সফল খতীব হওয়ার উপায়
(২য় কিস্তি)
তৃতীয়ত : ইলমের ভান্ডার এবং সাংস্কৃতিক সম্ভার :
এই বিষয়বস্ত্ত কয়েকটি জিনিসকে শামিল করে। যা নিম্নে পেশ করা হ’ল-
(ক) পবিত্র কুরআনুল কারীম মুখস্থ করা :
খতীব তার বক্তব্যে আয়াত সমূহ সুন্দরভাবে সন্নিবেশিত করবে। যদি আয়াত তেলাওয়াত করে তাহ’লে তার বিবরণ পেশ করবে। অথবা তার বেশী অংশ হ’তে অল্প পরিমাণ হ’লেও তেলাওয়াত করবে। নিঃসন্দেহে হাফেযে কুরআনের ক্বলবে অধিক পরিমাণ আয়াত সংরক্ষিত থাকে। নিশ্চয়ই এই গুণাবলী সফল খতীবের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। প্রয়োজনীয় পরিমাণ তেলাওয়াত করা খতীবের জন্য যরূরী শুধু সুরেলা কণ্ঠে আবৃত্তি নয় বরং প্রথমত খতীবকে আল্লাহর কিতাব ছহীহ ও শুদ্ধ ভাষাগত ভুল-ত্রুটি ছাড়াই সাবলীলভাবে তিলাওয়াত করতে সক্ষম হওয়া। এ মর্মে আল্লাহর বাণী, وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا ‘আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন তিলাওয়াত কর’ (মুয্যাম্মিল ৭৩/৪)।
অতঃপর বক্তব্যের বিষয়বস্ত্তর সাথে সম্পৃক্ত আয়াত সমূহ উপস্থাপন করার এবং সেই আয়াতের তাফসীরে বিদ্বানগণের অভিমত জানা আর এর ব্যাখ্যার ছহীহ ও যঈফ কে পার্থক্য করার এবং এ সংশ্লিষ্ট ইসরাইলী কাহিনী ও মিথ্যা উদ্ভট কথা এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে ইলম অর্জন করা।
আর খতীবের জন্য সতর্কতা হ’ল সে যেন আয়াত সমূহ যথাযথ ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যত্র চালিয়ে না দেয় (অপব্যাখ্যা যেন না করে) অথবা আয়াত সমূহকে যামানার উন্মোচিত কোন মতবাদের অধীনে না করে অথবা সময় ও স্থানগত কোন ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা না করে। এই উল্লিখিত বিবরণ সমূহ আল্লাহর দ্বীনের বিপরীত কাজ।
(খ) রাসূলের (ছাঃ)-এর হাদীছ অধিক পরিমাণে মুখস্থ করা :
আর বিশেষ করে নতুন খতীবদের জন্যرياض الصالحين কিতাব মুখস্থ করা উচিত। কেননা এ কিতাব সহজ, অল্প শব্দ এবং সুন্দর ইবারত বিন্যাস করণ এবং অধ্যায়ের সাথে বিষয়বস্ত্তর অধ্যায় মিল করা হয়েছে নিপুনতার সাথে।
(গ) কুরআনুল কারীমের কিছ্ছা-কাহিনীর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য :
যেহেতু কুরআন মাজীদে অনেক শিক্ষণীয় কাহিনী রয়েছে যাতে মানুষের চিন্তার খোরাক আছে। আর মানুষ এ প্রকারের আলোচনা পসন্দ করে।
কুরআনের বিভিন্ন উল্লিখিত কিচ্ছা-কাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِنْ قَبْلِكَ مِنْهُمْ مَنْ قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ لَمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ-
‘আর অবশ্যই আমি তোমার পূর্বে অনেক রাসূল পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে কারো কারো কাহিনী আমি তোমার কাছে বর্ণনা করেছি আর কারো কারো কাহিনী তোমার কাছে বর্ণনা করিনি’ (মু’মিন ৪০/৭৮)।
(ঘ) রাসূল (ছাঃ)-এর যুদ্ধ সমূহ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা ও যোদ্ধাদের জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের উপস্থাপন করা :
কেননা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ হ’ল ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের জীবন ও সম্পদ সমূহ ক্রয় করে নিয়েছন’। মহান আল্লাহর ঘোষণা-
إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে। অতঃপর তারা হত্যা করে অথবা নিহত হয়। এর বিনিময়ে তাদের জন্য (জান্নাত লাভের) সত্য ওয়াদা করা হয়েছে তাওরাত, ইনজীল ও কুরআনে। আর আল্লাহর চাইতে নিজের অঙ্গীকার অধিক পূরণকারী আর কে আছে? অতএব তোমরা এই ক্রয়-বিক্রয়ের বিনিময়ে (জান্নাতের) সুসংবাদ গ্রহণ কর যা তোমরা তাঁর সাথে করেছ। আর এটাই হ’ল মহান সফলতা’ (তওবা ৯/১১১)।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ‘হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম। আর ওটা হল নিকৃষ্ট ঠিকানা’ (তওবা ৯/৭৩)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাদীছে আল্লাহর রাস্তায় ‘জিহাদের আলাদা ১০০ গুণ মর্যাদা বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন,
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم- قَالَ يَا أَبَا سَعِيدٍ مَنْ رَضِىَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ. فَعَجِبَ لَهَا أَبُو سَعِيدٍ فَقَالَ أَعِدْهَا عَلَىَّ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَفَعَلَ ثُمَّ قَالَ وَأُخْرَى يُرْفَعُ بِهَا الْعَبْدُ مِائَةَ دَرَجَةٍ فِى الْجَنَّةِ مَا بَيْنَ كُلِّ دَرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ. قَالَ وَمَا هِىَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّه-ِ
‘আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, হে আবু সাঈদ! যে কেউ আল্লাহকে রব, এবং ইসলামকে জীবন বিধান মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নবী হিসাবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছে তার উপর জান্নাত অবধারিত হয়ে গেছে। এ কথা শুনে আবু সাঈদ আশ্চর্যবোধ করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কথাটি আমাকে পুনরায় বলুন। সুতরাং তিনি কথাটি আবার বললেন। এতদ্ভিন্ন আরো একটি কাজ আছে যা জান্নাতে বান্দার মর্যাদা একশ গুণ বৃদ্ধি করে দেয়। এর যে কোন দু’টি স্তরের উচ্চতার মাঝখানে আসমান ও যমীনের সমান ব্যবধান। তখন আবু সাঈদ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেই কাজটি কি? তিনি বললেন আল্লাহর পথে জিহাদ, আল্লাহর পথে জিহাদ’।[1]
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَىُّ النَّاسِ أَفْضَلُ فَقَالَ رَجُلٌ يُجَاهِدُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ بِمَالِهِ وَنَفْسِهِ قَالَ ثُمَّ مَنْ قَالَ مُؤْمِنٌ فِى شِعْبٍ مِنَ الشِّعَابِ يَعْبُدُ اللَّهَ رَبَّهُ وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ-
‘আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, সবচেয়ে উত্তম লোক কে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে তার জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে। এরপর আবার জিজ্ঞেস করল এরপর কে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি গিরি-সংকটে বসবাস করে আল্লাহর ইবাদত করে এবং নিজের অনিষ্ট থেকে মানুষকে নিরাপদে রাখে’।[2]
(ঙ) ছাহাবীগণের জীবনীর প্রতি দৃষ্টিপাত :
তারা হ’লেন শ্রেষ্ঠতম মানব এবং মনোনীত জামা‘আত। মানুষের নিকট তারা অনুকরণীয় নমুনা এবং মানুষের জীবনের সাথে মেলবন্ধন। রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের সম্পর্কে বলেন, خَيْرُ أُمَّتِى الْقَرْنُ الَّذِينَ يَلُونِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ يَجِىءُ قَوْمٌ تَسْبِقُ شَهَادَةُ أَحَدِهِمْ يَمِينَهُ وَيَمِينُهُ شَهَادَتَهُ- আমার উম্মতের মধ্যে উত্তম লোক হচ্ছে আমার যুগের সংশ্লিষ্ট লোকে (ছাহাবীরা)। অতঃপর তাদের যুগের সাথে সংযুক্ত যুগের লোকে (তাবেঈরা)। অতঃপর তাদের যুগের সাথে সংযুক্ত যুগের লোক (তাবে-তাবেঈগণ)। অতঃপর এমন লোকের আর্বিভাব হবে যারা সাক্ষ্য দেয়ার পরপর শপথও করবে এবং শপথ করার সাথে সাথে সাক্ষ্যও দিবে’।[3]
