আটজন হাফেয সন্তানের মা শরীফাহ মাসতুরা
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
[‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ও কুষ্টিয়া যেলার সাবেক সভাপতি গোলাম যিল কিবরিয়া (কুষ্টিয়া)। তিনি মেহেরপুরের প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাড়াভাঙ্গা ডি.এইচ সিনিয়র ফাযিল মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন। তিনি ‘যুবসংঘে’র সূচনালগ্নের একজন ত্যাগী কর্মী। অদ্যাবধি তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলে আহলেহাদীছ আন্দোলনের দাওয়াত প্রচার ও প্রসারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজ সংস্কারে দৃঢ় প্রত্যয়ী এই বর্ষীয়ান নেতার দাওয়াতী কার্যক্রম কখনই মন্থর হয়নি। তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ কুষ্টিয়া পশ্চিম সাংগঠনিক যেলার সহ-সভাপতি মামুন বিন হাশমত। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল।-নির্বাহী সম্পাদক]
তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছি। আল্লাহ সুস্থ রেখেছেন।
তাওহীদের ডাক : এখন আপনার শারীরিক অবস্থা কেমন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : আলহামদুলিল্লাহ বর্তমানে শারীরিক অবস্থা ভাল। কিছুদিন আগে বাতের ব্যথার জন্য একেবারে অচল হয়ে গিয়েছিলাম। মসজিদে যেতে পারতাম না। এমনকি টয়লেটেও একাকী যেতে পারতাম না। আল্লাহর অশেষ রহমতে সুস্থ হয়েছি। এখন জুম‘আর ছালাত আদায় করতে পারছি। আশেপাশের মসজিদগুলোতে জুম‘আর খুৎবা দিতে পারছি। সকালে হাঁটতে পারছি। সবকিছু মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি।
তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় জানতে চাই।
গোলাম যিল কিবরিয়া : আমার জন্ম ১৯৫৬ সালের ৪ঠা ফ্রেরুয়ারী কুষ্টিয়া যেলার দৌলতপুর উপযেলার ১১নং আদাবাড়ি ইউনিয়নের ধর্মদহ গ্রামে। আমার বাবা গরীবুল্লাহ বিশ্বাস। তিনি ইংরেজ আমলের একজন শিক্ষিত মানুষ। আমার বাবা-মা দু’জনেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। আমরা চার ভাই, তিন বোন। আমার তিন নম্বর ভাই এলজিইডি বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমান সে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে উপযেলা প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত আছে। অন্যান্য ভাইগুলো কেউ ব্যবসা, কেউ কৃষি কাজে জড়িত। আমার তিন ছেলে। মেজ ছেলে আব্দুর রঊফ বি.এস.সি টে∙টাইল ইঞ্জিনিয়ার। সে ঢাকার বাইপাইলে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে। বড় ও ছোট ছেলে সিঙ্গাপুর প্রবাসী। এছাড়াও বড় ছেলের দেশে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা আছে। সে সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলনের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়াও আমার পরিবারে তিনটা নাতি-নাতনি আছে।
তাওহীদের ডাক : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর পাকিস্তান আমলে একটি হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করি। সেসময় প্রতিষ্ঠানটি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করত। অতঃপর বেদবাড়ি হাই স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হই। কিছুদিন পর হঠাৎ করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের পরে আবার ঐ স্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হই। ১৯৭৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এস.এস.সি পাশ করি। তারপর কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করি। ফলাফল ভাল না হওয়ায় বাবার বকুনিতে মন খারাপ হয়ে গেল। জীবনের পট পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলাম। চিন্তা-ভাবনা করলাম আমি এখন মাদ্রাসায় পড়ব। পরিবার থেকে আমার মা ছাড়া কেউ এতে সম্মতি দিল না। বাবা তো বলেই ফেলেছিলেন ওটা ফকিরী বিদ্যা। সকল চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে আমি ১৯৭৭ সালে মেহেরপুর হাড়াভাঙ্গা ফাযিল মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হই। ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে ক্লাস করা শুরু করি। সেসময় আলিয়া মাদ্রাসায় উর্দূ ভাষা পড়ানো হত। উর্দূ ভাষা শিখলাম। প্রতি বছর দুই শ্রেণী কভার করতাম। ১৯৮২ সালে দাখিল পাশ করলাম। আমার দাখিল পাশের পরে বাংলাদেশ সরকার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে উর্দূ তুলে দেয়। দাখিলে উর্দূ শেখার কারণে আমি এখনো উর্দূ বলতে, লিখতে এবং পড়তে পারি। যাহোক ১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়া কুওয়াতুল ইসলাম ফাযিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করি। ফাযিলও পড়লাম কিন্তু ফলাফল ভাল না হওয়ায় লেখাপড়া বন্ধ করি। জীবনের এই কঠিন সিদ্ধান্তে অনেকেই আমাকে খারাপ বলেছে। কিন্তু যখন আমি জুম‘আর খুৎবা দিতে শুরু করি তখন আমার বাবা অনেক খুশি হন। যারা একসময় কলেজ থেকে মাদ্রাসায় যাওয়াকে খারাপ বলেছে, তারা এখন সবাই ভাল বলে আলহামদুলিল্লাহ।
তাওহীদের ডাক : আপনার কর্মজীবনটা কখন ও কিভাবে শুরু হয়েছিল?
