অধিকাংশ সমাচার (৪র্থ কিস্তি)

লিলবর আল-বারাদী 525 বার পঠিত

খ. অধিকাংশ নারী :

জাহান্নামী ব্যক্তিরা দুনিয়া ও আখিরাতের উভয় জগতে সবচেয়ে বেশী লাঞ্চিত হবে। যদিও তারা দুনিয়াতে নিজেদেরকে মহা সম্মানিত মনে করে। তবে আফসোসের বিষয় হ’ল জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী হবে নারী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,غَيْرَ أَنَّ أَصْحَابَ النَّارِ قَدْ أُمِرَ بِهِمْ إِلَى النَّارِ ، وَقُمْتُ عَلَى بَابِ النَّارِ فَإِذَا عَامَّةُ مَنْ دَخَلَهَا النِّسَاءُ ‘জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর জাহান্নামের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, তাতে যারা প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশই নারী’।[1] অন্যত্র তিনি বলেন, وَاطَّلَعْتُ فِي النَّارِ فَرَأَيْتُ أَكْثَرَ أَهْلِهَا النِّسَاءَ ‘জাহান্নামে উঁকি মেরে দেখলাম যে, এর অধিকাংশই হ’ল নারী’।[2]

স্বামীর অবাধ্যতা ও ভাল ব্যবহার অস্বীকার করা হ’ল কুফরী। বিবাহের পর স্বামীই তার স্ত্রীর মূল অভিভাবক। অতএব স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করা জায়েয হবে না। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একদা রাসূললুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে দীর্ঘ রুকুু, ক্বিয়াম ও সিজদাসহ সূর্যগ্রহণের ছালাত আদায় করি এবং ছালাত শেষে লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা দেখলাম, আপনি নিজের জায়গা হ’তে কি যেন ধরছেন, আবার দেখলাম, আপনি যেন পিছনে সরে এলেন। জওয়াবে তিনি বলেন,إِنِّى رَأَيْتُ الْجَنَّةَ فَتَنَاوَلْتُ عُنْقُودًا، وَلَوْ أَصَبْتُهُ لأَكَلْتُمْ مِنْهُ مَا بَقِيَتِ الدُّنْيَا، وَأُرِيتُ النَّارَ فَلَمْ أَرَ مَنْظَرًا كَالْيَوْمِ قَطُّ أَفْظَعَ وَرَأَيْتُ أَكْثَرَ أَهْلِهَا النِّسَاءَ. ‘আমি জান্নাত দেখেছিলাম এবং এক গুচ্ছ আঙ্গুরের প্রতি হাত বাড়িয়েছিলাম। আমি তা পেয়ে গেলে দুনিয়াতে থাকা পর্যন্ত অবশ্যই তোমরা তা খেতে পারতে। অতঃপর আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়, আমি আজকের মত ভয়াবহ দৃশ্য কখনো দেখিনি। সেখানে দেখলাম, জাহান্নামের অধিকাংশ বাসিন্দা নারী’। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কী কারণে অধিকাংশ নারী? তিনি বলেন, بِكُفْرِهِنَّ. ‘তাদের কুফরীর কারণে’। জিজ্ঞেস করা হ’ল, তারা কি আল্লাহর সাথে কুফরী করে? তিনি বলেন, يَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ وَيَكْفُرْنَ الإِحْسَانَ، لَوْ أَحْسَنْتَ إِلَى إِحْدَاهُنَّ الدَّهْرَ كُلَّهُ، ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ شَيْئًا قَالَتْ مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَطُّ. ‘তারা স্বামীর অবাধ্য হয়ে থাকে এবং ইহসান অস্বীকার করে। তুমি যদি তাদের কারু প্রতি সারা জীবন সদাচারণ করো, অতঃপর সে তোমা হ’তে সামান্য ত্রুটি পায়, তাহ’লে বলে ফেলে, তোমার কাছে থেকে কখনো ভাল ব্যবহার পেলাম না’।[3] আর স্বামীর সাথে কুফরী করা স্ত্রীরা জাহান্নামী হবে। অন্যত্র এসেছে, রাসূল (ছাঃ) জনৈকা মহিলাকে বলেন,فَانْظُرِى أَيْنَ أَنْتِ مِنْهُ فَإِنَّمَا هُوَ جَنَّتُكِ وَنَارُكِ. ‘লক্ষ্য রেখো, তোমার স্বামীই তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম’।[4] স্বামীর নিকটে অকারণে তালাক্ব কামনাকারিনী স্ত্রী জান্নাতে যাবে না। হযরত ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইরশাদ করেন, أَيُّمَا امْرَأَةٍ اخْتَلَعَتْ مِنْ زَوْجِهَا مِنْ غَيْرِ بَأْسٍ لَمْ تَرِحْ رَائِحَةَ الجَنَّةِ ‘যে মহিলা তার স্বামীর কাছে অকারণে তালাক্ব কামনা করে, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না’।[5]

