• free web stats
  • At-Tahreek
    ভ্রমণস্মৃতি

    মেঘের রাজ্য সাজেকে

     

    বাংলাদেশের পাহাড়ী সৌন্দর্যের রাজধানী বান্দরবানে সর্বপ্রথম পা রেখেছিলাম ২০১২ সালে। তারপর গেলাম ২০১৪-এর নভেম্বরে। দ্বিতীয় সফরের পরিশ্রমের কথা স্মরণ করলে পাহাড়ের পথ মাড়ানোর ইচ্ছাটা নিমেষেই উবে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু কেন জানি কিছুদিন পার হলেই হৃদয়ের মনিকোঠায় প্রকৃতির ডাক আকুলি-বিকুলি করে। মধুর স্মৃতিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে বারবার। কষ্টের স্মৃতিগুলিকে ভুলিয়ে দিয়ে তাগাদা দেয় পূণর্যাত্রার। সেই হিসাবে আবার পরিকল্পনায় বসা। যথার্থ সফরসঙ্গী খোঁজা। আর গন্তব্য নির্ধারণ প্রচেষ্টা। সবমিলিয়ে এবারের গন্তব্য নির্ধারিত হল পাহাড়ী সৌন্দর্যের আরেক কেন্দ্রভূমি খাগড়াছড়ির সীমান্তবর্তী শহর সাজেক। আর সফরসঙ্গী আমাদের প্রায় সব দীর্ঘ ভ্রমণের সাথী এবং বহুদিনের সহপাঠী কাফী ভাই।

    ২৪ মে সন্ধ্যায় দেশ ট্রাভেলসে রওয়ানা হলাম চট্টগ্রামের পথে। সফরের পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে আত্মবিশ্বাসের কোন ঘাটতি নেই। ফলে ফুরফুরে মেজাজে নানা আলোচনায় দীর্ঘ ১২ ঘন্টা সময় কেটে গেল। পৌঁছে গেলাম চট্টগ্রাম।

    ২৫ তারিখ সকাল ৭-টায় চট্টগ্রাম নেমে সোজা ফুফাতো বোনের বাসায়। খাওয়া-দাওয়া আর সামান্য ঘুমের পর সিদ্ধান্ত নিলাম কক্সবাজার ঘুরে তারপর খাগড়াছড়ি যাবো।  দুপুরে ফোন দিলাম চট্টগ্রামে চাকুরীরত আমাদের বহুদিনের সহপাঠী, রাজশাহী মহানগরী ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সাবেক সেক্রেটারী সাইফুল ইসলাম ভাইকে। চট্টগ্রামে আমাদের আগমনের সংবাদ জেনে সাইফুল ভাই প্রায় আকাশ থেকে পড়ল। তবুও বন্ধুত্বের দাবী বলে কথা। কীভাবে যেন দ্রুত অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করে নিল। বিকালে তিনজনে রওয়ানা হয়ে গেলাম কক্সবাজারের পথে। পথে বৃষ্টি শুরু হ’ল। মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। কারণ বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির উচ্ছ্বল সাঁজ মানেই ভ্রমণ স্বার্থক হয়ে ওঠা।

    রাত সাড়ে ১২টায় পৌঁছলাম কক্সবাজার শহরে। অফ সিজনের কারণে হোটেল গুলি প্রায় শূন্য। ইজি বাইকের ড্রাইভার তার পরিচিত হোটেলে নেওয়ার জন্য তৎপর। কিন্তু সাইফুল ভাই যে আগে থেকেই হোটেল স্যানোভায় রূম ঠিক করে রেখেছে। ফলে তার কোন উপকার করা গেল না। হাল্কা খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত দুইটা পার হয়ে গেল। কিন্তু তাতে কি! ফজরের আযান হতে না হতেই আমাদের অটো এলার্ম কাফী ভাইয়ের ডাক। রেডি হয়ে চললাম মসজিদ পানে। ছালাত শেষে রওয়ানা হলাম বীচের দিকে। ইজি বাইকের ড্রাইভার ভাইয়ের জিজ্ঞাসা, বীচের ডায়াবেটিস পয়েন্টে যাবেন কি-না। আমরা হাসতে লাগলাম। ডাইবেটিস ঘরে ঘরে যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, তাতে আগামী দিনে আরও কতকিছুর সাথে ডায়াবেটিস যুক্ত হবে কে জানে। সে যাই হোক ডায়াবেটিকস রোগীদের সৌজন্যে স্থানটি অমন নামে অভিহিত হয়েছে। সমুদ্রে এদিকটায় সাধারণতঃ ডায়াবেটিস রাগীরাই আসেন। আমরা ডায়াবেটিসমূক্ত আলহামদুলিল্লাহ। তাই লাবনী পয়েন্টই বেঁছে নিলাম। ভেবে অবাক হলাম দীর্ঘ ১১ বছর পর এলাম কক্সবাজার। কতদ্রুতই না জীবনের সময়গুলো পেরিয়ে যাচ্ছে। ভোরের নির্জন সমুদ্রতটে, উন্মুক্ত বাতাসে, মাদকতাময় নির্বিরাম ঢেউয়ের তোড়ে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে গেলাম হোটেলে। নাস্তা সেরে কাপড়-চোপড় নিয়ে আবার ফিরে এলাম গোসল সারতে। সপ্তাহখানেক পূর্বেই জলোচ্ছাস হয়ে যাওয়ায় সমুদ্র ছিল বেশ উত্তাল। তাই ঘন্টাখানিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েও বেশী গভীরে যেতে পারলাম না। অবশেষে সাগরের মায়া কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।

    আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মহেশখালী। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ী দ্বীপ মহেশখালী। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ শত বছর পূর্বে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়। কক্সবাজার থেকে মাত্র ১২ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই দ্বীপটিতে এখন তিন লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। যার ৯০ শতাংশই মুসলিম। এখানে প্রায় সাড়ে চারশ’ মসজিদ ও অর্ধ শতাধিক মাদ্রাসা রয়েছে। যাতায়াতের জন্য দু’টি পথ। সড়ক পথে চকরিয়া থেকে বদরখালী হয়ে যেকোন পরিবহনে অথবা কক্সবাজার থেকে ট্রলার বা স্পীড বোটে।

    আমরা বোট যাত্রাকেই অগ্রাধিকার দিলাম। হোটেল থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত কস্ত্তরী ঘাট বা ৬ নম্বর ঘাটে গিয়ে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে উঠে পড়লাম স্পীডবোটে। বোট চলতে শুরু করল তার আপন গতিতে। দু’পাশে সারি সারি জলাবন আর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল পানিরাশি। সমুদ্র বেশ উত্তাল থাকায় একটু গভীরে যেতেই রীতিমত নাচন শুরু হয়ে গেল ছোট্ট বোটটির। ৩-৪ ফুট উপরে উঠে পরক্ষণেই ধপাস করে পানিতে আছাড় খাচ্ছে। সবমিলিয়ে দুলকি চালে ২৫ মিনিটের বোট যাত্রা বড়ই রোমাঞ্চকর হ’ল।

    ঘাটে নামতেই রিকশা ও ইজিবাইক ওয়ালাদের ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেল। বুঝে শুনে একটা রিকশা ঠিক করে ফেললাম। এখানকার দর্শনীয় স্থান হ’ল- মৈনাক পাহাড়, শুটকী মহাল, লবণ মাঠ, গোরকঘাটা জমিদারবাড়ী, আদিনাথ মন্দির, বৌদ্ধ প্যাগোডা ইত্যাদি। শুরুতেই ঘোরকঘাটা বৌদ্ধ বিহারের একটি প্যাগোডায় নিয়ে গেল রিকশাওয়ালা। সাজানো গোছানো ছবির মত সুন্দর পরিবেশ। ভিতরে ক’জন ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে। মুর্তির সামনে নানা পদের পানীয় সহ সারি সারি খাবার। যেন ঘুম থেকে উঠেই খেতে বসবে। পাশেই আরেকটি প্যাগোডায় গেলাম। দেখি মূর্তির সামনে একজন পূজা দিচ্ছে। হাতজোড় করে সশব্দে কতকিছু যে বলছে, তার আগামাথা বোঝার সাধ্য নেই আমাদের। তারপর চলে আসলাম বিখ্যাত আদিনাথ মন্দিরে। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮৮ ফুট উঁচু মৈনাক পাহাড় চুড়ায় অবস্থিত এই মন্দিরটি। অনেকগুলি সিড়ি মাড়িয়ে প্রবেশ করলাম সেখানে। দেখি মন্দিরের লোকেরা বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। জঙ্গীবাদের উত্তাপে যখন টগবগ করেছে দেশ, সেই মুহূর্তে আমাদের মত বেশভূষাধারীদের দেখে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে ঠাট-বাট বজায় রেখে আমরা ঘুরেফিরে দেখলাম সবকিছু। পাহাড়ের উপর থেকে পুরো দ্বীপটা দেখতে অনেক মনোরম। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেমে এসে দ্বীপের মিষ্টি ডাব খেয়ে ফিরে এলাম জেটি ঘাটে। ফিরতি পথে ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকা পেয়ে উঠে বসলাম তাতে। প্রায় ১ ঘন্টা সময় লাগলেও বেশ মজা পেলাম এই যাত্রা পথে।

    দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হলাম হিমছড়ি ও ইনানী বীচের উদ্দেশ্যে। ৬৫০ টাকা চুক্তিতে ইজিবাইক ভাড়া করে চললাম অনিন্দসুন্দর মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে। একপাশে পাহাড় আরেকপাশে সাগরবেষ্টিত মসৃণ এই সড়কটিকে দেশের সুন্দরতম সড়ক। সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে নির্মিতব্য ৮২ কি.মি. দীর্ঘ এই সড়কটি টেকনাফে গিয়ে শেষ হয়েছে। বর্তমানে ৪৮ কি.মি.-এর কাজ শেষ। বাকী অংশের কাজ চলমান। কক্সবাজার থেকে ৮ কি.মি. দূরে হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্র। আর ২৪ কি.মি. দূরে উখিয়া উপযেলার অন্তর্গত ইনানী বীচ। প্রথমে গেলাম কোরাল পাথর ঘেরা ইনানীতে। প্রায় জনমানবশুন্য বীচে সমুদ্রের নীল পানিরাশির মধ্যে সারি সারি কালো প্রবাল পাথরের মেলা। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে খেলা করছে ছোট ছোট লাল কাকড়া। চারিদিকে শামুক আর ঝিনুকের ছড়াছড়ি। পাথরগুলি ভাটির সময় দৃশ্যমান হয়। আবার জোয়ারে ডুবে যায়। আমরা বিকালের শুরুতে যাওয়ায় তখন পাথরস্ত্তপ অনেকটাই ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ পানির মধ্যে কাটিয়ে, শৈশবের আনন্দে এ পাথর থেকে সে পাথর লাফালাফি করে ফিরে আসলাম। বীচের পাশে বড় বড় সাইজের ডাব দেখে না থেমে পারলাম না। কারণ আগে থেকেই এখানকার ডাবের তীব্র মিষ্টতা সম্পর্কে জানা ছিল। তারপর ফিরে চললাম হিমছড়ির উদ্দেশ্যে। বাইক থেকে নেমে সোজা পাহাড়ের মাথায়। শেষ বিকালে প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়চূড়া থেকে সমুদ্রের ফেনিল ঢেউগুলির উপকূলে আছাড় খাওয়ার সুন্দর দৃশ্য মানসপটে বন্দী করে ফিরে চললাম পরবর্তী গন্তব্যে।

    হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠে পড়লাম। এভাবেই তৃপ্তিময় একটি দিন কাটিয়ে রাত্রি ১২ টায় পৌঁছে গেলাম বোনের বাসায়।

    পরদিন ফজর ছালাত আদায়ের পর শুরু হ’ল পরবর্তী গন্তব্য খাগড়াছড়ি যাওয়ার প্রস্ত্ততি। ভোর ৬-টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম অক্সিজেন বাস স্ট্যান্ডে। যেখান থেকে প্রতিদিন ৬-টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ১ ঘন্টা পর পর শান্তি পরিবহনের বাস ছেড়ে যায় খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। ৭-টার ২য় ট্রিপে রওয়ানা হলাম। কিছু সময় পার হতেই দেখা মিলতে শুরু করল সবুজ পাহাড়ের সারি। পথে ফোন দিলাম ফরিদপুরের নতুন আহলেহাদীছ, বর্তমানে রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে হিজরত করে আসা সেনাবাহিনীতে চাকুরীরত মাসঊদ ভাইকে। উনি সরাসরি বাঘাইছড়ির বাঘাইহাট এলাকায় অবস্থিত ১০ নম্বর সেনাক্যাম্পে চলে আসার জন্য বললেন। বেলা সাড়ে ১০-টায় আমরা পৌঁছালাম খাগড়াছড়ি শহরে। অটোতে চড়ে চলে এলাম দিঘিনালাগামী পরিবহন স্ট্যান্ডে। উঠে বসলাম একটি চাঁদের গাড়িতে। আমাদের মুখোমুখি বসা সুন্দর দাড়িওয়ালা একজন ভাইকে দেখে পরিচিত হলাম। জানলাম তিনি দিঘিনালা উপযেলা মসজিদের ইমাম। প্রথমে তিনি আমাদেরকে তাবলীগ জামা‘আতের সাথী মনে করলেও পরে আমাদের উদ্দেশ্য জেনে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকা জানিয়ে বললেন, গতকালও এখানে একজনকে কে বা কারা কুপিয়ে হত্যা করেছে।

