দুর্নীতির বিষবাষ্প : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

আব্দুল্লাহ আল-মুছাদ্দিক 808 বার পঠিত

ভূমিকা : বাংলাদেশ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ। গত ১৩ বছরে দেশের মোট গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ। বাংলাদেশের এই ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির উল্টো পিঠে লুকিয়ে আছে আরেক বিস্ময়। একদিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, আরেক দিকে উচ্চ দুর্নীতি। সুশাসনের সংকট, ঘুষ, দুর্নীতি, পরিবেশগত নানান বিপর্যয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব ইত্যাদি কারণে বিশ্বব্যাপী যত সূচকই প্রকাশ পায়, প্রায় সবকটিতেই বাংলাদেশ অনেক যোজন যোজন পিছিয়ে থাকে। দুর্নীতি উন্নয়নশীল দেশসমূহের গলার কাটা সদৃশ। রাষ্ট্রযন্ত্র এবং দুর্নীতি যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অক্সিজেন ব্যতিরেকে যেমন মানবদেহ অসার ও তেমনি অকার্যকর ঘুষ ছাড়া অফিসের ফাইল হস্তান্তর কল্পনাতীত। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক কোন শিরোপা না থাকলেও দুর্নীতিতে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। নিম্নে দুর্নীতির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এবং তা থেকে উত্তরণের কতিপয় দিক আলেচিত হ’ল।

দুর্নীতির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ : বাংলাদেশ কোন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভূস্বর্গ নয়। দেশটির দরিদ্র জনসংখ্যার ভারে নুব্জ কাঁধ এখনো সোজা হয়নি। রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ, প্রহসনমূলক গণতন্ত্র এবং দুর্নীতির বুভুক্ষা এদেশের মানুষের আষ্টেপিষ্টে লেগে অস্থিমজ্জায় মিলেমিশে একাকার। বঙ্গদেশে দুর্নীতির ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রায় দুই হাযার বছর পূর্বে দুর্নীতির হদিস পাওয়া যায়। রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজ উপদেষ্টা চাণক্য তার অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে লিখেন, ‘সরকারী কর্মচারীরা দু’ভাবে বড় লোক হয়। তারা হয় সরকারের সাথে প্রতারণা করে অথবা প্রজাদের উপর অত্যাচার করে’। অর্থশাস্ত্রের দু’টি অনুচেছদে লেখা হয়েছে, জিহবার ডগায় মধু থাকলে তা চেটে না থাকা যেমন অবাস্তব, তেমনি অবাস্তব হ’ল সরকারী তহবিল লেনদেন করে এতটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা’[1] কবিকঙ্কণ খ্যাত ষোড়শ শতকের বাঙ্গালী কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সেজন্য লিখেছেন,

সরকার হইলো কাল,

খিল ভূমি লিখে লাল।

বিনা উপকারে খায় ধুতি\

এসব বর্ণনায় দুর্নীতির বিবরণ পাওয়া গেলেও মূলত এদেশে মোটাদাগে দুর্নীতির সূত্রপাত হয় ইংরেজ শাসনামলে। সব ইংরেজ লর্ডরা দুর্নীতিবাজ না হলেও তারা এদেশে যে শাসনব্যবস্থা চালু করেছিল তা দুর্নীতির মহোৎসবের সমারোহ ঘটায়। ইংরেজ শাসনামলের পূর্বে মুসলিম আমল পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় ২৬ শতাংশ জিডিপির অধিকারী ছিল এ উপমহাদেশ। কিন্তু ইংরেজদের লুটপাট এবং পাচারতন্ত্রে ধন-সম্পদে নরক খ্যাত এদেশ অতি অল্প সময়ে কয়েকটি ভয়াল দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করে। যাতে এদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক মৃত্যুবরণ করে। সেদিকে ইঙ্গিত করে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয় না, হয় বণ্টনের অভাবে’।[2]

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দুর্নীতির চিত্র :

