জীবনটাকে গড়তে হবে

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1013 বার পঠিত

দিন যায়, দিন আসে। স্বপ্নবিভোর মানুষ আপন গতিতে ছুটতে থাকে। অধরা জাগতিক স্বপ্নের পেছনে। ধোঁকাময় দুনিয়ার পিছনে। অন্যের সাথে লিপ্ত হয় হাস্যকর প্রতিযোগিতায়। পদ কিংবা সম্পদের। স্বার্থ কিংবা সুনামের। অর্থহীন কাজে আর খেল-তামাশায় ভীষণভাবে অপচয় করতে থাকে ‘সময়’ নামক মহামূল্যবান সম্পদ। ভুলে যায় তার আসল স্বপ্নের কথা। চিরন্তন গন্তব্যের কথা। ভুলে যায় জান্নাতের অফুরন্ত নে‘মতের কথা, জাহান্নামের কল্পনাতীত শাস্তির কথা। এই আত্মভোলা মানুষকে সচকিত করতেই যেন মহান আল্লাহর দরদী সতর্কবার্তা- হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেকেরই ভেবে দেখা উচিৎ যে, সে আগামীকালের জন্য কী অগ্রীম পাঠিয়েছে। ...আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহ্কে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহও তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। তারাই হ’ল পাপাচারী (হাশর ১৮-১৯)। তিনি আরো বলেন, তোমরা জেনে রেখ যে, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পারিক গর্ব প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয় (হাদীদ ২০)

মূলতঃ পৃথিবীর এই জীবনের দু’টি রূপ। একটি তার দৃশ্যমান কিন্তু ধোঁকাময় রূপ। অপরটি অদৃশ্য কিন্তু বাস্তব রূপ। পর্দার সামনে বসে থাকা দর্শক যেমন জানে না পর্দার পিছনে কি হচ্ছে, তেমনি দুনিয়াবী নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলো বোঝে না পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চের পিছনে অলক্ষ্যে কী ঘটছে। যদিও সে নিজেকে বড়ই বুদ্ধিমান ভাবে। অতঃপর একদিন যখন সময় ঘনিয়ে আসবে, চোখটা বন্ধ হওয়া মাত্রই মুহূর্তে সে সবকিছু বুঝে ফেলবে। চোখের সামনে থেকে ধোঁকাময় পর্দা যখন খুলে যাবে, সবকিছুর বাস্তবতা যখন স্বচক্ষে দেখতে পাবে, তখন আল্লাহ তাকে বলবেন, ‘তুমি তো এই দিবস সম্পর্কে উদাসীন ছিলে, এখন তোমার সামনে থেকে পর্দা উঠিয়ে নিয়েছি। সুতরাং এখন তোমার দৃষ্টিতে সবকিছু স্পষ্ট’ (ক্বাফ ২২)

প্রিয় পাঠক, আমাদের এই পার্থিব জীবনটা নিরেট পরীক্ষার জীবন। এই পরীক্ষার সিলেবাস, পাঠ্যক্রম সবার জন্য একই। প্রশ্ন ও উত্তরপত্রও একই। হিন্দু হোক, খ্রীষ্টান হোক, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই আমরা একই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থী। একজন সচেতন পরীক্ষার্থী যেমন সতর্কতার সাথে তার পরীক্ষার সিলেবাস সবচেয়ে সঠিক উপায়ে এবং যথাযথভাবে পূরণ করার জন্য সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালায়, হাযারো পরিকল্পনা সাজায়; ঠিক তেমনিভাবে একজন সচেতন মুসলিমকে নিজের জীবন পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরী করতে হয়, গড়ে তুলতে হয়।

সুতরাং আমরা যারা সচেতন, যারা জীবনটাকে প্রকৃত অর্থে গড়ে তুলতে চাই, তাদেরকে অবশ্যই জীবনকে সাজাতে হবে এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই।

কিভাবে সাজাবো? আমাদের সিলেবাস হ’ল- পবিত্র কুরআনের অন্যতম সংক্ষিপ্ত সূরা আল-আছর। এই সূরার একটি আয়াতের মধ্যেই সেই সিলেবাস আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আমাদের জন্য উল্লেখ করেছেন। যা নিম্নরূপ-

