নবী ও রাসূলগণের দাওয়াতের মূলনীতি (শেষ কিস্তি)
আবু সাঈদ
ইহসান ইলাহী যহীর 4151 বার পঠিত
ছোটদের সাথে রসিকতা : আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদের সঙ্গে মিশতেন। এমনকি আমার ছোট ভাই আবু ওমায়ের, একটি ‘নুগায়ের’ অর্থাৎ লাল ঠোঁট বিশিষ্ট চড়ুই বা বুলবুলী জাতীয় পাখি পুষতো। যা নিয়ে সে খেলা করত। রাসূল (ছাঃ) যখন এসে তাকে খেলতে দেখতেন, তখন বলতেন, يَا أَبَا عُمَيْرٍ! مَا فَعَلَ النُّغَيْرُ؟ ‘ওহে আবু ওমায়ের! তোমার নুগায়ের কি করেছে?[1]
কল্যাণকামী সংগঠনে মুহাম্মাদ (ছাঃ) :
১০ বছর যাবৎ চলমান ফিজার যুদ্ধের ভয়াবহতা স্বচক্ষে দেখে মক্কায় শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে এবং নিপীড়িত মানুষের সাহায্যার্থে দয়াশীল মুহাম্মাদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। যেন ভবিষ্যতে এরূপ ধ্বংসাত্মক ঘটনা আর না ঘটে, সেজন্য তিনি দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেন। গড়ে তোলেন ‘হিলফুল ফুযূল’ (حِلْفُ الْفُضُولِ) বা ‘অনুগ্রহকারীদের সংঘ’ নামক সংগঠন। কুরাইশগণ একে (حِلْفَ الْمُطَيَّبِينَ) ‘শ্রেষ্ঠ লোকদের সংগঠন’ বলেও নামকরণ করত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হিলফুল ফুযূল-এর গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন,شَهِدْتُ حِلْفَ الْمُطَيَّبِينَ مَعَ عُمُومَتِى وَأَنَا غُلاَمٌ، فَمَا أُحِبُّ أَنَّ لِى حُمْرَ النَّعَمِ وَأَنِّى أَنْكُثُهُ- ‘আমার চাচাদের সঙ্গে আমি হিলফুল ফুযূলে অংশগ্রহণ করি, যখন আমি বালক ছিলাম। সুতরাং মূল্যবান লাল উটের বিনিময়েও উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করতে আমি রাযী নই’।[2]
নারীদের অধিকার সংরক্ষণ :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন প্রেরিত হ’লেন, তখন গোটা পৃথিবীতে নারীদের অধিকার পদে পদে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল। সে সময় স্বেচ্ছায় কোন নারীর বেঁচে থাকারও অধিকার ছিল না। এমনই পরিস্থিতিতে রহমতের নবী নারীদের অধিকার সংরক্ষণ করেছেন। তিনি বলেন,مَنْ كَانَ لَهُ ثَلاَثُ بَنَاتٍ فَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ فَأَطْعَمَهُنَّ وَسَقَاهُنَّ وَكَسَاهُنَّ مِنْ جِدَّتِهِ كُنَّ لَهُ حِجَاباً مِّنَ النَّارِ- ‘যার তিনটি কন্যা সন্তান রয়েছে, তাতে সে ধৈর্যধারণ করে। অতঃপর সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী তাদেরকে খাদ্য-পানীয় ও পোষাকাদি প্রদান করে, তাহ’লে তার জন্য তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,مَنِ ابْتُلِىَ بِشَىْءٍ مِّنَ الْبَنَاتِ فَصَبَرَ عَلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ حِجَابًا مِّنَ النَّارِ- ‘যাকে কন্যাসন্তান দ্বারা পরীক্ষা করা হয়েছে, সে যদি ধৈর্যধারণ করে, তাহ’লে তার জন্য তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে’।[3]
হোনায়েন যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈকা নারীর লাশ দেখতে পেয়ে বলেন, ‘এ মহিলা তো যোদ্ধা নয়’। রাসূল (ছাঃ) খালেদ বিন ওয়ালীদকে খবর পাঠান,قُلْ لِخَالِدٍ لاَ يَقْتُلَنَّ امْرَأَةً وَلاَ عَسِيفًا- ‘খালেদকে বল, কেউ যেন কোন নারী ও নিরীহ সেবককে হত্যা না করে’।[4]
নারী স্বাধীনতা :