স্বামীকে কষ্ট দিলে জান্নাতের হুররা সেই স্ত্রীর প্রতি ভৎর্সনা করে থাকে। মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تُؤْذِى امْرَأَةٌ زَوْجَهَا فِى الدُّنْيَا إِلاَّ قَالَتْ زَوْجَتُهُ مِنَ الْحُورِ الْعِينِ لاَ تُؤْذِيهِ قَاتَلَكِ اللَّهُ فَإِنَّمَا هُوَ عِنْدَكِ دَخِيلٌ يُوشِكُ أَنْ يُفَارِقَكِ إِلَيْنَا. ‘পৃথিবীতে কোন স্ত্রীলোক যখনই তার স্বামীকে কষ্ট দেয় তখনই (জান্নাতের) বিস্তৃত চক্ষুবিশিষ্ট হুরদের মধ্যে তার (ভাবী) স্ত্রী বলে, হে অভাগিণী! তাকে কষ্ট দিও না। তোমাকে আল্লাহ তা‘আলা যেন ধ্বংস করে দেন! তোমার নিকট তো তিনি কিছু সময়ের মেহমান মাত্র। শীঘ্রই তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি আমাদের নিকট চলে আসবেন’।[6]

গ. অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী ও হারাম খাদ্য ভক্ষণকারী :

আত্মসাৎ একটি গর্হিত কাজ। সাধারণ চুরির চেয়ে সম্পদ আত্মসাৎ অধিক গুণাহের কাজ। এ পাপের কারণে বান্দা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। আর মুমিন বান্দা ছাড়া এমন গর্হিত কাজ থেকে অন্য কেহ বিরত থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ الْخُلَطَاءِ لَيَبْغِي بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَقَلِيلٌ مَا هُمْ ‘আর শরীকদের অনেকেই একে অন্যের উপর সীমালঙ্ঘন (সম্পদ আত্মসাৎ) করে থাকে। তবে কেবল তারাই এরূপ করে না যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে। আর এরা সংখ্যায় খুবই কম’ (ছোয়াদ ৩৮/২৪)। পেশাদার যেনাকারী ও মাল আত্মসাৎকারীর ইবাদত ও দো‘আ কিছুই কবুল হয় না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, تُفْتَحُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ نِصْفَ اللَّيْلِ فَيُنَادِي مُنَادٍ: هَلْ مِنْ دَاعٍ فَيُسْتَجَابَ لَهُ؟ هَلْ مِنْ سَائِلٍ فَيُعْطَى؟ هَلْ مِنْ مَكْرُوبٍ فَيُفَرَّجَ عَنْهُ؟ فَلَا يَبْقَى مُسْلِمٌ يَدْعُو بِدَعْوَةٍ إِلَّا اسْتَجَابَ اللهُ لَهُ إِلَّا زَانِيَةٌ تَسْعَى بِفَرْجِهَا أَوْ عَشَّارٌ ‘মধ্যরাত্রিতে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। অতঃপর একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকেন। কোন আহবানকারী আছে কি? তার সেই আহবানে সাড়া দেওয়া হবে। কোন যাঞ্চাকারী আছে কি? তাকে প্রদান করা হবে। আছে কি কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি? তার বিপদ দূর করে দেওয়া হবে। এই সময় কোন মুসলিম বান্দা যে দো‘আ করে, আল্লাহ তার সে দো‘আ কবুল করেন। তবে সেই যেনাকারিণীর দো‘আ কবুল করা হয় না, যে তার লজ্জাস্থানকে ব্যভিচারে নিয়োজিত রাখে এবং যে ব্যক্তি অপরের মাল আত্মসাৎ করে’।[7]

