• free web stats
  • At-Tahreek
    পরশ পাথর

    গুয়ানতানামো বে’র কারারক্ষীর ইসলাম গ্রহণ

     

    টেরি হোল্ডব্রুক ১৯ বছরের আমেরিকান এক উচ্ছৃঙ্খল যুবক। হাতে ট্যাটু আঁকা, উন্মত্ত চলাফেরা, মদ, যৌনতা আর রক এন্ড রোল মিউজিকে ডুবে থাকত জীবন। তিনি ভাবতেন সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই, দুনিয়ার জীবনই সব। এগুলো ২০০৩ সালের কথা।

    কিন্তু মহান আল্লাহ যাকে হেদায়াত দেন, দুনিয়ার কোনো শক্তি নেই তাকে সত্য পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে। আল্লাহ বলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে সরল পথ প্রদর্শন করে থাকেন’ (বাক্বারা ২/১৪২)

    এর প্রমাণ হিসেবেই যেন ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে নিজেকে মুসলিম ঘোষণা করে, টেরি হোল্ডব্রুক থেকে হয়ে যান মুছত্বফা আবদুল্লাহ।

    ৭ জুলাই ১৯৮৩ সালে আমেরিকার আরিজোনায় জন্ম নেওয়া টেরি হোল্ডব্রুকের বয়স যখন সাত, বাবা-মা তাকে ফেলে যে-যার-মতো পথ বেছে নিয়েছিলেন। টেরি বড় হ’লেন দাদার কাছে।

    ২১ বছর বয়সে টেরি ভাবলেন, কিছু একটা করা দরকার। ৯/১১-এর কিছু পরের ঘটনা, আমেরিকায় তখন মিলিটারিতে নতুন নিয়োগ দেয়া হচ্ছে অনেক সৈন্যকে। বিশেষ বোনাস পাওয়ার সুবিধা দেখে মিলিটারি পুলিশের চাকরি নিলেন টেরি।

    টেরির দায়িত্ব পড়ল গুয়ানতানামোর বে’র কারারক্ষী হিসাবে। ইসলাম নিয়ে তখন টেরির কোনো ধারণাই ছিল না। তাকে বারবার ৯/১১-এর ভিডিও দেখানো হ’ত, বলা হ’ত, গুয়ানতানামো বে’তে যারা আছে, তারা এসব করেছে, তারা মানুষ নয়। তারা সামনে পেলেই তোমাকে খেয়ে ফেলবে। এদের সাথে কথা বলবে না, মেলামেশা করবে না। কারাগারে গার্ড দিতে গিয়ে একজনকে আবিষ্কার করলেন টেরি। তার বয়স ১৬। টেরি বুঝে উঠতে পারলেন যে, ছেলে এখনো সাগর দেখেনি, দুনিয়া কীভাবে চলে তা জানেনি, সে ওয়ার অন টেরর-এর কী বুঝে?

    টেরি আরো দেখলেন, কিছু সাধারণ মুসলিমদের, যাদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে আনা হয়েছে। তাদের কেউ ট্যাক্সি ড্রাইভার, ডাক্তার, প্রফেসর, সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ। টেরির দায়িত্ব ছিল কারাবন্দীদের ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে নিয়ে আসা। গুয়ানতানামো বে’র কারাগারে নিষ্ঠুর আর অমানুষিক নির্যাতনের সাক্ষী তিনি। তিনি বলেন, বন্দীকে শিকলে  বেঁধে  তাদের  উপর  হিংস্র কুকুর  লেলিয়ে

    দেয়া হ’ত, কুকুরগুলো তাদের মুখের ঠিক সামনে ঘেউ ঘেউ করত এবং কখনো কামড়ে দিত।

    প্রচন্ড চাপের মুখে রাখা হ’ত কারাবন্দীদের, তাদের  প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝে লোহার খাঁচায় ফেলে রাখা হ’ত দিনের পর দিন। এমন কারাবন্দীও আছে গুয়ানতানামো বে’তে, যাদের রুমের বাতি গত ৬/৭ বছর ধরে বন্ধ করা হয়নি, ক্ষণিকের জন্য তারা অন্ধকারে শান্তিতে ঘুমাতে পারেননি। টর্চারের সময় তাদের মুখের সামনে ৬০ ডিগ্রী তাপমাত্রার আলো জ্বালিয়ে রাখা হ’ত, কানের কাছে গান বাজানো হ’ত ঘন্টার পর ঘন্টা।

    টেরি বলেন, গুয়ানতানামো বে’তে বন্দীদের নির্যাতন করা হ’ত কোনো কারণ ছাড়াই। কথা নেই, বার্তা নেই, চার-পাঁচ জন এসে কোনো বন্দীকে ধরে বেধড়ক পেটাতে শুরু করত, কখনো দরজার মধ্যে হাত-পা চাপা দিত। তারা বন্দীদের মাথা ধরে কমোডে চুবিয়ে দিয়ে ফ্লাশ করে দিত। কখনো তার মরিচের গুঁড়া স্প্রে করে দিত বন্দীদের মুখে।

