মাওলানা আব্দুল মান্নান

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 430 বার পঠিত

[‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য এবং সাতক্ষীরা যেলা আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের সভাপতি (২০০১-বর্তমান) মাওলানা আব্দুল মান্নান (সাতক্ষীরা)। তিনি বর্তমানে সাতক্ষীরা আহসানিয়া মিশন আলিম মাদ্রাসার সম্মানিত ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ও আল-ইখলাছ হজ্জ কাফেলার পরিচালক। তিনি প্রায় ১৮ বছর যাবত অসংখ্য ব্যক্তিকে ছহীহ-শুদ্ধভাবে হজ্জ পালনে সহযোগিতা করে আসছেন। তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্বি-মাসিক ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ড. মুখতারুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল।]

তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ পাক ভাল রেখেছেন, সুস্থ রেখেছেন।

তাওহীদের ডাক : শুনেছি আপনি হার্টের সমস্যায় ভুগছেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ওমরায় গিয়ে আমি প্রথম হার্টের সমস্যা অনুভব করি। তখন হাটতে গেলে বুকে জ্বালা করত, আর দাঁড়ালে ভাল লাগত। ওমরা থেকে এসে ঢাকার হার্ট ফাউন্ডেশনে এনজিওগ্রাম করলাম। জানা গেল যে, হার্টে তিনটি ব্লক আছে, রিং বসাতে হবে। আমি ঢাকায় চিকিৎসা না করে ভারতের ব্যাঙ্গালুরের ডা. দেবী শেঠীর কাছে গেলাম। তিনি এশিয়া মহাদেশে হার্টের বিখ্যাত ডাক্তার। উনি আমার এনজিওগ্রাম দেখে বললেন, আপনাকে খুব যরূরী ছোট একটা বাইপাস করাতে হবে। তাছাড়া যেকোন সময় বড় কোন সমস্যা হ’তে পারে। আমি ভারতে মেডিকেল ভিসাতে না যাওয়ায় সেখানে অপারেশন করাটা ভাল মনে হ’ল না। তাই ফিরে এসে ঢাকাস্থ ইউনাইটেড হাসপাতালের চীফ কার্ডিওলজি কনসালটেন্ট ডা. এন এ এম মোমেনুজ্জামানকে দেখালাম। তিনিও বললেন, আপনার ব্লক এমনভাবে হয়েছে যে, আপনাকে বাইপাস করাতেই হবে।

কিন্তু ২০২২ সালের হজ্জের সময় চলে আসায় আমি কোন প্রকার চিকিৎসা ছাড়াই ১২০ জন হাজী নিয়ে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় চলে যাই। আমি ওখানে অনেক ভাল ছিলাম। আমি হজ্জে একাকী যাবতীয় কার্যক্রম করেছি। এমনকি ১০ই যিলহজ্জ মুযদালিফায় ফজরের ছালাত আদায়ের পরে হাজীদের নিয়ে হেটে রওনা দেই। আমার জন্য একটি হুইল চেয়ার থাকলেও আলহামদুলিল্লাহ তার প্রয়োজন পড়েনি। বরং আমি একটানা তিন ঘণ্টা হেঁটেছি। জামরায় পাথর মেরে তাবুতে ফিরেছি। এরপর মীনায় ১০৪টি পশু যবেহ দিয়েছি। ওখান থেকে হাজীদের জন্য কুরবানীর গোশত এনে তাদের খাইয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ সে পর্যন্ত আমার হার্টে ব্যথা, জ্বালা-যন্ত্রণা কিছুই হয়নি। সুস্থভাবে দেশে ফিরেছি। ৩০শে জুলাই ঢাকায় ফিরে এনজিওগ্রাম করার পর জানা গেল যে, শুধু রিং বসালেই হবে না অপারেশনও করাতে হবে। অতঃপর ২৭ই সেপ্টেম্বর ২০২২ ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে হার্টের অপারেশন সফলভাবে হয় আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু অপারেশনের সাত দিন পর হঠাৎ মাইল্ড স্ট্রোকে আক্রান্ত হই। পরে একটু সুস্থ হওয়ার পর ১৫ই অক্টোবর দেশে ফিরে আসি। তখন থেকে প্রায় শয্যাগত আছি। মোটামুটি চলাফেরা করতে পারছি এখন। আমি আপনাদের সবার কাছে দো‘আ চাই যেন আল্লাহ আমাকে দ্রুত সুস্থতা দান করেন। আমীন!