মা-ভগিনীগণ যখন পর্দা বজায় রেখে বৈধ কাজ-কর্ম সম্পাদন করবেন, তাতে দোষের কিছু নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্যতম স্ত্রী যয়নব বিনতে খুযায়মা (রাঃ) স্ব-হস্তে চামড়া পাকানোর কাজ করে অর্থ উপার্জন করতেন ও তার মূল্য ফকীর-মিসকীনদের ছাদাক্বা করতেন।[5] স্ব-হস্তে উপার্জন করে অধিক দানশীলা ও গরীবের দরদী হিসাবে তিনি ‘উম্মুল মাসাকীন’ বা ‘অসহায়দের মা’ নামে পরিচিত ছিলেন।[6] কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর স্ত্রীকে কখনো বারণ করেছেন বা কাজে নিরুৎসাহিত করেছেন, এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং তিনি তাঁর স্ত্রীর এ মহৎ গুণাবলীর জন্য তাঁকে أَطْوَلُكُنَّ يَدًا، বা ‘দানশীলতায় তোমাদের মধ্যে দীর্ঘ হাত বিশিষ্ট’ অর্থাৎ উদারহস্ত বলে উৎসাহিত করেছেন।[7] নিঃসন্দেহে এতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক নারী স্বাধীনতা প্রদানের প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
নবীজীর দৃঢ়চিত্ততার প্রশিক্ষণ :
খাববাব ইবনুল আরাত (রাঃ) আল্লাহর পথে কঠিন নির্যাতন ভোগ করেছেন। মুসলমান হওয়ার অপরাধে মুশরিকরা তার উপর লোমহর্ষক নির্যাতন চালায়। নানাবিধ নির্মম অত্যাচারের মধ্যে সবচাইতে মর্মান্তিক ছিল এই যে, তাকে প্রজ্বলিত লৌহখন্ডের উপরে চিৎ করে শুইয়ে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। তার পিঠের চামড়া ও গোশত পুড়ে গলে যাবার ফলে লোহার আগুন নিভে গিয়েছিল। বারবার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট গমন করেন। তখন তিনি কা‘বা চত্বরে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করার জন্য আকুলভাবে নিবেদন করেন। তখন উঠে রাসূল (ছাঃ) রাগান্বিত হয়ে দ্বীনের জন্য বিগত উম্মতগণের কঠিন নির্যাতন ভোগের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দেন ও তাদের দ্বীনের উপর দৃঢ়চিত্ততার প্রশিক্ষণ দিয়ে বলেন,كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِى الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ، فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ، مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ،... وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ- ‘বিগত জাতি সমূহের লোকদের দ্বীনের কারণে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। অতঃপর তাতে পুঁতে দিয়ে তাদের মাথার মাঝখানে করাত দিয়ে শরীরকে দুই টুকরা করে চিরে ফেলা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও তাদেরকে দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। লৌহ চিরুনী দ্বারা গোশত ও শিরা-উপশিরা অস্থি হ’তে আলাদা করা হয়েছে। তথাপিও এগুলো তাদেরকে দ্বীন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ...কিন্তু তোমরা খুবই তাড়াহুড়া করছ’।[8] নবীজীর দৃঢ়চিত্ততার এ প্রশিক্ষণ পেয়ে ছাহাবীগণের ঈমান বহুগুণে বেড়ে যায়।
নীতি-নৈতিকতা :
তৎকালীন আরবে নীতি-নৈতিকতা ও ইনছাফের হিসাব করা হ’ত শুধু নিজ বংশ, গোত্র, বর্ণ ও আত্মীয়তার মধ্যে এবং এখনো সারাবিশ্বে তাই চলছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই সকল ব্যবধানকে মূলোৎপাটন করে নীতি-নৈতিকতা ও ইনছাফের এমন বিধান প্রবর্তন করেন যে, এক্ষেত্রে কারো বংশ-মর্যাদা, ধনী-দরিদ্র, দল, গোত্র ও রাষ্ট্র বাধা হ’তে পারেনি। যার মাধ্যমে সকল শ্রেণীর মানুষ ন্যায়বিচার পেয়েছিল।