অন্যায়ভাবে আত্মসাৎকারী ব্যক্তি মহাপাপী। এদের ইবাদত, যিকির ও দো‘আ কিছুই কবুল হয় না। এরা আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে তখন, যখন আল্লাহ ভীষণ রাগান্বিত থাকবেন। আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, مَنِ اقْتَطَعَ مَالَ امْرِئٍ مُسْلِمٍ بِيَمِينٍ كَاذِبَةٍ لَقِىَ اللَّهَ وَهْوَ عَلَيْهِ غَضْبَانُ ‘যে ব্যক্তি কারো সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য মিথ্যা কসম খায়, সে আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তিনি তার উপর ক্রোধান্বিত থাকবেন’।[8]

জান্নাতে প্রবেশের পূর্বে সম্পদ আত্মসাতের হিসাব আবারও গ্রহণ করা হবে। কারণ কোন ব্যক্তি ওয়ারিছকে তার হক্ব থেকে বঞ্চিত করলে আল্লাহ তাকেও জান্নাত থেকে বঞ্চিত করবেন। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইরশাদ করেন, مَنْ فَرَّ مِنْ مِيرَاثِ وَارِثِهِ، قَطَعَ اللَّهُ مِيرَاثَهُ مِنَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ. ‘যে ব্যক্তি কোন ওয়ারিছকে তার অংশ থেকে বঞ্চিত করলো, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন’।[9] এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيْلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِّىَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ ‘অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন। যে দীর্ঘ সফর করেছে। যার চুল উষ্কখুষ্ক, কাপড় ধূলিমলিন। সে আকাশ পানে দু’হাত প্রসারিত করে বলে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং হারাম দ্বারা দেহ গঠিত। কাজেই এমন ব্যক্তির দো‘আ কিভাবে কবুল হ’তে পারে’?[10] অন্যত্র, আবু বকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِالْحَرَامِ ‘হারাম খাদ্যে গঠিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[11] ইবনে রজব (রহঃ) বলেন,فأكل الحرام وشربه ولبسه والتغذي به سبب موجب، ‘হালাল খাওয়া, হালাল পান করা, হালাল পরিধান করা ও হালাল খেয়ে পরিপুষ্ট হওয়া দো‘আ কবুল হওয়ার শর্ত’।[12] হারাম রূযী ভক্ষণকারীর পরিণতি সম্পর্কে ইবনুল জাওযী (রাহিঃ) বলেন, اَلْحَرَامُ مِنَ القُوْتِ نَارٌ تُذِيْبُ شَحْمَةَ الفِكْرِ، وَتُذْهِبُ لَذَّةَ حَلاَوَةِ الذِّكْرِ، وَتُحَرِّقُ ثِيَابَ إِخْلاَصِ النِّيَّاتِ، وَمِنَ الْحَرَامِ يَتَوَلَّدُ عَمَى الْبَصِيْرَةِ وَظَلاَمِ السَّرِيْرَةِ. ‘হারাম খাদ্য এমন এক আগুন, যা চিন্তা শক্তিকে বিনষ্ট করে দেয়, যিকিরের স্বাদ দূরীভূত করে দেয় এবং নিয়তের পরিশুদ্ধতার পোষাক জ্বালিয়ে দেয়। আর হারাম খাদ্য গ্রহণের ফলে চোখে ও অন্তরজুড়ে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে’।[13]