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় জানতে চাই।

মাওলানা আব্দুল মান্নান : আমার জন্ম তারিখ নির্দিষ্টভাবে মনে নেই। সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার বর্তমান বয়স ৫২ বছর হলেও মূল বয়স ৫৮ বছর। আমার জন্ম সাতক্ষীরা যেলার সদর থানার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে। আমার পিতার নাম আযীমুদ্দীন সরদার ও মায়ের নাম আমেনা বেগম। আমার বাবা বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমাদের আগরদাড়ী ইউনিয়নে প্রেসিডেন্ট সদস্য হিসাবে দীর্ঘ ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই সুবাদে আমার পিতা এলাকায় বিচার-শালিস করতেন। তিনি যেমন নামীদামী লোক ছিলেন, তেমনি ছিলেন ধার্মিক। তিনি মসজিদে ওয়াক্তিয়া ছালাত পড়ানো, জানাযা পড়ানো, কখনোবা বিবাহও পড়ানোতেও দায়িত্ব পালন করতেন। আর আমরা পৈত্রিকসূত্রে আহলেহাদীছ। আমার আববা আলেম-ওলামাদের কদর করতেন। আমি মাওলানা আহমাদ আলী, মাওলানা মতীউর রহমান সালাফীসহ অনেক আলেমে দ্বীনকে ছোট বেলায় আমাদের বাড়ীতে দেখেছি। আমরা তিন ভাই ও দুই বোন। বড় ভাই প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক আব্দুছ ছামাদ ২০১৭ সালে মারা গিয়েছেন। মেজ ভাই আব্দুল গফুর কৃষিকাজ করেন। আর আমি সাতক্ষীরা শহরের আহসানিয়া আলিম মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালন করছি।

আমার ১ মেয়ে ও ৩ ছেলে। বড় মেয়ের নাম সুমাইয়া। নামটি আমীরে জামা‘আত রেখেছিলেন। ১ম ছেলে নাঈম আব্দুল্লাহ ফাযিল ২য় বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছে। ২য় ছেলে নাফীস আব্দুল্লাহ এবার আলিম পাশ করেছে। আর ছোট ছেলে নাবীল আব্দুল্লাহ ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ার পাশাপাশি হিফয করছে।

তাওহীদের ডাক : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যদি বলতেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : আমি আমাদের বাড়ীর নিকটে বাবুলিয়া মডেল প্রাইমারী স্কুলে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি। আমার আববার ইচ্ছা ছিল আমি আলেম হব। সেজন্য তিনি মক্তবের হুজুরের কাছে স্পেশালভাবে কুরআন ও ঊর্দূ শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর আমি আগরদাড়ী কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হই। আমার বাড়ি থেকে ৬/৭ কিলোমিটার হেঁটে মাদ্রাসায় যেতে হত। মাঝে মাঝে আমার বড় ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে যেতাম। একদিন বড় ভাইয়ের শখের সাইকেল নষ্ট হয়ে গেল। তিনি রেগে গিয়ে আমাকে নিকটবর্তী বকচরা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। ১৯৮৩ সালে আমি বকচরা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করলাম।

সেই সালেই আমি আমীরে জামা‘আতের আববা মাওলানা আহমাদ আলী প্রতিষ্ঠিত কাকডাঙ্গা সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হই। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি থাকতে পারব না বলে কান্নাকাটি করতে লাগলাম। সে কারণে আববা আমাকে আগরদাড়ী কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। এখান থেকেই আমি আলিম ও ফাযিল পাশ করি। সেসময় আগরদাড়ী মাদ্রাসার কামিল বোর্ড পরীক্ষার অনুমোদন ছিল না। ফলে শাহাবাদ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসা, নড়াইল থেকে কামিল পরীক্ষা দিয়েছি। ১৯৯০ সালে আমি কামিল পাশ করি।

আমার কলেজে পড়ার অনেক ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার আববা অনেক কঠোর হওয়ার কারণে সেটা তখন সম্ভব হয়নি। তিনি ১৯৮৫ সালে আমার আলিম রেজাল্ট হওয়ার ১৭ দিন আগে মারা যান। সেই সময় আমি আলিমে খুব ভাল রেজাল্ট করি। দাখিলে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। আমি মনে করছিলাম, আলিমেও একই রেজাল্ট হবে। আলিমের রেজাল্ট পাওয়ার জন্য আমরা ৫-৬ জন ছেলে কলারোয়া গেলাম। সেসময় এক দোকানে পত্রিকা আসত। পত্রিকায় সবার রেজাল্ট পাওয়া গেলেও ২য় বিভাগের জায়গায় আমারটা ছিল না। আমি হতাশ হয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার এক বন্ধু (বর্তমানে সাতক্ষীরা আলিয়া মাদ্রাসার সিনিয়র প্রভাষক) বলছে, তোর রেজাল্ট তো ১ম বিভাগে। আমি তো দেখে হতবাক! যাদের ১ম বিভাগ পাওয়ার কথা তারা পায়নি আর আমি পেয়ে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ! সেসময় সাতক্ষীরা যেলায় মাত্র একটি সেন্টার ছিল। আর সাতক্ষীরা সেন্টারে দু’টি ছেলে ১ম বিভাগ পেয়েছিল। তন্মন্ধে আমি একজন। এই রেজাল্ট আমাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল।

এবার আমি ইন্টারে কলেজে ভর্তি হব। একেবারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কিন্তু আমার আববা মারা যাওয়ার আগে বড় ভাইকে বলে গিয়েছিলেন, আব্দুল মান্নান যেন কলেজে না পড়ে। বড় ভাই তখন বললেন, ‘তুমি কলেজে পড়তে পারবা না। হয় তুমি মাদ্রাসায় পড়বা, না হয় মাঠে জমি-জমা চাষ করবা’। তখন আমি বাধ্য হয়েই আগরদাড়ী মাদ্রাসায় ফাযিলে ভর্তি হই। তখন মাদ্রাসা থেকে আমাকে ৩০ টাকা বৃত্তি দেওয়া হত। সে সময় ৩০ টাকার অনেক কদর ছিল। ১২-১৫ টাকায় এক কেজি গরুর গোশত পাওয়া যেত। ফাযিল ২য় বিভাগে পাশ করার পরেও আমার কলেজে পড়ার অনেক ইচ্ছা ছিল। তাই আমি ডিগ্রীতে ভর্তি হলাম। ওদিকে কামিলেও ভর্তি হলাম।

