অধিকাংশ সমাচার (৩য় কিস্তি)
লিলবর আল-বারাদী
লিলবর আল-বারাদী 710 বার পঠিত
ঝ. অশ্ললীলভাষী, অভিশাপকারী ও খোঁটাদানকারী : মুমিন মানুষ সর্বদা মেপে মেপে পরিমিত কথা বলবে। বাচাল, অশালীন ও কর্কশভাষী, অভিশাপ দেয় এমন ব্যক্তি মুমিন হ’তে পারে না। এরা সরাসরি জান্নাতে যেতে পারবে না। আব্দুুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَيْسَ المُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلَا اللَّعَّانِ وَلَا الفَاحِشِ وَلَا البَذِيءِ. ‘মুমিন কখনো দোষারোপকারী ও নিন্দাকারী, অভিশাপকারী, অশ্ললীল কাজ সম্পাদনকারী এবং কটুভাষী হ’তে পারে না’।[1] অন্যত্র আনাস (রাঃ) বলেন, لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَاحِشًا، وَلاَ لَعَّانًا، وَلاَ سَبَّابًا، كَانَ يَقُولُ عِنْدَ الْمَعْتَبَةِ: مَا لَهُ تَرِبَ جَبِينُهُ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনো অশ্লীলভাষী, অভিশাপকারী বা গালি বর্ষণকারী ছিলেন না। অসন্তুষ্ট হ’লে তিনি বলতেন, তার কি হ’ল? তার কপাল ধূলিমলিন হোক’।[2]
ঞ. নিজ পিতা ব্যতীত অন্য ব্যক্তিকে পিতা বলে দাবীকারী : কোন ব্যক্তি স্বজ্ঞানে অন্য ব্যক্তিকে নিজের পিতা বলে দাবী করলে সে ব্যক্তি মুমিন থাকে না এবং তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়। হযরত সা‘দ ও আবু বকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইরশাদ করেন, مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ وَهْوَ يَعْلَمُ فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ. ‘যে ব্যক্তির পিতৃপরিচয় থাকা সত্ত্বেও জেনে বুঝে অন্যকে নিজের পিতা বলে দাবী করে, তার জন্য জান্নাত হারাম’।[3]
ট. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি নাফরমান ব্যক্তি : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতি যারা আনুগত্য করেন, কেবল তারাই জান্নাতে যাবেন। আর নাফরমান ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইরশাদ করেন, كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى ‘আমার সব উম্মত জান্নাতে যাবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যে অস্বীকার করেছে’। ছাহাবীগণ আরজ করলেন, হে আল্লাহ রাসূল! কে অস্বীকার করেছে? তিনি বললেন,مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى ‘যারা আমার আনুগত্য স্বীকার করেছে তারা জান্নাতে যাবে। আর যে আমার নাফরমানী করল, সে (জান্নাতে যেতে) অস্বীকার করেছে’।[4]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ عَصَى اللَّهَ وَمَنْ يُطِعِ الأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِى وَمَنْ يَعْصِ الأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِى وَإِنَّمَا الإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللَّهِ وَعَدَلَ ، فَإِنَّ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ ‘আমরা (পৃথিবীতে) সর্বশেষে আগমনকারী এবং (জান্নাতে) সর্বাগ্রে প্রবেশকারী। আর যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলারই আনুগত্য করল; আর যে ব্যক্তি আমার নফরমানী করল, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলারই নাফরমানী করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আমারই আনুগত্য করল; আর যে ব্যক্তি আমীরের নাফরমানী করল সে ব্যক্তি আমারই নাফরমানী করল। ইমাম তো ঢাল স্বরূপ। তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ এবং তাঁরই মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করা হয়। অনন্তর যদি সে আল্লাহর তাক্বওয়ার নির্দেশ দেয় এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে, তবে তার জন্য এর প্রতিদান রয়েছে, আর যদি সে এর বিপরীত করে তবে এর মন্দ পরিণতি তার উপরই বর্তাবে’।[5] রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করলে আল্লাহর আনুগত্য করা হয়। আর যে ব্যক্তি তা না করে অবশ্যই সে নাফরমান ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হবে। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ. ‘যে মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে আসলে আল্লাহরই অবাধ্যতা করল। আর মুহাম্মাদ হ’লেন মানুষের মাঝে পার্থক্যের মাপকাঠি’।[6]
