জানার আছে অনেক কিছু
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 196 বার পঠিত
[পৃথিবীর বুকে অবরুদ্ধ ৪টি মুসলিম অঞ্চল হ’ল শিনজিয়াং, গাযা, কাশ্মীর ও আরাকান। যেখানে লাখ লাখ মুসলমান প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসীর গোচরে-অগোচরে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। স্রেফ মুসলিম হওয়ার অপরাধে আজ তারা নিজভূমে পরবাসী। পরাধীনতার নির্মম শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে তারা অতিবাহিত করছে এক দুর্বিষহ মানবেতর জীবন। নিপীড়িত এই ৪টি অঞ্চল নিয়েই ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর বার্ষিক ক্যালেন্ডার ২০২৩ প্রকাশিত হয়েছে।]
শিনজিয়াং, চীন :
পশ্চিম চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে অবস্থিত চীনের একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ ‘শিনজিয়াং’, যার আয়তন বাংলাদেশের ১১ গুণ। চীনের ২২টি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় এই প্রদেশে প্রায় দেড় কোটি উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস। প্রায় ২৫ হাযার মসজিদ রয়েছে। পাহাড়-পর্বত পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলটির পূর্বনাম ছিল পূর্ব-তুর্কিস্তান। তাদের ভাষাতেও রয়েছে অনেকটা তুর্কী ও আরবী ভাষার সংমিশ্রণ। এরা জাতিগতভাবে মধ্য এশীয়দের কাছাকাছি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিনজিয়াং-এর অর্থনীতি কৃষি ও বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। এই অঞ্চলের শহরগুলোর ভিতর দিয়েই গেছে বিখ্যাত সিল্ক রোড। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে উইঘুররা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু এই অঞ্চলটিকে চীনের নতুন কম্যুনিস্ট সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।
তিববতের মত শিনজিয়াংও স্বায়ত্বশাসিত এলাকা। কিন্তু বাস্তবে দু’টি এলাকাই চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই প্রদেশটিকে দখলে রাখতে চীন সরকার শুরু থেকে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কয়েক দশকে চীনের সংখ্যাগুরু হান জাতির বহু মানুষকে শিনজিয়াং-এ প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। বর্তমানে উইঘুর জনগোষ্ঠীর মুসলিম পরিচয়, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে নিশানা করে গণহারে তাদের আটক করে রাখা হচ্ছে। তাদেরকে কোণঠাসা করতে প্রকাশ্যে ধর্মীয় শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বহু মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে বহু বিশিষ্ট উইঘুর ব্যক্তিকে। সেখানে বিশাল আকারের সব বন্দীশিবির নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে দেড় কোটি উইঘুর জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ লাখই বর্তমানে বন্দী রয়েছে। শুধু তাই নয় চীন সরকারের যুলুম থেকে বাঁচার জন্য প্রায় ২৫ লক্ষ উইঘুর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তিববতের মত শিনজিয়াংও বর্তমানে নিষিদ্ধ জনপদে পরিণত হয়েছে, যার আড়ালে নীরবে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে লক্ষ-কোটি উইঘুর মুসলমানদের জীবন।
গাযা, ফিলিস্তীন :
অধিকৃত ফিলিস্তীনের প্রাচীর বেষ্টিত কারাগারের মত অবরুদ্ধ শহর ‘গাযা’। ইসরাঈলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় ভূমধ্যসাগর ঘেঁষে এক চিলতে জায়গায় এর অবস্থান। আয়তন মাত্র ৩৬০ বর্গ কি.মি.। দৈর্ঘ্য ৪১ কি.মি. ও প্রস্থ ১২ কি.মি.। এই শহর বর্তমানে একটি সুবৃহৎ আকারের শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে, যার ১৬ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৮৩ ভাগই দরিদ্র। ১৯৬৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত গাযা এলাকা দীর্ঘকাল ইসরাঈলের দখলে ছিল। ফিলিস্তীনীদের অবিরাম প্রতিরোধ-আনেদালনে বাধ্য হয়ে অত্যাচারী ইসরাঈলীরা ২০০৫ সালে গাযা ছেড়ে গেলেও গাযার উপর অবরোধ চাপিয়ে দেয়। তারা গাযায় ঢোকার ও বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়। দক্ষিণ মিসরের সিনাইয়ের দিকে একটা প্রবেশ পথ আছে। কিন্তু মার্কিন-ইসরাঈলের চাপের মুখে মিসর সে পথটিও বন্ধ করে দেয়। আর এভাবে গাযা পরিণত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম কারাগারে।
১৯৪৮ সালে আরব লীগের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তীনকে বিভক্ত করে ‘ইসরাঈল’ নামে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাশ হয়। ইসরাঈল নামক এই রাষ্ট্রটির অবৈধ জন্মলাভের পর থেকেই তার ভিতরে লুকানো পশু প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ক্রমেই ঘটতে থাকে। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তীন-ইসরাঈল যুদ্ধের সময় পশ্চিমতীর জর্ডানের এবং গাযা মিসরের দখলে চলে আসে। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের ভয়াবহ যুদ্ধে ইসরাঈল পুনরায় সেগুলো দখল করে নেয়। ১৯৪৮ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রায় ৭৫ বছরে ইসরাঈল যে বর্বরতা ও পাশবিকতা দেখিয়েছে, তা মানুষ কোনদিন কল্পনাও করেনি। হাযার হাযার ফিলিস্তীনী নর-নারীর রক্তে রঞ্জিত গাযা এখনও মর্মন্তুদ মুসলিম নিপীড়ন এবং মানবতার চূড়ান্ত পরাজয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
