• free web stats
  • At-Tahreek
    আক্বীদা

    পরকালের প্রতি ঈমান

    পরকালের প্রতি ঈমান

    ভূমিকা : মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হিসাবে মানুষকে দুনিয়াতে দিতে হয় বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা। দুনিয়ার পরীক্ষা শেষে মানুষের জন্য স্থায়ী ও চিরন্তন পুরস্কারের জগৎ পরকাল অপেক্ষমান। পরকালে মানুষ শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জান্নাত পেয়ে ধন্য হয় নতুবা ভীষণ লাঞ্চিত ও বঞ্চিত হয়ে নিকৃষ্ট জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে  অজানা জগৎ পরকালের দালায়েল, মাসায়েল ও স্বরূপ সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।

    পরকালের ধারনা :

    রাসূল (ছাঃ)-এর ভাষ্যমতে মৃত্যু পরবর্তী পুরো জীবনটাই হলো পরকাল। পরকাল বলতে বারযাখী জীবন তথা কবরের ফিৎনা শান্তি বা শাস্তি, সিঙ্গার ফুৎকার, পুনরুত্থান, হাশর, শাফা‘আত, ক্বিয়ামত, বিচার-ফায়ছালা, মীযান বা দাঁড়িপাল্লা, হাউযে কাওছার, পুলছিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় সমূহকে বুঝায়।

    আব্দুলাহ ইবনু আববাস (রাঃ) মহান আল্লাহর বাণী উল্লেখ করে বলেন, وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ ‘আর আখেরাতে জীবনের প্রতি যারা নিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করে’ (বাক্বারাহ্ ২/৪)। ‘অর্থাৎ পরকাল হ’ল পুনরুত্থান, ক্বিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব-নিকাশ ও মীযানকে শামিল করে’।[1]

    ইবনু হাযার (রহঃ) বলেন, ‘পরকালের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথে কবরের জিজ্ঞাসা, পুনরুত্থান, বিচার দিবস, মীযান, পুলছিরাত, জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতিও ঈমান আনা’।[2]

    ‘পরকালকে পরকাল নামকরণ করা হয়ে থাকে এই জন্য যে, এটি এমন একটি দিন যা অনন্তকাল, এর পরে আরো কোন দিন বাকী থাকবেনা’।[3]  আর এই দিনের সমানও আর কোন দিন হবে না’।

    পরকালের নামকরণ:

    কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এই দিনটিকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন : يَوْمُ الْقِيَامَةِ ক্বিয়ামতের দিন يَوْمُ الدِّينِ বিচারের দিন, يَوْمَ التَّنَادِ প্রচন্ড হাক-ডাকের দিন, يَوْمُ الْخُرُوجِ পুনরুত্থানের দিন, يَوْمُ التَّغَابُنِ হার-জিতের দিন, الْوَاقِعَةُ মহা প্রলয়ের দিন, الْحَاقَّةُ   শেষ বিচারের দিন, الْقَارِعَةُ  মহা প্রলয়ের দিন, الطَّامَّةُ الْكُبْرَى মহা বিচারের দিন, الصاخة প্রচন্ড শব্দের দিন ইত্যাদি।

    পরকাল সম্পর্কে সকল মুসলমাদের জানা আবশ্যক। আর সেই বিভীষিকাময় দিনটি থেকে পরিত্রাণের জন্য উত্তম আমল দ্বারা প্রস্ত্ততি নেওয়া যরূরী। সাথে সাথে যে সমস্ত কাজ আল্লাহ রাগান্বিত হন সে কাজগুলি থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা এই দিনটিকে ভুল গিয়ে দুনিয়ার লোভ-লালসা, চাকচিক্য আর জৌলুসে নিমগ্ন হ’লে আমাদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে’  (ছদ ৩৮/২৬)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَقَالَ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا الْمَلَائِكَةُ أَوْ نَرَى رَبَّنَا لَقَدِ اسْتَكْبَرُوا فِي أَنْفُسِهِمْ وَعَتَوْا عُتُوًّا كَبِيرًا ‘আর যারা  আমাদের সাক্ষাৎ কামনা করেনা তারা বলে, কেন আমাদের কাছে ফেরেশতা নাযিল করা হয় না অথবা কেন আমরা আমাদের প্রতিপালককে দেখিনা? তারা নিজেদের অন্তরে অহংকার লুকিয়ে রাখে এবং গুরুতর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয় (ফুরকান ২৫/২১)