ডিগ্রীতে ভর্তি হওয়ার পরপরই কুয়েতী সংস্থা ‘ইয়াহইয়াত তুরাছ’ থেকে ছাত্রবৃত্তি ছাড়ল। তখন সাংগঠনিক দায়িত্বশীল হওয়ার কারণে আমার জন্য ১০০ কিংবা ২০০ টাকার বৃত্তি চালু করে দিল। ফলে আমার কলেজে পড়ার জন্য একটা সাপোর্ট হয়ে গেল। এরপর আমি ডিগ্রী পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিভিয়াস মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। এরপর মাস্টার্সে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস করার সুযোগ হত না। মাঝে মধ্যে নওদাপাড়া মারকাযে এসে হাফেয ইউনূস, শেখ রফীক ও দুর্রুল ভাইদের রুমে থাকতাম।

তাওহীদের ডাক : আপনি চাকরী জীবনে কিভাবে আসলেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : ১৯৯০ সালে কামিল পাশ করার পর তালা উপযেলা নগরঘাটা আমিনিয়া দাখিল মাদ্রাসায় আমি চাকরী পেয়ে গেলাম। ২০০৫ সালে সেটি আলিমে পাঠদানের অনুমতি পায়। সেই থেকে আমি সেখানে ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। পরে ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে সাতক্ষীরা শহরের আহসানিয়া মিশন আলিম মাদ্রাসায় ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হিসাব যোগদান করি। অত্র প্রতিষ্ঠানটিতে প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে আছেন যেলা আন্দোলনের সেক্রেটারী ও কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা আলতাফ হোসাইন। এটি শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।

চাকরীর বিষয়ে আরেকটা কথা বলে রাখি, আমি চাকরী পাওয়ার আগে অথবা পরে ইয়াহইয়াত তুরাছের দাঈ ছিলাম। এই সংস্থাটি আমাদের সংগঠনকে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে সহযোগিতা করত। তিন মাস অন্তর আমাদের ১০০০ টাকা সম্মানী দিত। ২০০৫ সালে আমীরে জামা‘আত গ্রেফতার হলে ইয়াহইয়াত তুরাছের অফিস উত্তরার ২১ নম্বর বাড়ি থেকে সরাসরি সম্মানী তুলতে হত। সেসময় সংগঠনের পক্ষ থেকে আমি, মাওলানা আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ও মাওলানা রুস্তম আলী শিক্ষক ও দাঈ ছিলাম। পরবর্তীতে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।

আমার মনে পড়ে আমীরে জামা‘আতের এক ছাত্র আব্দুছ ছামাদ আনওয়ারী আহলেহাদীছের ঐতিহাসিক পটভূমি, আরবী বিভিন্ন ইবারত, মনীষীদের বিভিন্ন উক্তি তোতা পাখির মত বলতেন। আমীরে জামা‘আত তাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি প্রত্যেক ইজতেমায় বক্তব্য রাখতেন। আর ঢাকার মুহাম্মাদপুরের আল-আমীন মসজিদে খুৎবা দিতেন। তিনি একদিন আমাকে বললেন, আব্দুল মান্নান তোমাকে আল-আমীন মসজিদে খুৎবা দিতে হবে। আমি খুৎবা দিলাম। আমার বক্তব্য শুনে মসজিদের মুতাওয়াল্লী মুক্তিযোদ্ধা নযরুল ইসলাম চাচা বললেন, আব্দুল মান্নান! আমাদের মসজিদে তোমাকে মাসে একটা খুৎবা দিতে হবে। আমি প্রতি মাসের ৩য় জুম‘আয় খুৎবা দিতাম। এরপর আমি মাওলানা জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে গেলাম। সে আবার আব্দুর রাযযাক ছাহেবকে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে একদিন বন্ধুবর শামসুর রহমান আযাদী আমাকে বেরাইদ পূর্বপাড়া মসজিদে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমি খুৎবা দিলাম। তারা আমার খুৎবা পছন্দ করলে আমি সেখানে ৬-৭ বছর খতীবের দায়িত্ব পালন করেছি।

তাওহীদের ডাক : আপনি কিভাবে বক্তব্যের জগতে আসলেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : ছোটবেলা থেকে আমার কণ্ঠস্বর ভাল ছিল। ছাত্রজীবনে আমাদের মাদ্রাসায় বক্তব্য, গযল, কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতায় আমি প্রায়ই প্রথম হতাম। বক্তব্য দেওয়ার প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ ছিল। কখনও আববার পাশে বসে কানে হাত দিয়ে ওয়ায করতাম। ১৯৯১ সালে আল-হেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে একটা অডিশনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অডিশনে আমি, জয়পুরহাটের শফীকুল ইসলাম, মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম, কুষ্টিয়ার নিযামুদ্দীনসহ আরো কয়েকজন উত্তীর্ণ হলাম। তখন থেকে আমরা বিভিন্ন জায়গায় জাগরণী বলতে যেতাম।

