আমানতদারিতা
আল-কুরআনুল কারীম :
1- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ-
(১) ‘হে মুমিনগণ! তোমরা (অবাধ্যতার মাধ্যমে) আল্লাহ ও রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না এবং (এর অনিষ্টকারিতা) জেনে-শুনে তোমাদের পরস্পরের আমানত সমূহে খেয়ানত করো না’ (আনফাল ৮/২৭)।
2- إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا-
(২) ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার যথার্থ হকদারগণের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সর্বোত্তম উপদেশ দান করছেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (নিসা ৪/৫৮)।
3- وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ- أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ- الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ-
(৩) ‘আর যারা তাদের আমানত ও অঙ্গীকার সমূহ রক্ষাকারী। এবং যারা তাদের ছালাত সমূহের হেফাযতকারী। তারাই হবে উত্তরাধিকারী। যারা উত্তরাধিকার লাভ করবে জান্নাতুল ফেরদৌসের। যেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (মুমিনূন ২৩/৮-১১)।
4- قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي سَفَاهَةٌ وَلَكِنِّي رَسُولٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ- أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ-
(৪) ‘সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে মোটেই বোকামি নেই। বরং আমি বিশ্বপালকের প্রেরিত একজন রাসূল মাত্র। আমি তোমাদের নিকট আমার প্রতিপালকের পয়গামসমূহ পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাংখী’ (আ‘রাফ ৭/৬৭-৬৮)।
হাদীছে নববী :
5- عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ-
(৫) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোন একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। ১. আমানত রাখা হ’লে খেয়ানত করে; ২. কথা বললে মিথ্যা বলে; ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে; এবং ৪. বিবাদে লিপ্ত হ’লে অশ্লীলভাবে গালাগালি করে’।[1]
6- عَنْ عِمْرَانَ بْنَ حُصَيْنٍ رضى الله عنهما قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم خَيْرُكُمْ قَرْنِى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ. قَالَ عِمْرَانُ لاَ أَدْرِى أَذَكَرَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم بَعْدُ قَرْنَيْنِ أَوْ ثَلاَثَةً. قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِنَّ بَعْدَكُمْ قَوْمًا يَخُونُونَ وَلاَ يُؤْتَمَنُونَ، وَيَشْهَدُونَ، وَلاَ يُسْتَشْهَدُونَ وَيَنْذِرُونَ وَلاَ يَفُونَ، وَيَظْهَرُ فِيهِمُ السِّمَنُ-
(৬) ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা, অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা। ইমরান (রাঃ) বলেন, আমি বলতে পারছিনা, নবী করীম (ছাঃ) তাঁর যুগের পরে দুই যুগ নাকি তিন যুগের কথা উল্লেখ করেছেন। রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, তোমাদের পর এমন লোকেরা আসবে, যারা খেয়ানত করবে, আমানত রক্ষা করবে না; সাক্ষ্য দিতে না ডাকলেও তারা সাক্ষ্য দিবে; তারা মানত করবে কিন্তু তা পূর্ণ করবেনা। তাদের মধ্যে মেদওয়ালাদের প্রকাশ ঘটবে’।[2]
7- عَنْ عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَبَّاسٍ رضى الله عنهماأَخْبَرَهُ قَالَ أَخْبَرَنِى أَبُو سُفْيَانَ أَنَّ هِرَقْلَ قَالَ لَهُ سَأَلْتُكَ مَاذَا يَأْمُرُكُمْ فَزَعَمْتَ أَنَّهُ أَمَرَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَالصِّدْقِ وَالْعَفَافِ وَالْوَفَاءِ بِالْعَهْدِ وَأَدَاءِ الأَمَانَةِ. قَالَ وَهَذِهِ صِفَةُ نَبِىًٍّ-
(৭) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ হ’তে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আবু সুফিয়ান আমাকে খবর দিয়েছেন যে, হিরাক্লিয়াস তাকে বলেছিল, তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, নবী করীম (ছাঃ) তোমাদের কি কি আদেশ করেন? তুমি বললে যে, তিনি তোমাদের ছালাতের, সত্যবাদিতার, পবিত্রতার, ওয়াদা পূরণের ও আমানত আদায়ের আদেশ দেন। হিরাক্লিয়াস বললেন, এটাই নবীগণের ছিফাত’।[3]
8- عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ اضْمَنُوا لِى سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَضْمَنْ لَكُمُ الْجَنَّةَ اصْدُقُوا إِذَا حَدَّثْتُمْ وَأَوْفُوا إِذَا وَعَدْتُمْ وَأَدُّوا إِذَا ائْتُمِنْتُمْ وَاحْفَظُوا فُرُوجَكُمْ وَغُضُّوا أَبْصَارَكُمْ وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ-
(৮) ওবাদা ইবনু ছামেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিন, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের পক্ষ হ’তে আমাকে ছয়টি বিষয়ের যামানত দাও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের যামিন হব। ১. তোমরা যখন কথা বল, তখন সত্য বল; ২. যখন ওয়াদা কর, তা পূর্ণ কর; ৩. যখন তোমাদের কাছে আমানত রাখা হয়, তা আদায় কর; ৪. নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাযত কর; ৫. স্বীয় দৃষ্টিকে অবনমিত রাখ এবং ৬. স্বীয় হাতকে অন্যায় কাজ হ’তে বিরত রাখ’।[4]
9- عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَرْبَعٌ إِذَا كُنَّ فِيكَ فَلاَ عَلَيْكَ مَا فَاتَكَ مِنَ الدُّنْيَا حِفْظُ أَمَانَةٍ وَصَدْقُ حَدِيثٍ وَحُسْنُ خَلِيقَةٍ وَعِفَّةٌ فِى طُعْمَةٍ-
(৯) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, যখন তোমার মাঝে চারটি জিনিস থাকবে, তখন দুনিয়ার সবকিছু হারিয়ে গেলেও তোমার কোন সমস্যা নেই। ১. আমানত রক্ষা করা; ২. সত্য কথা বলা; ৩. সুন্দর চরিত্র এবং ৪. হালার রূযী’।[5]
10- عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ مَا خَطَبَنَا نَبِىُّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ قَالَ لاَ إِيمَانَ لِمَنْ لاَ أَمَانَةَ لَهُ وَلاَ دِينَ لِمَنْ لاَ عَهْدَ لَهُ-
(১০) হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে এরূপ উপদেশ খুবই কমই দিয়েছেন, যাতে একথাগুলি বলেননি যে, যার আমানতদারিতা নেই তার ঈমান নেই এবং যার অঙ্গীকারের মূল্য নেই তার দ্বীন-ধর্ম নেই’।[6]
মনীষীদের বক্তব্য :
১. ইমাম বুখারী (রহঃ) আমানতদারিতা সর্ম্পকে বলেন, ‘আমানত রক্ষা করা সাধারণত ওছিয়ত পূরণের চেয়েও অধিক যরূরী’।[7]
২. ইমাম মানাবী (রহঃ) বলেন, ‘আমানতদারিতা হ’ল ঐ সমস্ত হক বা অধিকার যা আদায় ও সংরক্ষণ তোমার উপর আবশ্যক’।[8]
৩. ইমাম কাফাবী (রহঃ) বলেন, ‘আমানতদারিতা হ’ল আল্লাহ তা‘আলা বান্দার উপর যে সমস্ত বিধি-বিধান ফরয করেছেন তা আদায় করা যেমন-ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, ঋণ আদায় বিশেষ করে গচ্ছিত সম্পদ ও কাজের গোপনীয়তা রক্ষা করা একটি বড় আমানতদারী’। তিনি অন্যত্র বলেন, আমানতদারী হ’ল সমস্ত নিষিদ্ধ বস্ত্ত, গচ্ছিত সম্পদ ও কোন কাজের গোপনীয়তা রক্ষা করা’।[9]
৪. ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘আমানতদারিতা ও অঙ্গীকার দুইটি জিনিস-ই মানুষের মধ্যে থাকে যা তার দ্বীন-দুনিয়ার কথা ও কাজে প্রকাশ পায়। এটা সাধারণ জনগণের ওয়াদা অঙ্গীকারকেও শামিল করে। আর এর অভীষ্ট লক্ষ্যস্থল হ’ল সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন। আমানতদারিতা অঙ্গীকারের চেয়ে ব্যাপকতর একটি বিষয়। তবে সমস্ত অঙ্গীকার-ই আমানতদারীর মধ্যে পড়ে’।[10]
৫. ইমাম গাযালী (রহঃ) বলেন, ‘আমানতদারিতা হ’ল গোপনীয় পাপাচার, কাবীরা গুনাহ, এমনকি ছগীরা গুনাহের পীড়াপীড়ি থেকে নিজেকে পবিত্র রাখা’।[11]
সারবস্ত্ত :
১. আমানতদারিতা হ’ল ঈমানের পরিপূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্য।
২. আমানতদারিতার উপরে আকাশ ও যমীনের যাবতীয় বিষয় দন্ডায়মান।
৩. আমানতদারিতা হ’ল দ্বীনের কেন্দ্রবিন্দু ও মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরুপ।
৪. আমানতদার ব্যক্তিকে আল্লাহ ও মানুষ সকলেই ভালবাসে।
৫. যে সমাজে আমানতদারিতা রয়েছে সে সমাজ যাবতীয় কল্যাণ ও বরকতে ভরা।
[1]. বুখারী হা/৩৪; মিশকাত হা/৫৬।
[2]. বুখারী হা/২৬৫১; নাসাঈ হা/৩৮০৯; তিরমিযী হা/২২২২।
[3]. আহমাদ হা/২৩৭০; বুখারী হা/২৬৮১।
[4]. আহমাদ হা/২২৮০৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৭০; মিশকাত হা/৪৮৭০।
[5]. আহমাদ হা/৬৬৫২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৭৩৩; মিশকাত হা/৫২২২।
[6]. আহমাদ হা/১২৪০৬; মিশকাত হা/৩৫।
[7]. ফাৎহুল বারী ৫/৪৪৩ পৃ.।
[8] . ফায়যুল কাদীর ১/২২৩ পৃ.।
[9] . আল-কুল্লিয়াতুল কাফাবী ১৭৬, ১৮৬ পৃ.।
[10] . তাফসীরে কুরতুবী ৩/৩৮৬ পৃ.।
[11] . এহয়াউল ঊলূম ১/১৭৫ পৃ.।