• free web stats
  • At-Tahreek
    সম্পাদকীয়

    একজন দাঈ ইলাল্লাহ ডা. আব্দুর রহমান আস-সুমাইত্বের কথা

     

    আব্দুর রহমান বিন হামূদ আস-সুমাইত্ব (১৯৪৭-২০১৩ইং)। কুয়েতী এই চিকিৎসক সমকালীন বিশ্বে মানবসেবার এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জীবনের ২৯টি বছর আনুষ্ঠানিকভাবে মানবসেবার কাজে নেমে আফ্রিকার অন্ততঃ ২৯টি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সমূহে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষের জীবনে হাসি ফুটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এ সময়ে তাঁর হাত ধরে ইসলাম গ্রহণে ধন্য হয়েছে অন্ততঃ ১১ মিলিয়ন তথা ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ। তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে তিনি সশরীরে আফ্রিকার পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন মরুভূমিতে। গহীন বন-জঙ্গল পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে গিয়েছেন। আফ্রিকার সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট কিলিঞ্জোমারো পর্যন্ত আরোহণ করেছেন। এসব যাত্রায় কখনও তিনি বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠীর হামলার শিকার হয়েছেন। কখনও বিদ্যুৎ-পানিবিহীন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। জঙ্গলে বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছুর আক্রমণের শিকার হয়ে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকেও রক্ষা পেয়েছেন। কোন কিছুই তাকে পিছপা করতে পারেনি। বিরামহীন কঠোর পরিশ্রমের ফলে জীবনের শেষদিকে তিনি নানা রোগে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েন। এতদসত্ত্বেও অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি দাওয়াতী মিশন অব্যাহত রেখেছিলেন। মৃত্যুর প্রায় বছর খানিক পূর্বে তিনি কোমায় চলে যান। সে অবস্থায় কখনও কখনও জ্ঞান ফিরলে তিনি একটি কথাই জিজ্ঞাসা করতেন- ‘আফ্রিকার অসহায় মানুষদের কি অবস্থা, দাওয়াতের কি অবস্থা?’

    জীবনের শুরুকাল থেকেই তিনি দারিদ্রে্যর কষ্টকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। তিনি যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তীব্র গরমে রাস্তায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য অপেক্ষমাণ শ্রমিকদের দেখে খুব কষ্ট পান। তাদের দুর্দশা লাঘবে সেই বয়সেই তিনি বন্ধুদের নিয়ে পুরোনো গাড়ি ক্রয় করে বিনা ভাড়ায় তাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু করেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করার পর ১৯৭৪ সালে লন্ডন এবং ১৯৭৮ সালে কানাডা থেকে উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। অতঃপর দেশে ফিরে চিকিৎসা পেশায় জড়িত হওয়ার পরিকল্পনা করলেও স্ত্রীর উৎসাহে অবশেষে তিনি শৈশবের স্বপ্ন তথা প্রান্তিক মানবসেবাকেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করেন। কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেন আফ্রিকাকে। হিসাববিজ্ঞানে উচ্চডিগ্রীধারী তাঁর স্ত্রী কেবল উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া অর্থ-সম্পদ দান করে দেন এই কার্যক্রমে। কুয়েতের আয়েশী জীবন ত্যাগ করে স্বামীর সাথে মাদাগাস্কারের মানাকারা গ্রামের ছোট্ট একটি গৃহে বসবাস শুরু করেন। দুস্থ, অশিক্ষিত, সভ্যতার আলোকহীন কালো মানুষদের জন্য তাঁরা কেবল বৈষয়িক সহযোগিতাই নয়, বিশুদ্ধ জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার সার্বিক ব্যবস্থা করেন। সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায়গুলো নামে মুসলমান হলেও তাদের কৃষ্টি-কালচার ছিল কবর-মাযারকেন্দ্রিক শিরক ও বিদ‘আতে আচ্ছন্ন। এই দৃশ্য দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং তাঁদের মধ্যে তাওহীদের বিশুদ্ধ দাওয়াত প্রচারের ব্যবস্থা করেন। তাঁর কার্যক্রম ধীরে ধীরে আফ্রিকার ২৯টি দেশে বিস্তার লাভ করে। তিনি সুবিধাবঞ্চিত এলাকাসমূহে একের পর এক হাসপাতাল, ইয়াতীমখানা, হিফযখানা, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করতে থাকেন। এভাবে দুর্ভিক্ষ ও অজ্ঞতার করাল গ্রাসে ডুবে থাকা আফ্রিকার কয়েক কোটি হতদরিদ্র মানুষ তাঁর মাধ্যমে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন খুঁজে পায়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মাঝে তাঁর এই মানবিক কার্যক্রমে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।