গোলাম যিল কিবরিয়া : ১৯৮২-৮৩ সালে আমার গ্রামের একটি রেজিস্টার্ড বেসরকারী প্রাইমারী বিদ্যালয়ে আমার বাবা সহকারী শিক্ষক হিসাবে আমাকে ঢুকিয়ে দেন। তখন কোন বেতন-ভাতা কিছুই ছিল না। এরপর মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করে হাড়াভাঙ্গা দাখিল মাদ্রাসায় ইবতেদায়ী বিভাগে সহকারী শিক্ষক হিসাবে চাকুরি পাই। সেখানে আমি সাত বছর শিক্ষকতা করি। ১৯৯১ সালে মাদ্রাসার চাকুরি থেকে ইস্তফা দেই। তৎকালীন সরকার যখন রেজিস্টার্ড প্রাইমারী শিক্ষকদের ৫০০ টাকা বেতন দেওয়া শুরু করে, তখন আমি পুনরায় প্রাইমারীর চাকরিতে ফিরে আসি। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার বেসরকারী প্রাইমারীকে সরকারী ঘোষণা করলে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমি সরকারী প্রাইমারী বিদ্যালয়ে চাকরী করি। সর্বমোট ৭ বছর মাদ্রাসায় এবং ২৪ বছর প্রাইমারীতে চাকরি করেছি। অতঃপর ২০১৫ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী থেকে ৩১ বছরের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন সমাপ্ত করে অবসর গ্রহণ করি। এখন আমার বর্তমান বয়স ৬৬ বছর।
তাওহীদের ডাক : সংগঠনে কিভাবে যোগদান করলেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : আমি যখন হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসার ছাত্র তখন মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন মাওলানা আবু বকর ছিদ্দীক (ঝিনাইদহ)। তিনি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ঝিনাইদহ যেলা সভাপতি ছিলেন। আমি তার কাছে সর্বপ্রথম ‘যুবসংঘে’র ফরম পূরণ করে সাংগঠনিক জীবন শুরু করি। তারপর মাদ্রাসায় ছাত্রদেরকে ‘যুবসংঘে’র দাওয়াত দিয়ে সংগঠিত করতে থাকি। এক পর্যায়ে সংগঠনের কাজের সুবিধার্থে কুষ্টিয়া যেলার দৌলতপুর ও মেহেরপুর যেলার গাংনী-এর সমন্বয়ে মেহেরপুর যেলা গঠন করা হয়। এই দুই উপযেলার সমন্বয়ে গঠিত সাংগঠনিক যেলায় আমাকেই যেলা ‘যুবসংঘে’র সভপতি হিসাবে মনোনীত করা হয়। অতঃপর আমার ক্ষুদ্র প্রয়াসে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলতে থাকে।
তাওহীদের ডাক : শুনেছি আপনার হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসায় একবার আমীরে জামা‘আতকে নিয়ে বড় একটা প্রোগ্রাম হয়েছিল। সে প্রোগ্রামের কোন স্মৃতি কি আপনার মনে আছে?
গোলাম যিল কিবরিয়া : ১৯৮২ সালের ৬ই মার্চ হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসায় অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণভাবে যুবসংঘের ‘যেলা কর্মী সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অনেক আলেম-ওলামা, সুধীবৃন্দ এবং যুবসংঘের কর্মী-সমর্থকরা উপস্থিত ছিল। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব অত্যন্ত গুরুগম্ভীর স্বরে তেজোদীপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। আমরা যুবসংঘের কর্মীরা মুহুর্মুহ স্লোগানে সে সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিলাম। এটাই আমার প্রতিষ্ঠানে আমীরে জামা‘আতের প্রথম পদচারণা ছিল।
এরপর ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয়বার হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসায় যেলা কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আমীরে জামা‘আত এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন মাওলানা আব্দুল মতীন সালাফী ছাহেব। তবে কোন কারণবশতঃ সালাফী ছাহেব যোগদান করতে পারেননি। সে সম্মেলন প্রথমবারের তুলনায় আরো বেশী প্রাণবন্ত ছিল। বহু সুধী ও যুবকের আগমন ঘটেছিল। আমীরে জামা‘আত বক্তব্যের পর পুনরায় আমাকে যেলা সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন।
তাওহীদের ডাক : আপনার সাংগঠনিক জীবনের শুরুটা কেমন ছিল?
গোলাম যিল কিবরিয়া : যখন আমি এলাকায় যুবসংঘের সাংগঠনিক দাওয়াতী কাজ শুরু করি, তখন এলাকার প্রবীণ আহলেহাদীছ আলেমগণ সহজে এ দাওয়াত গ্রহণ করতে পারেননি। তাদের সাথে অনেক বাকবিতন্ডা হয়েছে। শবেবরাতের লিফলেট, মৃত্যু পরবর্তী বিদ‘আতী অনুষ্ঠানগুলোর লিফলেট এবং ফরয ছালাত পরবর্তী সম্মিলিত মুনাজাতসহ ইত্যাকার বিষয় নিয়ে তৎকালীন সময়ের আহলেহাদীছ আলেমরাই চরম বিরোধিতা করেছিলেন। খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। বিশেষভাবে যারা হানাফী আলেম ছিলেন তারা বলতেন, এই ছেলেরা কি জানে? তারা শবেবরাত উঠিয়ে দিচ্ছে, মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উঠিয়ে দিচ্ছে, মুনাজাত উঠিয়ে দিচ্ছে, না জানি আবার কবে ছালাতও উঠিয়ে দেয়! তারাবীহর ছালাত আট না বিশ রাক‘আত এ বিষয়ে আমরা লিফলেট বিতরণ করেছি এবং বিভিন্ন জায়গায় আলোচনাও করেছি। তাতে একটা সংঘাতময় মারমুখী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। যুবসংঘের দাওয়াতী তৎপরতা এতটাই বেগবান হয়েছিল যে, হানাফী আলেমগণ প্রকাশ্যে মসজিদে মসজিদে, হাটে-বাজারে আহলেহাদীছ আলেমদের গালিগালাজ করত। ইহুদী-খ্রিষ্টানদের দালাল বলত। আমাকে গালিগালাজ শুনতে হ’ত। এমনকি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে দাজ্জালও বলত। তারাবীহ, মাযহাব, মুনাজাত, ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ, জোরে আমীন বলা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমাদের অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে। তৎকালীন সময়ে সমাজে যে একটা উত্তপ্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তার মধ্য দিয়েও আমাদের দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হয়েছে। তখন রাস্তাঘাট কাঁচা ছিল। আমাদের কোন মটরসাইকেল ছিল না। সুদূর দুর্গম ধূলিময় কিংবা কর্দমাক্ত রাস্তা পাড়ি দিয়ে, কখনো পাঁয়ে হেঁটে আবার কখনো সাইকেলযোগে দাওয়াতী কাজ করতে হ’ত। কোথায় সোহরাজপুর, কোথায় মহববতপুর এই বিশাল-বিস্তীর্ণ এলাকায় আমরা দাওয়াতী কাজ করতাম। এক সাইকেলে দুই-তিন জন কর্মী যেত। বারবার সাইকেল ভেঙ্গে গেছে, সাইকেল মেরামত করে আবার চলতে হয়েছে। সংগঠন শুরুর পরিস্থিতিটা আমাদের এমনই কঠিন ছিল। এগুলো এখন স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে।
তাওহীদের ডাক : আপনার সাথে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের প্রথম সাক্ষাৎ কিভাবে হয়েছিল?