ঘ. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ও প্রতিবেশীকে কষ্ট দানকারী :

কুরআন মাজীদে আল্লাহ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে অভিশপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَن تُفْسِدُوْا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوْا أَرْحَامَكُمْ، أُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ لَعَنَهُمُ اللهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ- ‘তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’লে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকে লা‘নত করেন এবং করেন বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২২-২৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী বলেন, এতে দু’টি বিষয় রয়েছে। ১. আল্লাহর আনুগত্য আবশ্যকীয় করে নেয়া এবং তাঁর আদেশকে যথার্থভাবে পালন করা। এটা কল্যাণ, হেদায়াত ও কামিয়াবী। ২. আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিমুখ হওয়া, তাঁর নির্দেশ প্রতিপালন না করা। যার দ্বারা দুনিয়াতে কেবল বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আর এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয় পাপাচার ও অবাধ্যতামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এবং জ্ঞাতি বন্ধন ছিন্ন করার কারণে। তারাই ঐসকল লোক যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে। আল্লাহ স্বীয় রহমত থেকে তাদেরকে দূর করে দিয়ে এবং তাঁর ক্রোধের নিকটবর্তী করে তাদের অভিসম্পাত করেন’।[14]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَلَقَ الله الْخَلْقَ فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَامَتِ الرَّحِمُ فَأَخَذَتْ بِحَقْوِ الرَّحْمَنِ فَقَالَ لَهَا مَهْ قَالَتْ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيعَةِ قَالَ أَلاَ تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَذَاكِ لَكِ ‘আল্লাহ্ তা’আলা সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করেন। এ থেকে তিনি নিস্ক্রান্ত হ’লে রাহিম (রক্ত সম্পর্কে) দাঁড়িয়ে পরম করুণাময়ের অাঁচল টেনে ধরল। তিনি তাকে বললেন, থামো। সে বলল, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী লোক থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্যই আমি এখানে দাঁড়িয়েছি। আল্লাহ বললেন, যে তোমাকে সম্পর্কযুক্ত রাখে, আমিও তাকে সম্পর্কযুক্ত রাখব; আর যে তোমার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে, আমিও তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করব এতে কি তুমি খুশী নও? সে বলল, নিশ্চয়ই, হে আমার প্রভু। তিনি বললেন, যাও তোমার জন্য তাই করা হ’ল। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِى الأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ ‘ইচ্ছে হ’লে তোমরা পড়, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’লে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বাঁধন ছিন্ন করবে’।[15]

আত্মীয়তা হ’ল শ্রেষ্ঠ বন্ধন ও সম্পর্ক। বিপদে-আপদে এরাই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে। কিন্তু তাদের সাথে যদি সম্পর্ক না রাখা হয় তাহ’লে আল্লাহ নারাজ হোন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশে বিরত রাখেন। জুবায়র ইবনু মুতঈম (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ. ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[16] তিনি আরো বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ خَمْرٍ وَلاَ مُؤْمِنٌ بِسِحْرٍ وَلاَ قَاطِعُ رَحِمٍ ‘জান্নাতে প্রবেশ করবে না মদ পানকারী, জাদুতে বিশ্বাসী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী’।[17] আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর নেক আমল আল্লাহ তা‘আলা গ্রহণ করেন না। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ أَعْمَالَ بَنِى آدَمَ تُعْرَضُ كُلَّ خَمِيسٍ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ فَلاَ يُقْبَلُ عَمَلُ قَاطِعِ رَحِمٍ. ‘আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রিতে (আল্লাহ তা‘আলার নিকট) উপস্থাপন করা হয়। তখন আত্মীয়তার বন্ধন বিচ্ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না’।[18] আল্লাহ তা‘আলা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর শাস্তি দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন। উপরন্তু আখিরাতের শাস্তি তো তার জন্য প্রস্ত্তত আছেই। আবু বাকরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ ذَنْبٍ أَجْدَرُ أَنْ يُعَجِّلَ اللَّهُ لِصَاحِبِهِ العُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنَ البَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ. ‘দু’টি গুনাহ ছাড়া এমন কোনো গুনাহ নেই, যে গুনাহ‌গারের শাস্তি আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতেই দিবেন এবং তা দেওয়াই উচিৎ। উপরন্তু তার জন্য আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। গুনাহ দু’টি হচ্ছে, অত্যাচার ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী’।[19]