    দুস্থ মানবতার সেবায় ময়দানে নামলেও মূলতঃ দ্বীনের দাওয়াতই পরিণত হয় তাঁর ধ্যানজ্ঞান। প্রতিটি পদক্ষেপেই যেন তিনি দ্বীন প্রচারের সুযোগ নিতেন। এমনি একদিনের ঘটনা। কোন এক গ্রামে গিয়ে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার পর নিজে তিনি খেতে বসে উচ্চৈঃস্বরে বললেন- ‘একমাত্র আল্লাহ, যিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও জীবন-মৃত্যুর মালিক, তিনিই তাঁর অসীম অনুগ্রহে আমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন’। তাঁর এই ছোট্ট কথাটিই উপস্থিত মানুষদের হৃদয়ে দাগ কেটে গেল এবং সাথে সাথে তারা ইসলাম কবুল করে নিল। কখনও দেখা যেত পুরো একটি গ্রাম তাঁর সুন্দর আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তিনি বলতেন, যদিও আমার ইসলাম প্রচারের অভিজ্ঞতা ২৫/২৬ বছরের বেশী নয়, তবুও আমি বলব মানুষের প্রতি সুন্দর আচরণই দাওয়াতের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হ’ল, যখন আমি দেখি কারো শাহাদাত আঙ্গুলি প্রথমবারের মত আকাশমুখী হয়ে আল্লাহ্র একত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে’।

    ব্যক্তিজীবনে তিনি কখনও বিশ্রামের কথা ভাবেননি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোথায় থামতে চান? তিনি বলেন, ‘মৃত্যু না আসা পর্যন্ত আমার বিরতি নেয়ার কোন সুযোগ নেই। কেননা হিসাবের দিনটি খুব কঠিন। তোমরা জান না আব্দুর রহমান কত বড় পাপিষ্ঠ। আমি কিভাবে অবসর নেব যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ হেদায়াতের দাওয়াত পেতে উন্মুখ হয়ে আছে? কিভাবে আমি বসে থাকতে পারি, যখন এই নওমুসলিম সন্তানদেরকে পুনরায় দ্বীন থেকে দূরে সরানোর জন্য ইসলাম বিরোধীরা তৎপর রয়েছে?’

    ২০১৩ সালে এই মহান দাঈ ইলাল্লাহ চিরবিদায় গ্রহণ করেন। স্বীয় কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘বাদশাহ ফায়ছাল পুরস্কার’ সহ বহু পুরস্কার লাভ করেছেন। তবে সেসব পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত সকল অর্থ মানবতার সেবায় দান করে দিয়েছেন। মানুষকে সর্বদা মানবতার কল্যাণে অগ্রগামী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে বলতেন, ‘আমাদের প্রত্যেকেরই একটি মিশন থাকা উচিৎ, যা হবে এই পৃথিবীকে অধিকতর উত্তম পৃথিবী হিসাবে রেখে যাওয়ার মিশন’। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের সবাইকে আফ্রিকায় গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে তা নয়; কিন্তু কখনও নিজ গৃহে ও নিজ সমাজে দাওয়াত দেয়া বন্ধ করো না। মানুষের সামনে নিজেকে উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপন কর। যেন মানুষ তোমাকে দেখে কল্যাণের পথে উৎসাহিত হয়’ ।

    দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের মুসলিম তরুণরা কেবল মাদার তেরেসারদের কথাই জানে। অথচ তাদের প্রকৃত রোল মডেলরা দৃশ্যপটের আড়ালেই থেকে যান। ডা. আব্দুর রহমান সুমাইতের মত নিষ্ঠাবান মহান দাঈ’র কথা আমরা ক’জনেই বা জানি! অথচ তাঁদেরই কিনা হওয়ার কথা ছিল তরুণদের প্রেরণাবাতি! আল্লাহ রাববুল আলামীন এই মহান মানবসেবী দাঈকে জান্নাতুল ফেরদাউস নছীব করুন এবং মুসলিম তরুণ সমাজকে তাঁর মত দাঈদের পদাঙ্ক অনুসরণে দ্বীনের প্রকৃত খাদেম হিসাবে গড়ে ওঠার তাওফীক দান করুন- আমীন!

     


    HTML Comment Box is loading comments...