গোলাম যিল কিবরিয়া : আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ হওয়াটা আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৮০ সালে ঢাকা যেলা ক্রীড়া মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর প্রথম কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমি কখনো ঢাকায় যাইনি। সেজন্য হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল ছাহেব আমীরে জামা‘আত বরাবার চিঠি লিখে রাস্তার ঠিকানা দিয়ে আমাকে পাঠালেন। আমি সেই ঠিকানা অনুযায়ী ঢাকা যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় পৌঁছালাম। ‘যুবসংঘে’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সেই মাদ্রাসায় থাকতেন। ওখানে গিয়ে আমার পরিচয় দিয়ে চিঠি দেই। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে চিঠি পড়লেন। আমার গোসল ও খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। এই হৃদ্যতা কখনো ভোলার না। সেদিনের সেই ব্যবহারে আমি চরম মুগ্ধ হয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম, তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ। তিনি আমাকে পেয়ে খুশি হয়েছিলেন। তাঁর কারণে আমি ‘যুবসংঘ’-এর প্রথম কর্মী সম্মেলনে যোগদান করতে পেরেছিলাম। ফালিল্লাহিল হামদ!
তাওহীদের ডাক : মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার জীবনের কোন স্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ করবেন কী?
গোলাম যিল কিবরিয়া : মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে একবার বগুড়ায় সফরসঙ্গী হিসাবে দীর্ঘক্ষণ থাকার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে সম্ভবত বন্যা পরবর্তী সময়ে বগুড়া পাইলট হাই স্কুল মিলনায়তনে কর্মী সম্মেলন ও প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমাকে ‘যুবসংঘে’র পরিচিতি ‘ক’-এর উপরে কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে বলা হয়েছিল। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় ছালাতের বিরতিতে পার্শ্ববর্তী হামীদপুর গ্রামে তৎকালীন জমঈয়তের একজন দায়িত্বশীল রফীকুল ইসলাম ছাহেবের মসজিদে আমাকে খুৎবা দিতে পাঠানো হয়। অতঃপর খুৎবা পরবর্তী প্রোগ্রাম শেষ করে রাজশাহী ফিরে আসার পালা। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত বগুড়ার বিখ্যাত দই কিনে বাড়ি পর্যন্ত সংরক্ষণের জন্য আমার হাতে দিলেন। আমি দই হাতে নিয়ে আমীরে জামা‘আতের পাশে বসে বাসে বগুড়া থেকে রাজশাহী পর্যন্ত আসি। আসার পথে আমাদের অনেক কথা হ’ল। আমি শুনলাম আর নিজের জীবনটাকে ধন্য মনে করলাম। বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘের একজন সভাপতি, জগদ্বিখ্যাত একজন আলেমের সাথে একই ছিটে বসে আমি রাজশাহী পর্যন্ত আসলাম। আমীরে জামা‘আতের সাথে এটা আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।
তাওহীদের ডাক : ‘যুবসংঘ’ ও ‘আন্দোলনে’র সাথে দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনের কোন অভিজ্ঞতা থাকলে যদি বলতেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : ১৯৭৮-১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আমি গাংনী-দৌলতপুর সাংগঠনিক যেলার সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করি। দীর্ঘ ১১ বছরের সাংগঠনিক জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে। অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। সমাজে অনেক গণ্য-মান্য ব্যক্তি থাকা সত্বেবও আল্লাহ আমাকে দিয়ে তাঁর দ্বীনের কাজ করিয়ে নিয়েছেন। এতে দেশব্যাপী আমার একটা পরিচিতি হয়েছে। দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু উপলব্ধি হয়েছে যে, যদি যুবসংঘ গঠন না হ’ত তাহ’লে ঘুণেধরা এই সমাজের কিছুই পরিবর্তন হ’ত না। আমাদের সাংগঠনিক দাওয়াতী কাজের বরকতে শিরক ও বিদ‘আতে পুঞ্জীভূত এই সমাজের অনেক অসঙ্গতির পরিবর্তন ও সংস্কার হয়েছে। পরবর্তীতে আমার ‘যুবসংঘে’র বয়স শেষ হওয়ার কারণে আমি ফরম পূরণ করে ‘আন্দোলনে’ যোগদান করে মূল সংগঠনের সাথে কাজ শুরু করি। ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’ মিলে দীর্ঘ ৪৪ বছরের সাংগঠনিক জীবনে বিভিন্ন বই-পুস্তক অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আলহামদুলিল্লাহ যে জ্ঞান অর্জন হয়েছে, আমার মনে হয় এ যুগের টাইটেল পাশ মাওলানা হ’লেও আমি এ জ্ঞান অর্জন করতে পারতাম না। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারীরা পূর্বে নিজেদেরকে আহলেহাদীছ পরিচয় দিত না। তারা কেউ ফরায়েজী, মুহাম্মাদী কিংবা শাফেঈ হিসাবে পরিচয় দিত। আমাদের বংশের লোকেরা নিজেদেরকে শাফেঈ বলত। আমার বাবাকেও বলতে শুনেছি, আমরা শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী। ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র এই দাওয়াতের ফলেই এখন সবাই নিজেদেরকে আহলেহাদীছ বলে। আমরা মানুষকে এটা উপহার দিতে পেরেছি যে, মানুষ জানতে পেরেছে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ এবং ‘যুবসংঘ’ একটা নির্ভেজাল ইসলামী সংগঠন। মুহাতারাম আমীরে জামা‘আতের ক্ষুরধার লেখনী, বক্তব্য এবং হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাওহীদ বনাম শিরক, সুন্নাহ বনাম বিদ‘আত, তাক্বলীদ বনাম ইত্তেবা ইত্যাদি বিষয়ের পার্থক্য করতে শিখেছি। শিরক, বিদ‘আত, সম্মিলিত মুনাজাত, শবে বরাত, তাজিয়া ইত্যাকার সুন্নাহ বিরোধী আমলে সমাজ ভরপুর ছিল। এইসব বিষয় নিয়ে আমরা হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসার ছাত্রদের সংগঠিত করে যখন লিফলেট বিতরণ করি, তখন সেই মাদ্রাসার প্রবীণ আলেমদের সাথেই আমাদের টক্কর দিতে হয়েছে। এভাবেই বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এখনো এভাবেই সমাজ সংস্কারের কাজ চলছে।
তাওহীদের ডাক : আপনার সাংগঠনিক জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু স্মৃতিচারণ যদি করতেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : সংগঠনের বহু স্মৃতি আমার স্মরণে আছে। তন্মধ্যে ৩টি উল্লেখ করতে চাই।-
১. ১৯৭৯ সালে হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসায় ‘যুবসংঘে’র ছাত্রদের নিয়ে সমাজ সংস্কারমূলক এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলাম। ১৯৭৯ সালের মে মাসের ২০ তারিখের কথা। হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসার নিকটস্থ ব্রজপুর গ্রামের কপনিপাড়ায় একটা আস্তানা ছিল। সেখানে ঘোড়ার মূর্তির পূজা করা হ’ত। আমরা জানতে পেরে আস্তানা ভাঙ্গার জন্য হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসার ‘যুবসংঘে’র বিশাল টিম নিয়ে সেখানে যাই। আমরা আস্তানা ঘিরে ফেলে গুড়িয়ে দিই। সেখানে ছোট-বড় প্রায় ১৫০টির মত মূর্তি ছিল। গাছের নিচে ছেঁড়া-ফাটা অনেক টাকা পড়ে ছিল। সেগুলো এক পুটলিতে নিয়ে আমরা শিরকের ভয়াবহতার উপর জোরালো বক্তব্য দেই। তারপর ‘কপনিপাড়ার আস্তানা ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও, ঘোড়া পূজার আস্তানা ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও’ স্লোগান দিতে দিতে আমরা ‘যুবসংঘে’র টিম নিয়ে মাদ্রাসায় উপস্থিত হই। এই বিষয়টি লক্ষ্য করে আশেপাশে এলাকার শিক্ষকমন্ডলী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সবাই আমাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বাহবা দিতে থাকল। এরপর সমস্ত এলাকাব্যাপী আমরা একটা সাংগঠনিক দাওয়াতী সপ্তাহ পালন করছিলাম। সেখানে বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট মুনাযির মাওলানা আব্দুর রঊফ (খুলনা), মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানী (দিনাজপুর) হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আবু বকর ছিদ্দীক এবং সহকারী শিক্ষক মাওলানা রেযাউল্লাহ। ৭ দিন ব্যাপী গোটা গাংনী দৌলতপুর এলাকায় ব্যাপক দাওয়াতী কাজ করেছিলাম। এতে এলাকায় আহলেহাদীছ আন্দোলনের দাওয়াতের একটা সাড়া পড়ে গেল।
২. ১৯৮৭ সালের ৯ই জুনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে। শুভরাজপুরে আমাদের একটা শাখা ছিল। সেখানে একটা মসজিদও ছিল। আমাদের প্রকাশিত বই-পুস্তক মসজিদের লাইব্রেরীতে রাখা ছিল। সেখানকার দ্বীনী ভাইয়েরা ঐ এলাকায় দাওয়াতী কাজ করত। হঠাৎ একদিন হানাফীরা অতর্কিতভাবে মসজিদটি ভাঙচুর করে কুরআন হাদীছের বই পুস্তক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। এমনকি মসজিদের সামনে খড়ের তৈরি মূর্তি রেখে চলে যায়। এলাকার পরিস্থিতি চরমে পৌঁছালে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে। তারা এসে উভয়পক্ষকে শান্ত করে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে।
এরপরে ১৯৮৮ সালে ১১ই মার্চ। মেহেরপুরের এসপি ও ডিসির মাধ্যমে মেহেরপুরে হানাফী-আহলেহাদীছ বাহাছ অনুষ্ঠিত হয়। রাত সাড়ে সাতটা থেকে প্রায় রাত দুইটা পর্যন্ত মেহেরপুর ডিসির কনফারেন্স হলে এসপির উপস্থিতিতে উভয় পক্ষের আলেমদের নিয়ে বাহাছ হ’ল। হানাফীরা কনফারেন্স হলের চতুর্পাশ্বে হৈ চৈ ও গালিগালাজ করা শুরু করল। আলিমুদ্দীন কোথায় বের কর, ওমুক আলেম কোথায় বের কর ইত্যাদি কথা বলে পরিবেশ উত্তপ্ত করে রেখেছিল। আমি যুবসংঘের কর্মীদেরকে নিয়ে আমাদের আলেমদেরকে হল ঘরে প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা দিয়েছিলাম। আলোচনার ক্ষেত্রে হানাফী আলেমদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা হারুন অর রশীদ (বগুড়া), মাওলানা ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, মাওলানা মুসলিম (ঝিনাইদহ), মাওলানা হাশমতুল্লাহ (কুষ্টিয়া)। আহলেহাদীছ আলেমদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আব্দুর রঊফ (খুলনা), মাওলানা আলীমুদ্দীন (মেহেরপুর), হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসা থেকে মাওলানা আবু বকর ছিদ্দীক এবং মাওলানা রেযাউল্লাহ (ঝিনাইদহ)। পরিচালক হিসাবে ছিলেন মেহেরপুর সরকারী কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক হাসানুয্যামান। সেদিন হানাফী পক্ষের লোকেরা হৈ চৈ করে পরিবেশ নষ্ট করায় পুলিশ দুই মিনিটের মধ্যে লাঠিচার্জ করে তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দেয়। সেখানে মাযহাব, তারাবীহ, সূরা ফাতিহা পাঠ, জোরে আমীন বলা, নিয়ত পড়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। হানাফী আলেমরা সেদিন ডিসি ও এসপির সামনে ভালভাবে আরবী ইবারত পড়তে পারেনি। মাওলানা হাশমা তুল্লাহ কিতাব পড়তে গিয়ে আমতা আমতা শুরু করে। পক্ষান্তরে আহলেহাদীছের আলেম মাওলানা আব্দুর রঊফ (খুলনা) অসাধারণ বাগ্মিতার পরিচয় দিয়ে দলীল উপস্থাপন করেছিলেন। সেদিন তিনি আহলেহাদীছদের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করেছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে ডিসি ছাহেব আলোচনা শুনলেন। তিনি ইসলাম সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি বললেন, হানাফী আলেমরা কুরআন হাদীছ ভাল করে পড়ে না আর আহলেহাদীছ আলেমরা কুরআন হাদীছ অধ্যয়ন করে ও বুঝে। আজকের বাহাছ এখানেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হ’ল। উল্লেখিত বিষয়ের উপর ৩ মাস পর এই কনফারেন্স হলে আবারো বাহাছ হবে। সে বাহাছ আর কখনো হয়নি। একজন দ্বীনী ভাই বাহাছের সমস্ত তথ্য চিঠি আকারে বইয়ের মত প্রিন্ট করে আমাকে দিয়েছিল। ২০১১ সালে সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্মেলনে আমার বক্তব্যের পরে কেন্দ্রে হেফাযতের জন্য আমার কাছ থেকে সেগুলো নেওয়া হয়।
৩. কুষ্টিয়ায় প্রথম ১৯৯৪ সালের ১৪ই জানুয়ারী সংগঠনের যেলা সম্মেলন হয়েছিল। আমার গ্রামের রাস্তাঘাট কাঁচা ছিল। কোন ডেকোরেশনের ব্যবস্থা কিংবা সাউন্ড সিস্টেম ছিল না। তারপরেও লোকাল ব্যবস্থার মাধ্যমে মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া যেলার সহযোগিতায় আমার বাড়ির আম বাগানে কুষ্টিয়ার মাটিতে প্রথম যেলা সম্মেলন হয়েছিল। যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার। এছাড়াও তৎকালীন নায়েবে আমীর শায়েখ আব্দুছ ছামাদ সালাফী, মাওলানা শিহাবুদ্দীন সুন্নী (গাইবান্ধা), অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম (যশোর) এবং আল-হেরার দায়িত্বশীল শফিকুল ইসলাম ভাই উপস্থিত ছিলেন। মাত্র দু’টি মাইকের মাধ্যমে অত্যন্ত অপ্রতুল ব্যবস্থাপনায় সেই সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলার অশেষ রহমতে সেই সময়ে সম্মেলনের মাধ্যমে দৌলতপুর কুষ্টিয়া এলাকায় দাওয়াতী কাজ আরো বেশী জোরদার হয়। আমীরে জামা‘আত কুয়েতী সংস্থার সাহায্যে সেখানে একটি মসজিদ তৈরি করে দিয়েছিলেন, যা এখনো বিদ্যমান এবং সেখানে সাংগঠনিক কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।
তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে সংগঠনের উপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল সে সময়ের কথা যদি কিছু বলতেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : ২০০৫ সাল আমাদের সংগঠনের জন্য একটি কালো অধ্যায়। ইজতেমার আর মাত্র ২/১ দিন বাকি। কুষ্টিয়া পশ্চিম সংগঠনিক যেলা ও আমার নিজ গ্রামের সবাই ইজতেমায় যাওয়ার জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। আমাদের গ্রামের কিছু যুবক ও মুরুববী সাইকেল চালিয়ে ইজতেমায় যাওয়ার জন্য পূর্ণ প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ করে খবর এল, আমীরে জামা‘আতসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়েছেন। ইজতেমা বন্ধ হয়ে গেছে। খবরটি পেয়ে আমাদের মন ভেঙ্গে গেল। সে সময় মোবাইলের এমন প্রচলন ছিল না। দোকানে গিয়ে টাকা খরচ করে বারবার খোঁজ খবর নিতে থাকলাম।