(১) এক আল্লাহর প্রতি বিশুদ্ধ ঈমান আনা : জীবনটাকে গড়তে হ’লে আমাদের সর্বপ্রথম কর্তব্য জীবনের দর্শন ঠিক করা। কারণ এই দর্শনের শুদ্ধতাই আমাদের চলার পথের শুদ্ধতা নির্ধারণ করে দেবে। এই দর্শনে ভুল থাকলে বাকী সবকিছুই ভুলে পরিণত হয়। এই দর্শনের মূল বিষয়বস্ত্ত হ’ল, নির্ভেজাল তাওহীদী আক্বীদা, যাতে এক আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ থাকে, তার সাথে অন্য কাউকে শরীক স্থাপন না করা হয়। এই দর্শনের মূল কথা হ’ল- আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি, একমাত্র আপনার কাছেই সাহায্য চাই। এই দর্শনের মূল রস হ’ল- সবকিছু কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করা, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়, ভিন্ন কোন স্বার্থে নয়, যার নাম ইখলাছ। এই দর্শনে চলার পথ হ’ল রিসালাত ও আখেরাত। রিসালাত হ’ল ছিরাতুল মুস্তাকীমের রাস্তা আর গন্তব্য হ’ল আখেরাত। এই তাওহীদ-রিসালাত-আখেরাত দর্শনই আমাদের জীবন গড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 

(২) সৎআমল করা : যা কিছু আল্লাহ করতে বলেছেন, তা করা; যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকার নামই সৎআমল। এই সৎআমলের দলীল হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর আনীত দু’টি মৌলিক জিনিস- কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। এই দলীল বোঝার মানদন্ড হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের বুঝ, যাকে বলা হয় মানহাজুস সালাফ। কোন আমলকে সৎআমল হ’তে গেলে অবশ্যই উপরোক্ত মানদন্ডে উত্তীর্ণ হ’তে হবে, নতুবা সেটা কখনই সৎআমল হবে না। সুতরাং জীবনটাকে সমৃদ্ধ করতে হ’লে নিজের আমলনামাকে ঐ সৎআমল দিয়ে সাজাতে হবে, যে সৎআমলগুলো রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক অনুমোদিত। সেই সাথে যাবতীয় পাপ ও অসৎকাজ থেকে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

(৩) মানুষকে কল্যাণের পথে দাওয়াত দেয়া : কেবল নিজেকে গড়া নয়, অন্যকেও জীবনগড়ার কাজে সহযোগিতা করা আমাদের অন্যতম কর্তব্য। যাতে আবার নিজের জন্যও রয়েছে অফুরান ছওয়াব। এমনকি যাকে সহযোগিতা করব, তার সমপরিমাণ ছওয়াব আমাদের নিজের আমলনামাতেও যুক্ত হ’তে থাকবে।

তবে শর্ত হ’ল- এই দাওয়াত হ’তে হবে রাসূল (ছাঃ)-এর দেখানো পথে, নিজেদের মত নয়। এই দাওয়াত হ’তে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, নিজের স্বার্থ হাছিলের জন্য নয়।

(৪) ধৈর্যধারণ করা : জীবন গড়ার এই পথ নিঃসন্দেহে সহজ নয়। প্রতি মুহূর্তে এখানে বাধা আসবে, মহাপ্রতিরোধ আসবে, চ্যালেঞ্জ আসবে। যে যত দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলবে, তাকে তত বেশী এই বাধা মোকাবিলা করতে হবে। এই বাধা মোকাবিলায় যেই বর্ম আমাদের সবচেয়ে বড় সুরক্ষা দেবে, তার নাম ধৈর্য, ধৈর্য এবং ধৈর্য। যে কোন মূল্যে জীবন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে হবে-এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে দাঁতে দাঁতে চেপে এই পথে টিকে থাকার নামই ধৈর্য। মনে রাখতে হবে জীবনটাকে সঠিকভাবে গড়ার পথে আমাদের সবচেয়ে শত্রু বড় হ’ল শয়তান। সে আমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আমাদের বিশ্বাসে সংশয় ঢুকিয়ে, অন্তরে কুমন্ত্রণা যুগিয়ে, শুবহাত ও শাহওয়াতের ঘোর লাগা চকচকে হাতিয়ার চালিয়ে সে সদা-সর্বদা ছুটছে তার ওয়াদা বাস্তবায়নের পথে- ‘আমি অবশ্যই পাপ ও অন্যায় কাজকে মানুষের কাছে সুশোভিত করে তুলব, তাদের সকলকেই বিপথগামী করে ছাড়ব। তবে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদের ছাড়া’ (হিজর ৩৯-৪০)

তাওহীদী আক্বীদা-বিশ্বাসে কুমন্ত্রণা ঢোকাতে পারা তার সবচেয়ে বড় সফলতা। ভক্তি আর যুক্তির চোরাস্রোত দিয়ে কোনভাবে যদি সে বিশ্বাসের ফাটল ধরাতে পারে। যদি শিরক আর বিদ‘আতের ফাঁদে আটকাতে পারে, যদি অন্তরে নিফাকীর ফর্মালিন ঢুকিয়ে দিতে পারে। তাহলেই সে সফল। যদি তাতে সফল না হয়, তখন সে আমাদের চলার পথে কাঁটা বিছায়, কখনও আমল নষ্ট করার চেষ্টা চালায়, কখনও আমলের ঘাটতি ঘটানোর চেষ্টায় অবিচল থাকে।

