দক্ষিণ এশিয়ায় আহলেহাদীছ আন্দোলন
আধুনিক যুগঃ ৩য় পর্যায় (খ)
নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী
স্বীয় লেখনীর বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে তিনি বলেন ‘আমার অধিকাংশ লেখনী তাহকীক বা সূক্ষ্ম গবেষণার ভিত্তিতে লিখিত’। এতদসত্ত্বেও তিনি সকল বিদ্বানমন্ডলীকে আহবান জানিয়ে বলেন, ‘দ্বীনদার বিদ্বানগণের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, আমার কিতাবের যেসব মাসআলা কিতাব ও সুন্নাতের ছহীহ দলীলের বিরোধী প্রমাণিত হবে, তা যেন উঠিয়ে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারা হয় এবং যেসব মাসআলা কুরআন ও হাদীছের অনুকূল হবে, তা যেন কবুল করা হয়। আমি ইনশাআলাহ আমার প্রতিবাদে খুশী হব। .... বরং ভুল শুদ্ধির সমালোচনাই সকলের নিকটে আমার একান্ত দাবী। আমি প্রত্যেকের ঐ সকল উত্তম কথা যা শরী‘আত ও জ্ঞানের অনুকূল, তা কবুল করি। যদিও ঐ ব্যক্তি আমার সমান বা আমার ছোট হৌক না কেন। পক্ষান্তরে যে কথা দলীলের খেলাফ হবে তা কবুল করিয়া যদিও তার সমর্থন কোন বড় আলিম, ফাযিল যোগ্য ব্যক্তি হৌক না কেন’।[1]
তিনি বলেন, ‘মূলতঃ কিতাবগুলি আমি আমার নিজের ফায়দা হাছিলের জন্য লিখেছিলাম। কাউকে ফায়েদা পৌছাবার জন্য নয়। তবু কিতাবগুলি অন্যের উপকার এসে গেছে। লেখনীর ব্যাপারে হুকুম ও মাসআলার ব্যাপারে হক-কে বাতিল হ’তে এবং বিশুদ্ধতম বিশুদ্ধ -(اصح و صحيح) কে দুর্বলতম ও দুর্বল (أضعف و ضعيف) হ’তে বাছাই করা। একই সাথে দলীল থেকে প্রমাণিত বিষয়গুলি রায়-এর ভিত্তিতে লিখিত বিষয়গুলি হ’তে পৃথক করা। এর দ্বারা আমরা দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল ঐসব মুসলমানকে ফায়েদা পৌছানো, যারা কোন প্রকারের গোঁাড়ামি (تعصب) ছাড়াই কেবল হক-এর সন্ধনী এবং ছিরাতে মুস্তাক্বীম-এর উপরে চলতে আগ্রহী।[2]
আহলেহদীছ আন্দোলনে আলামা ছিদ্দীক হাসানের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল হাদীছ ও ফিক্হুল হাদীছেল দুর্লভ বিতাবসমূহের প্রকাশনা ও ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ। জীবনের প্রথম তিন চতুর্থাংশ চরম দারিদ্রের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হ’লেও ১২৮৮ হিজরী মোতাবেক ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে ভূপালের বিধবা রাণী শাহজাহান বেগমের সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহের পর হ’তে তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হন। এই সম্পদকে তিনি দ্বীনের তাবলীগের কাজে ব্যয় করেন এবং লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে দ্বীনী কিতাবসমূহ মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ছাপাখানা হ’তে ছাপিয়ে এনে হিন্দুস্থান ও অন্যত্র বিলি করেন। তিনি বলেন যে, আমার অধিকাংশ সম্পদ কিতাব ও সুন্নাতের ইল্মসহ প্রচারের পিছনে ব্যয় হয়ে যায়। আমি প্রতিটি গ্রন্থ এক হাযার কপি ছেপে এনে নিকট ও দূরের সকল দেশে বিলি করেছি। কারু কাছ থেকে কখনও কিতাবের মূল্য নেইনি। আমার সন্তানেরা বহু গ্রন্থ রচনা করেছে’।[3] অতঃপর রাণী শাহজাহান বেগম সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রাণীর গর্ভে আমার কো সন্তান জন্মেনি। তবে গ্রন্থ প্রকাশনা ও প্রচারণার মাধ্যমে- যা সৌভাগ্যের দিক দিয়ে রক্তের সন্তানের চেয়েও অধিক, সেই সব ভাবগত সন্তানের (أولاد معنوى) সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। যা কেবলমাত্র উচ্চ মর্যাদা ও অবসর পাওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। যদি রাণীর সঙ্গে আমরা বিবাহ না হ’ত, তাহ'লে বাস্তবিকপক্ষে ঐসব দ্বীনী কিতাবসমূহের প্রকাশনা ও প্রচারের কোন সুযোগ আমার হ’ত না’।[4]