ঠ. বিনা অপরাধে যিম্মীকে যে হত্যাকারী : ইসলামে যিম্মী ব্যক্তির সাথে উত্তম আচরণ করতে বলা হয়েছে। তাকে হত্যা করা বড় পাপ। হত্যাকারী জান্নাতে প্রবেশ তো দূরের কথা জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَتَلَ مُعَاهَدًا لَمْ يَرَحْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ، وَإِنَّ رِيحَهَا تُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ أَرْبَعِينَ عَامًا ‘যে ব্যক্তি কোন যিম্মীকে হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না। আর জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব থেকে পাওয়া যাবে’।[7]
ড. বাহাদুরী যাহির করা ও মানুষকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ইলম অর্জনকারী : একজন ইলম অর্জনকারী জ্ঞানের ভারে নুয়ে পড়ে। তারা দুনিয়াতে বিনয়ী ও আখিরাতমুখী হয় এবং বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হয় না। পক্ষান্তরে বাহাদুরী যাহির ও মানুষকে আকৃষ্ট করা ব্যক্তিগণ বৈষয়িক কথাবার্তায় চমৎকার মিষ্টভাষী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি। আল্লাহ বলেন,َمِنَ النَّاسِ مَنْ يُعْجِبُكَ قَوْلُهُ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيُشْهِدُ اللَّهَ عَلَى مَا فِي قَلْبِهِ وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ ‘আর মানুষের মধ্যে এমনও কিছু লোক রয়েছে, যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করবে। আর তারা নিজের মনের কথার ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষী স্থাপন করে। প্রকৃতপক্ষে তারা কঠিন ঝগড়াটে লোক’ (বাক্বারাহ ২/২০৪)।
বাহাদুরী যাহির করা ও ঝগড়াটে ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ لِيُبَاهِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ وَيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ وَيَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ جَهَنَّمَ. ‘যে ব্যক্তি আলেমদের উপর বাহাদুরী যাহির করা, নির্বোধদের সাথে ঝগড়া করা এবং নিজের দিকে সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন’।[8]
একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য জ্ঞানার্জন করতে হবে। অন্যথায় ক্বিয়ামতের মাঠে লাঞ্চিত হ’তে হবে এবং জান্নাতের সুগন্ধিও হারাম হয়ে যাবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ. ‘যে ব্যক্তি এমন জ্ঞান অর্জন করল, যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, তা সে কেবল পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে অর্জন করল, ক্বিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধ পর্যন্ত পাবে না’।[9]
ঢ. চোগলখোর ব্যক্তি : চোগলখোরী নিন্দনীয় গুনাহ। অধিক কসমকারী, পশ্চাতে নিন্দাকারী এবং চোগলখোরী করে বেড়ায় এমন ব্যক্তিদের ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ ‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে সামনে নিন্দাকারী ও পেছনে গীবতকারী’ (হুমাযাহ ১০৪/০১)। অন্যত্র বলেন, هَمَّازٍ مَشَّاءٍ بِنَمِيمٍ ‘পিছনে নিন্দাকারী ও যে চোগলখুরী করে বেড়ায়’ (ক্বালাম ৬৮/১১)। চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না। এর জন্য জাহান্নাম অনিবার্য। হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইরশাদ করেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[10]