ঙ. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, মদ্যপ, দাইউস ও খোটাদানকারী ব্যক্তি :

চার শ্রেণীর ব্যক্তি জাহান্নণামে যাবে। পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদ্য পানকারী মাতাল, যে দান করার পরে খোটা দেয় এবং গর্ব করে সকলের কাছে বলে বেড়ায় এবং পরিবারের অশ্লীলতাকে মেনে নেয়া দাইউস ব্যক্তি। ইবনে উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ثَلَاثَةٌ قَدْ حَرَّمَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَلَيْهِمْ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ الْخَمْرِ وَالْعَاقُّ وَالدَّيُّوثُ الَّذِي يُقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخُبْثَ ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না; পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মদপানে অভ্যাসী মাতাল এবং দান করার পর যে বলে ও গর্ব করে বেড়ায় এমন খোঁটাদানকারী ব্যক্তি’।[20] অন্যত্র বলেন, وثَلاثَةٌ لا يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ العاقُّ لِوَالِدَيْهِ والمُدْمِنُ الخَمْرَ والمَنَّانُ بِما أعْطَى ‘তিন শ্রেণীর লোকের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। অব্যাহতভাবে মদ পানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্যজন এবং এমন বেহায়া, যে তার পরিবারের অশ্লীলতাকে মেনে নেয়’।[21]

চ. অত্যাচারী শাসক ও পুরুষের বেশ ধারণকারীনী রমণী :

সমাজের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম হ’ল অত্যাচারী শাসক। যারা প্রজার সম্পদ লুণ্ঠন ও অত্যাচার করে। আর যে সকল নারী পুরুষের মত পোষাক পরিধান করে এবং পরপুরুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও আকর্ষিত হয়। এছাড়া উটের কুঁজের মত করে মাথায় খোঁপা করে। এরা এতই দুর্ভাগা হবে যে, জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا : قَومٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ البَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُؤُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ البُخْتِ المائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيحَهَا وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكذَا.

‘দুই প্রকার জাহান্নামী লোক আমি প্রত্যক্ষ করিনি (এক) এমন এক সম্প্রদায় যাদের কাছে গরুর লেজের মত চাবুক থাকবে, যা দিয়ে তারা জনগণকে প্রহার করবে। (দুই) এমন এক শ্রেণীর মহিলা, যারা এমন পোশাক পরবে অথচ তারা উলঙ্গ থাকবে, অন্যের প্রতি নিজেদের আকর্ষণ করবে এবং নিজেরাও অন্যদের আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা হবে উটের হেলে যাওয়া কুঁজের মত। এ ধরনের মহিলারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধিও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধি এত এত দূরত্বের পথ থেকে পাওয়া যাবে’।[22]

