুসলিম সমাজে সহজ-সরল ও বিশুদ্ধভাবে কুরআন অনুবাদ করে মুসলিম সমাজের বিরাট অভাব পূরণ করেছেন। তাঁর সেই অবদান জাতি চিরদিন স্মরণে রাখবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশ্যা। যার আলোকেই আমরা বাংলাভাষায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও গবেষণা গ্রন্থে তাঁর নাম ও অবদান দেখতে পাই। তন্মন্ধে মাসিক ‘মোহাম্মাদী’ ১৩৪০ সনের আষাঢ় সংখ্যা, ৬ষ্ঠ বর্ষ; ইসলামী একাডেমী পত্রিকা ১৯৬১ ১ম বর্ষ এপ্রিল-জুন সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১২৪; সাপ্তাহিক আরাফাত ১ আশ্বিন ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ; সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ, ঢাকা, ১৯৬৪, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১২৫; সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ঢাকা প্রভৃতিতে তাঁর নাম ছড়িয়ে আছে।
এ দেশের এক শ্রেণীর আলেম সমাজ প্রচার করে থাকেন যে, কুরআন-হাদীছ চর্চায় আহলেহাদীছদের মৌলিক কোন অবদান নেই। অথচ অনেক বই-পত্রে কুরআনের প্রথম অনুবাদক হিসাবে মাওলানা আববাস আলীর নাম উল্লেখিত হয়। কিন্তু তিনি যে, আহলেহাদীছ ছিলেন, তা সম্ভবত অনেকেরই অজানা রয়েছে। অথবা জেনেও তা গোপন করা হয়। যেমনভাবে কুরআনের জগদ্বিখ্যাত তাফসীর ‘তাফসীর ইবনে কাছীর’- প্রথম বঙ্গানুবাদ করেছেন আহলেহাদীছ জামা‘আতের প্রখ্যাত পন্ডিত প্রফেসর ড. মাওলানা মুজিবুর রহমান। এ ক্ষেত্রে তাঁদের এসব অবদান সর্বজন স্বীকৃত। তাই গর্বের সঙ্গে বলা যায়, সৃজনশীল ও মৌলিক জ্ঞান-গবেষণায় কোন কালেই আহলেহাদীছ ওলামাদের অবদান ও কৃতিত্ব কোন অংশে কম ছিল না।
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা : বিরামহীন পরিশ্রম করার ফলে মাওলানার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে কলিকাতা মহানগরীর কোলাহলময় ব্যস্ত জীবন ত্যাগ করে মাওলানা আববাস আলী শেষ জীবনে শান্ত-শ্যামল পাড়া-গায়ের গ্রামীণ জীবনে ফিরে আসেন। কিন্তু কর্ম ও সৃষ্টি সাধনা যাঁদের ব্রত, বয়স তাঁদের কাছে কোন বাঁধা নয়। নিজ অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে তিনি চন্ডীপুর গ্রামে একটি ইসলামীয়া মাদরাসা স্থাপন করেন। এখানেও তিনি অক্লান্ত শ্রম ও সাধনা দ্বারা দূর-দূরান্ত থেকে আগত তালেবুল এলেমদের বিনা খরচে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন। ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের বুযুর্গ পিতা, খুলনা, যশোর, ২৪ পরগনা অঞ্চলের খ্যাতনামা আলেম, যশস্বী ওস্তায, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও স্বনামধন্য বাগ্মী মাওলানা আহমাদ আলী (রহঃ) (১৮৮৩-১৯৭৬ খৃ.) এই চন্ডীপুর মাদরাসাতেই এক বছর ব্যাপী শিক্ষকতা করেছেন।[19]
বাক্যেশ্বর বাহাছে অংশগ্রহণ : বাংলা ১৩২৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী যেলার অন্তর্গত দাদপুর থানাধীন বাক্যেশ্বর গ্রামে হানাফী ও আহলেহাদীছের মধ্যে একটি বিরাটাকারের ঐতিহাসিক ‘বাহাছ’ অনুষ্ঠিত হয়। আলোড়ন সৃষ্টিকারী উক্ত বাহাছ সভায় আহলেহাদীছ পক্ষে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত তৎকালীন মাসিক ‘আহলে হাদিস’ পত্রিকার বৃদ্ধ সম্পাদক মাওলানা বাবর আলী, মাওলানা এফাযুদ্দীন, খুলনা যেলার তৎকালীন তরুণ আলেম মাওলানা আহমাদ আলী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম-এর সহিত, কলিকাতা থেকে তৎকালীন ‘আঞ্জুমানে আহলে হাদিস বাঙ্গালা’র পক্ষ হ’তে মাওলানা আববাস আলীও যোগদান করার সৌভাগ্য লাভ করেন।[20]
জনহিতকর কার্যাবলী : সে আমলে দেশবাসীর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুব দুর্দশাগ্রস্ত। সড়ক যোগাযোগের উন্নতি সাধন ও জনহিতকর কার্যাবলী সম্পাদনের লক্ষ্যে মাওলানা আববাস আলী বশিরহাট মহকুমার তৎকালীন লোকাল বোর্ডের সদস্য পদ এবং স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের ‘প্রেসিডেন্ট’ পদ গ্রহণে বাধ্য হন। বশিরহাট মহকুমার ‘মসলন্দাপুর তেঁতুলিয়া রোড’ নামক বর্তমান বিশাল রাস্তাটি নির্মাণ তাঁর জীবনের অক্ষয় কীর্তি রূপে আজও বিদ্যমান। এই রাস্তা নির্মাণে প্রয়োজনীয় জমি সংগ্রহের সময় স্থানীয় এক হিন্দু জমিদার তনয় তাঁর প্রতি বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে উদ্যত হয়েছিল।[21] এভাবে জনকল্যাণমূলক কাজে নেতৃত্ব দিয়ে বারাসাত ও বশিরহাট মহকুমার, হিন্দু-মুসলিম সকল শ্রেণীর মানুষের তিনি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসা অর্জন করেন।
