বিশ্বাস করতে পারিনি ঈশ্বর মারা গেছেন- আব্দুর রহীম গ্রীণ
রেযওয়ানুল ইসলাম
ডা. শরীফ মহিউদ্দীন 801 বার পঠিত
আমেরিকায় আপনি এককাপ চা খেতে কোথাও যেতে হলেও গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। আর সে কারণে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের ঘরে খাবার না থাকলেও গ্যারেজে একটি গাড়ি থাকেই থাকে। খুব বেশী দিন হয়নি এদেশে এসেছি। গাড়ি কিনব কিনব করে কেনা হয়ে উঠেনি। তাই বাধ্য হয়েই উবারে চলাফেরা করতে হয়।
ছোট্ট আমায়াহ আর তার মাকে নিয়ে সাপ্তাহিক বাজার করতে গ্রোসারী শপে (মুদিবাজার) যাবা উবারে। একজন প্রায় ৭০ বছর বয়েসী আমেরিকান শ্বেতাংগ রমনী আমাদের উবার ড্রাইভার। গাড়িতে উঠে কেমন আছেন, দিন কেমন গেল- টাইপের প্রশ্ন করা স্বাভাবিক আমেরিকান ভদ্রতা। আমিও সেমতে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন? উত্তরের জন্য কোনভাবে প্রস্ত্তত ছিলাম না। শুদ্ধ উচ্চারণে বলে উঠলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’।
আমি কি ভুল শুনলাম? তাই প্রশ্ন করলাম তুমি কি মুসলিম? কোথায় তোমার আসল বাড়ি? সে আবার বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমি মুসলিম। এই আমেরিকাতেই আমার বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটে-মাটি। আমি একেবারেই খাঁটি আমেরিকান।
মনের বাসনা থেকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি ইসলামে আসলে কি করে? উত্তর এল- আমি ইসলাম বেছে নেইনি, ইসলামই আমাকে বেছে নিয়েছে।
তাঁকে বললাম, তোমার গল্প কি আমাকে শোনাবে। ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে শুনাতে শুরু করল ঘুম ভাঙ্গার গল্প। আসুন! তার মুখেই সে গল্প শুনি-
আমেরিকার মন্টানা অঙ্গরাজ্যে এক খ্রীষ্টান পরিবারে আমার জন্ম। জন্মের পর যখন বুঝ-জ্ঞান হতে শুরু করল, আমি পরিবারের অন্যান্য ভাইবোনদের সাথে কেন যেন মিশতে পারতাম না ভালোভাবে। তুমি তো জানো পাহাড় আর নদী ঘেরা এক প্রাকৃতিক লীলাভূমি মন্টানা। আমি একা একা প্রায় দূর দুপুরে দূর পাহাড়ে চলে যেতাম, ভাবতাম আমি কেন দুনিয়ায় এসেছি, আমার কি কারণে আসা। আমি যেন কেমন হাহাকার বোধ করতাম মনের ভেতর। একটু তরুণী হবার পর থেকে আমার বন্ধুরা, ভাইবোনেরা বিভিন্ন ক্লাবে গিয়ে মদ খেত, আনন্দ করত। আমি তাদের সাথে যেতাম না। যদিও আমি খ্রিষ্টান কিন্তু কোনদিন আমি একটি বারের জন্যও মদ পান করিনি। আধুনিক খ্রিষ্টধর্মে মদপান নিষিদ্ধও নয়।
আমার বন্ধুরা ছোট ছোট জামা পরে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াত, সুইমিং কষ্টিউম পরে সাঁতার কাটত, কিন্তু আমি কোনদিন ওসব পরতে পারতাম না। আমার বিবেক আমাকে বাধা দিত। আমি জানিনা কেন পারতাম না।
আমি আবিষ্কার করলাম আমি আসলে একা ভীষণ একা। আমার কোন ভালো বন্ধু নেই। ভাইবোনেরা আমাকে সময় দিত না। একসময় আমার বিয়ে হল, সন্তান দুনিয়ায় আসল। আমার ছেলে বড় হল।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ বিপত্তি ঘটল একদিন। একদিন গভীর রাতে স্বপ্নে আমি এক অজানা কন্ঠে কিছু গান মধুর সুরের অজানা ভাষার গান শুনতে পেলাম। বাক্যগুলো ছিলো এমন- আললাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ্...
পরদিন সকালে সে স্বপ্নের কথা ভুলে গেলাম। কিন্তু না প্রতি রাতেই আমি স্বপ্নে দেখি সে মধুর সুরের গান। আমি অস্থির হয়ে গেলাম। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ঘুমের ঔষধ খেতে লাগলাম। যতই ঘুমের ঔষধ খাইনা কেন মাঝ রাতে সে মধুর শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
এভাবে প্রায় ছয়মাস কেটে গেলো। একদিন টিভিতে আমেরিকায় মুসলিম সন্ত্রাসীদের নিয়ে একটি পর্ব প্রচারিত হচ্ছিল। আমি পাশের রুমে ছিলাম। সেখানে এই গানও দেখাচ্ছিলো। আমি দ্রুত টিভির সামনে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, এই তো সে গান যা আমি স্বপ্নে দেখেছি গত ছয়টি মাস ধরে। এই তো সেই সন্ত্রাসীদের গান। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, হে গড! আমি কি তাহলে সন্ত্রাসী হয়ে যাচ্ছি!
