ব্যবসায়ীর বদান্যতা

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 329 বার পঠিত

অনেক দিন আগের কথা। এক ব্যবসায়ী বাজারের এক মুদি দোকানীর সাথে ব্যবসা করার চুক্তি করেছিল। ব্যবসায়ী তার পণ্যদ্রব্য মুদি দোকানীর কাছে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করত। আর যখন তার ছোট-খাট জিনিসের দরকার হত তখন দোকানীকে সেটা পৌঁছে দিতে বলত। দোকানী তার কর্মচারীকে দিয়ে সেসব জিনিস ব্যবসায়ীর বাড়িতে পৌঁছে দিত। জিনিসের দামটাও ব্যবসায়ীকে বলে দিত। চুক্তি ছিল এক বছর পর হিসাব করে হালখাতা করা হবে। বছর শেষে একদিন ব্যবসায়ী মুদির দোকানে হিসাব করার জন্য গেল। প্রত্যেকে তাদের খাতায় নিজ নিজ হিসাব লিখেছিল। মুদির জমা হিসাব অনুযায়ী দশ হাযার টাকা হয়েছিল। কিন্তু মিলানোর সময় উভয়ের মধ্যে মতভেদ হল। ব্যবসায়ীর হিসাব মতে মুদির বাকি ১০ হাযার ১ টাকা। মুদি দোকানী ১০ হাযার টাকা দিয়ে মিটমাট করতে চাচ্ছিল কিন্তু ব্যবসায়ী তা মানলো না। সে বললো ১০ হাযার ১ টাকা দিতে হবে। কেউ কারো কথা মানতে রাজি হচ্ছিল না। দোকানী বললো, আমার পুঁজি কম। আমি এক বছর যাবৎ এই ছোট জিনিসের হিসাব রেখেছি। যেহেতু তুমি বড় ব্যবসায়ী এই এক টাকার হিসাব না করেই নিতে পার।

কিন্তু ব্যবসায়ী বলল, হিসাব হিসাবের জায়গায়, বন্ধুত্ব বন্ধুত্বের জায়গায়। হিসাব গরমিল কোথায় তা দেখ। এক টাকা হিসাব না করেই নিব তার মানেই হয় না। আর তুমি ফকীর নও যে তোমাকে দিয়ে দিব। যদি অন্ধ হতে তবুও এক টাকার হিসাব না করে আমি ধনী হতাম না। ধন-সম্পদ এক এক টাকা করে জমা করা হলেই তা এক হাজারে পরিণত হয়। নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হব এরকম কোনই কারণ নেই। অবশেষে দরাদরি করে কোন ফলাফলে পৌঁছাতে পারল না। সমস্ত হিসাব দু’জনে পুনরায় দেখার পর গরমিল খুঁজে পায়।

ঐ দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সমস্ত হিসাব এক এক করে দেখার পর বুঝতে পারল ব্যবসায়ীর হিসাব ঠিক ছিল এবং মুদি দোকানীর হিসাব ভুল। ঐ সময় মুদি দোকানী বলল, এখন তোমার নেওয়ার অধিকার আছে কিন্তু এই এক টাকা না দেখেই নিতে পারতে। কারণ তুমি তোমার পণ্য এক জায়গায় বিক্রি করেছ। কিন্তু আমি বিভিন্ন জায়গায় সাধারণত নিত্য প্রয়োজনীয় ছোট জিনিস বিক্রি করি যার হিসাব রাখা কঠিন। আমার ব্যবসা হিসাবে এই এক টাকা আমার জন্য মূল্যবান, কিন্তু তোমার জীবনে তা কোনই প্রভাব ফেলবে না। ব্যবসায়ী বলল, তোমার কথা ঠিক। কিন্তু হিসাব তো হিসাবই। হিসাব ঠিক রাখার জন্য আমার কঠোরতা করার অভ্যাস আছে। যদি আমি এক টাকার হিসাব না করেই নিতে চাইতাম তাহলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সময় নষ্ট করতাম না। অবশেষে দোকানী বাধ্য হয়ে ১০ হাযার ১ টাকা তাকে দিয়ে হিসাবের খাতা বন্ধ করে দেয়। ব্যবসায়ী দোকানীকে বিদায় দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের দিকে চলে যায়।

