জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবার কতিপয় কারণ
ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
তামান্না-ই জান্নাত 844 বার পঠিত
ভূমিকা : ভালবাসা মহান রবের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত একটি মহৎ গুণ, যা আল্লাহ মানুষের হৃদয়ে ঢেলে দেন। এই ভালবাসা নামক গুণটির কারণেই মানুষ একে অন্যের উপর দয়া, অনুগ্রহ প্রদর্শন করে থাকে। আর এই গুণ কারো মধ্যে না থাকলে সে যালিমে পরিণত হয়। আবার এই ভালবাসার কদর্য রূপও আছে, যা মানব-মানবীর তথাকথিত হারাম সম্পর্কের মধ্যে নিহিত থাকে। এই অনৈতিক ভালবাসা ইসলামের দৃষ্টিতে গর্হিত অপরাধ, যা কোন অবস্থাতেই অনুমোদনযোগ্য নয়। নিম্নে ‘ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ভালবাসার স্বরূপ আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
ভালবাসা আল্লাহর পক্ষ প্রাপ্ত নে‘মত :
ভালবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত। কোন ব্যক্তি চাইলেই কাউকে ভালবাসতে পারে না অথবা চাইলেও কারও ভালবাসা প্রাপ্ত হয় না। আল্লাহ চাইলেই তা শুধুমাত্র সম্ভব। তিনি চাইলে শত্রুর অন্তরেও ভালবাসা তৈরী করতে পারেন। যেমনটি মূসা (আঃ)-এর ক্ষেত্রে হয়েছে। কেননা মূসা (আঃ) ফের‘আউনের গৃহে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,أَنِ اقْذِفِيهِ فِي التَّابُوتِ فَاقْذِفِيهِ فِي الْيَمِّ فَلْيُلْقِهِ الْيَمُّ بِالسَّاحِلِ يَأْخُذْهُ عَدُوٌّ لِي وَعَدُوٌّ لَهُ وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِنِّي وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِي- ‘তা এই যে, তুমি (মূসাকে) সিন্দুকে ভর। অতঃপর সিন্দুকটিকে (নীল) নদীতে ভাসিয়ে দাও। যাতে নদী তাকে তীরে ঠেলে দেয়। তখন ওকে আমার শত্রু ও তার শত্রু (তীরে) উঠিয়ে নেবে। আর (হে মূসা) আমি তোমার উপর আমার পক্ষ হ’তে মহববত ঢেলে দিয়েছিলাম (যাতে শত্রুরাও তোমাকে ভালবাসে)। এবং যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’ (ত্বোয়াহা ২০/৩৯)।
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা চাইলে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্কে জোড়া লাগাতে পারেন। যেমন আল্লাহ বলেন,وَاذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوْبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ-‘আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর সেই নে‘মতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তর সমূহে মহববত পয়দা করে দিলেন। অতঃপর তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
অপর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ لَوْ أَنْفَقْتَ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا مَا أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ وَلَكِنَّ اللهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ إِنَّهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ، ‘তিনি তাদের অন্তর সমূহে পরস্পরে ভালবাসা সৃষ্টি করেছেন। যদি তুমি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যয় করতে, তবুও তাদের অন্তর সমূহে ভালবাসা সৃষ্টি করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে পরস্পরে মহববত পয়দা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৬৩)।
আল্লাহর জন্য ভালবাসায় ঈমানের পূর্ণতা লাভ :
আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালবাসবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুশমনী করবে; আর দান করবে আল্লাহর জন্য এবং দান করা থেকে বিরত থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, সে ব্যক্তি তার ঈমান পরিপূর্ণ করেছে।[1]
আল্লাহর ভালবাসা প্রাপ্তির উপায় :
কোন মুমিনকে ঈমানের কারণে ভালবাসলে আল্লাহ তাকে ভালবাসবেন। এজন্য সর্বাগ্রে রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ الله فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ الله وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَ الله غَفُورٌ رَحِيمٌ- ‘বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)।