গ্রন্থরচনা ও প্রকশনা ছাড়াও আরব দেশে থেক হাদীছেল বহু কিতাব খরিদ করে এনে তিনি হিন্দুস্থানের বিভিন্ন ছাপাখানা হ'তে ছাপিয়ে এনে বিপুলহারে বিভিন্ন দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও লাইব্রেরীসমূহে ছিলনা নওয়াব ছাহেবের রচিত বা প্রকাশিত কোন গ্রন্থ পাওয়া যেতনা।[5]
বিগত ওলামায়ে দ্বীনের যে সমস্ত কিতাব বহু অর্থব্যয়ে ছাপিয়ে তিনি ফ্রি বিলি করেন, তন্মধ্যে কয়েকটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হ’লঃ ১। ছহীহ বুখারীর ভাষ্য ‘ফাৎহুল বারী’ ২। তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩। ইমাম শাওকানীর ‘নায়লুল আওত্বার’ প্রভৃতি। এতদ্ব্যতীত তাঁর নিজস্ব রচনার সংখ্যা ছিল বিপুল। মাওলানা আবু ইয়াহ্ইয়া ইমাম খান নওশাহরাবী স্বীয় বইয়ে নওয়াব ছাবেহের রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন বিষয়ে মোট ২২২ খানা কিতাবের তালিকা দিয়েছেন যা সত্যিই বিস্ময়কর।[6]
গ্রন্থপ্রণয়ন, প্রকাশনা ও সুষ্ঠু বন্টনের ব্যবস্থা ছাড়াও তিনি ইয়াতীম ও ছিন্নমূল ছেলেমেয়েদের জন্য মাদরাসা সুলাইমানিয়া ও মাদরাসা বিলক্বিসিয়াহ, মাদরাসা জাহাংগীরী ও মাদরাসা ছিদ্দীক্বী প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে মৌলবী, আলেম, ফাযেল, মুফতী, মুন্শী ও কাবেল-মোট ছয়টি স্তরের ডিগ্রী দেওয়া হ’ত। তাদেরকে যোগ্যতানুসারে মাসোহারাও দেওয়া হ’ত।
মাদরাসা ছাড়াও তিনি কয়েটি কুতুবখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন কুতুবখানা ফায়যে আম, কুতুবখানা মাদরাসা জাহাংগীরী, কুতুবখানা সরকারী, কুতুবখানা ওয়ালাজাহী। শেষোক্ত কুতুবখানাটি মৃত্যুর পূর্বে তিনি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করে দেন। সেখান থেকে তাঁর পুত্র নওয়াব আলী হাসান খান নিজের অংশের গ্রন্থসমূহ ‘নাদ্ওয়াতুল উলামা’ লাক্ষ্মেী-এর জন্য ওয়াক্ফ করে দেন।[7] কিছু কিতাব ভূপালের ‘নূরমহল’ -এর ব্যক্তিগত কুতুবখানায় আছে।[8]
এতদ্ব্যতীত হাদীছ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি কুরআনের ন্যায় হাদীছ হেফ্য করার জন্য আকর্ষণীয় পুরষ্কারসমূহ ঘোষণা করেন। যেমন- ১। ছাহীহ বুখারী শরীফ হেফ্য করার জন্য এক হাযার টাকা। ২। বুলূগুল মারাম-এর জন্য একশত টাকা। শুধু তাই নয় যারা উক্ত মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন তাদেরকে হেফ্য শেষ হওয়া অবধি মাসিক ত্রিশ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হবে। যারা এই ব্যাপরে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে দু’জনের নাম পাওয়া যায়। একজন হাফেয হলেন মৌলবী আবদুত্ তাওয়াব গযনবী আলীগড়ী।[9]
নওয়াব ছাহেব এই ব্যাপক প্রচার ব্যবস্থাপনায় বিরোধী আলিমদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা চক্রান্ত শুরু করে এবং জনগণকে নওয়াবের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে গোপন প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। নওয়াব ছিদ্দীক হাসান সবকিছু জেনেও কোন প্রতিকার করেননি। বরং নওয়াবী ছেড়ে দেওয়াই নিরাপদ মনে করেন।
দুশমনদের চক্রান্তের কোন জওয়াব তিনি দিতেন না। স্বীয় আত্মজীবনীতে তিনি বলেন, ‘দুনিয়ার ব্যাপারে আমার দুশমন ছিল। যখন কোন দিক দিয়েই তারা আমার উপর প্রধান্য বিস্তারে সক্ষম হা হয়, তখন চক্রান্তের মাধ্যমে কখনও আমাকে বিষ প্রয়োগের চেষ্ঠা করে। কখনও গোপনে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কখনও জাদুকরদের সাহায্য নিয়ে আমার উপরে জাদু করার চেষ্ঠা করে। কিন্তু তাদের কোন কৌশল যখন সফল হ’ল না, তখন তারা আমার উপরে মাযহাবী তোহমত ও রাজ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগ এনে হাংঙ্গামা শুরু করে দেয়। .... এর পরে আমার পারিবারিক ব্যাপারেও তারা ভিত্তিহীন আজগুবি সব ছড়িয়ে দেয়’।[10]
