শী‘আ মতবাদের বিস্তৃতি
আব্দুল আলীম
মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম 2290 বার পঠিত
ভূমিকা : মানুষ আল্লাহর ইবাদত করবে এবং পাপ বর্জন করবে। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আর লোকদের এই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহর তা‘আলা মাঝে মধ্যে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। সকল নবী-রাসূল স্বীয় উম্মতকে আল্লাহর আনুগত্য করতে ও পাপ বর্জন করতে উপদেশ দিয়েছেন। এমন কিছু পাপ আছে যেগুলোকে লোকেরা অনেক হালকা মনে করে। আবার এমন কিছু পাপ আছে লোকেরা যেগুলোকে নিজের অজান্তে করে। এজন্য রাসূল (ছাঃ) কিছু পাপের নাম উল্লেখ করেছেন যাতে উম্মত সতর্ক হয়ে যায়। আবার এমন কিছু পাপ বা পাপী আছে যেগুেলোকে রাসূল (ছাঃ) উম্মতের জন্য অতি ভয়ংকর মনে করতেন। যেমন ছোট শিরক, পথভ্রষ্ট নেতা, কপট বাগ্মী, চরমপন্থা, সমকামিতা, কুরআন ত্যাগ করা, জামা‘আত ও জুম‘আ পরিহার করা, যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, বিবাহের পূর্বে যৌবন নষ্ট করা, কৃপণতা, প্রবৃত্তির অনুসরণ ইত্যাদি পাপকে রাসূল (ছাঃ) উম্মতের জন্য অতি ভয়ংকর মনে করতেন। আর রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যৎ বাণীও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। এজন্য আমাদের সে সকল পাপের বিবরণ একান্ত জানা প্রয়োজন। যাতে করে সেগুলো থেকে নিজেকে হেফাযত করা যায়। নিম্নে কতিপয় ভয়ংকর পাপের বিবরণ তুলে ধরা হ’ল-
১. ছোট শিরক : শিরক করা মহাপাপ। কিন্তু কিছু শিরক আছে যেগুলো সম্পর্ক অনেকের ধারণা নেই। অনেকে আবার ছোট মনে করে গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। যেমন লোক দেখানোর জন্য কিংবা খ্যাতির জন্য সৎ আমল করা। যেমন হাদীছে এসেছে,
عَنْ مَحْمُودِ بْنِ لَبِيدٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ. قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِىَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِى الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً-
মাহমূদ বিন লাবীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের উপর আমার সবচেয়ে অধিক যে জিনিসের ভয় হয় তা হ’ল ছোট শিরক। ছাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছোট শিরক কী জিনিস? উত্তরে তিনি বললেন, রিয়া (লোক প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আমল)। আল্লাহ যখন (ক্বিয়ামতে) লোকদের আমলসমূহের বদলা দান করবেন তখন সকলের উদ্দেশ্যে বলবেন, তোমরা তাদের নিকট যাও, যাদেরকে প্রদর্শন করে দুনিয়াতে তোমরা আমল করেছিলে। অতঃপর দেখ, তাদের নিকট কোন প্রতিদান পাও কি না!।[1] অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَشِرْكَ السَّرَائِرِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَمَا شِرْكُ السَّرَائِرِ؟ قَالَ: يَقُومُ الرَّجُلُ فَيُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلَاتَهُ جَاهِدًا لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ النَّاسِ إِلَيْهِ، فَذَلِكَ شِرْكُ السَّرَائِرِ- ‘হে মানবমন্ডলী! তোমরা গুপ্ত শিরক হ’তে সাবধান হও। সকলে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! গুপ্ত শিরক কী? তিনি বললেন, মানুষ ছালাত আদায়ে দাঁড়িয়ে তার ছালাতকে চেষ্টার সাথে সুশোভিত করে (সুন্দর করে পড়ে); এই কারণে যে, লোকেরা যেন তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখে। এটাই (লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ছালাত পড়া) হ’ল গুপ্ত শিরক।[2]
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ: خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ، فَقَالَ: أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ؟ قَالَ: قُلْنَا: بَلَى، فَقَالَ: الشِّرْكُ الْخَفِيُّ، أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّي، فَيُزَيِّنُ صَلَاتَهُ، لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ- আবু সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন আমরা মাসীহ-দাজ্জাল সম্পর্কে একে অপরের মাঝে আলোচনা করছিলাম। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে এসে বললেন, সাবধান! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যাপারে অবগত করব না যা আমার নিকট তোমাদের জন্য মাসীহ-দাজ্জাল হ’তেও অধিক ভয়ানক? আমরা বললাম, হ্যা, বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, তাহ’ল গোপনীয় শিরক অর্থাৎ কোন ব্যক্তি ছালাতে দাঁড়িয়ে এজন্য ছালাতকে দীর্ঘায়িত করে যে, তার ছালাত কোন ব্যক্তি দর্শন করছে’।[3]