    ক্বিয়ামত তথা পরকাল সংঘটিত হওয়ার সময় :

    এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পরকালের অন্যতম বিষয় হলো ক্বিয়ামত। আর ক্বিয়ামত শুধুমাত্র দিনেই সংগঠিত হবে রাতে নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সকাল-সন্ধার থাকবে কিন্তু রাতের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا إِلَّا سَلَامًا وَلَهُمْ رِزْقُهُمْ فِيهَا بُكْرَةً وَعَشِيًّا  ‘সেখানে তারা ‘সালাম’ (শান্তি) ব্যতীত কোন অসার বাক্য শুনবে না। আর সেখানে তাদের জন্য সকাল-সন্ধ্যায় রিযিক থাকবে’ (মারইয়াম ১৯/৬২)

    এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়টি সকাল-সন্ধা হবে কিন্তু দুনিয়ার মত দিন-রাত হবে না। তবে সময় ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে এবং সেই দিনটি সারাক্ষণ উজ্জ্বল আলোকময় থাকায় একে অপরকে চিনতে পারবে’।[4]

    পরকালের প্রতি ঈমান :

    পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের পঞ্চম তম রুকন। সুতরাং ঈমান ব্যতিরেকে কেউ ঈমানদার হ’তে পারবে না। বরং সে কাফের সাব্যস্ত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا  ‘আর যে কেউ অবিশ্বাস করে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাগণের উপর, তাঁর কিতাবসমূহের উপর, তাঁর রাসূলগণের উপর ও ক্বিয়ামত দিবসের উপর, সে দূরতম ভ্রষ্টতায় নিপতিত হ’ল’ (নিসা ৪/১৩৬)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

     لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ-

    ‘(ইবাদত কালে) পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফেরানোটাই কেবল সৎকর্ম নয়, বরং প্রকৃত সৎকর্মশীল ঐ ব্যক্তি, যে বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহ, বিচার দিবস, ফেরেশতামন্ডলী, আল্লাহর কিতাব ও নবীগণের উপর এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সম্পদ ব্যয় করে নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির, প্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য। আর যে ব্যক্তি ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করে এবং অভাবে, রোগ-পীড়ায় ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যের সাথে দৃঢ় থাকে। তারাই হ’ল সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই হ’ল প্রকৃত আল্লাহভীরু’ (বাক্বারাহ ২/১৭৭)

    পরকালের প্রতি বিশ্বাসে মুমিনের বৈশিষ্ট্য :

    যারা মুমিন মুত্ত্বাকী ব্যক্তি হবেন তাদের বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্য হ’তে অন্যতম হ’ল পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। মহান আল্লাহ বলেন,

    إِنَّ الْإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا- إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا- وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا- إِلَّا الْمُصَلِّينَ-الَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ- وَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَعْلُومٌ-لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ- وَالَّذِينَ يُصَدِّقُونَ بِيَوْمِ الدِّينِ-

     ‘নিশ্চয়ই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ভীরু রূপে। যখন তাকে বিপদ স্পর্শ করে, তখন সে হা-হুতাশ করে। আর যখন কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে হয় কৃপণ। তবে মুছল্লীগণ ব্যতীত। যারা নিয়মিত ছালাত আদায় করে। যাদের ধন-সম্পদে হক নির্ধারিত রয়েছে। প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্য। যারা বিচার দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে’ (মা‘আরিজ ৭০/১৯-২৬)

    পরকালের প্রতি অবিশ্বাসে কাফেরদের বৈশিষ্ট্য :

     নিশ্চয় যারা কাফের তারা পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা পবিত্র কুরআনে কাফেরদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে তাদের এই গুণটিও বর্ণনা করেছেন।

     كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ- إِلَّا أَصْحَابَ الْيَمِينِ- فِي جَنَّاتٍ يَتَسَاءَلُونَ- عَنِ الْمُجْرِمِينَ- مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ-  قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ- وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ- وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ- وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ-

    ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের নিকট দায়বদ্ধ। (আনুগত্যের কারণে) ডান সারির লোকেরা ব্যতীত। তারা জান্নাতে থাকবে। তারা পরস্পরে জিজ্ঞেস করবে-পাপীদের বিষয়ে। কোন বস্ত্ত তোমাদেরকে সাক্বারে (জাহান্নামে) প্রবেশ করিয়েছে? তারা বলবে, আমরা মুছল্লীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য দিতাম না। আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনায় মগ্ন থাকতাম। আমরা বিচার দিবসকে মিথ্যা বলতাম’ (মুদ্দাছির ৭৪/৩৮-৪৬)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,  وَيْلٌ يَوْمَئِذٍ لِلْمُكَذِّبِينَ الَّذِينَ يُكَذِّبُونَ- بِيَوْمِ الدِّينِ  ‘সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যারোপকারীদের জন্য। যারা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে’ (মুতাফফিফিন ৮৩/১০-১১)

    পরকালের বিশ্বাসের প্রতি নবী-রাসূলদের দাওয়াত :

    এমন কোন নবী-রাসূল নেই যে, তারা পরকালের প্রতি ঈমান আনার কথা বলেন নি। ফলে শরী‘আতের আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সকল উম্মতের জন্য পরকালের বিশ্বাস করা ওয়াজিব। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে বলেন, وَالَّذِي أَطْمَعُ أَنْ يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ ‘আমি আকাংখা করি যে, তিনি শেষ বিচারের দিন আমার পাপসমূহ ক্ষমা করবেন’ (শু‘আরা ২৬/৮২)

    শু‘য়াইব (আঃ) সম্পর্কে বলেন,   فَقَالَ يَاقَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَارْجُوا الْيَوْمَ الْآخِرَ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ ‘সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও বিচার দিবসে (প্রতিদান) কামনা কর। আর তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না’ (আনকাবুত ২৯/৩৬)

    মুসা (আঃ) সম্পর্কে বলেন,  إِنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيهَا لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَى  ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে। আমি সেটা গোপন রাখতে চাই। যাতে প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ করতে পারে’ (ত্বহা ২০/১৫)

    সুতরাং এই আয়াতগুলি দ্বারা প্রমাণ করে যে, প্রত্যেক নবী-রাসূলগণ তাদের স্বীয় জাতিকে পরকালের প্রতি ঈমান আনায়নের জন্য দাওয়াত ও জোর তাকীদ দিয়েছেন।

    পরকাল সম্পর্কে জাহান্নামের কারারক্ষীদের জিজ্ঞাসা :

    পরকালের প্রতি অবিশ্বাসী কাফেরদের জাহান্নামের কারারক্ষীরা জিজ্ঞাসা করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,

    وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا فُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَتْلُونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا قَالُوا بَلَى وَلَكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ

    ‘আর অবিশ্বাসীদের দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে। অবশেষে যা তারা জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হবে, তার দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে এবং তার দাররক্ষীরা তাদের বলবে, তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য হ’তে রাসূলগণ আসেননি? যারা তোমাদের নিকট তোমাদেরকে এদিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সতর্ক করতেন? তারা বলবে, হ্যাঁ। কিন্তু অবিশ্বাসীদের উপর অবধারিত শাস্তির আদেশ বাস্তবায়িত হয়েছে’ (যুমার ৩৯/৭১)

    পরকালের প্রতি ঈমান আনার মাধ্যম :

    আর সেটা ঈমানে মুজমাল ও ঈমানে মুফাছছাল দ্বারা হ’তে হবে।

    (১) ঈমানে মুজমাল :

    এটা বিশ্বাস করা যে, তিনিই একমাত্র ক্ষমতাধর। তিনিই ক্বিয়ামত দিবস সংঘটিত করবেন এবং সেই দিন সকল মানুষকে পুনরুত্থান ঘটাবেন। অতঃপর তাদের আমল অনুযায়ী প্রতিদান দিবেন। ঈমানে মুজমাল হল :

    আ-মানতু বিল্লা-হি কামা হুয়া বি আসমা-ইহী ওয়া ছিফা-তিহী ওয়া ক্বাবিলতু জামী‘আ আহকামিহী ওয়া আরকা-নিহী’)

    ‘আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর উপর যেমন তিনি তাঁর যাবতীয় নাম ও গুণাবলী সহকারে এবং কবুল করলাম তাঁর যাবতীয় আদেশে-নিষেধ ও ফরয-ওয়াজিব সমূহকে’।