এরপরও যদি কোন বান্দা আক্বীদা ও আমলে শতভাগ সঠিক অবস্থান বজায় রাখার যুদ্ধে শয়তানকে পরাস্ত করে তখন সে সর্বশেষ চাল হিসাবে নিয়তটাকে নষ্ট করার সুযোগ নেয়। ভালো কাজ থেকে বিরত রাখতে না পারলে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যেন সেই ভালো কাজ যেন কোন মতেই আল্লাহর জন্য না হয়। আর এভাবে ভালো কাজের মধ্যেও ইখলাছটাকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ ও নিফাকীর বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দেয়। বান্দা যখন নিশ্চিত যে, এবার বোধহয় সে সফল হ’ল, শয়তানের হাত থেকে বোধহয় সে এখন নিরাপদ, ঠিক তখনই তাকে সর্বহারা করার এমন ভয়ংকর সুক্ষ্ম আয়োজন করে শয়তান (কাহফ ১০৩)

সুতরাং শয়তানের এই মহাপরিকল্পনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে ছবর বা নিরন্তর ধৈর্যের কোন বিকল্প নেই। যিনি যত বেশী ধৈর্য অবলম্বন করতে পারেন, তিনি তত বেশী ইস্তিকামাত অর্জন করতে পারেন। শয়তানের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা ততবেশী তার বৃদ্ধি পায়।

এখানে আরো একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হ’ল, আমাদের জীবনটা বড়ই বৈচিত্রময়। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন হাযারো রং ও বর্ণের মানুষ আমাদের মাঝে সৃষ্টি করেছেন। কাউকে ধনী করেছেন, কাউকে করেছেন দরিদ্র। কাউকে সুবিধাভোগী করেছেন, কাউকে সুবিধাহীন। সবকিছু মিলিয়ে এ জীবনে আনন্দ আসবে, হতাশা আসবে। আক্ষেপ থাকবে, অভিমান থাকবে। পাপ থাকবে, ইস্তিগফার থাকবে। ভুল থাকবে, তওবা থাকবে। উত্থান আসবে, পতন আসবে। স্বচ্ছলতা আসবে, দারিদ্র্য আসবে। এসবই জীবনের নিত্য অনুষঙ্গ। সুতরাং জীবনের কোন একটা সময় হয়ত মনে হ’তে পারে, জীবনটা কি আসলে দুঃখময়? জীবনে চূড়ান্ত সুখ বলে কি কিছু নেই?

হ্যাঁ, এই পৃথিবীর জীবন সেই অর্থে পুরোপুরি সুখের কখনই হবে না। কেননা দুনিয়া চিরস্থায়ী জায়গা নয়। চিরস্থায়ী সুখের জায়গা একমাত্র জান্নাত। তবুও এ জীবনে সর্বাবস্থায় একটা সুখময় অনুভূতির জায়গা আল্লাহ রেখেছেন। যার পাসওয়ার্ডটা জানা আমাদের জন্য যরূরী। আর তা হ’ল- (১) সর্বাবস্থায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, যা আসে তাক্বদীরের প্রতি বিশ্বাস তথা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্টি থেকে। (২) নিয়মিত ধৈর্য ধারণের অনুশীলন করা, যা আসে তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর প্রতি আশাবাদী ভরসা থেকে। সুতরাং জীবনটাকে গড়তে চাইলে আমাদেরকে শুকরিয়া ও ছবরের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান অর্জন করতে হবে (মুসলিম হা/২৯৯৯)

অতএব প্রিয় বন্ধুগণ! আসুন আমরা আখেরাতের জন্য বাঁচি। প্রতিটি সময়কে আখেরাতের জন্য ব্যয় করি। আসুন জীবনের পরিকল্পনাটা আমরা এমনভাবে সাজাই, যেন আখেরাতের সফলতাই আমাদের মূখ্য হয়। শুধু তাই নয়, আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ যেন আমাদের দ্বারা উপকৃত হয়। সবাইকে নিয়ে যেন আমরা জান্নাতের মহাসফলতা অর্জন করতে পারি। এটাই সর্বোত্তম পরিবার ও সমাজ পরিকল্পনা। এটা সমাজ বিপ্লবের মৌলিক সংগ্রাম (সূরা ছফ ১০-১৩)। এমন জীবন যেন আমরা না গড়ি, যাতে পৃথিবীতে আমাদের আসা না আসা সমান হয়ে যায়। এমন জীবন যেন না হয়, যে জীবন খালি হাতে এসেছে, আবার খালি হাতে ফিরে গেছে, কিছুই নিতে পারেনি। এত বড় ব্যর্থতা নিয়ে যেন আমরা জীবনটা শেষ না করি। আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন আমাদের সকলকে দুনিয়াবী জীবন সঠিক পথে গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন এবং পরকালীন জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন তথা জান্নাতুল ফেরদাঊসের পথে পরিচালিত করুন। আমীন!



বিষয়সমূহ: আদর্শ জীবন
আরও