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَا مِنْ عَبْدٍ يَقُومُ فِي الدُّنْيَا مَقَامَ سُمْعَةٍ وَرِيَاءٍ إِلَّا سَمَّعَ اللهُ بِهِ عَلَى رُءُوسِ الْخَلَائِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে বান্দা পৃথিবীতে শ্রুতি এবং প্রদর্শনের জন্য কোন আমল করবে, আল্লাহ ক্বিয়ামত দিবসে সমস্ত সৃষ্টির সামনে তার অসৎ নিয়তের কথা মানুষকে শুনিয়ে দিবেন’।[4]
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي سَعِيدِ بْنِ أَبِي فَضَالَةَ الأَنْصَارِيِّ وَكَانَ مِنَ الصَّحَابَةِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: "إِذَا جَمَعَ اللَّهُ الأَوَّلِينَ وَالآخِرِينَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لِيَوْمٍ لَا رَيْبَ فِيهِ نَادَى مُنَادٍ مَنْ كَانَ أَشْرَكَ فِي عَمَلِهِ لِلَّهِ أَحَدًا فَلْيَطْلُبْ ثَوَابَهُ مِنْ عِنْدِهِ فَإِنَّ اللَّهَ أغْنى الشُّرَكَاء عَن الشّرك". আবু সাঈদ ইবনু আবু ফাযালাহ আনছারী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন যখন লোকদের সমবেত করবেন, যেদিন সম্পর্কে সন্দেহের কোন সুযোগ নেই। সেদিন কোন এক ঘোষণাকারী ঘোষণা দেবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কোন আমল করতে অন্য কাউকেও অংশীদার বানিয়েছে, সে যেন আল্লাহ ছাড়া ঐ ব্যক্তির থেকেই তার প্রতিদান অন্বেষণ করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা অংশীদার হ’তে সম্পূর্ণ মুক্ত’।[5]
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى عَلِىٍّ رَجُلٌ مِنْ بَنِى كَاهِلٍ قَالَ خَطَبَنَا أَبُو مُوسَى الأَشْعَرِىُّ فَقَالَ أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا هَذَا الشِّرْكَ فَإِنَّهُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ. فَقَامَ إِلَيْهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ حَزْنٍ وَقَيْسُ بْنُ الْمُضَارِبِ فَقَالاَ وَاللَّهِ لَتَخْرُجَنَّ مِمَّا قُلْتَ أَوْ لَنَأْتِيَنَّ عُمَرَ مَأْذُونٌ لَنَا أَوْ غَيْرُ مَأْذُونٍ. قَالَ بَلْ أَخْرُجُ مِمَّا قُلْتُ خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ فَقَالَ أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا هَذَا الشِّرْكَ فَإِنَّهُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ. فَقَالَ لَهُ مَنْ شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَقُولَ وَكَيْفَ نَتَّقِيهِ وَهُوَ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ্র قُولُوا اللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئاً نَعْلَمُهُ وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ نَعْلَمُ -
আবু আলী হ’তে বর্ণিত যিনি বনু কাহেলের জনৈক ব্যক্তি, তিনি বলেন, আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) একদা আমাদের সম্মুখে বক্তৃতা করলেন। তিনি বললেন, হে লোক সমাজ! তোমরা এই শিরককে ভয় কর। কেননা উহা পিপিলিকার চলার শব্দ থেকেও গোপন ও সুক্ষ্ম। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন হাসান ও কায়স বিন মুযারেব তাঁর কাছে উঠে গিয়ে বললেন, আপনি যা বলেছেন অবশ্যই তার সূত্র আমাদেরকে বলবেন। অন্যথায় আমরা ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর কাছে যাব, তিনি আমাদেরকে অনুমতি দিবেন বা না দিবেন। তিনি বললেন, বরং আমি যা বলেছি তার সূত্র বলছি। একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের সামনে খুৎবা দিলেন। তিনি বললেন, হে মানব মন্ডলী! তোমরা শিরককে ভয় কর (তা থেকে বেঁচে থাক)। কেননা উহা পিপিলিকার চলার শব্দ থেকেও গোপন বা সুক্ষ্ম। তখন আল্লাহ যাকে চাইলেন এমন এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে আমরা তা থেকে বেঁচে থাকব, অথচ উহা পিপিলিকার চলার শব্দের চেয়েও গোপন? তিনি বললেন, তোমরা এই দো‘আ বলবে, اللَّهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئاً نَعْلَمُهُ وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ نَعْلَمُ (আল্লাহুম্মা ইন্না নাঊযুবিকা মিন আন নুশরিকা বিকা শাইআন নালামুহু ওয়া নাস্তাগফিরুকা লিমা লা নালামাহু) ‘হে আল্লাহ জেনে শুনে কোন কিছুকে তোমার সাথে শরীক করা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং না জেনে শিরক হয়ে গেলে তা থেকে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’।[6]