‘... এই বৎসর ১৩০৫ হিজরীতে এই শহরে (ভূপালে) আমার অবস্থানের মেয়াদ ৩৫ বছর হ’তে চল্ল। কিন্তু ভাল-মন্দ সকলেই যেন আমাকে এড়িয়ে চল্তে চায়। কাউকেই আমি বন্ধু হিসাবে পেলাম না। যদিও আমি কারু প্রতি খারাব ধারণা রাখিনা বা বিদ্বেষ পোষণ করিনা। আমি যেন এখানে কবির কথায়-(خلوت در انجمن و سفردر وطن) ‘মজলিসের মধ্যেও একা এবং ঘরের মধ্যেও মুসাফির’ অবস্থায় আছি’।[11] ...... ‘হিংসুক ও বিরোধীরা বহুদিন থেকে উর্দূ ও ইংরেজী পত্রিকাসমূহের মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে শত শত গীবত ও তোহমত রটনা করেছে। কিন্তু আমি কোন জওয়াব দেইনি। .....ঐসব শত্রুরা মূলতঃ আমার বন্ধু। তাদের গীবত- তোহমত, গালি-গালাজ ও মিথ্যা প্রচারণা ইন্শাআল্লাহ আমার জন্য আল্লাহর পক্ষ হদে মাগফিরাতের কারণ হবে’।[12]
জীবনের তিন চতুর্থাংশ সময় চরম দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান ছিলেন চরম ত্যাগ ও ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক। পিতার মৃত্যুর পরে বড় ভাইয়ের কাচ থেকে পৈতৃক সম্পত্তির অংশ হ’তে মাহরূম হয়ে ও একইসাথে বিধবা মা ও ছোট বোনদের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মাত্র ২৪ বছরের এই বেকার মুত্তাক্বী আলিমের অবস্থা কি হ’তে পারে সহজেই অনুমান করা চলে। পরবর্তীতে বৈবাহিক জীবনে প্রথম স্ত্রী ও তার পক্ষের সন্তানদের কাছ থেকে আমৃত্যু নিষ্ঠুর ব্যবহারে অতিষ্ঠ আল্লামা ছিদ্দীক হাসান ‘আহলেহাদীছ’ হওয়ার অপরাধে (?) সামাজিক জীবনেও ছিলেন বিরোধীদের চরম হিংসা ও বিদ্বেষের শিকার। বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ এই মানুষটি তাঁর ৫৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনের মধ্যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভূপালে ৩৭ বছর চরম বিরোধী পরিবেশে কালাতিপাত করেন। তার মধ্যে বছর নওয়াবীর গুরুদায়িত্ব বহনের মত রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যস্ততার মধ্যে প্রায় সোয়া দু’শো ছোট বড় মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা হওয়া সত্যিই অলৌকিক ব্যাপার বৈ-কি। তীক্ষ্ণ ধীশক্তি, অপরিমেয় মেধা গভীর ধৈর্য ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সর্বোপরি আল্লাহর বিশেষ একত্রিত হ’লেই কেবল এটা সম্ভব হ’তে পারে।
লেখক ও রাজনীতিক হওয়ার সাথে সাথে কুরআন ও হাদীছে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য সমসাময়িক আলিম সমাজের ঈর্ষার কারণ ছিল। পান্ডিত্য অর্জনের চাইতে ইল্মে হাদীছের প্রচার ও প্রসারেই তাঁর অধিক মনোযোগ ছিল। যার কারণে আলিমদের খান্কাহ থেকে বের হয়ে কুরআনের তাফসীর ও হাদীছ জনসাধারণের নাগালের মধ্যে এসে যায়। বলা চলে যে, এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তিনি সাথে সাথে উঁচুদরের কবিও ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রশংসায় তাঁর লিখিত ‘আল-ক্বাছীদাতুল আম্বারিয়াহ’ (القصيدة العنبرية) এব্যাপারে উল্লেখের দাবী রাখে।[13] (চলবে)
[বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব প্রণীত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ.ডি থিসিস) শীর্ষক গ্রন্থ পৃঃ ৩৫২-৩৫৬)]
[1]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৫।
[2]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৩।
[3]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৫।
[4]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬২-৬৩।
[5]. ‘তারাজিম’ পৃঃ ২৪৩।
[6]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫১-৬১।
[7]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৬-৪৭।
[8]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬১।
[9]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৭।
[10]. ‘মিনার’ পৃঃ ১১৫-১৬।
[11]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৭।
[12]. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭১-১৭৩, ২৩৯।
[13]. ‘তারাজিম’ পৃঃ ২৪১।