ণ. কালো কলপ ব্যবহারকারী : কালো কলপ ব্যবহার করা সকল মুসলমান নর-নারীর জন্য নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে হলুদ অথবা লাল রং দিয়ে সাদা দাঁড়ি ও মাথার চুল রাঙাতে হবে। কেননা এটা ইহুদী-নাছারাদের বিরোধীতা করা। ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَكُونُ قَوْمٌ يَخْضِبُونَ فِى آخِرِ الزَّمَانِ بِالسَّوَادِ كَحَوَاصِلِ الْحَمَامِ لاَ يَرِيحُونَ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ ‘শেষ যামানায় এমন এক শ্রেণীর লোক হবে; যারা পায়রার ছাতির মতো কালো কলপ ব্যবহার করবে, তারা জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না’।[11]
ত. অধিনস্থদের সাথে খিয়ানতকারী নেতা : খিয়ানতকারী দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জগতে হেয়প্রতিপন্ন হবে। ক্বিয়ামতের মাঠে খিয়ানতকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্য আলাদা আলাদা পতাকা দেয়া হবে, যা তার পিঠের পেছনে পুঁতে দেওয়া হবে। আর জনগণের খিয়ানতকারী সবচেয়ে বড় খিয়ানতকারী। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ عِنْدَ اسْتِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَفِي رِوَايَةٍ : لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرْفَعُ لَهُ بِقَدْرِ غَدْرِهِ أَلاَ وَلاَ غَادِرَ أَعْظَمُ غَدْرًا مِنْ أَمِيرِ عَامَّةٍ ‘প্রত্যেক খিয়ানতকারীর জন্য ক্বিয়ামতের দিন একটি ঝান্ডা থাকবে, যা তার পিঠের পিছনে পুঁতে দেওয়া হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তার খিয়ানতের পরিমাণ অনুযায়ী সেটি উঁচু হবে। সাবধান! জনগণের নেতার খেয়ানতের চাইতে বড় খেয়ানত আর হবে না’।[12]
সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা খিয়ানত করতে নিষেধ করে বলেন, يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَخُونُوا اللهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوآ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খিয়ানত করো না এবং জেনে-শুনে তোমাদের পরস্পরের আমানত সমূহে খিয়ানত করো না’ (আনফাল ৮/২৭)।
কিন্তু খিয়ানতকারী যদি নেতা হয়, তবে তা বড় আফসোসের বিষয় হবে। কারণ নেতার অধিনস্ত ব্যক্তিরা নেতাকে অনুসরণ করে এবং তাদের বৈষয়িক বিষয়ে চাওয়া পাওয়া নেতার আমানতের মধ্যে নিহিত থাকে। হোক তা পরিবারের, সমাজের, কিংবা রাষ্ট্রের সংগঠনের নেতা। এসকল খেয়ানতকারী নেতা জান্নাতে যাবে না। হাসান (রহঃ) বলেন, মা‘কিল ইবনু ইয়াসার-এর মৃত্যুশয্যায় উবাইদুল্লাহ ইবনু যিয়াদ তার সাক্ষাতে যান। মা‘কিল তাকে বললেন, আজ তোমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে শোনা এমন একটি হাদীছ শুনাবো যা আমি আরো বেঁচে থাকব বলে জানলে তা কিছুতেই শুনাতাম না। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে একথা বলতে শুনেছি,مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً، يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ، إِلَّا حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ. ‘আল্লাহ তা‘আলা যাকে জনগণের দায়িত্ব দিয়েছেন, কিন্তু খেয়ানতকারীরূপে যদি তার মৃত্যু হয়। তবে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন’।[13]
১০. অধিকাংশ গরীব ও দুর্বল ব্যক্তি জান্নাতী : আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্যশীল ব্যক্তি দুনিয়াতে গরীব ও দুর্বল হ’লেও আখেরাতের চূড়ান্ত পরীক্ষায় সে হবে সফলকাম। প্রবেশ করবে চির শান্তির আবাস জান্নাতে। বর্তমান এই সমাজের গরীব-মিসকীন ও দুর্বল শ্রেণীই অধিকহারে আল্লাহর বিধানের প্রতি আনুগত্যশীল হয়। ফলে জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসীও হবে তারাই। ডান হাতে আমলনামা পেয়ে আনন্দচিত্তে সেদিন জান্নাতি বান্দা বলে উঠবে, إِنِّي ظَنَنْتُ أَنِّي مُلَاقٍ حِسَابِيَهْ - فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ - فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٍ - قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ - كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا أَسْلَفْتُمْ فِي الْأَيَّامِ الْخَالِيَةِ - ‘নিশ্চয়ই আমি জানতাম যে, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হ’তে হবে। অতঃপর সে সুখী জীবন-যাপন করবে। সুউচ্চ জান্নাতে। যার ফল সমূহ থাকবে অবনমিত। (বলা হবে) বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে তার প্রতিদানে তৃপ্তি সহকারে খাও এবং পান কর’ (হাক্কাহ ৬৯/২০-২৪)।
