সংগঠনের বিরোধিতা কেন?
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 851 বার পঠিত
তরুণ সমাজের একটি অংশ যখন বস্ত্তবাদের লাল নেশায় মত্ত হয়ে দুনিয়ার পিছনে অন্ধের মত ছুটছে, পুঁজিবাদের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মরণ প্রতিযোগিতায় নেমেছে, ঠিক তখনই তরুণদের অপর একটি অংশ বস্ত্তবাদের নয়া টোপ গিলে আখেরাতমুখিতাকে একপাশে রেখে অন্ধের মত দুনিয়ার পিছনে ঘুরছে। এ যেন এক নয়া ঈমানী বস্ত্তবাদ। দ্বীনদারিতার পোষাকে এই ঈমানী বস্ত্তবাদীদের প্রধান আলামত হ’ল ইখলাছহীনতা এবং আখলাকহীনতা। শয়তান যখন তাদের দ্বীনের পোষাক খুলতে পারেনি, তখন ইখলাছ আর আখলাকের ছিদ্র দিয়ে ঈমান ছিনতাইয়ের সুযোগ গ্রহণ করেছে। সরাসরি ঈমান হরণ করতে পারে না; বরং বান্দার আখলাকী বর্মে আঘাত হেনে সঙ্গোপনে ঈমান হরণের আয়োজন করেছে। আর এই সূক্ষ্ম ফাঁদগুলো এমনই ধ্বংসাত্মক যে, যা থেকে নিজেকে রক্ষা করা তরুণদের জন্য যেন এক কঠিনতম যুদ্ধের শামিল। বাহ্যিক লেবাস-পোষাক, এমনকি ইলম ও আমলের প্রাচুর্য দিয়েও তা যেন ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রাণান্ত চেষ্টা করতে করতে একসময় তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে। দ্বীনদারিতা, আল্লাহভীতি, জীবনের মহৎ লক্ষ্য, আখেরাতে মুক্তির তীব্র ইচ্ছা কোন কিছুই তাকে আগলে রাখতে পারছে না। নিমিষে হারিয়ে যাচ্ছে ঈমানী বস্ত্তবাদের চোরাস্রোতে। রাসূল (ছাঃ) যথার্থই বলেছেন, দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগলের পালে ছেড়ে দেয়া হ’লে তা যতটুকু না ক্ষতিসাধন করে, কারো সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ এর চেয়ে বেশী ক্ষতিসাধন করে তার ধর্ম ও ধার্মিকতায় (তিরমিযী হা/২৩৭৬)।
তরুণ সমাজের এই আখলাকী নৈরাজ্যের চিত্রগুলো দিনে দিনে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। যেমন :
(ক) ভাইরাল হওয়ার আকাঙ্খা : বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পরিচিতি পাওয়াটা খুব সহজ। সেজন্য ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যেকোনভাবে ভাইরাল হওয়ার নেশা তরুণদের মধ্যে উন্মাদনা ছড়িয়েছে। মাল ও মর্যাদার লোভ এর সাথে যুক্ত হয়ে পুরো পরিবেশটা এখন ইখলাছ ও আত্মমর্যাদাহীন প্রদর্শনীতে গম গম করছে। যে যা নয়, তার চেয়ে বেশী প্রদর্শনের ইচ্ছা ও চেষ্টা আর কথায় কথায় আমিত্বের প্রতিষ্ঠার বিপুল আগ্রহ নিয়ে আত্মপ্রচারের ফুলঝুরি চলছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। পড়াশোনা কিছু দূর যেতে না যেতেই শায়খ, মুফতি বনে যাওয়া বকওয়াজ তরুণদের ভিড়ে প্রকৃত আলেমদের খুঁজে পাওয়া এখন ভীষণ দুষ্কর।