    (২) ঈমানে মুফাছছাল :

    আ-মানতু বিল্লাহি ওয়া মালা ইকাতিহী ওয়া কুতুবিহী ওয়া রুসূলিহী ওয়াল ইয়াওমিল আ-খিরি ওয়াল ক্বদরি খয়রিহী ওয়া শাররিহী মিনাল্লা-হি তা‘আলা’)

    ‘আমি বিশ্বাস স্থাপন করলাম (১) আল্লাহর উপর (২) তাঁর ফেরেশতাগণের উপরে (৩) তাঁর প্রেরিত কিতাবের উপর (৪) তাঁর রাসূল গণের উপরে (৫) ক্বিয়ামত দিবসের উপরে (৬) আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে।

    বারযাখী বা কবরের জীবন :

    বারযাখ আরবী শব্দ যার অর্থ পর্দা, মধ্যবর্তী স্থান, অন্তরায় ইত্যাদি’।[5]

    মহান আল্লাহ বলেন, مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَان- بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لَا يَبْغِيَانِ ‘তিনি দু’টি সমুদ্রকে প্রবাহিত করেছেন মিলিতভাবে। উভয়ের মাঝে করেছেন অন্তরাল, যা তারা অতিক্রম করে না’ (রহমান ৫৫/১৯-২০)। পারিভাষিক অর্থে এটা এমন  একটি জীবন যা দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘বরং তাদের সামনে পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)

    ইমাম ফাররা (রহঃ) বলেন, কবরের জীবন বলতে মৃত্যুবরণের দিন থেকে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত সময়। আর এই জীবন শুরু হয় মৃত্যুবরণের মধ্য দিয়ে। আর মৃত্যু হলো দেহ থেকে আত্মা বের হয়ে যাওয়া’।[6]

    কবরের ফিৎনা :

    ফিৎনা আরবী শব্দ যার অর্থ বিপদ, কষ্ট, পরীক্ষা, ইত্যাদি’।[7]  কবরের ফিৎনা বলতে মৃত ব্যক্তিকে দুইজন  ফেরেশতার জিজ্ঞাসাবাদ। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করে তার রব, দ্বীন ও নবী সম্পর্কে। পবিত্র কুরআনে কবরের ফিৎনা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ ‘আল্লাহ মুমিনদেরকে দৃঢ় বাক্য দ্বারা দৃঢ় রাখেন ইহজীবনে ও পরজীবনে’ (ইবরাহীম ১৪/২৭)

    হাদীছে এসেছে,

    عَنِ الْبَرَاءِ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى قَوْلِ اللَّهِ (يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِى الآخِرَةِ) قَالَ فِى الْقَبْرِ إِذَا قِيلَ لَهُ مَنْ رَبُّكَ وَمَا دِينُكَ وَمَنْ نَبِيُّكَ.

    বারাআ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন নবী করীম (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর তা‘আলার বাণী ‘আল্লাহ মুমিনদের দৃঢ় বাক্য দ্বারা মযবূত রাখেন ইহকালীন জীবনে ও পরকালে (ইবরাহীম-ঐ)। যখন তাকে বলা হবে তোমার প্রভু কে, তোমার দ্বীন কি এবং তোমার নবী কে?।[8]

    রাসূল (ছাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছে কবর আযাব বিষয়ে। যখন তাকে বলা হবে, তোমার প্রতিপালক কে? সে বলবে, আমার প্রতিপালক আল্লাহ। আমার নবী মুহাম্মাদ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১২৫)। একই রাবী থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, কবরে দু’জন ফেরেশতা আসবে। তারা তাকে উঠিয়ে বসাবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার রব কে? সে বলবে, আমার রব আল্লাহ। অতঃপর বলবে, তোমার দ্বীন কি? সে বলবে, আমার দ্বীন ইসলাম। অতঃপর তারা বলবে, এই ব্যক্তিটি কে, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল? সে বলবে, তিনি আল্লাহর রাসূল। তারা বলবে, কিভাবে তুমি জানলে? সে বলবে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি। অতঃপর তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি ও তাকে সত্য বলে মেনেছি। আর সেটি হ’ল উক্ত আয়াত, ‘আল্লাহ মুমিনদেরকে দৃঢ় বাক্য দ্বারা দৃঢ় রাখেন ইহজীবনে ও পরকালে’ (ইবরাহীম ২৪/২৭)। তখন আকাশে একজন ঘোষক ঘোষণা দিবেন, আমার বান্দা সঠিক কথা বলেছে। অতএব তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। জান্নাতের পোষাক পরিয়ে দাও এবং জান্নাতের দিকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দাও। অতঃপর তা খুলে দেওয়া হবে... (আহমাদ, আবু দাঊদ, মিশকাত হা/১৩১)’। [9]