একদা মাখযূম গোত্রের ফাতেমা নাম্নী জনৈকা মহিলা চুরির অপরাধে ধৃত হ’ল। নবীর আদালতে হাত কর্তনের দন্ড জারী করা হ’ল। রাসূলের স্নেহভাজন ছাহাবী উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) কর্তৃক দন্ডবিধি মওকূফের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে সুফারিশ করা হ’ল। যেন এমন সম্মানিতা একজন মহিলাকে এত বড় একটি হীনকর শাস্তি প্রদান করা না হয়। আল্লাহর দন্ডবিধি সমূহ বাস্তবায়নে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিরপেক্ষ বিচারে তাঁর মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ফুটে উঠেছিল। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সেদিন বলেছিলেন,وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا- ‘আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কর্তন করব’।[9]
সমাজ কল্যাণমূলক কাজে সহযোগিতা :
রাসূল (ছাঃ) কেবলমাত্র একজন সফলতম দা‘ঈ ছিলেন না, তাঁর তৎপরতা ছিল সকল মানবিক ও সেবামূলক কাজেও। যার মাধ্যমে মুসলিম-অমুসলিম সকলেই উপকৃত হ’ত। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, মদীনায় একজন ইহূদী ছিল। সে আমাকে আমার খেজুর পাড়ার মেয়াদ পর্যন্ত কর্য দিত। ...একবার আমি কর্য পরিশোধে এক বছর বিলম্ব করলাম। এরপর খেজুর নামানোর সময়ে ইয়াহূদী আমার কাছে আসল। আমি তখনও খেজুর সংগ্রহ করতে পারিনি। আমি তার কাছে আগামী বছর পর্যন্ত সময় চাইলে সে অস্বীকার করল। এ খবর নবী করীম (ছাঃ)-কে জানানো হ’ল। তিনি ছাহাবীদের বললেন, চল জাবেরের জন্য ইহূদী থেকে সময় নেই। তারপর তাঁরা আমার বাগানে আসলেন। নবী করীম (ছাঃ) ইহূদীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললেন। সে বলল, হে আবুল ক্বাসেম! আমি তাকে আর সময় দেব না। নবী করীম (ছাঃ) তার একথা শুনে উঠলেন এবং বাগানটির চারদিকে ঘুরে তার কাছে এসে আবার আলাপ করলেন। সে এবারও অস্বীকার করল। ...তখন তিনি দ্বিতীয়বার খেজুর বাগানে গেলেন এবং বললেন,يَا جَابِرُ جُدَّ وَاقْضِ، فَوَقَفَ فِى الْجَدَادِ فَجَدَدْتُ مِنْهَا مَا قَضَيْتُهُ وَفَضَلَ مِنْهُ فَخَرَجْتُ حَتَّى جِئْتُ النَّبِىَّ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَبَشَّرْتُهُ فَقَالَ : إِشْهَدْ أَنِّى رَسُولُ اللهِ- ‘হে জাবের! তুমি খেজুর সংগ্রহ কর এবং ঋণ পরিশোধ কর’। এই বলে তিনি খেজুর পাড়ার স্থানে বসলেন। আমি গাছ থেকে খেজুর নামিয়ে ইহূদীর পাওনা পরিশোধ করলাম। এরপর আরও খেজুর উদ্বৃত্ত রইল। আমি বেরিয়ে এসে নবী (ছাঃ)-কে এ সুসংবাদ দিলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি সাক্ষী থাক যে, অবশ্যই আমি আল্লাহর রাসূল’।[10]
মযলূমের হক আদায়ে সোচ্চার :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পবিত্র জীবনের আরেকটি উজ্জ্বলতম দিক হ’ল, কারও পেরেশানী দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন এবং এগিয়ে গিয়ে তা দূর করার চেষ্টা করতেন। একবার ইরাশ (إرَاش) গোত্রের জনৈক ব্যক্তি একটি উট নিয়ে মক্কায় এল। আবু জাহল তার কাছ থেকে উটটি খরিদ করল, কিন্তু মূল্য পরিশোধ করতে গড়িমসি করছিল। শেষে ব্যর্থ হয়ে একদিন কা‘বা চত্বরে এসে কুরাইশ নেতাদের কাছে পাওনাদি ফেরত পেতে আবেদন করল। কিন্তু তাদের কেউই আবু জাহলের বিপক্ষে ঐ ব্যক্তির ফরিয়াদ আমলে নিল না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই অপরিচিত এক ব্যক্তির আবেদনে সাড়া দিলেন এবং আবু জাহলের কাছ থেকে তার প্রাপ্য আদায় করে দিলেন।[11]