    অপরাধের উপত্যাকা হিসাবে দিঘিনালা সম্পর্কে আগে থেকেই কিছুটা ভীতি রয়েছে। তার কথায় তা একটু বৃদ্ধি পেল। ৩৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম দিঘিনালা। এখান থেকেই সাজেকগামী ল্যান্ড ক্রুজার, চাঁদের গাড়ি, সিএনজি বা মটরসাইকেল ভাড়া নিতে হয়। তবে আমাদের লক্ষ্য ভিন্ন হওয়ায় ভাড়া হোন্ডায় চেপে চলে আসলাম সেনাবাহিনীর ১০ নং ক্যাম্পে। মাসঊদ ভাই এসে নিয়ে গেলেন ক্যাম্পের ভিতরে। সুন্দর সাঁজানো গোছানো ক্যাম্প। টিলার মাথায় বাঁশ নির্মিত অতিথিশালা। সেখানে আবার বাঁশের সোফাসেট ও খাট। লাইট-ফ্যান। এমনকি টয়লেটে হাইকমোড। জানালা দিয়ে দেখা মেলে সবুজ চাদরে ঢাকা পাহাড়ের সারি। আর সাথে নির্মল বায়ু প্রবাহ। মনে হচ্ছিল এ ঘরেই কাটিয়ে দেই সপ্তাহটা। ভাই বললেন, দাড়িওয়ালা মানুষ আসবে বলে আমাকে একদিনের জন্য অনুমতি নিতেই অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।

    যাইহোক জুম‘আর দিন। তাই কাপড়-চোপড় ছেড়ে পুকুরে গোসল সেরে স্থানীয় মসজিদে জুম‘আ পড়লাম। মসজিদ ভরা মুছল্লী দেখে মনটা ভরে গেল। কিন্তু খত্বীব ছাহেবের নিষ্প্রাণ ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য শুনে যথারীতি মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছালাতের পর পাশে অবস্থিত বেশ বড় একটা হেফয খানা পরিদর্শন করে ফিরে এলাম অতিথিশালায়। এবার খাদ্যগ্রহণের পালা। ভাই জানালেন যে, এসব স্থানে ভেজাল খাবারের কোন অস্তিত্ব নেই। তাই সবকিছুর স্বাদের একটু ভিন্নতা। তাঁর নিজ হাতে রান্না করে মুরগীর বিরানী খেয়ে সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারলাম। তাইতো তিনজনে বড় এক গামলা বিরানী মুহুর্তেই সাবাড় করে ফেললাম। তবে এ যাত্রায় ক্যাম্পের গা ঘেষে বয়ে যাওয়া কাচালং নদীর অনন্য স্বাদের মাছের কথা কেবল শুনেই ক্ষান্ত হলাম এবং ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিলাম।

    এরই মাঝে দুপুর ৩টা পার হয়ে গেল। খবর এলো সেনাবাহিনীর সাজেকগামী স্কট চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চেপে বসলাম যাওয়া-আসা বাবদ ২৪০০ টাকা চুক্তিতে ভাড়া করা দু’টি মটরসাইকেলে। পর্যটকদের জন্য ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় বেলা ১০টা ও দুপুর ৩টায় সেনা পাহারায় সাজেকগামী পর্যটকবাহী গাড়ীগুলি যাওয়া আসা করে। অফটাইম ও বিকালের ট্রিপ হওয়ায় সামনে কেবল একটা কার, তারপর আমরা এবং পিছনে বাহিনীর গাড়ি। পাহাড়ের উঁচু-নীচু ও অাঁকা-বাকা পথে হোন্ডায় চলার যে কি চমৎকার অনুভূতি তা কেবল অভিজ্ঞরাই জানেন। ৩৪ কি.মি. পথযাত্রার কিছুদুর যেতে না যেতেই নেমে আসলো বৃষ্টি। কেবল আমাদের জন্য পুরো স্কট থেমে থাকবে তা কি হয়! দল এগিয়ে চলল। আমরা ভিজতে লাগলাম। আমাদের অবাধ্য যাত্রায় মেঘগুলি যেন বিরক্তই হ’ল। এবার শুরু হ’ল ঝুম বৃষ্টি। বাধ্য হয়ে হোন্ডা থামিয়ে আশ্রয় নিলাম ছোট্ট একটি দোকানে। পুরো স্কট অপেক্ষমান। কেবল আমাদের জন্য দাড়াতে হচ্ছে দেখে বাহিনীর সদস্যরাও যেন বিরক্ত। আগত্যা আমাদের তিনজনকে তাদের খোলা জীপে নিয়ে নিলেন। হোন্ডাদু’টিও চলতে থাকলো সাথে সাথে।