পাটিগণিতে প্রায়ই চৌবাচ্চা সংক্রান্ত প্রশ্ন দেখতে পাওয়া যায়। যেমন একটি চৌবাচ্চায় ৫০ লিটার পানি ধরে। তাতে দু’টি ফুটো আছে। একটি ফুটো দিয়ে মিনিটে দুই লিটার পানি বের হয়ে যায়, আরেকটি দিয়ে মিনিটে তিন লিটার বের হয়ে যায়। প্রতি মিনিটে ঐ চৌবাচ্চায় বালতি দিয়ে ১০ লিটার পানি ঢাললে কতক্ষণে তা ভর্তি হবে? চিন্তা করেন কী ভয়ানক সমস্যা! এক দিকে বালতি দিয়ে পানি ঢালা হচ্ছে, অন্য দিকে দুই ফুটো দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছে। দুর্বোধ্য সেই পানি ঢালাঢালি বিষয়ক অঙ্ক করার সময় ভাবতাম ফুটো বন্ধ না করে আমি পানি ঢালতে যাব কেন? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে দেশবাসীকে দুর্ভিক্ষের অগ্রিম খবর দেওয়া হচ্ছে। জনগণকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সরকারী কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণও সীমিত করা হচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে পত্রিকায় নিউজ আসে, ‘বাড়ি পাচ্ছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব। খরচ ধরা হয়েছে ৪৩ কোটি টাকা’। প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে সাড়ে ২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রতিটি বাসভবনে দুই সেট সুইমিং পুল হবে। শুধুমাত্র এই পুলের খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। সম্পূর্ণ টাকার জোগান দিবে রাষ্ট্রীয় তহবিল’।[3]

এই সংবাদ সম্পূর্ণ চৌবাচ্চার অঙ্কের মত দু’টি ফুটো খোলা রেখে উপর থেকে পানি ঢালার মত। অথচ যখন আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ) খেলাফতের মসনদে আরোহণ করেন, তখন তিনি বলতেন আমার জাতি জানে যে, আমার উপার্জন আমার পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য অপর্যাপ্ত ছিল না। কিন্তু এখন আমি মুসলিম জনগণের কাজে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত হয়ে গেছি। অতএব আবু বকরের পরিবার রাষ্ট্রীয় কোষাগার হ’তে খাদ্য গ্রহণ করবে এবং আবু বকর (রাঃ) মুসলিম জনগণের সম্পদের তত্ত্বাবধান করবেন’।[4]

সাড়ে তিন হাযার কোটি টাকা লোপাটের জন্য দেশের আলোচিত নাম পিকে হালদার। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামে সে এ অপকর্ম সাধন করেন। আর এসব কাজে তাকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। সে জন্য মনে হয় চীনদেশে একটা প্রবাদ প্রচলন আছে যে, ‘বড় ধরনের ডাকাতরা ব্যাংক স্থাপন করে এবং ঘুষের মাধ্যমে লাল ফিতার দৌরাত্ম কাটিয়ে স্বার্থ হাসিল করে’। যাইহোক ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে যখন তার দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হ’তে শুরু করে, তখন পি কে ছাহেব ভারতে পালিয়ে যান। পরে বসবাস শুরু করেন কানাডা ও সিঙ্গাপুরে। তারপর আবার কারিশমা দেখিয়ে চলে আসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে’।[5]

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংকট শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থা সকলের সামনে প্রকাশ্যে আসে। মজার বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে যখন দুর্নীতির পৌষ মাস চলছিল তখন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে যে সাংবাদিক সবচেয়ে বেশী রিপোর্ট করেছিলেন সেই রোজিনা ইসলামকে পাঁচ ঘণ্টা মন্ত্রণালয়ে আটকে রাখার পর ১৮ই মে ২০২১ সালে অফিসিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্টের এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। দুর্নীতির পেছনের রুই-কাতলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ফলাফল এমনই হওয়ার কথা! গত ২রা অক্টোবর’২২ ফরিদপুরে দুই হাযার কোটি টাকা পাচার মামলায় গ্রেফতার হন যেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জীবন’।[6] চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অতি পরিচিত ষোলোশহর রেল স্টেশন সংলগ্ন মুদি দোকানে সেদিন দেখা মিললো, দুদকের সাবেক উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীনের। কয়েকমাস আগে তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তার অপরাধ কক্সবাজারে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির মামলা দায়ের ও তদন্ত করা’।[7]