সহমর্মিতার মহান শিক্ষা :
রাসূল (ছাঃ) স্বীয় ছাহাবী ও উম্মতের প্রতি অতি সহমর্মী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ كَتَبَ الإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذِّبْحَةَ وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ وَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ- ‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ইহসান অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে, আর যখন যবেহ করবে তখন দয়ার সঙ্গে যবেহ করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার যবেহকৃত প্রাণীকে কষ্টে না ফেলে’।[12]
হিশাম বিন যায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আনাস (রাঃ)-এর সাথে হাকাম বিন আইয়ূবের কাছে গেলাম। তখন আনাস (রাঃ) দেখলেন, কয়েকজন বালক বা তরুণ একটি মুরগী বেঁধে তার দিকে তীর ছুঁড়ছে। আনাস (রাঃ) বললেন, نَهَى النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ تُصْبَرَ الْبَهَائِمُ- ‘নবী করীম (ছাঃ) প্রাণীদেরকে বেঁধে এভাবে তীর ছুঁড়তে নিষেধ করেছেন’।[13]
রাসূল (ছাঃ)-এর দানশীলতা :
হুনাইনের যুদ্ধ শেষে রাসূল (ছাঃ) ফিরছিলেন এমতাবস্থায় যে, তাঁর গায়ে ছিল মোটা ঝালরযুক্ত নাজরানী চাদর। এসময় কতিপয় বেদুঈন তাঁর অনুসরণ করে তাঁর নিকট চাইতে থাকল। অতঃপর তারা তাঁকে একটি বৃক্ষের দিকে নিয়ে আসল, তারপর তিনি স্বীয় সওয়ারীর উপর থাকা অবস্থায় তাঁর চাদর নিয়ে নেওয়া হ’ল। অতঃপর জনৈক বেদুঈন তাকে ধরে সজোরে টানতে লাগল। যাতে রাসূল (ছাঃ)-এর ঘাড়ে জোরে টানের চোটে চাদরের ঝালরের দাগ লেগে গেল। তারপর বেদুঈন বলে উঠল, হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে যে সম্পদ আছে, তা থেকে আমাকে দানের আদেশ দাও। তিনি তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন ও তাকে সেখান থেকে কিছু দেওয়ার আদেশ দিলেন। তিনি বলেন,أَعْطُونِى رِدَائِى، لَوْ كَانَ لِى عَدَدُ هَذِهِ الْعِضَاهِ نَعَمًا لَقَسَمْتُهُ بَيْنَكُمْ، ثُمَّ لاَ تَجِدُونِى بَخِيلاً وَلاَ كَذُوبًا وَلاَ جَبَانًا- ‘আমাকে আমার চাদর ফিরিয়ে দাও, আমার উপর কি তোমরা কৃপণতার ভয় কর? তিনি আবার বললেন, আল্লাহর শপথ! আমার নিকট যদি এ বৃক্ষসমূহ পরিমাণও পশু থাকত তবুও আমি তা তোমাদের মাঝে বিতরণ করে দিতাম। তথাপিও তোমরা আমাকে কৃপণ হিসাবে পেতে না, মিথ্যাবাদী পেতে না, কাপুরুষ পেতে না’।[14]
কেউ যদি ইসলামের দোহাই দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট কিছু চাইত, তবে তিনি অবশ্যই তাকে দিতেন। একবার এক ব্যক্তি এসে তার নিকট চাইলে, তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত এক পাল বকরী প্রদান করলেন। সে ব্যক্তি স্বজাতির নিকট গিয়ে বলল,يَا قَوْمِ أَسْلِمُوا فَإِنَّ مُحَمَّدًا يُعْطِى عَطَاءً مَنْ لاَّ يَخَافُ الْفَقْرَ- ‘হে আমার জাতি! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। কেননা মুহাম্মাদ (ছাঃ) এমনভাবে দান করেন যে, তাতে অভাবের আশঙ্কা করেন না’।[15]
মনুষ্যত্বের প্রশিক্ষক :