সেসময় খুলনার তেরোখাদা, রূপসা ও বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপযেলায় অনেক আহলেহাদীছ ছিল। এই তিনটি উপযেলার কেন্দ্র হ’ল বামনডাঙ্গা। এই বামনডাঙ্গায় বিশাল একটা ফুটবল খেলার মাঠ আছে। ঐখানে আমাদের সংগঠনের আয়োজনে একটা বিশাল মাহফিল হ’ল। এটা ১৯৯৬ সালের কথা। ঐ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। বিশেষ অতিথি ছিলেন আব্দুছ ছামাদ সালাফী ও খুলনা আল-মাহাদ আস-সালাফীর প্রিন্সিপ্যাল। আমি ছিলাম শিল্পী। এটা আমার জীবনের অন্যতম একটা স্মরণীয় ঘটনা। সেই মাহফিলে আমীরে জামা‘আত, সালাফী ছাহেব, প্রিন্সিপ্যাল কেউ যেতে পারেননি। সবাই সবার বদলে অন্য কাউকে পাঠিয়েছিলেন। সম্মেলনে যখন বারবার পরিবর্তিত নাম ঘোষণা হচ্ছে তখন অনেকে উঠে যাচ্ছেন। আমি মঞ্চে জাগরণী বলার জন্য গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, ভাইয়েরা আপনারা যে যেখানে আছেন সবাই দাঁড়িয়ে যান, একটা গল্প শুনেন। রাস্তা দিয়ে দু’জন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। একজন খুব মোটা, আরেকজন খুবই চিকন। চিকন লোকটা জিজ্ঞাসা করছে, ভাই আপনার নাম কি? তখন সে বলল, আমার নাম সুবল চন্দ্র কাহিল। সে ভাবছে এত মোটা মানুষ কিভাবে কাহিল হয়। এরপর মোটা লোকটা তাকে বলছে, ভাই আপনার নাম কি? তখন চিকন লোকটি বলছে, আমার নাম চিকন চন্দ্র নেই। তখন সে বলছে, এটা আবার কি নাম? তখন চিকন লোকটি বলছে, আপনি এত মোট মানুষ হয়ে যদি কাহিল হন তাহ’লে আপনার কাছে আমি থাকি কেমনে? এত বড় বড় মানুষ আজ বক্তব্য দিবেন। আমি তো তাদের কাছে নেই। আমি একটা জাগরণী বলার জন্য এসেছি। আপনারা শুনেন। তারপর আমার স্বরচিত ‘গাউছুল আযম’ জাগরণী বলা শুরু করলাম। লোকজন সবাই দাঁড়িয়ে গেল। তখন সভাপতি ছাহেবের অনুমতি কিংবা উপস্থাপকের ঘোষণা ছাড়াই বললাম, আপনাদের সাথে পাঁচ মিনিট আলোচনা করতে চাই। লোকজন সবাই বসে পড়ল। এরপর সুর-তাল দিয়ে প্রায় এক ঘণ্টার বেশী কুরআন-হাদীছের আলোচনা করলাম। ঐ মঞ্চ থেকেই আমার দাওয়াতী ময়দানে নামা শুরু। তারপরের দিনই মোল্লাহাটের আমীনবাড়ী মসজিদের মাহফিলে বক্তব্য দিতে হ’ল। ঐখানে আবার কয়েকটা দাওয়াত হয়ে গেল। তখন থেকে আজও পর্যন্ত বক্তৃতার জগতে আছি। ফালিল্লাহিল হামদ!

এরপর ১৯৯৮ সালে তাবলীগী ইজতেমায় মাসিক আত-তাহরীকের প্রবন্ধ থেকে ‘মারেফাতে দ্বীন’-এর উপর একটা আলোচনা করলাম। ইজতেমায় আমার আলোচনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। পরের বছরে আবারও ‘ইকামতে দ্বীন’-এর বিষয়ে আলোচনা করলাম। মূলত ইজতেমা থেকেই আমার পরিচিতি সারাদেশ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।

তাওহীদের ডাক : আপনি কিভাবে যুবসংঘের পতাকাতলে আসলেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : আমি ছাত্রজীবনে ১৯৮৭ সালে যুবসংঘের সাথে যুক্ত হই। তখন আমি কোন সংগঠনের সাথে ছিলাম না। আমার কণ্ঠস্বর ভাল থাকায় ইসলামী ছাত্র শিবিরের ছেলেরা আমাকে দাওয়াত দিত। তাদের পিকনিক, বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমি কুরআন তেলাওয়াত, হামদ-নাত বলতাম। কিন্তু আমি কখনো তাদের সদস্য হিসাবে যুক্ত হইনি।