দোকানীর যে কর্মচারী দোকানে কাজ করত, সে তার মালিককে বললো, আমি এক বছর এই লোকের বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দিয়েছি। আমি আমার বকশীস নিতে ভুলে গিয়েছি। এখন গিয়ে আমার মজুরী নিব। মুদি দোকানী বললো, যে লোক এক টাকা ছাড় দেয় না, সে তোমাকে বকশীস দিবে? অযথা কষ্ট করে নিজের সম্মান নষ্ট করো না।

কর্মচারী বললো, আমি আমার অধিকার অবশ্যই দাবি করবো। যদি সে না দেয় তো দিবে না।

সে ব্যবসায়ীকে অনুসরণ করে দৌড় দিল। এক পর্যায়ে বাজারের মধ্যে তাকে পেল। কর্মচারী ব্যবসায়ীকে বললো, হিসাব তো মিটমাট হ’ল কিন্তু আমার মজুরী তো দিলেন না। আমি আপনার কাছে থেকে বকশীস নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু বলতে ভুলে গিয়েছি। ব্যবসায়ী পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঐ ১০ হাযার ১ টাকা দিয়ে বললো এটা তোমার মজুরী। কর্মচারী সেটা নিয়ে দোকানে ফিরে গেল।

দোকানে গেলে মুদি দোকানী তাকে বলল, আজব বোকা ছেলে তুমি! এই লোকটি সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত মাত্র ১ টাকার জন্য কথা কাটাকাটি করলো। শেষ পর্যন্ত হিসাব না করে আমাকে রেহাই দিল না। আমার প্রতিবেশী দোকানীদের সামনে এমন আচরণ করলো তবুও নিজের সম্মান ও মর্যাদার দিকে তাকাল না। তারপরেও তুমি তোমার বকশীসের জন্য তার পেছনে দৌড় দিলে। এখন কি হল, লাভ হল না?

কর্মচারী পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই টাকা বের করে বললো, কেন আমি বললাম আমার মজুরি তো দিলেন না, আর সে এই ১০ হাযার ১ টাকা দিয়ে চলে গেল। দোকানী আশ্চর্য হয়ে চিন্তায় পড়ল, আজব ব্যাপার! আমার এই কর্মচারী খুবই ভদ্র। বাঁচাল নয় যে বলব অভদ্রতা করে নিয়েছে। এই কৃপণ লোকটি ১ টাকার জন্য পুরা একদিন নষ্ট করলো। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার ঐ টাকাটা সে বখশিশ দিয়ে দিল।

সেদিনের পর থেকে মুদি দোকানী সব সময় ভাবতে থাকে এই ব্যবসায়ী তবে কেমন লোক। একদিন ব্যবসায়ী ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দোকানীর সাথে দেখা হয়। দোকানী কুশল বিনিময় করে বলে, আমি তোমার মাঝে আজব জিনিস দেখেছি। সেটার কারণ জানতে চাই। ঐদিন হিসাবের সময় তুমি এক টাকার জন্য সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দর কষাকষি করলে। তুমি আমাকেও ক্লান্ত করে দিলে, নিজেও ক্লান্ত হলে। তবুও এক টাকা ছাড়লে না। আমার প্রতিবেশী দোকানীরা তোমার এরকম কঠিন হিসাব দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। অথচ সেই টাকায় আমার কর্মচারীকে বকশীস দিয়ে দিলে। তাহলে ঐ কঠোরতার অর্থ কি ছিল আর এই দানবীরতার অর্থ কি হল- আমি জানতে চাই?