(খ) মাল ও মর্যাদার লিপ্সা : তরুণদের মধ্যে এই দু’টি রোগ এখন সবার শীর্ষে। দ্বীনের কাজে নেমে অর্থলিপ্সা, যশ-খ্যাতি আর পদ-পদবীর পিছনে ছোটার এই নেশা তরুণদের আমল-আখলাকের মধ্যে এক বিশাল নৈরাজ্য তৈরী করেছে। দাওয়াতী ময়দান এখন আর দ্বীনের দাওয়াতের কেন্দ্র নয়, যেন ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে দাড়িয়েছে। পুঁজিবাদী, বস্ত্তবাদী সমাজের মত এখানেও যে যার মত নিজের দর বাড়াতে হাজারো কৌশল ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিচ্ছে। দ্বীনদারিতা এখানে কেবল মুখোশ। আল্লাহর সন্তুষ্টির আলাপ কেবল মুখের বুলি। দিন শেষে মাল-মর্যাদা হাছিলের গোপন প্রতিযোগিতাই সবকিছু। এ এক অন্তহীন নেশাগ্রস্ত পথ, যার পিছনে ছোটা মানুষটা শেষ পর্যন্ত জানে না, তার গন্তব্য কোথায়। ইন্নালিল্লাহ! রাসূল (ছাঃ) বোধহয় এজন্যই মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘তোমাদের উপর আমার সবচেয়ে অধিক যে জিনিসের ভয় হয়, তা হ’ল লোক দেখানো আমল ও গোপন কুপ্রবৃত্তি’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫০৮)।
(গ) স্বার্থবাদিতা : মাল-মর্যাদার লোভের সাথে স্বার্থদুষ্টতা তরুণদের আখলাকী নৈরাজ্যে এনেছে এক নতুন মাত্রা। ভদ্রবেশী এই স্বার্থদুষ্টদের কাছে নিজের স্বার্থটাই সবকিছু। সামান্য স্বার্থহানিতে তাদের ঈমান টলটলায়মান। নিজের ব্যক্তিস্বার্থে জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে তারা এক মুহূর্ত দেরী করে না। নিজের দীর্ঘ লালিত নৈতিক আদর্শকে সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে এক লহমায় বিলিয়ে দিতে তারা কার্পণ্য করে না। যে কোন মূল্যে স্বার্থ উদ্ধারই তাদের প্রধান লক্ষ্য। নিজের স্বার্থ ধরে রাখতে সমাজে বিভেদের দুয়ার খুলতে তাদের বিন্দুমাত্র বাধে না। এতে যদি সমস্ত দুনিয়াও ধ্বংস হয়ে যায়, তাতে তাদের যায়-আসে না। মুসলিম উম্মাহ ও সমাজের প্রতি দায়-দায়িত্বহীন এই মানুষগুলো আপাত ধার্মিক হ’লেও প্রচন্ড রকম আত্মকেন্দ্রিক, নিষ্ঠুর এবং হৃদয়হীন। স্বার্থের জন্য হেন কিছু নেই, যা তারা করতে পারে না। এমন কিছু নেই, যা বলতে পারে না। এমন কোথাও নেই, যেখানে যেতে পারে না। যত নীচেই নামা লাগুক, তারা দ্বিধাবোধ করে না। মুহূর্তেই বন্ধুকে শত্রু, শত্রুকে বন্ধু বানাতে তারা নিত্য সিদ্ধহস্ত। নীতি-আদর্শের কোন মূল্য তাদের কাছে নেই। স্বার্থের মধ্যে তারা জীবনের অর্থ খুঁজে নেয়।
(ঘ) মুনাফিকী : ঈমানদারিতার ও ঈমানহীনতার মাঝামাঝি অবস্থান হ’ল মুনাফিকীর। বিশ্বাসগত মুনাফিক না থাকলেও আমলগত মুনাফিকে গিজ গিজ করছে সমাজ। কারো প্রতি বিশ্বাস, আস্থা রাখার যেন উপায় নেই। শয়তানী ফেরেবে পড়ে মুহূর্তে মুহূর্তে মানুষগুলো যেন ঈমান হারাচ্ছে। টাকা-পয়সার নয়-ছয়, দুর্নীতি, জালিয়াতি তাদের হাতের মোয়া। তাদের কথার সাথে কাজের কোন মিল নেই। মুখের সুন্দর কথা ও আচরণের সাথে বাস্তব জীবনের যোজন যোজন তফাৎ।