সে সময় প্রত্যেক যেলা সভাপতি ও শূরা সদস্যদের উপর বিপদ নেমে এসেছিল। আমার বাড়িতেও গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন একাধিকবার এসে তথ্য নিতে থাকে। তারা মোবাইলের মাধ্যমেও যোগাযোগ করে অনেক তথ্য জানতে চেয়েছিল। তখন দৌলতপুর থানার ওসি ছিলেন আব্দুল হাই ছাহেব। তাকে ক্রসফায়ারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। একদিন আমাকে, সহ-সভাপতি মাস্টার আমীনুল ইসলাম ও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মুহসিন আলীকে ওসি ছাহেব ডাকলেন। বিষয়টা শুনে সবার মনে একটা ভীতির সঞ্চার হ’ল। বাবা-মাকে বলতে পারলাম না। কারণ বললে তারা কান্নাকাটি শুরু করে দিবে। চুপচাপ দৌলতপুর কাজ আছে বলে চলে গেলাম। আমি সন্ধ্যার পর রেজুলেশন খাতা, কিছু লিফলেট এবং সেই সময় দেওয়ার মত কিছু প্রয়োজনীয় বই সাথে নিলাম। আব্দুল হাই ছাহেবের চেম্বারে গিয়ে বসা মাত্রই চারিদিকে সব দারোগারা এসে ঘিরে ধরল। আমার সঙ্গী-সাথীরা সবাই ভয় পেলেও আমি ভয় পাচ্ছিলাম না। আমাদের ঝাউপাড়া গ্রামের পূর্ব পাড়ায় যুবসংঘের একটা শাখা ছিল। তারা কবে কিভাবে জেএমবির অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তা আমাদের জানা ছিল না। এই সমস্ত ঘটনার আগেই আমরা দিনব্যাপী সেখানে প্রোগ্রাম করি। তারা আমাদেরকে বলেছিল, আসাদুল্লাহ আল-গালিব ছাহেব তো জিহাদের কথা বলেন, কিন্তু জিহাদের জন্য ডাক দেন না। জিহাদ সম্পর্কে আপনারা আদৌ কিছু বোঝেন? সেদিন তারা আমাদেরকে এক গ্লাস পানিও খেতে দেয়নি। সারাদিন তর্ক-বিতর্ক চালিয়েছে। পরিশেষে আমরা বাধ্য হয়ে ঐ শাখার কিছু মানুষের নামের তালিকা করে রেজুলেশনের মাধ্যমে সেই শাখা বাতিল ঘোষণা করি। থানাতে ঐ রেজুলেশন বের করে ওসি ছাহেবকে দেখাই এবং বলি, জেএমবির সিরিজ বোমা হামলায় কুষ্টিয়া থেকে শামসুল হকসহ আরো যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা এক সময় আমাদের সংগঠনভুক্ত ছিল। কিন্তু জঙ্গী আক্বীদা রাখায় আমরা বিষয়টি জানতে পেরে তাদেরকে সংগঠন থেকে বের করে দিয়ে রেজুলেশন করে রেখেছি। তখন ওসি ছাহেব বললেন, আপনি সঠিক কাজ করেছেন। বইপত্র এবং রেজুলেশনটা ফটোকপি করার জন্য আমাদের কাছ থেকে নিলেন আর বললেন, আমরা এটা বিভিন্ন দফতরে দেখাবো। আপনারা ভয় পাবেন না। সেই যে নিলেন আজও তা ফেরত দেন নি। তিনি আমাদেরকে চা খাওয়ালেন এবং অভয়বাণী দিয়ে বিদায় জানালেন। তারপর থেকে আমরা সেই ওসি ছাহেবের সাথে মাঝে মধ্যে ফোনে কথাবার্তা বলতাম। আল্লাহ তা‘আলার অশেষ রহমতে সেদিন আমরা নিরাপদে সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম।
আমাদের যেলা অফিস ছিল মাস্টার আমীনুল ইসলামের বাসায়। সেখানেও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অনেকবার হানা দিয়ে খোঁজা-খুজি করেছে। মাস্টার আমীনুল ইসলামকে অনেক প্রশ্ন করেছে। আমার তথ্য নেওয়ার জন্য কুষ্টিয়া শহরের জনৈক সাংবাদিকের মাধ্যমে আমার গ্রামে আসে। প্রায় দেড় ঘণ্টা গ্রামে অবস্থান করে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে। পরিশেষে ছদ্মবেশে আমার বাড়িতে এসে ভিন্ন পরিচয় দিয়ে চলে গেছে। এভাবে ২০০৫ সালে আমাকেও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হ’তে হয়েছিল। আমীরে জামা‘আতের উপর ১০টি মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে অন্যায়ভাবে সাড়ে তিন বছর জেলখানায় রেখেছিল। সেই সাথে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলার অশেষ রহমতে দীর্ঘদিন পরে হ’লেও এ সমস্ত মিথ্যা মামলার অসারতা প্রমাণ হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যেন এমন দিন আর না দেন। আর আমাদেরকে যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের যেন পরকালে হাশরের মাঠে আল্লাহ তা‘আলা যথাযথ বিচার করেন।
তওহীদের ডাক : সংগঠনকে গতিশীল করতে কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়াকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : সকল স্তরেই কাজেই পরিধি অনেক। তবে আমি এমন কিছু কাজের উল্লেখ করছি যেগুলো আমাদের আগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক।
১. সংগঠনের সিলেবাস অনুসারে আমাদেরকে কুরআন, হাদীছ ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করতে হবে। সাথে সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো মুখস্থ করে নিতে হবে।
২. দরসে কুরআন ও দরসে হাদীছ পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের আলেমদেরকে দেখা যায় দরসে কুরআন দিতে বললে রীতিমত ওয়াজ শুরু করে দেন। অথচ দরস প্রদান করার একটা নিয়ম আছে। সেইভাবে পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৩. সকল স্তরে সাপ্তাহিক তা‘লীমী বৈঠক ও মাসিক ইজতেমা নিয়মিত চালু রাখতে হবে।
৪. কর্মীদের ব্যক্তিগত গুণাবলী অর্জন করতে হবে এবং তোষামোদী বর্জন করতে হবে।
৫. প্রত্যেক কর্মীকে সংগঠন আগে ভালভাবে বুঝতে হবে এবং সংগঠনের প্রতি আনুগত্যশীল হ’তে হবে।
৬. সাংগঠনিক কাজে সময়ের কুরবানী করার মেজায গড়ে তুলতে হবে।
৭. নিয়মিত মাসিক এয়ানতসহ অন্যান্য দানে নিজেদের তৎপর হ’তে হবে। কোন কুপন কেন্দ্র থেকে আসলে আগে নিজেকে দান করে কুপন কেটে অপরকে কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
তওহীদের ডাক : আপনার জীবনের ব্যক্তিগত কোন স্মৃতি থাকলে যদি উল্লেখ করতেন!