অন্য হাদীছে এসেছে, عن عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرٍو يُحَدِّثُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ سَمَّعَ النَّاسَ بِعَمَلِهِ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ سَامِعَ خَلْقِهِ وَصَغَّرَهُ وَحَقَّرَهُ، قَالَ فَذَرَفَتْ عَيْنَا عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ- আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন যে, যে ব্যক্তি লোককে শুনাবার জন্য (সুনাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে) আমল করবে আল্লাহ তার সেই (বদ নিয়তের) কথা সারা সৃষ্টির সামনে (ক্বিয়ামতে) প্রকাশ করে তাকে ছোট ও লাঞ্ছিত করবেন’।[7]
২. নেতাদের ভ্রষ্টতা : শেষ যামানায় এমন কিছু নেতার আগমন ঘটবে যারা লোকদের বিভিন্নভাবে সত্য পথ থেকে ভুল ও ভ্রুষ্টতার পথে নিয়ে যাবে। আর এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) আশঙ্কা করতেন। যেমন হাদীছে এসেছে- عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّمَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِي الأَئِمَّةَ المُضِلِّينَ- ছাওবান হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি তো কেবল আমার উম্মতকে পথভ্রষ্টকারী ইমাম (আলেম ও নেতা প্রভৃতি)-দেরকে ভয় করি’।[8] আবু যার (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূল (ছাঃ)-এ সাথে হাঁটছিলাম। এমন সময় তিনি বললে,غَيْرُ الدَّجَّالِ أَخْوَفُ عَلَى أُمَّتِى مِنَ الدَّجَّالِ فَلَمَّا خَشِيتُ أَنْ يَدْخُلَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَىُّ شَىْءٍ أَخْوَفُ عَلَى أُمَّتِكَ مِنَ الدَّجَّالِ قَالَ : الأَئِمَّةَ الْمُضِلِّينَ ‘দাজ্জাল ছাড়াও আমার উম্মতের জন্য কিছু ব্যক্তিকে দাজ্জাল অপেক্ষা ভয়ঙ্কর মনে করি। আমি যখন আশঙ্কা করলাম যে তিনি বাড়িতে ঢুঁকে যাবেন তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, কোন জিনিসিকে আপনার উম্মতের উপর দাজ্জাল অপেক্ষা ভয়ঙ্কর মনে করেন? তিনি বললেন, পথভ্রষ্ট ইমাম বা নেতা’।[9]
৩. বক্তাদের ভ্রষ্টতা : বাগ্মিতা মানুষের একটি ভাল গুণ। কিন্তু এই গুণ যদি অন্যায়ের পক্ষে ব্যবহৃত হয় তাহলে তা হবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি চরম অকৃতজ্ঞতা। আর এই অকৃতজ্ঞ মানুষগুলোর ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) আতঙ্কিত ছিলেন। কারণ মুনাফিকেরা স্রষ্টার দেওয়া এই বিশেষ গুণের মাধ্যমে মুমিনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِى كُلُّ مُنَافِقٍ عَلِيمُ اللِّسَانِ - ওমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি আমার উম্মতের উপর মুখের (জিবের) জ্ঞানী তথা পন্ডিত বাগ্মী মুনাফেকদেরকে অধিক ভয় করি’।[10]
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَخْوَفُ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ جِدَالُ الْمُنَافِقِ عَلِيمِ اللِّسَانِ ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমার উম্মাতের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভয় করি, তা হ’ল মুনাফিকদের ঝগড়া-বিতর্ক, যারা হবে কথায় জ্ঞানী’।[11]
আহনাফ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, سَمِعْتُ عُمَرَ، يَقُولُ: كُنَّا نَتَحَدَّثُ إِنَّمَا يُهْلِكُ هَذِهِ الأُمَّةَ كُلُّ مُنَافِقٍ عَلِيمُ اللِّسَانِ ওমর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি আমরা আলোচনা করতাম যে, মুখের (জিবের) জ্ঞানী বা পন্ডিত বাগ্মী মুনাফেকরা এই উম্মতকে ধ্বংস করে দিবে’।[12]
হাসান বছরী বলেন, إِنَّ الأَحْنَفَ بْنَ قَيْسٍ قَدِمَ عَلَى عُمَرَ فِي وَفْدٍ، فَحَبَسَهُ حَوْلا، ثُمَّ قَالَ لَهُ: هَلْ تَدْرِي لِمَ حَبَسْتُكَ؟ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَذَّرَنَا كُلَّ مُنَافِقٍ عَلِيمِ اللِّسَانِ، وَإِنَّكَ لَسْتَ مِنْهُمْ إِنْ شَاءَ اللَّهُ، فَالْحَقْ بِبَلَدِكَ- ‘আহনাফ বিন কায়স একটি প্রতিনিধি দলের সাথে ওমর (রাঃ)-এর নিকট আসলেন। অন্যদের ছেড়ে দিলেও তাকে এক বছর আটকিয়ে রাখলেন। একদিন তাকে ওমর (রাঃ) বললেন, তোমাকে কেন আটকে রেখেছি জানো? রাসূল (ছাঃ) মুখের (জিবের) জ্ঞানী বা পন্ডিত বাগ্মী মুনাফেক সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করতেন। ইনশাআল্লাহ তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও। তুমি তোমার দেশে ফিরে যাও’।[13]