(চ) শরী‘আতের ইমামত ও ছালাত সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান :
এই গুণাবলী প্রথম গুণাবলী (হিফযুল কুরআন) শাখা। কিন্তু আমরা ছালাত ও ইমামতকে আলাদা করেছি এর প্রতি গুরুত্ব ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
সুতরাং খতীবের উচিত হবে তাকে খুৎবা ও ছালাতের শর্তসমূহ, গ্রহণীয় ও অগ্রহণীয় হওয়ার নিয়ম-কানুন ও তার ধরনসমূহ এবং এর পূর্ণতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা। আর এই শর্তারোপ করা হয়নি যে তাকে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানী, মুজতাহিদ হ’তে হবে তাকে সমস্ত হুকুম-আহকামের ব্যাপারে মুফতি ও সৃষ্টিজগতের মাঝে পন্ডিত হওয়ার শর্তারোপ করা হয়নি। কেননা অবশ্যই ঐ গুণাবলী সমূহ পূর্ণতার শিখরে আরোহনের জন্য সহায়ক। তবে তা খতীব হিসাবে গ্রহণীয় ও অগ্রহণীয় হওয়ার মাপকাঠি নয়।
(ছ) ইতিহাসের জ্ঞান :
ইতিহাস চর্চা খতীবকে সচেতন করে ও তার বিবেককে শানিত করে। তার মাঝে অতীত জাতির অবস্থা, মণীষীগণের জীবন চরিত এবং তাদের সেই সময়কাল ও (বর্তমান) সময় কালের অবস্থা সম্পর্কে সজাগ করে তোলে এবং ইতিহাসে সে অবলোকন করবে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রদত্ত জাতিসমূহের এবং তাদের সমাজ ও ব্যক্তিবর্গের উপর আপতিত শাস্তি, জয় ও পরাজয়ের আহবান। সুতরাং ইতিহাস থেকে ঈমান, তাকওয়ার সুফল এবং কুফরী ও পাপাচারের কুফল স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হয়। ইতিহাস হ’ল পেছনের ফেলা আসা যুগসমূহের দর্পণ।
আল্লাহ তা‘আলা (কুরআনে) কিচ্ছা-কাহিনীর গুরুত্ব এবং পূর্ববর্তীদের অবস্থা দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহর বাণী,قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلُ كَانَ أَكْثَرُهُمْ مُشْرِكِينَ- ‘বল, তোমরা যমীনে ভ্রমণ কর। অতঃপর দেখ পূর্ববর্তীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল। তাদের অধিকাংশই ছিল মুশরিক’ (রূম ৩০/৪২)।
তিনি অন্যত্র বলেন, وَكَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِنْ قَرْنٍ هُمْ أَشَدُّ مِنْهُمْ بَطْشًا فَنَقَّبُوا فِي الْبِلَادِ هَلْ مِنْ مَحِيصٍ- ‘আমরা তাদের পূর্বে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছি। যারা পাকড়াও করার ক্ষেত্রে এদের তুলনায় ছিল প্রবলতর, তারা দেশ-বিদেশ চষে বেড়াত। তাদের কি কোন পলায়নস্থল ছিল’? (ক্বাফ ৫০/৩৬)।
তিনি আরো বলেন,
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ-
‘নিশ্চয়ই নবীদের কাহিনীতে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে’ (ইউসুফ ১২/১১১)।
যখন দাঈ ও খতীব ইতিহাস অধিক চর্চা করবে এবং সেখান থেকে ফায়েদা হাছিল করবে, তখন তার জন্য সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। সে যে পথের দাওয়াত দেয় তাতে আরো সঠিকভাবে নিয়োজিত হ’তে সহায়ক হবে। বিশেষ করে যখন সে কোন স্থানের দৃষ্টান্ত পেশ করবে এবং কোন বিষয়ে সাদৃশ্য বোঝানোর জন্য সহায়তা নিবে। (ক্রমশঃ)
(আমীর ইবনে মুহাম্মাদ আল-মাদরীর বই অবলম্বনে লিখিত)
[লেখক : ২য় বর্ষ আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]
[1]. মুসলিম হা/১৮৮৪; মিশকাত হা/৩৮৫১।
[2]. বুখারী হা/২৭৮৬; মুসলিম হা/১৮৮৮।
[3]. বুখারী হা/২৬৫২; মুসলিম হা/২৫৩৩।