পুরুষের পোষাক বলে পরিচিত তা নারীরা পরিধান করলে তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ হবে। এমনি নারীদের মাথার চুল ছোট করে পুরুষের বেশ ধারণ করাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কোনভাবেই নারীরা তাদের ঢিলেঢালা পোষাকের পরিবর্তে পুরুষের পোষাকের মত পোষাক পরিধান করতে পারবে না। তাহ’লে তাদের ওপর লানত পরবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لَعَنَ الرَّجُلَ يَلْبَسُ لُبْسَةَ الْمَرْأَةِ وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لُبْسَةَ الرَّجُلِ ‘সেই পুরুষের ওপর অভিশাপ করেছেন যে, মহিলার পোষাক পরিধান করে এবং সে মহিলার উপর অভিশাপ করেছেন যে পুরুষের পোষাক পরিধান করে’।[23] অন্যত্র এসেছে, ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ الْمُخَنَّثِينَ مِنْ الرِّجَالِ وَالْمُتَرَجِّلاَتِ مِنْ النِّسَاءِ ‘নবী (ছাঃ) হিজড়ার বেশ ধারণকারী পুরুষের উপর অভিশাপ করেছেন এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী নারীর উপর অভিশাপ করেছেন’।[24] তিন শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামে যাবে। তন্মধ্যে পুরুষের বেশধারী নারী অন্যতম। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ثَلاَثَةٌ لاَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ الْعَاقُّ لِوَالِدَيْهِ وَالدَّيُّوثُ وَرَّجْلَةُ النِّسَاءِ ‘তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে যাবে না- (১) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান (২) বাড়ীতে বেহায়াপনার সুযোগ প্রদানকারী (৩) পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী’।[25] আবু মুলায়কা (রাঃ) বলেন, قِيلَ لِعَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا إِنَّ امْرَأَةً تَلْبَسُ النَّعْلَ فَقَالَتْ لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلَةَ مِنْ النِّسَاءِ ‘একদা আয়েশা (রাঃ)-কে বলা হ’ল- একটি মেয়ে পুরুষের জুতা পরে। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, রাসূল (ছাঃ) পুরুষের বেশধারী নারীর প্রতি অভিশাপ করেছেন’।[26] 

ছ. রিয়া বা লৌকিকতা প্রদর্শনকারী :

রিয়া বা লৌকিকতা প্রদর্শন করাকে শিরকে আছগার বা ছোট শিরক বলা হয়। আর আল্লাহ বিচার দিবসে এমন ব্যক্তিদেরকে তাড়িয়ে দিবেন। মাহমূদ বিন লাবীদ বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ قَالُوا وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاء ‘আমি তোমাদের জন্য যা সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হ’ল শিরকে আছগার (ছোট শিরক)। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেসা করলেন ‘হে আল্লাহর রাসূল ছোট শিরক কি?’ তিনি জওয়াবে বললেন ‘রিয়া’ লোক দেখানো বা জাহির করা। কারণ নিশ্চয়ই শেষ বিচারের দিনে মানুষ তার পুরস্কার গ্রহণের সময় আল্লাহ বলবেন, ‘বস্ত্তজগতে যাদের কাছে তুমি নিজেকে জাহির করেছিলে তাদের কাছে যাও এবং দেখ তাদের নিকট হ’তে কোন পুরস্কার পাও কি না’।[27]

আর এই রিয়া প্রদর্শন করাকে গুপ্ত শিরকও বলা হয়। এই শিরক দাজ্জালের ফেৎনার চেয়েও ভয়াবহ। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন রাসূল (ছাঃ) বের হয়ে এলেন এবং ঘোষণা দিলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِى مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ؟ قَالَ قُلْنَا بَلَى، فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِىُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّى فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ. ‘আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জালের চেয়ে ভয়ংকর একটি বিষয় সম্পর্কে বলব না? আমরা বললাম, জী বলুন। তিনি উত্তর দিলেন, সেটা হ’ল গুপ্ত শিরক। (অর্থাৎ) যখন কেউ ছালাত আদায় করতে উঠে ছালাত সুন্দর করার জন্য চেষ্টা করে এই ভেবে যে লোকেরা তার প্রতি চেয়ে আছে, সেটাই গুপ্ত শিরক’।[28] ইবনে আববাস (রাঃ) এই বাস্তবতা সম্বন্ধে উল্লেখ করে বলেছিলেন ‘চন্দ্রবিহীন রাত্রে একটা কালো পাথর বেয়ে উঠা একটা কালো পিঁপড়ার চেয়েও গোপন হ’ল শিরক’।[29]

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ‘তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللَّهُ بِهِ ‘যে ব্যক্তি জনসম্মুখে প্রচারের ইচ্ছায় নেক আমল করে আল্লাহ তা‘আলাও তার কৃতকর্মের অভিপ্রায়ের কথা লোকদেরকে জানিয়ে ও শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতার উদ্দেশ্যে কোন নেক কাজ করে, আল্লাহ তা‘আলাও তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা লোকেদের মাঝে ফাঁস করে দিবেন’।[30]