৪. জুম‘আ ও জামা‘আত ত্যাগ করা এবং সুন্নাহর সহায়তা ছাড়া কুরআনের তাফসীর করা : বর্তমান সময়ে একদল লোক জুম‘আর ছালাত বা জামা‘আতে ছালাত আদায়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না। এমন বক্তা রয়েছে যারা সারা বছর বক্তব্যের ময়দানে থাকে। যে ক’দিন বাসায় থাকে মসজিদে ছালাত আদায় করে না। বর্তমানে আরেক ভ্রান্ত দলের আবির্ভাব হয়েছে যারা হাদীছকে অস্বীকার করে। তারা কুরআনের মনগড়া তাফসীর বর্ণনা করে। এদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) উম্মতকে সতর্ক করেছেন।
যেমন হাদীছে এসেছে, عن عُقْبَةَ بْنَ عَامِرٍ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّمَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِى الْكِتَابَ وَاللَّبَنَ. قَالَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا بَالُ الْكِتَابِ قَالَ يَتَعَلَّمُهُ الْمُنَافِقُونَ ثُمَّ يُجَادِلُونَ بِهِ الَّذِينَ آمَنُوا. فَقِيلَ فَمَا بَالُ اللَّبَنِ قَالَ : أُنَاسٌ يُحِبُّونَ اللَّبَنَ فَيَخْرُجُونَ مِنَ الْجَمَاعَاتِ وَيَتْرُكُونَ الْجُمُعَاتِ-. উকবা ইবনু আমের হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমার উম্মতের জন্য কিতাব ও দুধের ফিৎনার ব্যাপারে আশঙ্কা করি। বলা হ’ল হে আল্লাহর রাসূল! কিতাবের ব্যাপারে ভয় কেন? তিনি বললেন, এই কিতাবকে মুনাফিকেরা শিখবে অতঃপর এর সাহায্যে মুমিনদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে। বলা হ’ল দুধের ব্যাপারে ভয় কেন? তিনি বললেন, কিছূ লোক দুধ পানকে প্রিয় করে নিবে। ফলে জামা‘আত থেকে দূরে সরে যাবে এবং জুম‘আ পরিহার করবে’।[14]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,يَتَعَلَّمُونَ الْقُرْآنَ فَيَتَأَوَّلُونَهُ عَلَى غَيْرِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَيُحِبُّونَ اللَّبَنَ فَيَدَعُونَ الْجَمَاعَاتِ وَالْجُمَعَ- ‘তারা কুরআন শিক্ষা করবে এবং আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করেছেন ঠিক তার বিপরীত ব্যাখ্যা করবে। আর তারা দুধ পানকে প্রিয় করে নিবে ফলে তারা জামা‘আত এবং জুম‘আ পরিহার করবে’।[15]
৫. জিহবার ছলচাতুরী : জিহবা আল্লাহর দেওয়া বিশেষ নে‘মত। এটি দ্বারা ভাল আমল করা যায় আবার মন্দ কর্মও করা যায়। মানুষ এই জিহবা দ্বারা মন্দ কর্মে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার ভয়ে রাসূল (ছাঃ) আতঙ্কিত ছিলেন।
যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ سُفْيَانَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الثَّقَفِىِّ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ حَدِّثْنِى بِأَمْرٍ أَعْتَصِمُ بِهِ قَالَ قُلْ رَبِّىَ اللهُ ثُمَّ اسْتَقِمْ قَالَ قُلْتُ َا رَسُولَ اللَّهِ مَا أَخْوَفُ مَا تَخَافُ عَلَىَّ قَالَ َأَخَذَ بِلِسَانِ نَفْسِهِ ثُمَّ قَالَ هَذَا. সুফইয়ান ইবনু আব্দুল্লাহ আছ-ছাকাফী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! যে জিনিসগুলো আপনি আমার জন্য ভয়ের বস্ত্ত বলে মনে করেন, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কোন জিনিসটি? রাবী বলেন, এ কথা শুনে তিনি নিজের জিহবা ধরে বললেন, এটা!।[16] আর জিহবাকে মন্দ কথা থেকে হেফাযতের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আমার (সন্তুষ্টির) জন্য তার দু’চোয়ালের মধ্যবর্তী বস্ত্ত (জিহবা) এবং দু’রানের মাঝখানের বস্ত্ত (লজ্জাস্থান) -এর হেফাযত করবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিনদার হব’।[17]
৬. অতিরিক্ত কৃপণতা করা : মানুষের অধিক কৃপণ হয়ে যাওয়াকে রাসূল (ছাঃ) অতি ভয়ংকর মনে করতেন। তাছাড়া প্রবৃত্তির অনুসরণ ও পথভ্রষ্ট নেতা বা ইমামদের ব্যাপারেও তিনি আতঙ্কিত ছিলেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي الْأَعْوَرِ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: مَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِي إِلَّا ثَلَاثًا شُحٌّ مُطَاعٌ وَهَوًى مُتَّبَعٌ وَإِمَامٌ ضَالٌّ- আবুল আওয়ার হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করে বলেন, আমি আমার উম্মতের উপর তিনটি বিষয়কে অতি ভয়ংকর মনে করি; ১. অনবরত লোভ বা কৃপণতা। ২. প্রবৃত্তির অব্যাহত অনুসরণ এবং ৩. পথভ্রষ্ট ইমাম বা নেতা’।[18]