    কারাবন্দীদের সাথে ফাঁকে ফাঁকে কথা বলতে চেষ্টা করতেন টেরি। তার সহকর্মীরা বিষয়টি পসন্দ করত না, তারা তাকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলত, আমরা আজকেই তোমার মাথা থেকে তালিবানদের ভূত তাড়াবো, তবু টেরি হাল ছাড়লেন না। অবাক হয়ে দেখলেন এই মুসলিমগুলোর উপর শত অত্যাচার আর নির্যাতন সত্ত্বেও তাদের মাঝে যেন একটা প্রশান্তি আর সন্তুষ্টি আছে। বন্দী হয়েও তারা যেন মুক্ত, আর কারারক্ষী হয়েও টেরি যেন বন্দী। সবসময় বসের অর্ডার মানতে গিয়ে তার নিজেকে মনে হ’ত দাস। তার যেন থেকেও নেই, আর বন্দীদের কিছু নেই তবু তাদের মুখে হাসি। নাইট শিফটের সময়ে তিনি বন্দীদের সাথে খোলাখুলিভাবে সবকিছু নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস, কালচার, নৈতিকতা সবকিছু। কারাবন্দীদের ইসলাম চর্চায় তিনি মুগ্ধ হ’লেন।

    তিনি ইসলামের মধ্যে তা আবিষ্কার করলেন যার সন্ধান তিনি এতদিন করে আসছিলেন, শৃঙ্খলা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা, যা একজন মানুষের হৃদয়কে তুষ্ট করতে পারে। অবাধ স্বাধীনতা কেবল মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে অনিয়ন্ত্রিত করে তোলে, কখনই তা হৃদয়কে শান্ত করতে পারে না। তিনি আল্লাহর দাসত্বের মাঝে শান্তি পেতে শুরু করলেন।

    আহমেদ এরাচিদি নামের এক মরোক্কানের সাথে টেরির পরিচয় হয় কারাগারে। আহমেদ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর গুয়ানাতানামোয় বন্দী ছিলেন। আল-কায়েদার ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেয়ার অভিযোগে তাকে আটকে রাখা হয়। আহমেদ তার কুরআনের কপিটি টেরিকে পড়তে দিলেন। টেরি কুরআন পড়তে শুরু করলেন, এবং এর মাঝে তিনি যুক্তিবোধের ছোঁয়া পেতে থাকলেন। খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদিধর্ম কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু তিনি ইসলামের প্রেমে পড়ে গেলেন। তার ভাষায়, ‘আমি যতই ইসলামকে জানতে লাগলাম, ইসলাম যেন ততই আমার কাছে আসতে লাগল’।

    টেরির অন্য সহকর্মীরা যেখানে পর্নোগ্রাফি, নেশা আর খেলাধূলায় ব্যস্ত, সেখানে টেরি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনায় সময় ব্যয় করতে লাগলেন। আজকের গতানুগতিক মুসলিমদের যেখানে বছরে এক ঘন্টাও ইসলাম নিয়ে পড়াশোনার সময় হয় না, সেখানে টেরি প্রতিদিন ইসলামকে জানতে ও বুঝতে ব্যয় করতে থাকেন। একটা সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।

    এক কারাবন্দীদের কাছে গিয়ে জানালেন এ কথা। সে বলল, তুুমি ভালো করে ভেবে দেখেছ তো? ইসলাম কোনো হাসিঠাট্টার বিষয় নয়, এটা সিরিয়াস ব্যাপার, জীবন বদলে যাবে তোমার। তোমাকে মদ খাওয়া ছাড়তে হবে, শরীরে ট্যাটুবাজি বন্ধ করতে হবে, নোংরা কাজকর্ম ছেড়ে দিতে হবে। তোমার চাকরি হারার সম্ভাবনা আছে, তোমার পরিবার তোমাকে ত্যাগ করতে হ’তে পারে, পারবে?

    টেরি ভেবে দেখলেন, হ্যাঁ, তিনি পারবেন, ইসলামের আলো যার মধ্যে প্রবেশ করেছে, সে কেনইবা পারবে না দুনিয়ার চাকচিক্য ছেড়ে আল্লাহর দিকে ফিরতে? অবশেষে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে টেরি কারাবন্দীদের মাঝে আরবিতে ঘোষণা দিলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল’। সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

    টেরি মদপান ছেড়ে দিলেন, গান-বাজনাও ছেড়ে দিলেন। টেরির ইসলাম গ্রহণের কথা তার সহকর্মীরা জানলে সমস্যা হ’তে পারে মনে করে তাকে লুকিয়ে ছালাত পড়তে হ’ত, ঘনঘন তাকে বাথরুমে যেতে হ’ত।

    ২০০৪ সালে টেরিকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় 'general Personality disorder'-এর অজুহাতে।

    টেরি হোল্ডব্রুক গুয়ানতানামোর সেই অল্প কিছু কারারক্ষীদের একজন যারা কিনা আমেরিকার শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মিথ্যা আশ্বাসকে তুলে ধরছেন সবার সামনে। তিনি বলেছেন, আমেরিকানদের লজ্জা পাওয়া উচিত এই জঘন্য কারাগারের মালিক হওয়ার জন্য। তিনি বর্তমানে তাই কাজ করে যাচ্ছেন মুসলিম লিগ্যাল ফান্ড অফ আমেরিকার সাথে। যে সকল আমেরিকান নাগরিক অন্যায়ভাবে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে বন্দী হয়ে আছেন কারাগারে, তাদের মুক্তির জন্য তারা ফান্ড তুলছেন এবং আইনগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

     

     


    HTML Comment Box is loading comments...