ইবনু রজব হাম্বালী (৭৩৬-৭৯৫হি.) (রহ:) বলেন, وَرَائِحَةُ الْرِيَاءِ كَدُخَانِ الْحِطَبِ، يَعِلُوْ إِلَى الْجَو ثُمَّ يَضْمِحَل وَتَبْقِى رَائحته الكَرِيْهَة ‘রিয়া বা লৌকিকতার ঘ্রাণ (উপমা) হ’ল কয়লার ধোঁয়ার ন্যায়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার পর তা নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার দূর্গন্ধ কেবল অবশিষ্ট থাকে’।[31]

রিয়া প্রদর্শনকারী ব্যক্তি জাহান্নামী হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা লোক দেখানো কোন ইবাদত কবুল করেন না। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এক শহীদ ব্যক্তির হিসাব নেওয়া হবে। তাকে আনা হবে, অতঃপর তাকে আল্লাহর নে‘মতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘তুমি এতে কি আমল করেছ?’ সে বলবে, আপনার জন্য জিহাদ করে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি এ জন্য জিহাদ করেছ যেন তোমাকে বীর বলা হয়, অতএব তা বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আবারও আলিম ব্যক্তিকে আনা হবে, যে ইলম শিখেছে, শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন তিলাওয়াত করেছে। অতঃপর তাকে তার নে‘মতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘তুমি এতে কি আমল করেছ?’ সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি ও শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি ইলম শিক্ষা করেছ যেন তোমাকে আলিম বলা হয়। কুরআন তিলাওয়াত করেছ যেন তোমাকে ক্বারী বলা হয়। অতএব তা-ই বলা হয়েছে’। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। পুনরায় আরও এক ব্যক্তিকে আনা হবে, যাকে আল্লাহ সচ্ছলতার সাথে সকল প্রকার ধন-সম্পদ দান করেছেন। তাকে তার নে‘মতরাজি জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘তুমি এতে কী আমল করেছ?’ সে বলবে, আপনি পছন্দ করেন এমন কোন খাত নেই, যেখানে আমি আপনার জন্য দান করিনি। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি দান করেছ যেন তোমাকে দানশীল বলা হয়। অতএব বলা হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[32]

জ. ঝগড়াটে, হঠকারী ও অহংকারকারী ব্যক্তি :

অহংকার হ’ল আল্লাহর চাদর। আর তা নিয়ে টানাহেঁচড়া করলে সেই ব্যক্তির পরিণাম জাহান্নাম। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) ও আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তাঁরা বলেন, রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, يَقُوْلُ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ الْعِزُّ إِزَارُهُ وَالْكِبْرِيَاءُ رِدَاؤُهُ فَمَنْ يُنَازِعُنِى عَذَّبْتُهُ. মহা সম্মানিত প্রতাপশালী আল্লাহ বলেছেন, ‘মাহাত্ম হচ্ছে তার লুঙ্গী, আর অহংকার তার চাদর। যে ব্যক্তি এ দু’টির যে কোন একটিতেও আমার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে, তাকে আমি শাস্তি প্রদান করব’।[33]

ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারীরা জান্নাতে যাবে না। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হ’ল দুর্বল এবং যাদেরকে লোকেরা দুর্বল ভাবে। কিন্তু তারা যদি আল্লাহর নামে কসম দিয়ে কিছু বলে, আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হ’ল বাতিল কথার উপর ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারী’।[34]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ. قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُوْنَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً. قَالَ إِنَّ اللهَ جَمِيْلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ. ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি বলল, কোন ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার কাপড়টা সুন্দর হোক, জুতাটা মনোরম হোক। তিনি বললেন, মহান আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যই পছন্দ করেন। অহংকার হচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করা ও লোকদের তুচ্ছ মনে করা’। [35]