অন্যত্র এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,ثَلَاثٌ مُهْلِكَاتٌ شُحٌّ مُطَاعٌ وَهَوًى مُتَّبَعٌ وَإِعْجَابُ الْمَرْءِ بِنَفْسِهِ، ‘আর ধ্বংসকারী বিষয় তিনটি হ’ল; অনুগত লোভ, প্রবৃত্তির অব্যাহত অনুসরণ এবং মানুষের নিজেকে নিয়ে অহংকার বা আত্মপ্রসাদ থাকা (আত্মগরিমা)।[19]
৭. সমকামিতায় লিপ্ত হওয়া : সমকামিতায় লিপ্ত হওয়া অন্যতম ভয়ংকর পাপ। যার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) সতর্ক করে দিয়েছেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِي عَمَلُ قَوْمِ لُوطٍ-জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি আমার উম্মাতের ওপর সবচেয়ে বেশি যে জিনিসের আশঙ্কা করি, তা হ’ল; লূত (আঃ)-এর গোত্রের কুকর্ম তথা সমকামিতা’।[20]
সমকামিতা এতোটাই ভয়ংকর যে এর শাস্তি সর্বোচ্চ তথা মৃত্যুদন্ড। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ وَجَدْتُمُوهُ يَعْمَلُ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ، فَاقْتُلُوا الْفَاعِلَ، وَالْمَفْعُولَ بِهِ ‘তোমরা যে ব্যক্তিকে লূত নবীর উম্মতের মত সমকামে লিপ্ত পাবে, সে ব্যক্তি ও তার সহকর্মীকে হত্যা করে ফেল’।[21] তিনি আরো বলেন, لَعَنَ اللَّهُ مَنْ عَمِلَ عَمَلَ قَوْمِ لُوطٍ ‘যে ব্যক্তি লূত (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের ন্যায় অপকর্মে লিপ্ত হয়, তার ওপর আল্লাহর লা‘নত (অভিশাপ)।[22]
আল্লাহ তা‘আলা এ সকল লোকদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির প্রতি (রহমত ও করুণার) দৃষ্টিপাত করেন না, যে কোন পুরুষের সাথে সহবাস করে অথবা নারীর গুহ্যদ্বারে সহবাস করে’।[23]
৮. জ্যোতিষীদের প্রতি বিশ্বাস, ভাগ্যে অবিশ্বাস ও শাসকদের নির্যাতন : লোকেরা তারকা বা নক্ষত্র দেখে ভবিষ্যৎ বলা এবং তা বিশ্বাস করার মত স্পর্শকাতর বিষয়ে জড়িয়ে পড়বে, ভাগ্যের ভাল-মন্দকে অবিশ্বাস করবে এবং শাসকেরা অন্যায়ভাবে প্রজাদের প্রতি অবিচার করবে এমন আশঙ্কা করতেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)।
যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ طَلْحَةَ بْنِ مُصَرِّفٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَتَخَوَّفُهُ عَلَى أُمَّتِي فِي آخِرِ الزَّمَانِ ثَلَاثًا: إِيمَانًا بِالنُّجُومِ، وَتَكْذِيبًا بِالْقَدَرِ، وَحَيْفَ السُّلْطَانِ- তালহা বিন মুছাররিফ হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, শেষ যামানায় আমার উম্মতের জন্য যে সকল বিষয়কে অতি ভয়ংকর মনে করি সেগুলো তিনটি; ১. তারকা বা নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাস ২. তাক্বদীরে (ভাগ্যে (অবিশ্বাস এবং ৩. নেতৃস্থানীয়দের যুলুম-অত্যাচার’।[24] অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, أَخَافُ عَلَى أُمَّتِيْ ثَلاَثًا اسْتِسْقَاءً بِالنُّجُوْمِ وَحَيْفَ السُّلْطَانِ، وَتَكْذِيْبًا بِالْقَدَرِ ‘আমি আমার মৃত্যুর পর আমার উম্মতের উপর তিনটি বস্ত্তর আশঙ্কা করছি। রাশি-নক্ষত্রের উদয়াস্তের কারণে বৃষ্টি হয় বলে বিশ্বাস, নেতৃস্থানীয়দের যুলুম-অত্যাচার ও তাক্বদীরে (ভাগ্যে) অবিশ্বাস’।[25]
আরেকটি হাদীছে এসেছে, নবী (ছাঃ) ইরশাদ করেন,أَرْبَعٌ فِي أُمَّتِي مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ، لَا يَتْرُكُونَهُنَّ: الْفَخْرُ فِي الْأَحْسَابِ، وَالطَّعْنُ فِي الْأَنْسَابِ، وَالِاسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُومِ، وَالنِّيَاحَةُ ‘আমার উম্মতের মাঝে জাহিলী যুগের চারটি কাজ চালু থাকবে। তারা তা কখনোই ছাড়বে না। বংশ নিয়ে গৌরব, অন্যের বংশে আঘাত, কোন কোন নক্ষত্রের উদয়াস্তের কারণে বৃষ্টি হয় বলে বিশ্বাস এবং বিলাপ’।[26]
৯. চরমপন্থা অবলম্বন করা এবং অতি ধার্মিকতা প্রদর্শন করা : এক সময় আসবে যখন কিছু যুবককে ইসলামমুখী মনে হবে। তারা একমাত্র নিজেদেরই মুসলিম মনে করবে আর অন্যদের কাফির ভাববে। তারা অন্য মুসলিমদের কাফির বলে ফৎওয়া প্রদান করবে। এভাবে তারা কুরআনের মূল দাবী থেকে সরে গিয়ে চরমপন্থী হয়ে মারা যাবে।