    আধাঘন্টার মত চলার পর বৃষ্টির তেজ কমে এলো। গাড়ি থেকে নেমে উঠে পড়লাম হোন্ডায়। কিছুদুর গিয়ে একটা দোকান থেকে বিশাল সাইজ পলিথিন কিনে তাতে সবগুলি ব্যাগ ভরে দিয়ে আবার যাত্রা শুরু হ’ল। একটু পর আবার বৃষ্টির প্রকোপ। এবার ব্যাগগুলো না ভেজার গ্যারান্টি পেয়ে সবাই ভিজতে লাগলাম মনের আনন্দে। একটু পর বৃষ্টি থেমে গেল। বৃষ্টিভেজা সারি সারি পাহাড় প্রাণ ভরে দেখতে দেখতে একসময় দেখি আশপাশ প্রবল কুয়াশার মত মেঘে ছেড়ে গেল। ১০ মিটার দুরের বস্ত্তও দেখা কষ্টকর ঠেকছে। তাই পথের শেষভাগ কিছুটা বিপজ্জনক মনে হলেও আল্লাহর রহমতে এর মধ্যদিয়েই আমরা পৌঁছে গেলাম সাজেক পয়েন্টে।

    সাজেক হল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। ৬০৭ বর্গমাইল আয়তন। রাঙামাটির একেবারে উত্তরে এর অবস্থান। ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী সর্বশেষ পাহাড়চুড়ার জঙ্গল পরিষ্কার করে নির্মিত আর্মি ক্যাম্প ও বিডিআর বিওপিই বর্তমান সাজেক পয়েন্ট। এখান থেকে পূর্বদিকে মিজোরাম বর্ডারের দূরত্ব একদিনের হাঁটা পথ, আর উত্তরের ত্রিপুরা সীমান্ত তিন দিনের যাত্রা। তাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পাহাড় আর গহীন অরণ্যে ঘেরা এই সীমান্ত রেখা প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত।

    সাজেক আর্মি ক্যাম্পের কাছাকাছি পাহাড়ী আদিবাসীদের দু’টি পাড়া আছে। রুই লুই এবং কংলাক। সাজেক পয়েন্টে যাবার একটু আগেই পড়ে রুই লুই পাড়া। এই পাড়াটির উচ্চতা ১৭২০ ফুট। এটি ক্ষুদ্র জাতীগোষ্ঠী পাংখোয়াদের বসতি। ঘন মেঘের কারণে পাড়াটির তেমন কিছুই নযরে আসলো না। হোন্ডাচালক ভাইয়েরা পাংখোয়াদের একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতে চাচ্ছিল। কিন্তু মাসঊদ ভাইয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সাজেকের মূল পয়েন্টে অবস্থিত এবং বিডিআর পরিচালিত অনিন্দসুন্দর রিসোর্ট ‘রুন্ময়’-এর পাশ্ববর্তী আর্মি পরিচালিত হোটেল ‘রক প্রশান্তি’তে গিয়ে উঠলাম। সিট ভাড়া প্রতিজন মাত্র ৩০০ টাকা। ১০ জনের রুমে কেবল আমরাই। বাইকচালকদের পরদিন সকালে এসে নিয়ে যেতে বললাম। তারপর ব্যাগপত্তর খুলে দেখি অর্ধেক কাপড় ভিজে শেষ। দড়ি টানিয়ে সব শুকাতে দিলাম। তারপর বাইরে এসে তো অবাক। মেঘের দল স্থানান্তর করেছে। সব নেমে গেছে চূড়া থেকে অনেক নীচে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়া সত্বেও বৃষ্টিভেজা পাহাড় চকচক করছে। (ক্রমশঃ)

     


    HTML Comment Box is loading comments...