কাশ্মীর :
গাযার মত এক অন্তহীন যুলুমের শিকার, লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত নর-নারীর রক্তে রঞ্জিত অঞ্চল কাশ্মীর। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরপরেই অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় কাশ্মীর ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেয়নি। কেননা কাশ্মীরের ৮০ ভাগ লোক মুসলমান হওয়ায় নীতিগতভাবে কাশ্মীর পাকিস্তা-নের প্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে লর্ড মাউন্টব্যাটন ও নেহেরু তা হ’তে দেননি। অপরদিকে তৎকালীন কাশ্মীরের শিখ শাসক মহারাজা হরি ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতেই তিনি ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেননি। তার আশংকা ছিল কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় ভবিষ্যতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হ’তে পারেন। সেজন্য তিনি যেনতেন প্রকারে অন্ততঃপক্ষে জম্মুকে কুক্ষিগত রাখতে তার ডোগরা সেনাদের দিয়ে নির্বিচারে মুসলিম গণহত্যা চালান।
ফলে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জম্মুতে শিখ ও বহিরাগত হিন্দুদের দ্বারা কমপক্ষে ২ লক্ষ ৩৭ হাযার মুসলিম পরিকল্পিত গণহত্যার শিকার হয়। একপর্যায়ে লর্ড মাউন্টব্যাটন ও নেহেরু গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু সেই গণভোট আর কখনোই অনুষ্ঠিত হয়নি। ইতিমধ্যে কাশ্মীরের এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যার নাম দেয়া হয় ‘আযাদ কাশ্মীর’। আর দুই-তৃতীয়াংশ থেকে যায় ভারতের কাছে, যা ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ নামে পরিচিত। আশির দশক থেকে পুনরায় শুরু হওয়া আযাদী আন্দোলনে এখনও পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক কাশ্মীরীর প্রাণহানী ঘটেছে। কিন্তু তারা আজও অবরুদ্ধ কারাগারের বন্দিত্ব নিয়ে মুক্তির প্রহর গুনছে।
আরাকান, মিয়ানমার :
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র বার্মা বা মিয়ানমারের অন্ত-র্গত বর্তমানে ‘রাখাইন স্টেট’ নামে পরিচিত বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব সীমান্তে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী পাহাড়বেষ্টিত একটি অনিনদ্য সুনদর অঞ্চল ‘আরাকান’। যার আয়তন ১৪,২০০ বর্গমাইল। এই প্রদেশের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাম ‘রোহিঙ্গা’। রোহিঙ্গাদের ইতিহাস হাযার বছরের পুরনো। অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে সময়ের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পর্যায়ে আরাকানে মুসলিম বসতি গড়ে উঠে এবং এটি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। কিন্তু বৃটিশ প্রশাসন ১৯৪৮ সালে বার্মাকে স্বাধীনতা দানের পূর্বে সুকৌশলে রোহিঙ্গা-মগদের মধ্যে বিভেদের সূত্রপাত ঘটায়, যাতে করে সেখানে কাশ্মীরের মত স্থায়ীভাবে রক্তপাত ঘটানো যায়। ফলে স্বাধীনতা উত্তর বার্মা সরকার ঐতিহাসিক সত্যকে পদদলিত করে রোহিঙ্গাদেরকে বহিরাগত হিসাবে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন আরম্ভ করে। তাদেরকে ক্রমশঃ প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে উচেছদপূর্বক গোটা প্রশাসনকে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে মগদের হাতে তুলে দেয় এবং নিয়ন্ত্রিত করে ফেলে তাদের নাগরিক অধিকার। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে বর্মী সেনা ও স্থানীয় মগরা যৌথভাবে তাদেরকে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, জবরদস্তি শ্রমসহ হেন নির্যাতন নেই যা তাদের উপরে চালানো হয়নি।
এককথায় তাদেরকে সমস্ত নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। নিষ্ঠুর ও লোমহর্ষক নির্যাতনের মাধ্যমে তারা হাযার হাযার রোহিঙ্গাদের হত্যা করে। ফলে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে স্বদেশ ছেড়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডে পালিয়ে যায়। রোহিঙ্গা উৎখাতের অংশ হিসাবে ১৯৩৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ছোট ও বড় আকারে প্রায় ১০০টি সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মিলিটারি স্টাইলে অপারেশন পরিচালিত হয়। এতে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। সর্বশেষ ২০১৭ সালে বর্মী সেনাদের নৃশংস হামলার শিকার হয়ে কয়েক লক্ষ বাস্ত্তচ্যুত রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। নিজ স্থায়ী আবাসভূমি থাকা সত্ত্বেও তারা আজ ভূমিহীন, রাষ্ট্রহীন হিসাবে ভাসমান ও ভিনদেশে শরণার্থী। বর্তমানে প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শুধু বাংলাদেশেই শরণার্থী হিসাবে অবস্থান করছে। বিশ্বের সর্বাধিক নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠী বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ট্রাজেডী।