অন্যত্র তিনি বলেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ أَحَدٌ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةِ خَرْدَلٍ مِنْ كِبْرِيَاءَ ‘যার অন্তরে সরিষাদানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[36]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের সকলকে সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্ত রেখে এবং জাহান্নামী কার্যক্রম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতী বান্দা হিসেবে কবুল করুন, আমীন।

 (ক্রমশঃ)

-লিলবর আল-বারাদী

[লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী ]

[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৩।

[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৪।

[3]. বুখারী হা/১০৫২; মুসলিম হা/৯০৭; মিশকাত হা/১৪৮২; নাসাঈ হা/১৪৯৩; আহমাদ হা/১৭১১, ৩৩৭৪; ইবনে হিবক্ষান হা/১৩৭৭।

[4]. আহমাদ হা/১৯০২৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬১২।

[5]. তিরমিযী হা/১১৮৬; ছহীহ হাদীছ।

[6]. তিরমিযী হা/১১৭৪; মিশকাত হা/৩২৫৮; আহমাদ হা/২২১৫৪; ছহীহুল জামি‘ হা/৭১৯২।

[7]. ছহীহাহ হা/১০৭৩; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৭১;

[8]. বুখারী হা/৭৪৪৫।

[9]. সুনানে ইবনু মাজাহ হা/২৭০৩।

[10]. মুসলিম হা/৬৫, মুসলিম হা/১০১৫; তিরমিযী হা/২৯৮৯; ছহীহুল জামি‘ হা/২৭৪৪; মিশকাত হা/২৭৬০।

[11]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১১৫৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬০৯; মিশকাত হা/২৭৮৭।

[12]. ইবনু রজব আল-হাম্বলী, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১ম খন্ড (বৈরূত : দারুল মারিফাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ), পৃঃ ২৯৩।

[13]. বাহরুদ দুমূ‘, পৃষ্ঠা-১৪৬।

[14]. আব্দুর রহমান ইবনু নাছের আস-সা‘দী, তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, ১/৭/৮৮, সূরা মুহাম্মাদ ২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।

[15]. বুখারী হা/৪৮৩০; মুসলিম হা/২৫৫৪।

[16]. বুখারী হা/৫৯৮৪; মুসলিম হা/২৫৫৬; মিশকাত হা/৪৯২২।

[17]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৭৮।

[18]. আহমাদ হা/১০২৭৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৫৩৮; হাসান।

[19]. তিরমিযী হা/২৫১১; ইবনু মাজাহ হা/৪২১১; ছহীহুত তারগীব হা/২৫৩৭।

[20]. আহমাদ হা/৬১১৩; মিশকাত হা/৩৬৫৫।

[21]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৭৪; হাসান ছহীহ।

[22]. মুসলিম হা/২১২৮; মিশকাত হা/৩৫২৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩২৬।

[23]. আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৪৪৬৯; হাদীছ ছহীহ।

[24]. বুখারী, মিশকাত হা/৪৪২৮।

[25]. ছহীহ আত-তারগীব হা/২০৭০; হাসান ছহীহ।

[26]. আবূদাঊদ হা/৪০৯৯; মিশকাত হা/৪৪৭০; হাদীছ ছহীহ।

[27]. আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৫৩৩৪।

[28]. ইবনে মাজাহ হা/৪২০৪; মিশকাত হা/৫৩৩৩।

[29]. ছহীহুল জামি‘ হা/৩৭৩০।

[30]. বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬; মিশকাত হা/৫৩১৬; আহমাদ হা/২০৪৭০।

[31]. মাজমূঊর রাসায়িল, পৃষ্ঠা-৭৫৮।

[32]. মুসলিম হা/১৯০৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৫১৮।

[33]. মুসলিম হা/৬৮৪৬; ছহীহ তারগীব ওয়াত-তারহীব হা/২৮৯৮।

[34]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৬ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ।

[35]. মুসলিম হা/২৭৫।

[36]. মুসলিম হা/৯১; মিশকাত হা/৫১০৭।



বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
আরও