(ঙ) পন্ডিতমন্যতা : জ্ঞান-বিজ্ঞানের সহজলভ্যতা এখন বহু তরুণকে অকাল পন্ডিত বানিয়ে ফেলেছে। যাকে তাকে কাফির, বিদ‘আতী আখ্যা দেয়ায় সিদ্ধহস্ত এই পন্ডিতমন্য সদ্য তরুণদের দাপটে থরহরিকম্প এখন সোশ্যাল মিডিয়া।
এদের পান্ডিত্যের দাপট ও কথাবার্তার ভাবসাব এমনই যে, তাদের দেখে মনে হয় তারা সবজান্তা সমশের কিংবা মুসলিম উম্মাহর মহান রক্ষাকর্তা। কথায় কথায় বিজ্ঞ আলেম-ওলামাদেরকে অপমানজনকভাবে রদ করা এবং কুরুচিপূর্ণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় মুসলিম জামা‘আত থেকে খারিজ করা এদের নিত্যকর্ম। মুখের ভাষা ও আখলাকে তারা এতটাই অবিনয়ী, উদ্ধত, হিংসুক, অহংকারী, ঝগড়াটে এবং কুটতর্কপ্রিয়, যা একজন দাঈ-র কাছে কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি আমার উম্মতের উপর জিহবার জ্ঞানী (عليم اللسان) তথা বাগ্মী মুনাফিকদেরকে অধিক ভয় করি’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০১৩)। তাবেঈ আহনাফ বলেন, আমি ওমর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি আমরা আলোচনা করতাম যে, মুখের (জিবের) জ্ঞানী বা বাগ্মী মুনাফেকরা এই উম্মতকে ধ্বংস করে দিবে’ (মুসনাদুল ফারূক ২/৬৬১)।
প্রিয় পাঠক! তরুণদের এই আখলাকী নৈরাজ্যের বাস্তবতা তুলে ধরার পিছনে উদ্দেশ্য এটাই যে, আমাদের তরুণদের বুঝতে হবে যে, প্রকৃত মুসলিমের জন্য ছহীহ আক্বীদা ও আমলই যথেষ্ট নয়, বরং সমানভাবে আখলাকী উন্নয়নও যরূরী। যদি সেটা করতে না পারি, তবে বুঝতে হবে আমাদের শুদ্ধ আক্বীদা, শুদ্ধ আমলের চর্চা কেবল বাহ্যিক। আমাদের অন্তরে তার কোন প্রভাব নেই। আমাদের চরিত্রে তার কোন প্রতিফলন নেই। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আমাদেরকে তাকওয়া, ইখলাছ ও আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণে ব্রতী হওয়ার পাশাপাশি অন্ততঃ দু’টি সামাজিক বিষয়ের চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।
(ক) সততা : সততা আমরা কমবেশী বজায় রাখার চেষ্টা করি বটে, তবে এতটুকুই যথেষ্ট নয়। পরিচ্ছন্ন অন্তর ও আখলাকী পূর্ণতা অর্জন করার জন্য যেটা প্রয়োজন- কথায় ও চিন্তায় শতভাগ সৎ থাকার সংগ্রাম। মিথ্যা ও প্রতারণার সংশ্লেষ থেকে নিজেকে সর্বোতভাবে দূরে রাখার প্রতিজ্ঞা। ভোগের লালসা ও মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা থেকেই অসততা ও দুর্নীতিপরায়ণতা তৈরী হয়। আল্লাহভীতি এবং সততার নিরন্তর চর্চার মধ্য দিয়েই কেবলমাত্র এই প্রবণতা থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্য-সঠিক কথা বল, তাহলে তিনি তোমাদের কাজ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে’ (আহযাব ৩৩/৭০-৭১)।