ব্যবসায়ী বললো, আশ্চর্য হয়ো না। আমি অত্যন্ত শক্তভাবে হিসাব করা লোক। কেনা-বেচাই আমার কাজ। হিসাবের খাতা আমার কাজের অর্জন। এই অর্জন অবশ্যই নির্ভুল হতে হবে। শুধু এক টাকা নয়, এক পয়সা কিংবা এক সিকিও হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বখশিশ ভিন্ন বিষয়। তোমার কর্মচারী আমার বাসায় এক বছর যাবৎ পনির, ঘি ও অন্যান্য জিনিস পৌঁছে দিয়েছে। যদি আমি নিজে এগুলো বহন করতাম তাহলে তার কষ্ট করতে হত না।

যখন সে বলল, আমার বখশিশ দেন। তখন আমি তার কাজের পরিমাণের দিকে ফিরে তাকালাম না। আমার বাসায় তিনটা সন্তান আছে। ভাবলাম, এই এক বছরে তারা সেই টাকার চেয়ে বেশী পনির, ঘি ঘরেই খেয়েছে। এই জন্য ১০ হাযার এক টাকা তাকে বখশিশ দিয়েছি। এক টাকার জন্য কঠোর হওয়া হিসাবের বিষয় ছিল। পণ্যের দাম যেমন নির্ধারিত তেমন হিসাবও নির্ধারিত। কিন্তু বখশিশ নির্দিষ্ট নয় বরং তা উপহার স্বরূপ ছিল। পূর্বপুরুষরা বলেছেন, এক পয়সা হলেও হিসাব কর, কিন্তু বখশিশের হাত লম্বা কর।

[ফার্সী থেকে অনূদিত]  

শিক্ষা : বর্তমান সমাজে মানুষের মধ্য থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে। ব্যবসায়ীরা বেশী লাভের আশায় একদিকে পণ্যদ্রব্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলছে। অপরদিকে ব্যবসার হিসাবে গরমিল করে সহকর্মী ব্যবসায়ীদের ঠকাচ্ছে। এই গল্পের প্রথম শিক্ষা সেসব অসৎ ব্যবসায়ীদের জন্য যারা বাকীতে জিনিস বিক্রি করে ক্রেতার অগোচরে বেশী দাম লিখে রাখে। এ সমস্ত প্রতারকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে হিসাবের খাতা রাখতে হবে এবং ১ টাকার গরমিল হলেও তা খতিয়ে দেখে হিসাব করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ নিজ অধীনস্ত শ্রমিককে অবশ্যই তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা আমাদের অধিনস্ত শ্রমিককে দিয়ে তার নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও কাজ করিয়ে নেই। কিন্তু তাকে হাদিয়া দেওয়া তো দূরের কথা, সামান্য ধন্যবাদ শব্দ উচ্চারণ করতেও কার্পণ্যবোধ করি।

এই গল্পের শেষাংশ আমাদের এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে, যারা আমাদের জীবনধারণের উপকরণ প্রত্যেকের হাতে হাতে পৌঁছে দিয়ে আমাদের জীবন নির্বাহ সহজ করে দেয়, তাদের সুখী রাখার জন্য অবশ্যই প্রাপ্য মজুরীর চেয়ে বেশী হাদিয়া দেওয়া উচিত। কেননা তাদের জন্যই আমরা বাড়িতে বসে থেকে বিনা পরিশ্রমে সুবিধা ভোগ করতে পারি। যদি তারা আমাদের ছোট-খাট কাজগুলো করে না দিত, তাহলে সে কাজগুলো নিজেরা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমরা আমাদের অত্মসম্মান ও সামাজিক মর্যাদা ধরে রাখতে পারতাম না। তাই সে সমস্ত শ্রমিকদের কখনো তাচ্ছিল্য করা উচিত নয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই গল্পের শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

-মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

অনুবাদক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।



বিষয়সমূহ: হালাল-হারাম
আরও