১৯৮৭ সালের দিকে ঢাকায় যুবসংঘ-এর একটা সম্মেলন হয়েছিল। সেখান থেকে আমাদের মসজিদের খতীব, সাতক্ষীরা পিএন স্কুলের নাম করা শিক্ষক আমার চাচা মৌলবী সাখাউদ্দীন আহমেদ আমার কাছে কিছু পরিচিতি আর ‘সমাজ বিপ্লবের ধারা’ বইটি দিয়ে বললেন, আমাদের যুব সংগঠন চলে এসেছে। এখন আর কোন সংগঠনে যাওয়া যাবে না। তিনি দিল্লী রহমানিয়া মাদ্রাসা ফারেগ। ইংরেজীতে তাফসীর করতেন। আমাকে অনেক ভালবাসতেন। আমাকে ছালাতে ইমামতি করা ও খুৎবা দেওয়ার ব্যাপারে অনেক উৎসাহ দিতেন। তিনি সাতক্ষীরা যেলা জমঈয়তের আমরণ অডিটর ছিলেন। খুবই দক্ষ একজন মানুষ ছিলেন।

তারপর আমরা যুবসংঘের সাংগঠনিক কাজ শুরু করলাম। আমাদের গ্রাম হাকীমপুরের বিখ্যাত তিন গম্বুজওয়ালা মসজিদে যুবসংঘের কমিটি গঠন করলাম। এরপর সাতক্ষীরা পৌরসভা মিলনায়তনে সম্মেলনের আয়োজন করলাম। সেই সম্মেলনেই প্রথম আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ। উক্ত সম্মেলনে কাকডাঙ্গা সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল এ বি এম মহিউদ্দিন ছাহেবকে সভাপতি, মৌলবী সাখাউদ্দীন আহমেদ ছাহেবের বড় ছেলে আব্দুর রঊফকে সেক্রেটারী আর মাওলানা আবু বকর ছিদ্দীককে সহ-সভাপতি করে সাতক্ষীরা যেলা কমিটি গঠন করা হ’ল। আমি সেই কমিটির অর্থ সম্পাদক ছিলাম।

তাওহীদের ডাক : তাহ’লে আপনার সংগঠনিক কাজ শুরু হয় সরাসরি যেলা দায়িত্বশীল হিসাবে?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : জ্বী! তখন তো আর উপযেলা ছিল না। সেই সময় আমরা বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক কাজ শুরু করলাম। আমি আবার এলাকার সহ-সভাপতি হ’লাম। হাসান নামের এক ছেলে সভাপতি হ’ল। আমরা নিয়মিত এয়ানত আদায়, রিপোর্ট পূরণ ও বৈঠক করতাম। এভাবে আমি সাংগঠনিক সম্পাদক, সেক্রেটারী ও তারপর সভাপতি হলাম। ২০০১ সাল থেকে আমি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সাতক্ষীরা যেলার সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। ফালিল্লাহিল হামদ

তাওহীদের ডাক : আপনি আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে কিভাবে যুক্ত হলেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : ১৯৯১ সালের দিকে যাদের কন্ঠ ভাল তাদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিটি যেলায় চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তখন আমি ও মাওলানা জাহাঙ্গীরসহ অনেকে পরীক্ষা দিতে আসলাম। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষক মন্ডলী আমাকে বেছে নিলে আমি আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে গেলাম। সেই সময় ‘গাউছুল আযম’ ছিল আমার প্রথম জাগরণী। আমি এটি কপোতাক্ষ ট্রেনে বসে লিখেছিলাম। এছাড়াও ‘এসো হে যুবক ও তরুণ’, ‘একটি জান্নাত আমার কাম্য’, ‘কে যাবি আয় সোনার মদীনায়’ এই জাগরণীগুলো আমার লেখা ।

তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে আমীরে জামা‘আত গ্রেফতারের পর সাতক্ষীরার প্রশাসনিক অবস্থা কেমন ছিল?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : আমরা সাতক্ষীরা যেলা আন্দোলন ও যুবসংঘ সব সময়ই প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রাখতাম। যেলার এসপি, ডিসি, ওসিদের সাথে আমরা দেখা করতাম। তাদেরকে আমাদের সংগঠনের বই-পুস্তক দিতাম। ২০০৫ সালের ইজতেমার জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। ইতিমধ্যে আমরা শুনতে পেলাম ইজতেমা হবে না। তৎকালীন সাতক্ষীরা সদরের ওসি আব্দুল কাদের বেগের সাথে আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। উনি আমাকে দেখা করতে বললেন। উনি বললেন, আপনাদের ইজতেমা হবে না। এটা শুনে আমরা ভেঙ্গে পড়লাম। তখন সবাই মিলে মিটিং করলাম। পরে ওসি ছাহেবকে ধরলাম আমরা সাতক্ষীরায় একটি সম্মেলন করব। তারা আমাদেরকে আব্দুর রাযযাক পার্কে জায়গা না দিয়ে সিটি কলেজ মাঠে সম্মেলনের অনুমতি দিল। দিনটি ছিল ২০০৫ সালের ১৪ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার। সেটা একটি কঠিন মুহূর্ত ছিল। সে সময়ের কথাগুলো মনে পড়লে আমার এখনো গা শিউরে উঠে। বারংবার ওসি আব্দুল কাদের বেগ এসে বলেন, শুনেন সভাপতি ছাহেব, কোন কিছু হলে কিন্তু আপনাকে জেল খাটা লাগবে। ওসি বারংবার ফোন দিয়ে তাড়াতাড়ি সম্মেলন শেষ করতে বলছিলেন। অবশেষে বহু বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে আমরা সম্মেলন শেষ করলাম। তৎকালীন এমপিদের কাছে আমীরে জামা‘আতের যামিনের জন্য বারংবার যাতায়াত করতাম। তারা শুধু আশ্বাস দিত কিন্তু কোন কাজ হ’ত না।