দুদক কর্মকর্তারই যদি এই অবস্থা হয় তা’হলে তো বলতেই হয়, রক্ষক যদি ভক্ষক হয় কে করিবে রক্ষা, ধার্মিক যদি চুরি করে কে দিবে তারে শিক্ষা? মৌলবাদী অর্থনীতি উৎখাত করার ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে লুটপাটের মত নানান চমকপ্রদ কর্মসূচী হাতে নেওয়া হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ভুয়া ঠিকানা ও কাগজে দুই কোম্পানী খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে দুই হাযার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। সব মিলিয়ে নানা উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাযার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী অর্থ তুলে নেওয়া হয় ১ থেকে ১৭ নভেম্বরের মধ্যে। যার পরিমাণ ২ হাযার ৪৬০ কোটি টাকা। এ জন্যই ব্যাংকটির কর্মকর্তারা গত বছরের নভেম্বর মাসকে ভয়ংকর নভেম্বর বলে অভিহিত করছেন’।[8] এদিকে ২৯ নভেম্বরে একটি ইংরেজী পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে, এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাযার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবন যাত্রার প্রায় সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ জঘন্য ব্যাধির করাল গ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। দুর্নীতিবাজদের অবস্থান এতই শক্তিশালী যে দেশের মানুষ দুর্নীতিকে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। মানুষেরা যখন আল্লাহ প্রদত্ত অহি-র বিধান ভূলন্ঠিত করে মানব রচিত মতাদর্শে নিজেদের সঁপে দেয় সমাজব্যবস্থা তখন এভাবেই শৃঙ্খলা হারায়।

দুর্নীতির কতিপয় কারণ ও তার প্রতিকার :

১. ঐতিহাসিক কারণ : উপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ বেনিয়াদের স্বার্থরক্ষার জন্য এদেশে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ আমলা ও মধ্যস্বত্ত্বভোগী সৃষ্টি করা হয়েছিল, যারা দূর্নীতি, প্রতারণা ও বঞ্চনার মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে দুর্নীতির সেই ধারা ক্রমবর্ধমান রয়ে গেছে।

২. নিয়োগে অস্বচ্ছতা : প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অস্বচ্ছতা দুর্নীতির দ্বার উন্মোচন করে থাকে। এই অসুস্থ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে সৎ, যোগ্য এবং পরহেযগার ব্যক্তিরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে একজন প্রার্থী যখন লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে চাকরি নেয়, সে তখন দুর্নীতি করাকে তার বৈধ অধিকার মনে করে। যদি সরকারী-বেসরকারী চাকরিতে স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি না খুঁজে মেধা, দক্ষতা, সততা এবং যোগ্যতার মানদন্ডে নিয়োগ দান করা হয়, তবেই কেবল দুর্নীতির বিষবাষ্প ক্রিয়াহীন করা সম্ভব।

৩. ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা : ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে স্বার্থবাদী, ভোগবাদী ও স্বেচ্ছাচারী হ’তে প্ররোচিত করে এবং

পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে উদাসীন হ’তে শেখায়। তাই তারা দুর্নীতি করতে পরোয়া করে না। সুতরাং ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ’ল ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় পাঠদানকে ক্ষেত্রবিশেষ ঐচ্ছিক এবং গুরুত্বহীন করে তোলা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশুদের মক্তবে যাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফলশ্রুতিতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত ইসলামী শিক্ষায় অন্তঃসারশূন্য একটি মাকাল ফল সদৃশ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। সারকথা হচ্ছে, ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখে মুখে যতই দেশপ্রেমের স্লোগান তোলা হোক না কেন, তা কখনো দুর্নীতি দমনে সহায়ক নয়।

৪. জবাবদিহিতার অনুভূতি না থাকা : জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে না উঠার কারণে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গনে দুর্নীতি সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে। জবাবদিহিতা দুই ধরনের। ইহকালীন ও পরকালীন। ইহকালীন জবাদিহিতা বলতে জনগণ বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জবাবদিহিতা বুঝায়। আর পরকালীন জবাবদিহিতা বলতে মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট স্বীয় অণু পরিমাণ সৎকর্ম ও অসৎকর্মের জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকা বুঝায়। ইহকালীন জবাবদিহিতার অভাবে ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী হয় এবং নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করে। অন্যদিকে পরকালীন জবাবদিহিতার ভয়হীনতা নৈতিক অবক্ষয়ের জন্ম দেয়। মানুষ হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা করে না। ফলে আললাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয় মানুষের হৃদস্পন্দনকে বিচলিত করে না।