বারা বিন আযিব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) আনছারদের সম্পর্কে বলেছেন,لاَ يُحِبُّهُمْ إلاَّ مُؤمِنٌ، وَلاَ يُبْغِضُهُمْ إلاَّ مُنَافِقٌ، مَنْ أحَبَّهُمْ أَحَبَّهُ الله، وَمَنْ أبْغَضَهُمْ أبْغَضَهُ الله- ‘তাদেরকে কেবল মুমিনই ভালবাসে এবং তাদের প্রতি কেবল মুনাফিকরাই বিদ্বেষ রাখে। যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালবাসে, আল্লাহ তাকে ভালবাসেন। আর যে ব্যক্তি তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখবে, আল্লাহ তার প্রতি বিদ্বেষ রাখবেন’।[2] আবু ইদ্রীস খাওলানী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَجَبَتْ مَحَبَّتي لِلْمُتَحَابِّينَ فِيَّ، وَالمُتَجَالِسينَ فِيَّ، وَالمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ، وَالمُتَبَاذِلِينَ فِيَّ ‘আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য যারা পরস্পরের মধ্যে মহববত রাখে, একে অপরের সঙ্গে বসে, একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ এবং একে অপরের জন্য খরচ করে, তাদের জন্য আমার মহববত ও ভালবাসা ওয়াজিব হয়ে যায়’।[3] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,مَا تَحَابَّ رَجُلَانِ فِي اللهِ إِلَّا كَانَ أَحَبُّهُمَا إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ أَشَدَّهُمَا حُبًّا لِصَاحِبِهِ، ‘দুই ব্যক্তি পরস্পরকে ভালবাসলে, তাদের মধ্যে যে অপরজনকে অধিক ভালবাসবে সে আল্লাহর নিকটে অপরজন থেকে অধিক ভালবাসার পাত্র হবে’।[4]
রাসূল (ছাঃ)-কে ভালবাসার স্বরূপ :
ভালবাসার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভালবাসাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ (প্রকৃত) মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান-সন্ততি এবং অন্যান্য সকল মানুষ হতে প্রিয়তম হই।[5]
আব্দুল্লাহ ইবনু হিশাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা একদা নবী (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি যখন ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর হাত ধরেছিলেন। ওমর (রাঃ) তাকে বললেন,يَا رَسُولَ الله لأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ إِلاَّ مِنْ نَفْسِى فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ فَإِنَّهُ الآنَ وَ الله لأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ نَفْسِى فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الآنَ يَا عُمَرُ- ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার প্রাণ ব্যতীত আপনি আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। তখন নবী (ছাঃ) বললেন, না। ঐ মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! এমন কি তোমার কাছে তোমার প্রাণের চেয়েও আমাকে অধিক প্রিয় হ’তে হবে। তখন ওমর (রাঃ) তাকে বললেন, এখন আল্লাহর কসম! আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয়। নবী (ছাঃ) বললেন, হে ওমর! এখন (তোমার ঈমান পূর্ণ হয়েছে)।[6]
আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ أَنْ يَكُونَ الله وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِى الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِى النَّارِ ‘তিনটি জিনিস এমন যার মধ্যে সেগুলো পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ পাবে। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তার কাছে অন্য সবকিছু থেকে প্রিয় হওয়া। ২. কাউকে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ভালবাসা। ৩. জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে যেভাবে অপছন্দ করে, তেমনি পুনরায় কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন করাকে অপছন্দ করে’।[7]
মুমিনের ভালবাসার স্বরূপ :
মুমিন ব্যক্তিরা আল্লাহর পক্ষ থেকে খাছভাবে ভালবাসাপ্রাপ্ত হন। কেননা মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَنُ وُدًّا ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের জন্য দয়াময় (সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তরে) মহববত সৃষ্টি করে দিবেন (মারইয়াম ১৯/৯৬)।