যেমন হাদীছে এসেছে, عَنِ حُذَيْفَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وسلم: إن مَا أَتَخَوَّفُ عَلَيْكُمْ رَجُلٌ قَرَأَ الْقُرْآنَ حَتَّى إِذَا رُئِيَتْ بَهْجَتُهُ عَلَيْهِ وَكَانَ رِدْئًا لِلْإِسْلَامِ غَيَّرَهُ إِلَى مَا شَاءَ اللَّهُ فَانْسَلَخَ مِنْهُ وَنَبَذَهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ وَسَعَى عَلَى جَارِهِ بِالسَّيْفِ وَرَمَاهُ بِالشِّرْكِ قَالَ قُلْتُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ أَيُّهُمَا أَوْلَى بِالشِّرْكِ الْمَرْمِيُّ أَمِ الرَّامِي قَالَ بل الرامي" হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি যে সকল বিষয় তোমাদের জন্য আশঙ্কা করি, তার মধ্যে এমন এক ব্যক্তি, যে কুরআন পড়েছে। পরিশেষে যখন তার মধ্যে কুরআনের মনোহারিত্ব দেখা গেল এবং সে ইসলামের একজন সহায়ক হয়ে গড়ে উঠল, তখন সে তা হ’তে অপসৃত হ’ল এবং তা নিজ পশ্চাতে নিক্ষেপ করল, নিজ প্রতিবেশীর উপর তরবারি তুলে ধরতে উদ্যত হ’ল এবং তাকে মুশরিক বলে অপবাদ দিল। ছাহাবী হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ওদের উভয়ের মধ্যে মুশরিক কে? অপবাদদাতা, নাকি যাকে অপবাদ দেওয়া হয়েছে সে? উত্তরে তিনি বললেন, বরং অপবাদদাতা’।[27]
১০. যেনা-ব্যভিচার এবং গোপন পাপ : রাসূল (ছাঃ) উম্মতের জন্য যে সকল পাপকে অতি ভয়ংকর মনে করতেন তার মধ্যে অন্যতম হ’ল, যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া এবং গোপন পাপে লিপ্ত হওয়া। আর এই গোপন পাপ হচ্ছে বিবাহ বহির্ভুতভাবে যৌবনকে অপচয় ও নষ্ট করা।
যেমন হাদীছে এসেছে- عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: يَا نَعَايَا الْعَرَبِ، يَا نَعَايَا الْعَرَبِ، إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الزِّنَا، وَالشَّهْوَةَ الْخَفِيَّةَ- আব্দুল্লাহ বিন যায়দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আরবের মরণ! আরবের মরণ! আমি তোমাদের উপর আমার সবচেয়ে অধিক যে জিনিসের ভয় হয়, তা হ’ল ব্যভিচার ও গুপ্ত কুপ্রবৃত্তি’।[28] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الرِّيَاءُ، وَالشَّهْوَةُ الْخَفِيَّةُ ‘তোমাদের উপর আমার সবচেয়ে অধিক যে জিনিসের ভয় হয়, তা হ’ল লোক দেখানো আমল ও গুপ্ত কুপ্রবৃত্তি’।[29]
অন্য হাদীছে এসেছে,تُفْتَحُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ نِصْفَ اللَّيْلِ، فَيُنَادِي مُنَادٍ: هَلْ مِنْ دَاعٍ فَيُسْتَجَابَ لَهُ، هَلْ مِنْ سَائِلٍ فَيُعْطَى، هَلْ مِنْ مَكْرُوبٍ فَيُفَرَّجَ عَنْهُ، فَلَا يَبْقَى مُسْلِمٌ يَدْعُو بِدَعْوَةٍ إِلَّا اسْتَجَابَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُ، إِلَّا زَانِيَةً تَسْعَى بِفَرْجِهَا، أَوْ عَشَّارًا ‘মধ্য রাতে আসমানের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়। তখন একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকেন, কোনও প্রার্থনাকারী আছ কি? যদি কেউ প্রার্থনা করে তাহলে তা কবুল করা হবে। কোনও যাঞ্ছাকারী আছ কি? যদি কেউ কিছু চায় তাহলে তাকে তা দেওয়া হবে। কোনও বিপদগ্রস্ত আছ কি? বিপদ মুক্তি চাইলে তার বিপদ কাটানো হবে। এ সময়ে যে কোনও মুসলিম যে কোনও বিষয়ে প্রার্থনা করুক, আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করবেন। শুধুমাত্র দেহ ব্যবসায়ী ব্যভিচারিণী ও টোল আদায়কারী (নাগরিকদের কষ্ট দিয়ে যে টোল খাজনা, চাঁদা ইত্যাদি আদায় করে) বাদে’।[30]
অন্য হাদীছে এসেছে, حَدَّثَنَا عِيسَى بْنُ يُونُسَ الرَّمْلِيُّ، حَدَّثَنَا عُقْبَةُ بْنُ عَلْقَمَةَ بْنِ حُدَيْجٍ الْمَعَافِرِيُّ، عَنْ أَرْطَاةَ بْنِ الْمُنْذِرِ، عَنْ أَبِي عَامِرٍ الأَلْهَانِيِّ، عَنْ ثَوْبَانَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ـ أَنَّهُ قَالَ : " لأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِي يَأْتُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِحَسَنَاتٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بِيضًا فَيَجْعَلُهَا اللَّهُ عَزَّ. قَالَ ثَوْبَانُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ صِفْهُمْ لَنَا جَلِّهِمْ لَنَا أَنْ لاَ نَكُونَ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لاَ نَعْلَمُ. قَالَ ছাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (ছাঃ) বলেন, আমি আমার উম্মাতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি যারা কেয়ামতের দ্বীন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমল সহ উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। ছাওবান (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় পরিস্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। তিনি বলেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক যে, একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে (ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৫, সনদ ছহীহ)।