তাওহীদের ডাক : প্রতি বছর তাবলীগী ইজতেমায় সাতক্ষীরা থেকে বহু মানুষ রিজার্ভ বাস নিয়ে রাজশাহী আসে। এটা কিভাবে সম্ভব হয়?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : এ ব্যাপারে আমরা কঠোর পরিশ্রম করি। আমরা প্রথমে টার্গেট করে এলাকা ভিত্তিক বাস কয়টা যাবে তা ভাগ করে দেই। আর সব সময় খোঁজ-খবর নিতে থাকি। যদি কোন এলাকা বাস নিতে না চায় তখন আমরা এর কারণ জানতে চাই। কখনও কোন এলাকায় লোক কম থাকলে অন্য এলাকা থেকে সমতা করার চেষ্টা করি। প্রথমবার এক সাথে ৮টি বাসে আমরা এসেছিলাম। সে যে কি এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! এখন আর এমনটা হয়ে ওঠে না। বর্তমানে প্রতি বছর ৮০-৮৫টা গাড়ি আসে সাতক্ষীরা থেকে। আন্দোলন, যুবসংঘের যেলা কমিটি, উপযেলা এবং এলাকা কমিটির মধ্যে আন্তরিকতার কারণেই এমনটা হয়ে থাকে। আর এর পিছনে আমাদের যেলা সেক্রেটারী ও কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাওলানা আলতাফ ছাহেবের অবদান অনেক বেশী। আমার চেয়ে সে অনেক বেশী পরিশ্রমী। সাতক্ষীরা যেলা সংগঠনের মযবূতির পেছনে মাশাআল্লাহ তাঁর অবদান অনেক বেশী। আল্লাহ তাঁকে এবং আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমীন!

তাওহীদের ডাক : আপনার একটা হজ্জ কাফেলা আছে। যা যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছে। শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : আমি ২০০৫ সালের ২৩ তারিখে আমার এক বন্ধুর সাথে হজ্জে গিয়েছিলাম। তার নাম ছিদ্দীকুল ইসলাম। সে ১৯৯৬ সাল থেকে হজ্জ কাফেলা পরিচালনা করে। সেবার আমি কেন্দ্রের মিটিংয়ে এসে কথা প্রসঙ্গে এবার হজ্জ করতে যাবো বললে ঝিনাইদহ আন্দোলন সভাপতি মাস্টার ইয়াকুব ছাহেব বললেন, আমরা সবাই মিলে সাংগঠনিকভাবে গেলে কেমন হয়? আমার পরিবার থেকে বাবা-মা, বড় ভাই-ভাবী, ভাইয়ের শ্বশুরসহ প্রায় সাত জন আছি। আমি সাতক্ষীরায় এসে আমার বন্ধু ছিদ্দীকুল ইসলামকে বললাম, চল ঝিনাইদহ-মেহেরপুরে যাই। সেখানে আমাদের সাংগঠনিক লোক আছে। তারপর মেহেরপুরে বিডিআর আনছার আলী ভাই ও আবু তাহের মাস্টার ছাহেবসহ ৭/৮ জন হ’ল। এভাবে ২০০৫ সালে আমার বন্ধুর ‘সুন্দরবন হজ্জ কাফেলায়’ আমিসহ ২৩ জন হজ্জে গেলাম। তবে সাংগঠনিক লোকদের একসাথে যাওয়ার উদ্যোক্তা ইয়াকুব ভাইয়ের ছেলের ব্যবসায় লস হওয়ায় তার আর যাওয়া হ’ল না।

আমার বন্ধু বিমানে উঠার আগেই সবাইকে ইহরাম বাধার কথা বলেছে। আর আমি আমার ২৩ জন লোককে বললাম, আমি যখন বলব তখন আপনারা ইহরাম বাধবেন। আমরা সবাই ইহরামের কাপড় ব্যাগে নিয়ে নিলাম। বিমানে ঘোষণা দেওয়ার পরই আমরা ইহরাম বাঁধলাম। আরাফার মাঠে, মুযদালিফাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিদ‘আতে ছড়াছড়ি চোখে পড়ল। এসমস্ত জায়গায় মু‘আল্লিমরা হাজী ছাহেবদের মিসগাইড করছে।