একজন মুমিনের ভালবাসার ব্যক্তি :
একজন মুমিন ব্যক্তি অপর কোন মুমিনকে ছাড়া ভালবাসতে পারবে না। এজন্য কাউকে ভালবাসতে হলে বা বন্ধুত্ব করতে মুমিন ব্যক্তিকেই নির্বাচন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ، ‘আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায়কে তুমি পাবে না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করে। যদিও তারা তাদের বাপ-দাদা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বেরাদর বা আত্মীয়-স্বজন হৌক’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)।
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلاَّ تَقِيٌّ ‘তুমি মুমিন ব্যতীত অন্য কারো সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন কেবল পরহেযগার লোকে খায়’।[8]
পিতা-মাতার প্রতি ভালবাসা :
পিতা-মাতা বহুকষ্টে সন্তানদের প্রতিপালন করে থাকে। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَّفِصَالُهُ فِيْ عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِيْ وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيْرُ- ‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে’ (লোক্বমান ৩১/১৪)।
এজন্য তাদের প্রতি রহম দিলওয়ালা হ’তে হবে। তাদের জন্য ভালবাসার পরশ বিছিয়ে দিতে হবে। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْراً- ‘অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’ (বনী ইস্রা্ঈল ১৭/২৩)।
স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা :
নারী-পুরুষ সংসার জীবনে দু‘জনের গুরুত্বই সমান। আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে আদম (আঃ)-কে একাকী সৃষ্টি করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আদম (আঃ) হ’তেই তাঁর স্ত্রী হওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছিলেন। অতঃপর আল্লাহ এ দু’জন হ’তেই সমগ্র মানব জাতিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালবাসার স্বরূপ উল্লেখ করে বলেন,وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ কর। আর তিনি তোমাদের (স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে পরস্পরে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য (আল্লাহর একত্বের ও অসীম ক্ষমতার) বহু নিদর্শন রয়েছে। (রূম ৩০/২১)।
সন্তানদের প্রতি ভালবাসা :
সন্তানের প্রতি স্নেহ, মমতা ও ভালবাসা মানুষের স্বভাবজাত। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার প্রগাঢ় ভালবাসার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ ‘আর জেনে রাখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পরীক্ষার বস্ত্ত মাত্র। এর চাইতে মহা পুরস্কার রয়েছে আল্লাহর নিকট (অর্থাৎ এগুলির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জান্নাত তালাশ কর)’ (আনফাল ৮/২৮)। এ ছাড়াও পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা সন্তানের প্রতি নবীদের স্নেহ ও মমতার একাধিক দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। যেমন প্রিয় সন্তান হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে হারিয়ে হযরত ইয়াকুবের ব্যাকুলতার বর্ণনা। সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি পর্যন্ত লোপ পেয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَتَوَلَّى عَنْهُمْ وَقَالَ يَاأَسَفَا عَلَى يُوسُفَ وَابْيَضَّتْ عَيْنَاهُ مِنَ الْحُزْنِ فَهُوَ كَظِيمٌ- قَالُوا تَاللَّهِ تَفْتَأُ تَذْكُرُ يُوسُفَ حَتَّى تَكُونَ حَرَضًا أَوْ تَكُونَ مِنَ الْهَالِكِينَ- ‘অতঃপর সে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং বলল, হায় আফসোস ইউসুফের জন্য! (আল্লাহ বলেন,) এভাবে দুঃখে (ক্রন্দনে) তার চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং অসহনীয় মনস্তাপে সে ছিল ক্লিষ্ট। ছেলেরা তখন তাকে বলতে লাগল, আল্লাহর কসম! আপনি তো ইউসুফের স্মরণ থেকে নিবৃত্ত হবেন না, যে পর্যন্ত না মরণাপন্ন হন কিংবা মৃত্যুবরণ করেন’ (ইউসুফ ১২/৮৪-৮৫)।
আত্মীয় স্বজনদের প্রতি পারস্পরিক ভালবাসা :