আহলেহাদীছ আন্দোলনের অবদান : বঞ্চনা ও অবহেলায় জর্জরিত, আত্মবিস্মৃত আহলেহাদীছ জামা‘আতের উন্নতি সাধনের জন্য মাওলানা আববাস আলী বহুমুখী তৎপরতা দ্বারা নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। সংকীর্ণ মাযহাবী গোঁড়ামী ও বানোয়াট তরীকার অন্ধ অনুসরণ পরিত্যাগ করে কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে মুসলিম ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা ছিল তাঁর জীবন সাধনা। এই ঐক্য প্রচেষ্টায় বহুবিধ বাধা-বিপত্তি ও বিপদাপদের সম্মুখীন হ’তে হয় তাঁকে। শেষে তিনি অনেকাংশে সফলতা অর্জন করেন। এইভাবে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকা প্রকাশনা, আলতাফী প্রেস পরিচালনা, বই-পুস্তক রচনা ও প্রকাশনা, মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষকতা, কুরআন অনুবাদ করা, বাহাছ-মুনাযারায় অংশ গ্রহণ করা প্রভৃতি কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ অঞ্চলে আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় অবদান রাখেন।
শেষকথা : মাওলানা আববাস আলী ছাড়াও তাঁর সমসাময়িককালে সুজলা-সুফলা বাংলার উর্বর প্রতিভা প্রসবিনী ভূমিতে জন্ম লাভ করেন মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ বর্ধমানী (১৮৫৯-১৯৪৩), মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮), মাওলানা বাবর আলী (১৮৭৩-১৯৪৬), মাওলানা আহমাদ আলী (১৮৮৩-১৯৭৬), মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ হিল বাকী (১৮৮৬-১৯৫২) প্রমূখ খ্যাতিমান ওলামায়ে কেরাম। তাঁরা সকলেই তাবলীগ ও তাদরীস, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। শত বাধা বিঘ্ন ও বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েও তাঁরা সর্বদাই নিজেদেরকে ‘মোহাম্মদী’ বা ‘আহলেহাদীছ’ নামে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। বর্তমান সময়ে ছহীহ আক্বীদা ও আমলের অনুসারী হয়ে কিছু কিছু মানুষ নিজেদের পরিচয় হবে শুধু ‘মুসলিম’। ‘আহলেহাদীছ’ বলা যাবে না এমন দাবী তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। আমার মনে হয় আহলেহাদীছকে যদি একটি ‘আন্দোলন’ রূপে তাঁরা বুঝতেন তাহ’লে এমন দাবী করতে পারতেন না। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর ইতিহাস এবং উল্লেখিত পূর্বসূরী ওলামায়ে কেরামের গর্বিত জীবন কর্ম থেকে নতুন প্রজন্মের সকল শ্রেণীর ‘মুসলিম’ সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক পথের সন্ধান দিন- আমীন!
[ লেখক : কেন্দ্রীয় দাঈ, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ]
[1]. বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা, ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান (ঢাকা : ইফাবা, ২য় সংস্করণ : জুন : ২০০৯), পৃ. ১৪১।
[2]. মাওলানা আকরম খাঁ, সংকলন ও সম্পাদনা আবু জাফর (ঢাকা : ইফাবা, ডিসেম্বর ১৯৮৬), পৃ. ২৯৬।
[3]. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, সম্পাদনা পরিষদ (ঢাকা : ইফাবা, জুন : ১৯৯৫), পৃ, ১/৪২।
[4]. প্রাগুক্ত।
[5]. মাওলানা আকরম খাঁ, পৃ. ২০৪, ২৯৭।
[6]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব (ঢাকা : হাফাবা, ১৯৯৬), পৃ. ৪৬৬।
[7]. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃ. ৪২।
[8]. বাংলাভাষায় কুরআন চর্চা, পৃ. ৩৬।
[9]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৫।
[10]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯।
[11]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮।
[12]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২।
[13]. বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা, পৃ.১৪২।
[14]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৩।
[15]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৪।
[16]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৪।
[17]. প্রাগুক্ত।
[18]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬-৪৭।
[19]. সাহিত্যিক মাওলানা আহমাদ আলী, শেখ আখতার হোসেন (রাজশাহী : হাফাবা), পৃ. ১২।
[20]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১২; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃ. ৪২৯।
[21]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৪৬৬; সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃঃ ৪২, ই.ফা.বা।