১১. উৎপাদন বৃদ্ধি ও দুনিয়ার চাকচিক্য : এক সময় আসবে যখন উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ও মানুষের অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। আর এর চাকচিক্য নিয়ে লোকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সম্পদের হক আদায় করবে না। আর এই অবস্থা আসাকে রাসূল (ছাঃ) উম্মতের জন্য অতি ভয়ংকর মনে করতেন। যেমন হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَخْوَفُ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ مَا يُخْرِجُ اللهُ لَكُمْ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا قَالُوا: وَمَا زَهْرَةُ الدُّنْيَا؟ يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: بَرَكَاتُ الْأَرْضِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَهَلْ يَأْتِي الْخَيْرُ بِالشَّرِّ؟ قَالَ: لَا يَأْتِي الْخَيْرُ إِلَّا بِالْخَيْرِ، لَا يَأْتِي الْخَيْرُ إِلَّا بِالْخَيْرِ، لَا يَأْتِي الْخَيْرُ إِلَّا بِالْخَيْرِ، إِنَّ كُلَّ مَا أَنْبَتَ الرَّبِيعُ يَقْتُلُ أَوْ يُلِمُّ، إِلَّا آكِلَةَ الْخَضِرِ، فَإِنَّهَا تَأْكُلُ، حَتَّى إِذَا امْتَدَّتْ خَاصِرَتَاهَا اسْتَقْبَلَتِ الشَّمْسَ، ثُمَّ اجْتَرَّتْ وَبَالَتْ وَثَلَطَتْ، ثُمَّ عَادَتْ فَأَكَلَتْ، إِنَّ هَذَا الْمَالَ خَضِرَةٌ حُلْوَةٌ، فَمَنْ أَخَذَهُ بِحَقِّهِ، وَوَضَعَهُ فِي حَقِّهِ، فَنِعْمَ الْمَعُونَةُ هُوَ، وَمَنْ أَخَذَهُ بِغَيْرِ حَقِّهِ، كَانَ كَالَّذِي يَأْكُلُ وَلَا يَشْبَعُ - আবু সাঈদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য এ ব্যাপারেই সর্বাধিক আশংকা করছি যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য দুনিয়ার চাকচিক্য প্রকাশিত করে দেবেন। জিজ্ঞেস করা হ’ল, দুনিয়ার চাকচিক্যসমূহ কী? তিনি বললেন, যমীনের বরকতসমূহ। তখন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে বললেন, কল্যাণ কি অকল্যাণ নিয়ে আসবে? তখন নবী (ছাঃ) কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন, যাতে আমরা ধারণা করলাম যে, তাঁর উপর অহী নাযিল হচ্ছে। এরপর তিনি তাঁর কপাল থেকে ঘাম মুছে জিজ্ঞেস করলেন, প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল, আমি। আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, যখন এটি প্রকাশ পেল, তখন আমরা প্রশ্নকারীর প্রশংসা করলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কল্যাণ কেবল কল্যাণই বয়ে আনে। নিশ্চয়ই এ ধনদৌলত সবুজ সুমিষ্ট। অবশ্য বসন্ত যে সবজি উৎপাদন করে, তা ভক্ষণকারী পশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় অথবা মৃত্যুর নিকটবর্তী করে। তবে যে প্রাণী পেট ভরে খেয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে জাবর কাটে, মল-মূত্র ত্যাগ করে এবং আবার খায় (এর অবস্থা ভিন্ন)। এ পৃথিবীর ধনদৌলত তেমন সুমিষ্ট। যে ব্যক্তি তা সৎভাবে গ্রহণ করবে এবং সৎভাবে ব্যয় করবে, তা তার খুবই উপকারী হবে। আর যে তা অন্যায়ভাবে গ্রহণ করবে, সে ঐ ব্যক্তির মত যে খেতে থাকে কিন্তু পরিতৃপ্ত হয় না’।[31]
উপসংহার : রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যৎ জানতেন না। তবে অহী প্রাপ্ত হয়ে লোকদের কর্ম দেখে পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে বলতেন ও জাতিকে সতর্ক করতেন। উম্মতের ব্যাপারে যে সকল পাপকে অতি ভয়ংকর মনে করতেন সেগুলো উল্লেখ করে তিনি উম্মতকে সতর্ক করেছেন, যাতে এই সকল পাপে লিপ্ত না হয়। কিন্তু বড় আফসোস! লোকেরা আজ সে সকল পাপেই জড়িয়ে পড়েছে যেগুলোর ব্যাপারে শরী‘আত প্রণেতা আশঙ্কা করতেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে ভয়াবহ পাপগুলো সহ যাবতীয় পাপ থেকে হেফাযতে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!