৫. সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণের প্রতিযোগিতা : সমাজ ব্যবস্থা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, যার যত বেশী অর্থ সে তত বেশী প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী। গতানুগতিক অর্থব্যবস্থা আমাদের শেখায় কিভাবে হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকতে হয়। অর্থ লিপ্সার এই তাড়না মানুষকে সৎ উপায়ে জীবিকার পথ ছেড়ে দুর্নীতির কালো গলিতে ছুঁড়ে ফেলে।

৬. অপর্যাপ্ত বেতন কাঠামো : সরকারী চাকরিজীবীদের বেতন তাদের সামগ্রিক চাহিদা এবং সামাজিক মর্যাদার তুলনায় অপ্রতুল। ফলে তারা অসীম চাহিদা পূরণের নিমিত্তে ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে। অনেক সমাজ বিজ্ঞানীগণ মনে করে থাকেন এটি দুর্নীতির মূল কারণ। তবে এটাও বলা যায়, যারা একবার দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, বেতন বাড়ালেও তাদের সৎ পথে ফেরানো সম্ভব না। তখন তারা বেতনও বেশী নিবে, আবার ঘুষও খাবে।

৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার কারণে এদেশকে দুর্নীতির আতুরঘর বলা হয়। লর্ড গ্রেশামের একটি উক্তি হচ্ছে, ‘খারাপ মুদ্রা ভাল মুদ্রাকে তাড়িয়ে দেয়’। অনুরূপভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকায় দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা সৎ কর্মচারীদের তাড়িয়ে দেয়। একথা সর্বজনসিদ্ধ যে, দুর্নীতি হ্রাসের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আইন অনুসারে সাজা দেওয়া। কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিহীন আইন হচ্ছে মাকড়সার জালের মত, যা ছোট ছোট পতঙ্গদের আটকাতে পারে কিন্তু বড় পোকাদের ঠেকাতে পারেনা। সেই নিরিখে একটি সভ্য সমাজ বিনির্মাণে মুহাম্মাদ (ছাঃ) সর্বপ্রথম আইনের শাসনকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তোমাদের আগের জাতিগুলোকে একাজই ধ্বংস করেছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোন বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে যখন কোন অসহায় গরীব লোক চুরি করত, তখন তার উপর হদ জারি করত’।[9]

দুর্নীতি প্রতিরোধে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি : ইসলাম সর্বপ্রথম একটি সুন্দর ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ইসলাম পার্থিব ও পরকাল উভয় জগতে শাস্তির বিধান রেখেছে। মানুষের ভিতর বিশ্বাসগত পরিবর্তন না আসলে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। প্লেটোর মতে, যারা ভাল লোক তাদের না বললেও তারা দায়িত্বশীল থাকবে। আর যারা খারাপ লোক তারা আইন ফাঁকি দেওয়ার কোন না কোন পথ বের করে নিবে। তাই ইসলাম দুর্নীতি প্রতিরোধে শাস্তির বিধানের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির পথও উন্মুক্ত রেখেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ইসলাম দুই স্তরের নিরাপত্তা গ্রহণ করেছে। যথা- ক) সংশোধনমূলক ও খ) শাস্তিমূলক।

ক. সংশোধনমূলক :

মস্তিষ্ক থেকে দুর্নীতির কালো ছায়া মুছে দিতে ইসলাম সচেতনভাবে কতিপয় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর এই পদক্ষেপ সমূহের ভূমিকা দুর্নীতি মোকাবিলায় যুদ্ধরত সেনাপতির ন্যায় ইস্পাত সদৃশ।

১. পরকালীন ভয় সৃষ্টি : দুনিয়ার জীবনই মানুষের শেষ নয় বরং আকাশের উপরেও আকাশ রয়েছে। পরকালীন জীবনে দুনিয়ায় কৃত প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে। দুনিয়ার জীবন হচ্ছে তুচ্ছ এবং পরকালের জীবন হচ্ছে অনন্ত। পরকালীন জবাবদিহিতার এ চিন্তা যখন মানুষের মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হবে সে অবশ্যই দুর্নীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিবে। ব্যক্তি কিভাবে এবং কোন পথে জীবিকা উপার্জন করবে তার গাইডলাইন সূচক ইসলামে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তোমাদেরকে হালাল এবং পবিত্র যা দিয়েছেন তা হ’তে তোমরা আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সুরা নাহ্ল-১১৪) সুতরাং ব্যক্তির মাঝে যখন হালাল-হারামের সীমারেখা মেনে চলার জ্ঞান জাগ্রত হবে তখন সে জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না।