ইন্টারনেটে সার্চ দিতাম সন্ত্রাসী সংগীত, সন্ত্রাসীদের গান, মুসলিম সংগীত এসব নামে। খুঁজতে গিয়ে একদিন পেয়ে গেলাম সেই সংগীত। জানলাম এর নাম আযান। মুসলিমদের ছালাতে আহবানের ডাক। আমার মত খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম নেয়া একজন মানুষকে কে শোনালো এই আযান? কে আমাকে আহবান করছে? আমি বুঝতে চাইলাম, ইসলাম কী? রব কী, রাসূল কে? কবর-হাশর, মীযান নিয়ে আমার বিস্তর পড়াশোনা শুরু হয়ে গেল। আমি বুঝলাম আকাশের মালিক আমাকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করেছেন। আমার সহস্র রাতের ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি জেগে উঠলাম।
বুঝলাম ইসলাম সন্ত্রাসীদের ধর্ম নয়, বরং সন্ত্রাসীরা ইসলামের নাম ব্যবহার করে মাত্র। পরদিন খুব ভোরে আমি জুম‘আ মসজিদে গিয়ে কালেমা শাহাদাত পাঠ করলাম। তুমি কি জানো এই কালেমার বিনিময়ে আমি কি হারিয়েছি?
আমার স্বামী আমাকে ত্যাগ করলেন। যে ছেলেকে আমি পেটে ধরেছি, বড় করেছি, সেই ছেলে আমাকে ত্যাগ করল। আমি তো আগেই একা ছিলাম। এখন আরো একা হয়ে গেলাম। আজ পনেরো বছর আমি একা।
তুমি কি জানো এতকিছুর বিনিময়ে আমি কি পেয়েছি? আমি আমার আল্লাহ্কে পেয়েছি। তুমি জানো এতকিছুর বিনিময়ে আমি কি পেয়েছি? ঐ যে ছোটবেলা থেকেই আমার অন্তরে যে হাহাকার ছিল, যে না পাওয়ার বেদনা ছিল, আমি বুঝেছি আমার হাহাকার ছিলো কালেমার জন্য, আমার হাহাকার ইসলামের জন্য। আমার মনের শুন্যতা দূর হয়েছে। আমি এখন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করছি।
তুমি জানো এই বুড়ো বয়সে কিছু খাবারের জন্য আমাকে উবার চালাতে হয়। কয়েক বছর আগে আমি একজন মিশরীয় মুসলিমকে বিয়ে করেছি শুধু জীবনের একাকীত্ব ঘোচাতে। কিন্তু সে এখন ক্যান্সার আক্রান্ত। তাকেও হয়তো রবের কাছে চলে যেতে হবে। আমি চেষ্টা করছি তার যথেষ্ট সেবা করতে। আমার ছেলেটাকে আমি দেখিনা আজ দু’বছর হ’ল। আমার ছেলের ঘরে নাতি হয়েছে অনেকদিন। কিন্তু জানো আমি তাকেও দেখিনি অনেকদিন হ’ল।
আমি চাইলেই স্বাভাবিক জীবনে চলতে পারতাম। স্বামী সন্তান নিয়ে আনন্দে থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি দুনিয়া এবং আখিরাতের মাঝে হিসাব করে দেখলাম, আমার জন্য আখেরাতই মঙ্গল। এখন যদি আমি না খেয়ে মরেও যাই, আমার দুঃখ থাকবেনা। জানি না কখন রবের ডাক এসে যায়। আমি দ্রুত আমার রবের সাথে দেখা করতে চাই। তাঁকে বলতে চাই ওগো আরশের মালিক! শুধু তোমায় দু’চোখ ভরে দেখব বলে আমি সব ছেড়ে এসেছি।
আমাদের গাড়ি গন্তব্যে এসে পেঁŠছেছে, গাড়ি থেকে নামতে পারছিনা আমি। চোখের পানিতে বুক ভেসে গেছে সেই কবে। শরীর অবসাদ হয়ে আসছে। এই মহিমান্বিত রমনীর অনুমতি নিয়ে তার একটি ছবি তুললাম, ইন্টারনেটে শেয়ারের অনুমতিও পেলাম।
তিনি হিজাব পরতেন। কিন্তু এখানে তাকে নানা কটু কথার শিকার হতে হয়েছে। তাই তিনি এখন কাজের সময় হিজাব পরেন না। তার আমেরিকান নাম এন্ড্রি। মুসলিম নাম তিনি নিজেই খুঁজে রেখেছেন ছাবাহ অর্থাৎ প্রভাত। যেহেতু তিনি সুবহে সাদিকের সময় মহান আল্লাহর আহবান শুনেছেন, তাই এই নামকরণ।
ছাবাহ আমাদের নামিয়ে দিয়ে দ্রুত আরেকটি ট্রিপ ধরবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের এক অস্থির সময়ে ফেলে গেলেন তিনি। আমি বলে উঠলাম :
ওগো আরশের মালিক! তুমি তোমার ছাবাহকে দেখে রেখো। ছাবাহকে দেখে আমি আবারও বুঝেছি, ওগো রহমান তুমি সত্য। তোমার দ্বীন সত্য। তোমার আলো সত্য।
[লেখক : ডা. শরীফ মহিউদ্দীন, হিউস্টোন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র]