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رضى الله عنه أَنَا، قَالَ : فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رضى الله عنه أَنَا، قَالَ : فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رضى الله عنه أَنَا، قَالَ : فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا؟ قَالَ أَبُو بَكْرٍ رضى الله عنه أَنَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- مَا اجْتَمَعْنَ فِى امْرِئٍ إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ- ‘আজ তোমাদের মধ্যে কে ছিয়াম পালনকারী হিসাবে ভোরে উঠেছে? উত্তরে আবু বকর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে কোন জানাযার ছালাতে শরীক হয়েছে? আবু বকর বললেন, আমি। আবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে কে কোন দরিদ্রকে খাবার দিয়েছে? আবু বকর বললেন, আমি। পুনরায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আজ কে তোমাদের মধ্যে কোন রোগীকে দেখতে গিয়েছে? এবারও আবু বকর বললেন, আমি। এটা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এতগুলো সদগুণ যার মধ্যে একত্র হবে, সে ব্যক্তি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[16]
অধীনস্তদের প্রতি সদাচরণকারী :
অধীনস্তদের প্রতি সদাচরণের ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর ভূমিকা মানব ইতিহাসের বিরল ঘটনা। যেমন আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি আমার এক গোলামকে প্রহার করার সময় পেছন দিক থেকে এরূপ শব্দ শুনতে পেলাম যে,اعْلَمْ أَبَا مَسْعُودٍ، اعْلَمْ أَبَا مَسْعُودٍ، فَالتَفَتُّ، فَإِذَا أَنَا بِرَسُولِ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَقَالَ : وَاللهِ لَلَّهُ أَقْدَرُ عَلَيْكَ مِنْكَ عَلَيْهِ- ‘হে আবু মাসঊদ! আল্লাহ তোমার উপর তার চাইতেও অধিক ক্ষমতা রাখেন, যেমন তুমি এর উপর রাখ! তখন আমি ফিরে দেখি যে, তিনি হ’লেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সে আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ। তখন নবী করীম (ছাঃ) বলেন,أَمَا لَوْ لَمْ تَفْعَلْ لَلَفَحَتْكَ النَّارُ، أَوْ لَمَسَّتْكَ النَّارُ- ‘যদি তুমি এরূপ না করতে, তবে জাহান্নামের আগুন তোমাকে অবশ্যই স্পর্শ করত’।[17]
আনাস (রাঃ) বলেন,خَدَمْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ سِنِينَ، وَاللهِ مَا قَالَ لِى أُفًّا قَطُّ، وَلاَ قَالَ لِى لِشَىْءٍ لِمَ فَعَلْتَ كَذَا وَهَلاَّ فَعَلْتَ كَذَا؟ ‘আল্লাহর শপথ! আমি নয় বছর রাসূল (ছাঃ)-এর সেবায় নিয়োজিত ছিলাম। কিন্তু আমার জানা নেই যে, কোন কাজ আমি করেছি, অথচ তিনি সে ব্যাপারে বলেছেন, এরূপ কেন করলে? কিংবা কোন কাজ করিনি, সে ব্যাপারে বলেছেন, কেন অমুক কাজটি করলে না’?[18]
গৃহপরিচারিকার সাথে সদাচরণ করার জন্যও রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا أَتَى أَحَدَكُمْ خَادِمُهُ بِطَعَامِهِ، فَإِنْ لَمْ يُجْلِسْهُ مَعَهُ، فَلْيُنَاوِلْهُ لُقْمَةً أَوْ لُقْمَتَيْنِ أَوْ أُكْلَةً أَوْ أُكْلَتَيْنِ، فَإِنَّهُ وَلِىَ عِلاَجَهُ- ‘তোমাদের কারো খাদেম যখন তার খাবার নিয়ে আসে, তখন তাকে যদি সাথে না বসায় তাহ’লে সে যেন তাকে এক লোকমা বা দুই লোকমা খাবার দেয়। কেননা সে তার গরম ও কষ্ট সহ্য করেছে’।[19]
আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) একদা মাটি থেকে এক খন্ড কাঠি অথবা অন্য কোন বস্ত্ত নিয়ে বললেন, তাকে আযাদ করার মধ্যে এর সমপরিমাণ পুণ্যও নেই। কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ لَطَمَ مَمْلُوْكَهُ أَوْ ضَرَبَهُ فَكَفَّارَتُهُ أَنْ يُّعْتِقَهُ- ‘যে ব্যক্তি নিজ ক্রীতদাসকে চপেটাঘাত করল অথবা প্রহার করল, এর কাফফারা হ’ল তাকে মুক্ত করে দেওয়া’।[20] এটা হচ্ছে ক্রীতদাসের সাথে ইসলাম নির্দেশিত আচরণ।
পরিবারের সদস্যদের সাথে সদাচরণকারী :
আয়েশা (রাঃ) বলেন,مَا ضَرَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَيْئًا قَطُّ بِيَدِهِ وَلاَ امْرَأَةً وَلاَ خَادِمًا إِلاَّ أَنْ يُّجَاهِدَ فِى سَبِيلِ اللهِ وَمَا نِيلَ مِنْهُ شَىْءٌ قَطُّ فَيَنْتَقِمَ مِنْ صَاحِبِهِ إِلاَّ أَنْ يُّنْتَهَكَ شَىْءٌ مِّنْ مَحَارِمِ اللهِ فَيَنْتَقِمَ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বহস্তে কোন দিন কাউকে প্রহার করেননি, কোন নারীকেও না, খাদেমকেও না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ব্যতীত। আর যে তাঁর অনিষ্ট করেছে তার থেকে প্রতিশোধও নেননি। তবে আল্লাহর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এমন বিষয়ে তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন’।[21]
শিশুদের প্রতি স্নেহশীলতা :
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُؤْتَى بِالصِّبْيَانِ فَيُبَرِّكُ عَلَيْهِمْ وَيُحَنِّكُهُمْ فَأُتِىَ بِصَبِىٍّ فَبَالَ عَلَيْهِ فَدَعَا بِمَاءٍ فَأَتْبَعَهُ بَوْلَهُ وَلَمْ يَغْسِلْهُ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে শিশুদেরকে আনা হ’ত। তিনি তাদের জন্যে বরকত ও কল্যাণের দো‘আ করতেন এবং ‘তাহনীক’ (মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবিয়ে মুখে দিতেন) করতেন। একদিন একটি শিশুকে আনা হ’ল, তিনি তাকে কোলে তুলে নিলেন। শিশুটি তাঁর কোলে প্রস্রাব করে দিল, পরে তিনি পানি চেয়ে নিলেন এবং প্রস্রাবের উপর কেবল পানির ছিটা দিলেন, আর তা পরিষ্কার করলেন না’।[22]
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,أن النبي صلى الله عليه و سلم كَانَ يَزُوْرُ الأَنْصَارَ وَيُسَلِّمُ عَلَى صِبْيَانِهِمْ وَيَمْسَحُ رُؤُوْسَهُمْ- ‘নবী করীম (ছাঃ) আনছারদের বাড়ীতে গমন করতেন এবং তাদের বাচ্চাদেরকে সালাম দিতেন। আর তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন’।[23]
উপসংহার : মানুষ বিভিন্ন মিডিয়ার বদৌলতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ধারণ করে আধুনিক হচ্ছে। নিত্যনৈমিত্তিক সকল চাহিদার বিষয় মুহূর্তেই হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম হচ্ছে। আধুনিকতার সকল দিক ও বিভাগ চর্চার মাধ্যমে বর্তমান পৃথিবীতে তাল-মিলিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে দিন দিন উত্তম চরিত্র ও মনুষ্যত্বের মানবিক গুণাবলী লোপ পাচ্ছে। মানুষের এই অসুস্থ চরিত্রকে সুস্থ করার একমাত্র উপায় হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। মানুষ যতদিন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর গুণে গুণান্বিত না হবে ততদিন আদর্শ মানুষ হ’তে পারবে না। আল্লাহ আমাদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর মহৎ গুণাবলীর আলোকে সার্বিক জীবন ঢেলে সাজানোর তাওফীক দান করুন-আমীন!