(খ) আমানতদারিতা : সততার সাথে সাথে আমানতদারিতার চর্চাও অত্যন্ত যরূরী। আমানতদারিতা খেয়ানতের বিপরীত। মুনাফিকী ও দ্বিচারিতার বিপরীত। প্রগাঢ় দায়িত্ববোধ, কর্তব্যনিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আস্থাভাজন হওয়ার মধ্যেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এটা এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বোধ ও কর্মনীতি, যেখান থেকে তৈরী হয় চারিত্রিক সততা, দৃঢ়তা, ধৈর্য, উদারতা, পরমতসহিষ্ণুতা, অহিংসা, অন্যের ক্ষতি করা থেকে মুক্ত থাকা প্রভৃতি মৌলিক সৎগুণ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) এমন কোন খুৎবা ছিল না যেখানে বলতেন না, ‘যার আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই এবং যার ওয়াদা-অঙ্গীকারের মূল্য নেই তার দ্বীনও নেই’ (আহমাদ, ছহীহুত তারগীব হা/৩০০৪)।
প্রিয় পাঠক! মানুষের মনুষ্যত্বের অধঃপতন এবং আখলাকী বিচ্যুতি শুরু হয় সততা ও আমানতদারিতায় ক্ষান্তি ঘটার মাধ্যমে। সততার যোগ যেমন নিজের সাথে, আমানতদারিতার যোগ তেমন অপরের সাথে। রাসূল (ছাঃ) নবুওতলাভের পূর্বেও বিশেষভাবে এদু’টি মৌলিক মানবীয় গুণের জন্য প্রশংসিত ছিলেন। বর্তমান প্রজন্ম জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেলেও মনুষ্যত্বের প্রতিযোগিতায় চরমভাবে পিছিয়ে পড়ছে। বস্ত্তবাদী ফেৎনার প্লাবন এবং নৈতিক ও আদর্শিক অবক্ষয় তাদেরকে নাবিকহারা নৌকার মত দিগ্বিদিকশূণ্য করে দিয়েছে। সেজন্য এই যুগে নিজেকে লক্ষ্যপথে ধরে রাখতে ব্যক্তিজীবনে যেমন তাক্বওয়া ও ইখলাছের চর্চা প্রয়োজন, তেমনি সামাজিক জীবনে প্রয়োজন সততা ও আমানতদারিতার কঠোর অনুশীলনের। তাকওয়া ও ইখলাছের পথ ধরেই শুদ্ধিতা আসে। আর সততা ও আমানতদারিতার ধারাবাহিক চর্চার মধ্য দিয়ে আখলাকী শুদ্ধতা স্থায়িত্ব পায়। প্রতি মুহূর্তে এই দুইয়ের চর্চা আমাদেরকে হৃদয়জগতকে পরিচ্ছন্ন, প্রশান্ত, আলোকিত, অমলিন ও অবিচল রাখে।
মুমিনের জিহাদ মূলতঃ রাজনৈতিক নয়, বরং আদর্শিক ও নৈতিক। এই জিহাদ যত না মানবশত্রুর বিরুদ্ধে; তার চেয়ে অনেক বেশী অন্তরশত্রুর বিরুদ্ধে। এই জিহাদই মুক্তির পথ। কলবে সালীম তথা বিশুদ্ধ চিত্ত অর্জনের পথ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হাজারো ফেৎনার জাল ছড়িয়ে শয়তান আমাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। শক্তহাতে সততা ও আমানতদারিতার ঢাল ধরে রেখে এই সকল চ্যালেঞ্জকে মুকাবিলা করতে হয়। অতএব শিরক ও বিদআত থেকে নিবৃত থেকে ঈমান ও আমলের শুদ্ধতা করা যেমন যরূরী, তদ্রুপই যরূরী রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্রে চরিত্রবান হয়ে আখলাকী শুদ্ধতা অর্জন করা। দুনিয়াবী যাবতীয় ফেৎনা থেকে মুক্ত থাকতে এবং আল্লাহর দেখানো পথে পবিত্র জীবন পরিচালনা করতে এর কোনই বিকল্প নেই। আল্লাহ আমাদেরকে ঈমানের পথে ইখলাছ ও ইস্তিকামাতের সাথে কায়েম ও দায়েম থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!