২. বিত্তহীনদের মর্যাদা প্রদান : বিত্ত-বৈভবের মোহে পড়ে মানুষ অনিয়ম দুর্নীতির দিকে ধাবিত হয়। তাই মুহাম্মদ (ছাঃ) ধনীদের চেয়ে গরীব অধিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘বৃত্তিহীনরা বিত্তশালীদের চেয়ে পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[10]

৩. আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ : কতিপয় এমন আমল রয়েছে যা মানুষকে আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ দেয়। যেমন ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ইত্যাদি। এসব ইবাদত বান্দাকে অবচেতনভাবে নানান অপরাধ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই ছালাত মানুষকে যাবতীয় অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে’ (আনকাবুত-৪৫)। বান্দাহ যখন ছিয়ামরত অবস্থায় থাকে, আল্লাহ দেখছেন বলে যাবতীয় খানাপিনা এবং পাপাচার থেকে বিরত থাকে। এই ভাবনা দুর্নীতির মত অনাচারের ক্ষেত্রেও তার হৃদতন্ত্রীতে রেখাপাত করে। তাছাড়া সম্পদের যাকাত প্রদানের মাধ্যমে বান্দার মধ্যে ভোগ নয় বরং ত্যাগের মানসিকতা তৈরি হয়।

৪. যোগ্য কর্মচারী নিয়োগ এবং নায্য পারিশ্রমিক প্রদান : যোগ্যদেরকে কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে যথাযথ পারিশ্রমিক প্রদান করলে ঘুষ লেনদেনের মত ঘটনা কমে আসবে। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের নির্দেশনা হচ্ছে, ‘তোমার জন্য সর্বোত্তম কর্মচারী হ’তে পারে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ (ক্বাছাছ- ২৬)। তাছাড়া রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বে তার মজুরি পরিশোধ করে দাও’।[11]

খ. শাস্তিমূলক :

দুর্নীতিবাজরা একদিনে জন্ম নেয়না, কাজেই রাতারাতি তারা উধাও হবে না। পৃথিবীতে যতদিন মানুষ থাকবে, দুর্নীতিও তত দিন থাকবে। তবে বিভিন্ন শাস্তিমূলক বিধান প্রয়োগ করে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। শাস্তিমূলক বিধান দুই ধরনের যথা- পার্থিব শাস্তি এবং পরকালীন শাস্তি। দুর্নীতির পার্থিব শাস্তি তা‘যীর পর্যায়ের অপরাধ বলে বিবেচিত। যেসব অপরাধের ক্ষেত্রে হদ্দের বিধান নেই সেসব ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী বিচারক কর্তৃক শাস্তি প্রদান করাকে ইসলামী পরিভাষায় তা‘যীর বলা হয়’।[12]

নিম্নে দুর্নীতির পার্থিব শাস্তি বিধান আলোচনা করা হ’ল :

১. দল ও স্বজনপ্রীতি : চাকরি এবং অন্যান্য সুবিধায় যোগ্যদের বঞ্চিত করে দলীয় কর্মী বা নিকটাত্মীয়দেরকে অন্যায় সুবিধা প্রদান শরী‘আতের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। এটা এক ধরনের আমানত এবং এ আমানতের খেয়ানত করা মুনাফিকীর লক্ষণ। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে’।[13] তাছাড়া এটা তা‘যীর পর্যায়ের অপরাধ। ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারক এজন্য দোষীকে তা‘যীরের আওতায় শাস্তি প্রদান করতে পারবে।

২. অর্থ আত্মসাৎ : ইসলামে অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাৎ করা হারাম। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ- অর্থাৎ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না’ (নিসা ৪/২৯)। অর্থ আত্মসাতের শাস্তির বিষয়ে দুই ধরনের মত রয়েছে। কেউ বলেন এটা তা‘যীর পর্যায়ের অপরাধ। আবার কেউ কেউ বলেন, আত্মসাৎ চুরির হুকুমের অন্তর্ভূক্ত। চুরির শাস্তি সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে,وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ- ‘আর পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও; তাদের কৃতকর্মের ফল ও আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসাবে। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (মায়েদাহ ৫/৩৮)