[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ এবং পিএইচ.ডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]
[1]. বুখারী হা/৬১২৯; মুসলিম হা/২১৫০ (৩০); মিশকাত হা/৪৮৮৪।
[2]. আহমাদ হা/১৬৫৫, ১৬৭৬; ছহীহাহ হা/১৯০০; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৬৭; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৩৭৩; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/১৩৪৫৯; দ্র. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ৭৫ পৃ.।
[3]. আহমাদ হা/১৭৪৩৯; তিরমিযী হা/১৯১৩; ইবনু মাজাহ হা/৩৬৬৯; ছহীহাহ হা/২৯৪, ১০২৭।
[4]. আহমাদ হা/১৬০৩৫; আবুদাঊদ হা/২৬৬৯; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৭৯১; ছহীহাহ হা/৭০১; মিশকাত হা/৩৯৫৫।
[5]. মিরক্বাত হা/১৮৯০-এর ব্যাখ্যা ৬/৩০২; মির‘আত হা/১৮৭৫-এর ব্যাখ্যা, ৪/১৩২৫ পৃ.।
[6]. হাকেম হা/৬৮০৫-৬; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/১৩৮০৫; ত্বাবারাণী, মু‘জামুল কাবীর হা/১৪৮; নায়লূল আওত্বার ৬/১৭৯।
[7]. বুখারী হা/১৪২০; আহমাদ হা/২৪৯৪৩; মিশকাত হা/১৮৭৫।
[8].বুখারী হা/৩৮৫২, আবুদাঊদ হা/২৬৪৯, মিশকাত হা/৫৮৫৮।
৯.বুখারী হা/৩৪৭৫, ৩৭৩৩, ৪৩০৪, ৬৭৮৭; মুসলিম হা/১৬৮৮-৯; আহমাদ হা/১৫১৮৮; আবুদাঊদ হা/৪৩৭৩; তিরমিযী হা/৪৩০; নাসাঈ হা/৪৮৯৯; ইবনু মাজাহ হা/২৫৪৭; মিশকাত হা/৩৬০৭, ৩৬১০।
[10]. বুখারী হা/৫৪৪৩; আবুদাঊদ হা/২৮৮৪।
[11]. সীরাতে ইবনু কাছীর ১/৪৬৯; সীরাতে ইবনু ইসহাক ১/৬৭; সীরাতে ইবনে হিশাম ২/২৩৩; বায়হাক্বী দালায়েল হা/৫০১; আল-বিদায়াহ ৩/৪৫ পৃ.।
[12]. নাসাঈ হা/৪৪০৫; তিরমিযী হা/১৪০৯।
[13]. বুখারী হা/৫৫১৩; মুসলিম হা/১৯৫৬; আবু দাউদ হা/২৮১৬।
[14]. বুখারী হা/২৮২১; আহমাদ হা/১৬৭৫৬; ত্বাবারাণী কাবীর হা/১৫৫২।
[15]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৫০২; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/২৩৭১।
[16]. মুসলিম হা/১০২৮, মিশকাত হা/১৮৯১।
[17]. মুসনাদ আহমাদ হা/২২৪০৪; মুসলিম হা/১৬৫৯।
[18]. মুসলিম হা/২৩০৯।
[19]. বুখারী হা/৫৪৬০; মুসলিম হা/১৬৬৩।
[20]. মুসলিম হা/১৬৫৭; আবু দাউদ হা/৫১৬৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫২৭।
[21]. মুসলিম হা/২৩২৮; মিশকাত হা/৫৮১৮।
[22]. মুসলিম হা/২৮৬; মিশকাত হা/৪১৫০।
[23]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৫৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৯৪৭।