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন সুদৃঢ় হয়। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, مَنِ اتَّقَى رَبَّهُ وَوَصَلَ رَحِمَهُ نُسِىءَ فِيْ أَجَلِهِ وَثُرِىَ مَالُهُ وَأَحَبَّهُ أَهْلُهُ ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে এবং তার আত্মীয়-স্বজনকে জুড়ে রাখে, তার মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়া হয়, তার সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে’।[9] অন্য শব্দে এসেছে এভাবে,مَنِ اتَّقَى رَبَّهُ، وَوَصَلَ رَحِمَهُ، أُنْسِيءَ لَهُ فِيْ عُمُرِهِ وَثُرِىَ مَالُهُ، وَأَحِبَّهُ أَهْلُهُ ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে ভয় করে, আত্মীয়তার বন্ধন জুড়ে রাখে, তার আয়ু বর্ধিত করা হয়, তার ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করা হয় এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে ভালবাসে’।[10]
ভালবাসার ব্যক্তি নির্বাচন :
ভালবাসার ব্যক্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা এতে পরকালীন কল্যাণ-অকল্যাণ নিহিত রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ كَيْفَ تَقُولُ فِى رَجُلٍ أَحَبَّ قَوْمًا وَلَمْ يَلْحَقْ بِهِمْ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ- ‘একদা একজন ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কি বলেন, যে ব্যক্তি একদল লোককে ভালবাসে। কিন্তু কোনদিন তাদের সঙ্গে সাক্ষাত হয়নি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জওয়াব দিলেন, (ক্বিয়ামতের দিন) মানুষ তার সঙ্গেই থাকবে, যাকে সে ভালবাসে’।[11]
হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,أَنَّ رَجُلاً مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ أَتَى النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ مَتَى السَّاعَةُ قَائِمَةٌ قَالَ : وَيْلَكَ وَمَا أَعْدَدْتَ لَهَا. قَالَ : مَا أَعْدَدْتُ لَهَا إِلاَّ أَنِّى أُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ. قَالَ : إِنَّكَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ- ‘একদা একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলল, ক্বিয়ামত কবে হবে? রাসূল (ছাঃ) তাকে ধমক দিয়ে বললেন, বল সেদিনের জন্য তুমি কি প্রস্ত্ততি নিয়েছ? লোকটি বলল, কোন প্রস্ত্ততি নেইনি। কেবল এতটুকুই যে আমি ভালবাসি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যাকে তুমি ভালবাস, তার সঙ্গেই তুমি থাকবে’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, এরপর থেকে আমি মুসলমানদেরকে এত আনন্দিত দেখেছি যা ইসলাম আনার পর কোনদিন তাদেরকে দেখিনি।[12]
ভালবাসার মাধ্যমে জান্নাত লাভ :
আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কারো সাথে সাক্ষাৎ করা জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِرِجَالِكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ؟ النَّبِيُّ فِي الْجَنَّةِ وَالشَّهِيدُ فِي الْجَنَّةِ وَالصِّدِّيقُ فِي الْجَنَّةِ وَالْمَوْلُودُ فِي الْجَنَّةِ وَالرَّجُلُ يَزُورُ أَخَاهُ فِي نَاحِيَةِ الْمِصْرِ فِي الْجَنَّةِ، ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে খবর দিব না? নবী জান্নাতী, শহীদ জান্নাতী, ছিদ্দীক্ব জান্নাতী, নবজাতক জান্নাতী, আর ঐ ব্যক্তিও জান্নাতী যে তার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে’।[13]
ভালবাসার বস্ত্ত আল্লাহর পথে উৎসর্গ করা :
আবার কখনও ভালবাসার প্রিয়বস্ত্তকে আল্লাহর জন্য সোপর্দ করা জান্নাত লাভের মাধ্যম। যেমন হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু তালহা (রাঃ) মদীনার আনছারদের মধ্যে খেজুর বাগানের মালিক হিসেবে সর্বাধিক সম্পদশালী ছিলেন। আর তার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিল মসজিদে নববী সামনের ‘বায়রাহা’ নামক বাগানটি। রাসূল (ছাঃ) এ বাগানটিতে প্রায়ই প্রবেশ করতেন ও এর পবিত্র পানি পান করতেন।