    রাসূল (ছাঃ) সূর্য গ্রহণের ছালাতান্তে বলেছিলেন, مَا مِنْ شَىْءٍ لَمْ أَكُنْ أُرِيتُهُ إِلاَّ رَأَيْتُهُ فِى مَقَامِى حَتَّى الْجَنَّةَ وَالنَّارَ ، فَأُوحِىَ إِلَىَّ أَنَّكُمْ تُفْتَنُونَ فِى قُبُورِكُمْ ، مِثْلَ - أَوْ قَرِيبًا لاَ أَدْرِى

    ‘যা কিছু আমাকে ইতোপূর্বে দেখানো হয়নি, তা আমি আমার এ স্থানেই দেখতি পেয়েছি। এমনকি জান্নাত ও জাহান্নামও। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট অহী প্রেরণ করলেন, ‘দাজ্জালের ন্যায় (কঠিন) পরীক্ষা অথবা তার কাছাকাছি বিপদ দিয়ে তোমাদেরকে কবরে পরীক্ষায় ফেলা হবে’।[10]

    মৃত্যুর মৃত্যু :

    মহান আল্লাহ বলেন, كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে’ (আলে ইমরান ৩/১৮৪ )

    তথাপিও মৃত্যুরও মৃত্যু ঘটবে। এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ, আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন মৃত্যুকে একটি ধূসর রঙের মেষের আকারে আনা হবে। তখন একজন সম্বোধনকারী ডাক দিয়ে বলবেন, হে জান্নাতবাসী! তখন তারা ঘাড়-মাথা উঁচু করে দেখতে থাকবে। সম্বোধনকারী বলবে, তোমরা কি একে চিন? তারা বলবে হ্যাঁ; এ হ’ল মৃত্যু। কেননা সকলেই তাকে দেখেছে। তারপর সম্বোধনকারী আবার ডেকে বলবেন, হে জাহান্নামবাসী! জাহান্নামীরা মাথা উঁচু করে দেখতে থাকবে। তখন সম্বোধনকারী বলবে, তোমার কি একে চিন? তার বলবে হ্যাঁ, এতো মৃত্যু। কেননা তারা সকলেই তাকে দেখেছে। তারপর (সেটিকে) যবহ করা হবে। আর ঘোষক বলবেন, হে জান্নাতবাসী! স্থায়ীভাবে (এখানে) থাক। তোমাদের আর কোন মৃত্যু নেই। আর হে জাহান্নামবাসী! চিরদিন এখানে থাক। তোমাদের আর মৃত্যু নেই। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) পাঠ করলেন, يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ ‘আল্লাহ মুমিনদেরকে দৃঢ় বাক্য দ্বারা দৃঢ় রাখেন ইহজীবনে ও পরজীবনে’ (ইবরাহীম ১৪/২৭) ’।[11] .....চলবে

     [লেখক : ৪র্থ বর্ষ, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]

    [1]. তাফসীরে ত্বাবারী ১/২৪৬। 

    [2]. ফৎহুল বারী ১/৫২। 

    [3]. তাফসীর ত্বাবারী ১/২৭১। 

    [4]. তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৫/২৪৭।

    [5]. আল-মুজামুল ওয়াফী ২১৪ পৃ.। 

    [6]. তাফসীরে বায়যাবী ১/২৪২২।

    [7]. মাকায়িসুল লুগাত ৪/৪৭২ পৃ.।

    [8]. তিরমিযী হা/৩১২০। 

    [9]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ‘তাফসীরুল কুরআন, সূরা ইবরাহীম-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য । 

    [10]. বুখারী হা/৮৬। 

    [11]. বুখারী হা/৪৭৩০; মুসলিম হা/২৮৪৯। 

     


    HTML Comment Box is loading comments...