[1]. আহমাদ হা/২৩৬৮৬; ছহীহাহ হা/৯৫১; ছহীহুল জামে‘ হা/১৫৫৫।
[2]. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/৯৩৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩১।
[3]. ইবনু মাজাহ হা/৪২০৪; মিশকাত হা/৫৩৩৩; ছহীহুত তারগীব হা/৩০।
[4]. তাবারানী কাবীর হা/২৩৭; ছহীহুত তারগীব হা/২৮।
[5]. ইবনু হিববান হা/৪০৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৮২।
[6]. আহমাদ হা/১৯৬২২; ছহীহুত তারগীব হা/৩৬।
[7]. আহমাদ হা/৬৫০৯; ছহীহুত তারগীব হা/২৫।
[8]. তিরমিযী হা/২২২৯; মিশকাত হা/৫৩৯৪; ছহীহুল জামে‘ হা/২৩১৬; ছহীহাহ হা/১৫৮২।
[9]. আহমাদ হা/২১৩৩৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪১৬৫।
[10]. আহমাদ হা/১৪৩; ছহীহাহ হা/১০১৩; ছহীহুত তারগীব হা/১৩২।
[11]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৮০; মাওয়ারিদুয যামআন হা/৯১।
[12]. আবু নাঈম, ছিফাতুন নিফাক হা/১৪৯; ফিরিয়াবী, ছিফাতুন নিফাক হা/২৭; মুসনাদুল ফারূক ২/৬৬১।
[13]. ইবনু বাত্ত্বা, আল ইবানাতুল কুবরা হা/৬৪০; আবু নাঈম, ছিফাতুন নিফাক হা/১৪৮।
[14]. আহমাদ হা/১৭৩৫৬; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৩১৮২, সনদ হাসান।
[15]. আহমাদ হা/১৭৪৫১; ছহীহাহ হা/২৭৭৮।
[16]. তিরমিযী হা/২৪১০; মিশকাত হা/৪৮৫৩; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৬২।
[17]. বুখারী হা/৬৪৭৪; মিশকাত হা/৪৮১২।
[18]. ছহীহাহ হা/৩২৩৭।
[19]. মুসনাদে বাযযার হা/৭২৯৩; ছহীহাহ হা/১৮০২।
[20]. তিরমিযী হা/১৪৫৭; মিশকাত হা/৩৫৭৭; ছহীহুল জামে‘ হা/১৫৫২।
[21]. আবুদাউদ হা/৪৪৬২; মিশকাত হা/৩৫৭৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫৮৯।
[22]. আহমাদ হা/২৯১৫; মিশকাত হা/৩৫৮৩ ; ছহীহাহ হা/৩৪৬২।
[23]. তিরমিযী হা/১১৬৫; মিশকাত হা/৩৫৮৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮০১।
[24]. আবু আমর দানী, আস-সুনানুল ওয়ারেদাতু ফিল ফিতান হা/২৮২; ছহীহাহ হা/১১২৭।
[25]. আহমাদ হা/২০৮৬৪; মিশকাত হা/৩৭১২; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০২২।
[26]. মুসলিম হা/৯৩৪; মিশকাত ১৭২৭হা/।
[27]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৮১; ছহীহাহ হা/৩২০১।
[28]. বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান হা/৬৪০৫; ছহীহুত তারগীব হা/২৩৯০।
[29]. ছহীহাহ হা/৫০৮।
[30]. তাবরানী, আওসাত্ব হা/২৭৬৯; ছহীহাহ হা/১০৭৩।
[31]. বুখারী হা/১৪৬৫; মুসলিম হা/১০৫২; মিশকাত হা/৫১৬২।