৩. রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় : অপচয় শয়তানের একটি বৈশিষ্ট্য। মন্ত্রী, এম.পি, সচিব থেকে কর্মচারী পর্যন্ত সবাই রাষ্ট্রীয় কোষাগারের যথেচ্ছা ব্যবহারকে একটি ফ্যাশনে পরিণত করেছে। ইসলামে এ ধরনের অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে মহানবী (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি জিনিস অপছন্দ করেছেন। ১. অনর্থক ও বাজে কথা বলা ২. সম্পদ অপচয় ও অপব্যয় করা ৩. অত্যাধিক প্রশ্ন করা।[14]

৪. ঘুষ দেওয়া-নেওয়া : ঘুষ হচ্ছে অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা। যেভাবেই হোক, আর যে নামেই হোক, ঘুষ

সম্পূর্ণরূপে হারাম। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ شَفَعَ لِأَحَدٍ شَفَاعَةً، فَأَهْدَى لَهُ هَدِيَّةً عَلَيْهَا، فَقَبِلَهَا، فَقَدْ أَتَى بَابًا عَظِيْمًا مِنْ أَبْوَابِ الرِّبَا- ‘যে ব্যক্তি কারো জন্য কোন সুপারিশ করল এবং সেই সুপারিশের প্রতিদান স্বরূপ সে তাকে কিছু উপহার দিল ও সে তা গ্রহণ করল, তবে সে সূদের দরজা সমূহের একটি বড় দরজায় উপস্থিত হ’ল’।[15]

উপসংহার : বাংলাদেশ হচ্ছে পরিসংখ্যান সর্বস্ব অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের দেশ। কিন্তু বাস্তবে মাকাল ফল। দুর্নীতির প্রকোপে দেশ বর্তমানে অন্তঃসারশূন্য। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংস্কারের যুদ্ধ বড়ই জটিল। হয়ত কেউ আগ্রহী হয়ে সংস্কার শুরু করে কিন্তু সাফল্যের সাথে পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারে না। বরং তার নিজের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে চোরদের অপকর্মের সাজা পেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। যারা আজ জনগণের সম্পদ অন্যায়ভাবে চুরি করছে, দেশে-বিদেশে বাড়ি বানাচ্ছে; তারা মূলত জাহান্নামে নিজেদের আবাস কিনছে। আল্লাহ এ সমস্ত যালেমদের হেদায়েত দান করুন এবং দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে জাতিকে রক্ষা করুন।- আমীন!

-আব্দুল্লাহ আল মুছাদ্দিক

[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।]


[1]. পরার্থপরতার অর্থনীতি, আকবর আলি খান, পৃ.

[2]. Poverty and Famines: An Essay on Entitlement and Deprivation

[3]. দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ই অক্টোবর ২০২২

[4]. ছহীহ বুখারী, আধুনিক প্রকাশনী, হা/১৯২৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হা/ ১৯৪০।

[5]. দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ই মে ২০২২।

[6]. বাংলা ট্রিবিউন, ২২শে আগস্ট ২০২০।

[7]. দৈনিক প্রথম আলো, ৭ই নভেম্বর ২০২২।

[8]. দৈনিক প্রথম আলো, ২৪শে নভেম্বর ২০২২।

[9]. বুখারী হা/ ৩৪৭৫।

[10]. তিরমিযী হা/২৩৫৩; ইবনু মাজাহ হা/৪১২২।

[11]. ইবন মাজাহ, মিশকাত হা/২৯৮৭।

[12]. ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্নীতি প্রতিরোধ, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ৩১ পৃষ্ঠা টীকা দ্রষ্টব্য।

[13]. ছহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হা/ ৬৬৫৩।

[14]. বুখারী হা/১৬, মুসলিম হা/১৭১৫, আহমাদ হা/৮১৩৪, ৮৫০১, ৮৫৮১, মুওয়াত্তা মালিক হা/১৮৬৩, ৪৩, তিরমিযীহা/২৬২৪।

[15]. আবু দাঊদ, মিশকাত হা/৩৭৫৭, সনদ হাসান।



আরও