গোলাম যিল কিবরিয়া : হ্যাঁ ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছু স্মৃতি আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা বলছি।
স্মৃতিচারণ-১ : ১৯৭৯ সালের ১০ই আগস্টের কথা। আমার বংশের পদবী ফরায়েজী বংশ। এক বাউল ফকির আমার চাচাত ভাইয়ের সাথে আতাত করে আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করতে থাকে। বিষয়টি দৃষ্টিকটু হওয়ায় আমার ভাইকে বললে সে কোন ভ্রুক্ষেপ করল না। হঠাৎ একদিন আমি জুম‘আর ছালাত আদায় করে বাউল ফকিরকে ধরে ছোটখাটো একটা বাহাছ শুরু করে দিলাম। বাউল ফকির আমার প্রতিটি প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। আমি তখন ‘যুবসংঘে’র আপোষহীন কর্মী, ফলে আমি তার বড় বড় চুল ধরে মার দেওয়া শুরু করলাম। যুবকদেরকে ডেকে বললাম, কাচি নিয়ে এসো এর চুল কেটে দিব। ঐসময় আমার ভাই কয়েকজনকে সাথে নিয়ে ধারালো দা, লাঠি, বাঁশ নিয়ে আমাকে মারার জন্য চলে আসে। আমার সাথে থাকা যুবকরা আমাকে হেফাযত করে। সেই সময় গ্রামে একটা উত্তেজনাকর আবহাওয়া বিরাজ করতে লাগল। আমি সেই সময় গ্রামে থাকতাম না। হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসায় পড়তাম বিধায় সেখানে চলে গেলাম।
স্মৃতিচারণ-২ : নিজ যেলা ছাড়াও অন্য যেলায় আমরা সাংগঠনিক সফর করতাম। হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসার শিক্ষক মৃত ক্বারী আব্দুল হাকীমকে (ঝিনাইদহ) সাথে নিয়ে সাইকেল যোগে এক সপ্তাহব্যাপী ঝিনাইদহের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দাওয়াত দেওয়া শুরু করি। গ্রামগুলো ছিল ডাকবাংলা, হলিধানী, উত্তর ও পশ্চিম লক্ষ্মীপুর, বেড়াশুলা, আশুরহাট, কিসমত ঘোড়াঘাট, বাটিকাডাঙ্গাসহ বারো-তেরোটা গ্রামে সাইকেলযোগে দাওয়াতী কাজ করেছি। তখন ১৯৮৭ সাল চলছিল। এরপর ১৯৮৯ সালে একটা ঐতিহাসিক সফর করেছি রাজশাহীর বাগমারা থানায়। কেন্দ্র ১০০ এইচএস মটরসাইকেল কিনেছিল। সেই মটরসাইকেলযোগে আমরা সফর করেছিলাম। আমার সফরসঙ্গী ছিলেন মাস্টার আমীরুল ইসলাম। আমীরে জামা‘আত কাগজপত্রসহ রামাযানের এক মাস দাওয়াতী কাজের জন্য আমাদেরকে প্রেরণ করলেন। তখন সম্ভবত সৌদি আরবের মুবাল্লেগ আব্দুর রহমান কারামী বাসার সম্মুখে ছিলেন। তিনি ও আমীরে জামা‘আত আমাদের জন্য দো‘আ করে বিদায় দিলেন। রামাযানের কঠিন খরার দিনে আমরা ৩৫টি মসজিদ সফর করলাম। ৩৫টি মসজিদেই বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘের আহবায়ক শাখা গঠন করে দিলাম। সেই সফরে দুইশত বছরের পুরাতন মৃধাপাড়া বিহান আলী মসজিদও সফর করেছিলাম। প্রত্যেকটি মসজিদেই আমীর ছাহেবের দেওয়া খেজুর ভাগ করে দিলাম। সাত দিন সফর করার পরে তীব্র রৌদ্রের কারণে ফিরে এসে কেন্দ্রে সমস্ত রিপোর্ট জমা দিলাম।
স্মৃতিচারণ-৩ : ১৯৮৮ সাথে যুবসংঘের ৪র্থ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্মেলনে যোগদান করেছিলাম। ১৯৮৯ সালে খুলনা বাগেরহাট কর্মী সম্মেলন ও প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগদান করেছিলাম। সেখানে আমীরে জামা‘আতসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। খুলনা আল-মা‘হাদ ইসলামী আস-সালাফী মাদ্রাসায় প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে ‘উপমহাদেশে আহলেহাদীছ’ শিরোনামে বক্তব্য দিয়েছিলাম। এছাড়া ১৯৮৬ সালের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্মেলনেও আমি উপস্থিত ছিলাম।
স্মৃতিচারণ-৪ : ১৯৮০ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বরের একটা উল্লেখযোগ্য স্মৃতি। আমাদের নিজ গ্রামে তখন সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা খুব ভাল চলছিল। আমাদের ফরায়েজী বংশের পুরানো যে আহলেহাদীছ মসজিদ ছিল সেটা অত্র এলাকার প্রথম মসজিদ। আহলেহাদীছ হলেও সে সময় আমাদের মসজিদে জুম‘আর দিন দুই আযান চালু ছিল। কুরআন ও হাদীছ দিয়ে বুঝিয়ে সবাই সম্মিলিতভাবে এক আযান হবে বলে মেনে নিয়েছিল। এক আযান চালু করার তিন মাস পর আমাদের মধ্যে একটা গ্রুপিং হয়ে গেল। একটা গ্রুপ একদিন জোর করে মসজিদে আবারও দুই আযান চালু করতে যাচ্ছিল। কিন্তু এক আযানের পক্ষের লোকদের বিরোধিতায় তারা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। দুই আযানের পক্ষের লোকেরা তাদের ওয়াক্তিয়া মসজিদকে জুম‘আ মসজিদ বানাল। সেই সময়ের চরম আহলেহাদীছ বিদ্বেষী হানাফী আলেম মাওলানা হাশমতুল্লার কাছে গিয়ে তার আনুগত্য স্বীকার করল। আমাদের সাথে আলোচনা ছাড়াই মাইকিং করে ফেলল যে, ধর্মদহ পূর্বপাড়া ফরায়েজী মসজিদে আজ হানাফী-আহলেহাদীছ বাহাছ হবে। আহলেহাদীছদের পক্ষে মাওলানা রেযাউল্লাহ এবং তার লোকজন, আর হানাফীদের পক্ষে মাওলানা হাশমতুল্লাহ এবং তার লোকজন। অথচ আমরা কিছুই জানি না।
আমরা আর চুপ থাকতে পারলাম না। সে সময়ের কর্মী মাওলানা গোলাম রহমানের বাড়িতে বহু কিতাব ছিল। সেগুলোসহ হাড়াভাঙ্গা মাদ্রাসার সকল শিক্ষক, আলেম-ওলামা, যুবসংঘের সকল কর্মী, সুধী ও দায়িত্বশীল সবাই গাড়ি ভর্তি কিতাব নিয়ে আমার বাড়িতে উপস্থিত হ’ল। বাহাছের প্রিন্ট করা চুক্তিনামা দেওয়া হ’ল মাওলানা হাশমতুল্লাহর কাছে। তিনি সেটা দেখে থর থর করে কাঁপতে শুরু করলেন। বললেন, আমি তো বাহাছ করতে আসিনি, আমি ওয়ায করতে এসেছি। মাগরিবের পর অনুষ্ঠান। আমার বাবাকে তারা সভাপতি করল। আমরা প্রস্তাব দিলাম তা’হলে প্রথমে মাওলানা আবু বকরকে বক্তব্য দিতে দেওয়া হোক। এরপর মাওলানা রেযাউল্লাহ এবং হাশমতুল্লাহকে দেওয়া হোক। কিন্তু তারা কারো পরোয়া না করে সরাসরি হাশমতুল্লাহকে তুলে দিল। সবাই দাঁড়িয়ে হৈ চৈ শুরু করে দিল। মাহফিল কমিটি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী লাঠি-সোঁটা, বল্লম, ফলা নিয়ে আমাদের মারার জন্য চলে আসল। আমরা নিরস্ত্র ছিলাম বিধায় কিছু না বলে ওখান থেকে চলে আসলাম। আফসোস! যারা সেদিন মারতে এসেছিল তারা আমাদেরই রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়।