হজ্জ শেষে দেশে আসার পর আমার খুবই খারাপ লাগল যে, আমাদের এই লোকগুলো ছহীহভাবে হজ্জ পালন করতে পারে না। বিশুদ্ধভাবে হজ্জ পালনের জন্য একটি হজ্জ কাফেলার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। অনেকেই আমাকে হজ্জ কাফেলা খোলার জন্য উদ্বুদ্ধ করল। তারপর আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমীরে জামা‘আতের সাথে দেখা করতে গেলাম। তাঁকে বললাম, আমি তো হজ্জ করে আসলাম। হজ্জে গিয়ে যে অবস্থা দেখলাম তাতে বিদ‘আতী মু‘আল্লিমের কারণে আমাদের লোকজন বিশুদ্ধভাবে হজ্জ করতে পারে না। সেজন্য আমি একটি হজ্জ কাফেলা খুলতে চাচ্ছি যদি আপনি অনুমিত দিতেন। আর নাম দিতে চাচ্ছি ‘আল-ইখলাছ হজ্জ কাফেলা’। স্যার তখন বললেন, তুমি পারবা? আমি বললাম, স্যার আপনি দো‘আ করেন আমি ইনশাআল্লাহ পারব। আমি আমার বন্ধুর সাথে থেকে ছোট করে শুরু করব। জেলখানায় স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই আমার হজ্জ কাফেলা শুরু হয়।

২০০৭ সালে প্রথম আমার নেতৃত্বে ও বন্ধুর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ২৩ জনকে হজ্জে নিয়ে গেলাম। পরের বছর ১১ জন হাজী হ’ল। আমি শুধুমাত্র হাজীদের বিশুদ্ধভাবে হজ্জ পালনের দিকে নযর রাখতাম। তারপর ২০০৯ সালে ৩৪ জন হাজী নিয়ে গেলাম। ২০১০ সাল থেকে আমার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ৬২ জন হাজী নিয়ে আল-ইখলাছ হজ্জ কাফেলার যাত্রা শুরু করি। এরপর থেকে ২০১১ সালে ১৪৫ জন, ২০১২ সালে ২১২ জন, ২০১৩ সালে ১৯৬ জন হাজীকে বিশুদ্ধভাবে হজ্জ পালনে সহযোগিতা করতে পেরেছি। এভাবে প্রতি বছর কাফেলা নিয়ে যাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ। আমীরে জামা‘আতের ‘হজ্জ ও ওমরা’ বইটি হাজীদের ব্যাপক কাজে লাগে। স্যারের এই বইটি একজন হাজীকে বিশুদ্ধভাবে হজ্জ পালনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্যারের বইটি হাজীদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি। এ বছর ২০২২ সালে আমার সাথে ১২০ জন হাজী ছিল।

তাওহীদের ডাক : আপনি মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের বহু বছরের সাথী। তাঁর সাথে আপনার উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি পাঠকের উদ্দেশ্যে বলবেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : স্মৃতির ঝাপি খুললে তো হাজারো স্মৃতি এসে ধরা দেয়। তবে বিশেষ করে প্রথম জীবনের স্মৃতিগুলো খুব নাড়া দেয়। ১৯৮৯ সালে জমঈয়ত ও যুবসংঘের সাথে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণার পর স্যার যশোরের কেশবপুর প্রোগ্রামে এসেছিলেন। তৎকালীন সাতক্ষীরা যেলা সভাপতি আবু বকর ভাই আমাকে ডেকে বললেন, স্যার আর সালাফী ছাহেব আসবেন। তুমি স্যারকে নিয়ে যাও। তখন আমি ছাত্র। সেদিন আমার মোটরসাইকেলে (রাজ ৬৬১৩) আমীরে জামা‘আত ও সালাফী ছাহেবকে নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে প্রোগ্রামস্থল কেশবপুরে আসলাম। তখন রাস্তা অনেক খারাপ ছিল। আবার তারা মোট দু’জন মানুষ। আমি কোন রকমে মটরসাইকেলের ট্যাঙ্কির উপর বসে তাদের নিয়ে আসলাম। সেদিন আমার অনেক কষ্ট হলেও তাদের এত কাছাকাছি যেতে পারায় নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করেছিলাম। সেই স্মৃতি মনে পড়লে এখনও ভাল লাগা কাজ করে।

অনুরূপভাবে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে আমীরে জামা‘আতের সাথে গিয়েছিলাম। আশাশুনি, মুন্সিগঞ্জ, শ্যামনগরের আটুলিয়া প্রভৃতি এলাকায় ত্রাণ বিতরণ শেষে আশাশুনি এসে খাওয়া হ’ল। আমি তখন একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত অন্য এলাকায় যাওয়ার জন্য আমীরে জামা‘আত সদা প্রস্ত্তত। তিনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, চলো এখনই যেতে হবে। সেদিন এই পৌঢ় বয়সেও আমীরে জামা‘আতের মধ্যে ভরা তারুণ্যের আলোকচ্ছটা দেখেছি। এখনও তাঁর তেজোদীপ্ত ভাষণ, কাজের স্পৃহা এবং ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করে।

তাওহীদের ডাক : ১৯৮৯ সালে জমঈয়ত ও যুবসংঘের মাঝে ভাঙ্গন এর কারণ কি? আপনি কি মনে করেন।