আনাস (রাঃ) বলেন, যখন অর্থাৎ তোমরা ততক্ষণ জান্নাতে অবশ্যই পৌঁছতে পারবে না, যে পর্যন্ত তোমাদের প্রিয়তর জিনিস আল্লাহর পথে খরচ না করবে’ (আলে ইমরান ৩/৯২)। এ আয়াত নাযিল হ’ল; তখন আবু তালহা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অর্থাৎ আমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ ‘বায়রাহা’ আল্লাহর নামে ছাদাক্বা করলাম। আমি আশা করব আমি এর জন্য আল্লাহর কাছে ছওয়াব পাব। হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তা কবুল করুন। যে কাজে আল্লাহ চান তাতে আপনি তা লাগান। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাবাশ! সাবাশ!! বলে উঠলেন। তিনি বললেন, এ সম্পদ খুবই কল্যাণকর হবে। তোমার ঘোষণা আমি শুনেছি। এ বাগানটি তুমি তোমার গরীব নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দাও। আবু তালহা (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর আসূল! আমি তাই করব। অতঃপর আবু তালহা (রাঃ) খেজুর বাগানটিকে তাঁর নিকটাত্মীয় ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন।[14]
পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধির উপায় :
১. সালামের প্রসার :عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ঈমানদার ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের তা বলে দিব না, কি করলে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালবাসার সৃষ্টি হবে? তা হ’ল, তোমরা পরস্পর বেশি বেশি সালাম বিনিময় করবে।[15]
২. হাদিয়া প্রদান : ইসলাম পরস্পরকে হাদিয়া দিতে উৎসাহিত করেছে। পরস্পরের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টিতে তা সহায়ক হয়। এবিষয়ে হাদীছে এসেছে, ‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত। নবী (ছাঃ) বলেন, তোমরা পরস্পর উপহারাদি বিনিময় কর, তোমাদের পারস্পরিক মহববত সৃষ্টি হবে।[16] রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা দাওয়াত কবুল কর এবং হাদিয়া ফেরৎ দিয়ো না’।[17]
৩. ভালবাসার কথা জানানো : নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا أَحَبَّ الرَّجُلُ أَخَاهُ فَلْيُخْبِرْهُ أَنَّهُ يُحِبُّهُ ‘যখন কোন ব্যক্তি তার কোন ভাইকে ভালবাসে, তখন সে যেন তাকে বলে, আমি তোমাকে ভালবাসি।
উপসংহার :
এক মুসলমান অপর মুসলমানকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও ক্বিয়ামতের দিন জান্নাত লাভের আশায় ভালবাসতে হবে। এই ভালবাসা যেন দুনিয়াবী স্বার্থে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবেই এই ভালবাসার বন্ধন পবিত্র ও কল্যাণময় হবে। মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান যুগে প্রচলিত তথাকথিত ভালবাসা দিবস পালন করা এবং মানব-মানবীর মাঝে অবৈধ ভালবাসা যে রমরমা চলছে, তা কখনই আল্লাহর সন্তুষ্টি ডেকে আনে না। বরং তাতে রয়েছে আল্লাহর গযব ও যাবতীয় অকল্যাণ। অতএব আমাদেরকে অবশ্যই হারাম ভালবাসার অপবিত্র বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আল্লাহর আমাদেরকে প্রকৃত ভালবাসায় উজ্জীবিত করুন এবং যাবতীয় হারাম প্রেম-ভালবাসা থেকে বিরত থাকার তাওফীক দান করুন। আমাদেরকে তার সন্তুষ্টি ও ভালবাসা অর্জন করে মৃত্যুবরণের তাওফীক দান করুন।- আমীন!
তামান্না-ই জান্নাত
লেখক : ইত্তা, মনিরামপুর, যশোর।]
[1]. আবু দাউদ হা/৪৬৮১; মিশকাত হা/৩০।
[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬২০৭।
[3]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০১১।
[4]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৭৩২৩; ছহীহাহ হা/৪৫০।
[5]. বুখারী হা/১৫; মুসলিম হা/৪৪; ইবনু মাজাহ হা/৬৭।
[6]. বুখারী হা/৬৬৩২।
[7]. বুখারী হা/১৬, ২১, ৬০৪১।
[8]. বুখারী হা/৬০১১; মুসলিম হা/২৫৮৬; মিশকাত হা/৪৯৫৩।
[9]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৮, সনদ হাসান।
[10]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯, সনদ হাসান।
[11]. বুখারী হা/৬১৬৯; মুসলিম হা/২৬৪০; মিশকাত হা/৫০০৮।
[12]. বুখারী হা/৬১৬৭; মুসলিম হা/২৬৩৯; মিশকাত হা/৫০০৯।
[13]. ছহীহাহ হা/২৮৭; ছহীহুল জামে‘ হা/২৬০৪।
[14]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৯৪৫।
[15]. মুসলিম হা/৫৪।
[16]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪।
[17]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১৫৭; আহমাদ হা/৩৮৩৮, সনদ ছহীহ।