পরবর্তীতে তারা আমার ও আমার পরিবারের নামে আগ্নেয়াস্ত্রসহ মাহফিল পন্ড করতে এসেছিল বলে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে থানায় অভিযোগ দেয়। এক পর্যায়ে আমরাও মামলা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিছুদিন পর আমাদের উভয় পক্ষকে থানায় ডেকে মীমাংসা করে দিয়েছিল। কিন্তু সেই রক্তের সম্পর্ক আর থাকল না। দেখা হ’লে কথা বলা ও সালাম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। অবশেষে আমার দীর্ঘদিনের দাওয়াতী প্রচেষ্টায় আবারও তারা সংশোধন হন। শবেবরাত, সম্মিলিত মুনাজাতের মত বিদ‘আতী আমলগুলো ছেড়ে দিল। এক সময় যারা আমার বিরোধিতা করেছিল তারাই আমার মাধ্যমে সঠিক পথের দিশা পেল। আলহামদুলিল্লাহ! পরবর্তীতে আমি আমীরে জামা‘আতের মাধ্যমে সেখানকার টিনের মসজিদ ভেঙ্গে ঝকঝকে একটা সুন্দর মসজিদ তৈরি করে দিয়েছি। আজ তাদের সাথে আমাদের যাবতীয় লেনদেন চলছে। বর্তমানে সে মসজিদে যুবসংঘের শাখা রয়েছে। যা আমার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি। ফালিল্লাহিল হামদ!
তাওহীদের ডাক : দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনে পথ চলার অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান বিপথগামী যুবসমাজের উদ্দেশ্যে যদি কোন নছীহত করতেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : যুবকদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ নছীহত থাকবে, ‘হে যুবক! তোমার প্রতি ফোঁটা রক্ত আল্লাহর দেওয়া পবিত্র আমানত। তোমাকে জান্নাত দেওয়ার জন্য সে আমানত আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন’। সেজন্য আহলেহাদীছ আন্দোলনের দাওয়াতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তোমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। সকলের প্রতি আমার নছীহত থাকবে, বর্তমানে ইসলাম বিভিন্ন মাযহাব, তরিকা ও ইজমের বেড়াজালে আবেষ্টিত। সেখান থেকে তোমাদের পিওর ইসলামের সন্ধান করতে হবে। কেননা পরকালে কুরআন-হাদীছের অনুসরণ ব্যতিরেকে জান্নাত পাওয়া সম্ভব নয়। সকল যুবকের প্রতি আমার উদাত্ত আহবান, তোমরা সত্যের সন্ধান করতে থাক। দেখতে পাবে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ই একমাত্র যুবকদের জন্য সত্য ও ন্যায়ের নির্ভেজাল আদর্শিক প্লাটফরম। এখানে তোমরা যোগদান কর। এখান থেকে তোমরা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দাওয়াত গ্রহণ কর। আর জান্নাতী হওয়ার জন্য উপযুক্ত আমলকারী হয়ে যাও।
আজকে তোমরা যুবক, আগামী দিনে তোমরাই দায়িত্বশীল। একদিন আমরা থাকব না। আমাদের শূন্যতা তোমাদেরই পূরণ করতে হবে। মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের হাতে গড়া অনেক দায়িত্বশীল মারা গেছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। কাজেই তোমরা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়ার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ কর। জান্নাত পাওয়ার জন্য জান্নাতের পিয়াসী হয়ে দাওয়াতী কাজ কর। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র পতাকা তলে এসে জান্নাতে যাওয়ার জন্য নিজেকে ও পরিবারকে তৈরি কর। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের যুবকদেরকে এই নছীহতগুলো আমল করে আগামী দিনে পথ চলার তাওফীক দান করুন-আমীন!
তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার পাঠকদের সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
গোলাম যিল কিবরিয়া : আত-তাহরীকের পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত ‘তাওহীদের ডাক’ও একটি গবেষণামূলক পত্রিকা। এই পত্রিকাটি নিয়মিত সবাইকে পড়তে হবে। যারা খুৎবা দিতে পারে তাদের জন্য এই পত্রিকাটি বিষয় ভিত্তিক খুৎবা দানে সহায়তা করবে। এই পত্রিকা দ্বারা শিরক-বিদ‘আত মুক্ত আমলের পথ সুগম হবে। নিজে পড়ে অপরকে পড়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। প্রত্যেক পাঠককে প্রতিমাসে নতুন নতুন পাঠক বানাতে হবে। বিশেষভাবে যুবসংঘের ছেলেদের এই পত্রিকার প্রচার-প্রসার এবং বিক্রয় বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বস্তরের শিক্ষিত মহলের দোড়গোড়ায় এই পত্রিকা পৌঁছে দিতে হবে। সর্বোপরি তাওহীদের ডাক পত্রিকার কলেবর বৃদ্ধি পাক, গ্রাহক ও পাঠকের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি হোক এই কামনা করি।
তাওহীদের ডাক : আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে জাযাকুমুল্লাহ খায়রান।
গোলাম যিল কিবরিয়া : আলহামদুলিল্লাহ! তাওহীদের ডাক আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ায় জন্য নিজেকে ধন্য মনে করছি। তোমাদেরও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলের জীবনকে কল্যাণময় করুন ও দ্বীনের পথে আমাদের প্রচেষ্টাকে কবুল করে নিন-আমীন!