মাওলানা আব্দুল মান্নান : যুবসংঘের সাথে জমঈয়তের ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা খুবই দুঃখজনক বিষয় ছিল। এর পিছনে মূল কারণ ছিল, আমীরে জামা‘আতের মাধ্যমে আহলেহাদীছদের মধ্যে সারা দেশে গতিশীল চেতনার যে বিপ্লব হয়েছিল সেটা জমঈয়ত নেতৃবৃন্দ সহ্য করতে পারেননি। এই গতিকে থামিয়ে দিতেই হঠাৎ এই অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা যুবসংঘ-এর সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করেন। আবার এই বিভাজনকে স্থায়ী করার জন্য তারা শুববান নামক নতুন যুব সংগঠনের ঘোষণা দেন। আহলেহাদীছ জামাআতকে বিভক্তকারী এই সিদ্ধান্ত ছিল চরম আত্মঘাতি। ভাবতে অবাক লাগে, ১৯৮৯ সালে রাজশাহীর রাণীবাজার মাদ্রাসা মসজিদে যুবসংঘের যে কেন্দ্রীয় কমিটি হ’ল সেখানে জমঈয়ত সভাপতি ড.আব্দুল বারী স্যার নিজেই স্ব-শরীরে উপস্থিত ছিলেন। আমিও সেই সম্মেলনে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত আরাফাত পত্রিকায় যেটা আমরা দেখেছি তা নিতান্তই বিস্ময়কর ও দুঃখজনক। এই একটা সিদ্ধান্তের কারণে সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেল। সেই থেকে তাদের পক্ষ থেকে আদাজল খেয়ে আমীরে জামাআতের বিরুদ্ধে বিষোদগার ছড়ানো এবং আন্দোলন-এর নেতা-কর্মীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ এখনও অব্যাহত রয়েছে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। আমীন!

তাওহীদের ডাক : বর্তমানে নতুন এক ফিৎনা শুরু হয়েছে- সংগঠন করা যাবে না। এটা আপনি কিভাবে দেখেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : এটা এক শ্রেণীর মানুষের অদূরদর্শিতা, অপরিপক্কতা ও জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনে অনীহার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমি মনে করি ছাহাবীদের যুগ থেকে চলে আসা আহলেহাদীছদের প্রকৃত আদর্শকে ধ্বংস করার সূক্ষ্ম কৌশলও বটে। তাছাড়া এটি জামা‘আতী শক্তিকে নস্যাৎ করার অপকৌশল বৈকি! এই বিভ্রান্তি ও ষড়যন্ত্রকে অবশ্যই সফল হতে দেয়া যাবে না। আমাদেরকে বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, আমরা আহলেহাদীছ। আমরা সংগঠন করি, আমরা আন্দোলন করি, আমরা যুবসংঘ করি।

তাওহীদের ডাক : বর্তমানে যুবসমাজ অধঃপতনের অতলতলে হারিয়ে যাচ্ছে। সেসমস্ত যুবকদের সঠিক দ্বীনে ফিরে আসার ব্যাপারে যদি নছীহত করতেন?

মাওলানা আব্দুল মান্নান : পরবর্তী প্রজন্মকে হক্বের উপর টিকিয়ে রাখতে হলে হক্বের দাওয়াত যুবসমাজের মাঝে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদের বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের শিক্ষার বিষয়ে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। আর এই কাজটি সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে নিলে সহজ হবে। কারণ জামা‘আতবদ্ধ জীবন রহমত ও জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত থাকে (ছহীহাহ হা/৬৬৭; তিরমিযী হা/২১৬৫)। এক সময় আমি, আপনি, আমীরে জামা‘আত- আমরা কেউ থাকব না। কিন্তু এই আন্দোলন থাকবে, সংগঠন থাকবে। সাথে সাথে তাদেরকে নিয়মিত আমীরে জামা‘আতের জুম‘আর খুৎবা শুনানো ও সমসাময়িক বইগুলো পড়াতে হবে। তাহ’লে তারা যুগ-জিজ্ঞাসার সমুচিত জবাব পেয়ে যাবে। সাথে সাথে আগামী দিনের পথ চলার খোরাক পাবে ইনশাআল্লাহ।

তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন।

মাওলানা আব্দুল মান্নান : আল-হামদুলিল্লাহ! আমি নিয়মিত তাওহীদের ডাক পত্রিকা পড়ি। পত্রিকা হাতে পেলেই প্রথমে সাক্ষাৎকারটি পড়ি। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে প্রত্যেকের সংগ্রামী জীবনের স্মৃতিচারণগুলো অনেক ভাল লাগে। যদিও অন্যদের মত আমি সাংগঠনিক জীবনে বাধার সম্মুখীন কখনো হইনি। আর আমার মত নগণ্য ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য এই পত্রিকার সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই পত্রিকা দ্বি-মাসিক না হয়ে মাসিক হলে আরও ভাল হয়। উত্তরোত্তর তাওহীদের ডাক পত্রিকার কলেবর বৃদ্ধি পাক, গ্রাহক ও পাঠক সংখ্যা আরো বৃদ্ধি হোক- আল্লাহর নিকট এই দো‘আই করছি।

তাওহীদের ডাক : আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মাওলানা আব্দুল মান্নান : আপনাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা রইল। জাযাকুমুল্লাহু খায়রান। মহান আল্লাহ আমাদের সকলের কল্যাণ করুন, আমাদের সকলের প্রচেষ্টাকে কবুল করে নিন-আমীন! 



আরও