প্রতারণার পরিণাম

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 367 বার পঠিত

অনেক দিন আগের কথা। এক লোক এক হাযার ভেড়ার মালিক ছিল। সে ব্যক্তি হিসাবে অসৎ ছিল। তার কাছে হালাল-হারামের কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু তার ভেড়ার রাখাল ছিল সৎ ও ধর্মভীরু।

রাখাল প্রতি রাতে দুধওয়ালা ভেড়াদের দুধ দোহন করে তার মালিকের বাড়িতে নিয়ে আসত। যতটুকু দুধ হ’ত মালিক সে পরিমাণ পানি দিয়ে দিগুণ করে রাখালকে বিক্রি করার জন্য দিত। রাখাল প্রতিদিন তার মালিককে নছীহত করে বলত, এভাবে দুধের মধ্যে পানি দেয়া খেয়ানতের কাজ। যে ব্যক্তি আল্লাহর বান্দাদের সাথে ধূর্ততা করে তার সম্পদের বরকত উঠে যায়। পরবর্তীতে তাকে খেয়ানতের সাজা ভোগ করতে হয়। তার মালিক রাখালের উপদেশ শুনত না। বলত, আমি আমার কাজকে শ্রেষ্ঠ মনে করি। তুমি কাজের লোক, তোমার কাজের বিনিময়ে মজুরী পাও। এসব কথা তোমার কাছ থেকে শুনব না।

নিরুপায় হয়ে রাখাল দুধ নিয়ে রাস্তায় ‘দুধ, এই দুধ’ বলে হাঁক ছেড়ে মেপে মেপে বিক্রি করত। দিনশেষে অবশিষ্ট দুধ যা থাকত সেটা রাস্তার পাশের দুধ বিক্রেতার দোকানে দিয়ে টাকাগুলো মালিকের কাছে পৌঁছে দিত। মাঝে মাঝে ক্রেতারা বলত এই দুধে পানি মিশ্রিত আছে। রাখাল চাকরি হারানোর ভয়ে বলতো, আপনি ভুল করছেন, পানির মধ্যে দুধ দোহন করা হয়নি। যেহেতু এটা দুধ, পানি তো থাকবেই। দুধ তো আর শুষ্ক জিনিস না। কিন্তু ভেড়ার দুধ সর্বদা নির্ভেজাল হয়। রাখালের এই কথার উদ্দেশ্য হ’ত, যখন দুধ দহন করা হয় তখন নির্ভেজালই থাকে। যাহোক এরপরেও সে মালিককে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলত, দয়া করে এই কাজ করবেন না। সাবধান! এ কাজের পরিণতি ভাল নয়।

এভাবেই দিন চলতে থাকল। এক রাতে রাখাল ভেড়াগুলোকে একটি শুষ্ক নদীতে রেখে সে উঁচু জায়গায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। পাহাড়ি অঞ্চলটিতে আগেই বৃষ্টি হয়েছিল। সে বৃষ্টির পানি বন্যার পানির মত এসে শুষ্ক নদীটিকে সয়লাব করে দিল। ভেড়াগুলোকে পানিতে ভেসে গেল। রাখাল যখন বুঝতে পারল তখন আর কিছুই করার ছিল না। নিরাশ হয়ে রাখাল খালি হাতে শহরে মালিকের কাছে ফিরে গেল। মালিক প্রশ্ন করল, দুধ কোথায়? রাখাল বলল, আমি বেকার হয়ে গেলাম। আপনি যে কাজ করেছেন তার প্রভাবে মধ্যরাতে বন্যা এসে ভেড়াগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

মালিক বলল, এই পানি কোথায় থেকে আসল যে কিছুই বোঝা গেল না? রাখাল বিদ্রুপ করে বলল, আমি বুঝতে পারি নি কিন্তু এই পানি এমনি এমনি আসে নি। এগুলো সেই পানি যা দুধের মধ্যে ঢেলে দিতেন এবং দুধের দামে মানুষের কাছে বিক্রয় করতেন। সেই পানি জমা হয়ে ভেড়াগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমি আপনাকে কত নছীহত করেছি কিন্তু শুনেন নি। আজ আপনি ভেড়া হারালেন আর আমি কাজ হারালাম।

মালিক রাখালের কথা মেনে নিয়ে বলল, ভেড়াগুলোকে পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে এ কথা মেনে নিলাম। কারণ আমি জানি তুমি মিথ্যা কথা বল না। কিন্তু তোমার উপদেশ মানতে পারব না। যেভাবে আমার ভেড়ার পালকে বন্যার পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তা এক দুর্ঘটনা মাত্র। এটা খেয়ানতের শাস্তি নয়। কেননা এই শহরে আমি ছাড়াও অনেক মালিক আছে। আমার মত তারাও পানি বিক্রয়ে ব্যস্ত কিন্তু তাদের ভেড়া তো ভেসে যায় নি। রাখাল বলল, অন্যদের সাথে আমাদের কোন কাজ নেই। সত্যটাই আপনাকে বললাম। যে ব্যক্তি আল্লাহর সৃৃষ্টির প্রতি খেয়ানত করে তার সম্পদের কল্যাণ ও বরকত চলে যায়। আবারও বলছি এই পানি সেই পানি যা আপনি দুধে মিশিয়ে বিক্রয় করতেন। অন্যরা হয়ত সাজা পেয়েছে অথবা ভবিষ্যতে পাবে। অন্যায় করলে সব সময় বন্যা এসে ভেড়া নিয়ে যায় না। কখনো দুর্ঘটনা হয়ে জীবন নিয়ে যায়, কখনো বদনামের মাধ্যমে সম্মান চলে যায়, কখনো স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার নিয়ে যায়, কখনো দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশ হারিয়ে যায়। যে ব্যক্তি শুধু খেয়ে-পরে রাস্তায় চলে তাকেই মানুষ বলা হয় না। মানুষ সেই ব্যক্তি, যে সৃষ্টি ও স্রষ্টার কাছে অপমানজনক কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকে। এবং সত্য ও ন্যায়কে অন্তরে ধারণ করে। আপনি যাদের কথা বলছেন যে, তারা নিজেদের কাজে ব্যস্ত; আমার ও অন্যান্যদের দৃষ্টিতে মূলত তারা নেকড়ের মত মানুষ যারা পরস্পরকে কামড়াতে ব্যস্ত। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও নিকটজনের কাছে তাদের কোন মান-মর্যাদা নেই। তারাও তাদের ভেড়াগুলোকে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে অথচ এ ব্যাপারে তারা কোন খবরই রাখে না।

[গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত।]

শিক্ষা : গল্পের ভিতরেই শিক্ষা নিহিত রয়েছে। বর্তমান সমাজের অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতারণার চিত্র গল্পটিতে ফুটে উঠেছে। প্রতারকরা প্রতিনিয়ত মানুষ ঠকিয়ে ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাদের কাছে হালাল-হারামের কোন পার্থক্য নেই। নশ্বর দুনিয়ায় অধিক উপার্জনই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। অথচ এই কাজের মাধ্যমে দুনিয়ায় কিছু সময়ের জন্য উপকৃত হলেও পরকালে রয়েছে কঠোর শাস্তি। এই শাস্তি সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়। আল্লাহ আমাদেরকে প্রতারণা করা থেকে হেফাযত করুন এবং সঠিক পথের দিশা দান করুন। -আমীন!

-মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

[অনুবাদক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।]



আরও