হারিসাহ্ ইবনু ওহায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لأَبَرَّه، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ. ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতবাসী লোকেদের কথা বলে দেব না? তারা হলেন বৃদ্ধ ও দুর্বল লোক। তারা যদি আল্লাহর দরবারে কসম করে, তখন আল্লাহ তাদের সে শপথকে সত্যে পরিণত করে দেন। তিনি আরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামবাসী লোকেদের কথা বলে দেব? তারা হ’ল, মিথ্যা ও তুচ্ছ বস্ত্ত নিয়ে অতি বিবাদকারী, ঠান্ডা মাথায় ধন-সম্পদ সঞ্চয়কারী ও অহংকারী ব্যক্তি’।[14] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম। দেখলাম, যারা জান্নাতে প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশই গরীব-মিসকীন। আর ধনীদেরকে (হিসাবের জন্য) আটকে রাখা হয়েছে ...।[15] অন্যত্র তিনি বলেন, আমি জান্নাতে উঁকি মেরে দেখলাম যে, এর অধিকাংশ অধিবাসী হ’ল গরীব-মিসকীন ...।[16]
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,احْتَجَّتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ فَقَالَتِ النَّارُ فِىَّ الْجَبَّارُونَ وَالْمُتَكَبِّرُونَ. وَقَالَتِ الْجَنَّةُ فِىَّ ضُعَفَاءُ النَّاسِ وَمَسَاكِينُهُمْ. قَالَ فَقَضَى بَيْنَهُمَا إِنَّكِ الْجَنَّةُ رَحْمَتِى أَرْحَمُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ وَإِنَّكِ النَّارُ عَذَابِى أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ وَلِكِلاَكُمَا عَلَىَّ مِلْؤُهَا. ‘জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যে বিবাদ হ’ল। জাহান্নাম বলল, আমার মধ্যে উদ্ধত ও অহংকারী লোকেরা থাকবে। আর জান্নাত বলল, আমার মধ্যে দুর্বল ও দরিদ্র ব্যক্তিরা থাকবে। অতঃপর আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ফায়ছালা করলেন এইভাবে যে, তুমি জান্নাত আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। আর তুমি জাহান্নাম আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিব। তোমাদের উভয়কেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব’।[17] ধনী ব্যক্তিরা হালাল পন্থায় উপার্জন করলেও ক্বিয়ামতের মাঠে সকল সম্পদের আয় ও ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে। কিন্তু গরীব মুমিন ব্যক্তি ধনীদের পূর্বে সম্পদের হিসাব শেষ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘দরিদ্ররা ধনীদের চাইতে পাঁচ শত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তা হ’ল (আখেরাতের) অর্ধদিনের সমান’।[18] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘দরিদ্র মুসলমানগণ ধনীদের চাইতে অর্ধদিন পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর এই অর্ধদিন হ’ল পাঁচ শত বছরের সমান’।[19]
মানুষের অপছন্দের এ দু‘টি বস্ত্ত হ’ল তার স্বভাবগত, অথচ তা তার জন্য কল্যাণকর। সে অপছন্দের বস্ত্ত দু‘টি হ‘ল মৃত্যু এবং স্বল্প সম্পদ। মাহমূদ ইবনু লাবীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,اثْنَتَانِ يَكْرَهُهُمَا ابْنُ آدَمَ: يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَالْمَوْتُ خَيْرٌ لِلْمُؤْمِنِ مِنَ الْفِتْنَةِ وَيَكْرَهُ قِلَّةَ الْمَالِ وَقلة المَال أقل لِلْحسابِ. ‘আদম সন্তান দু‘টি জিনিসকে অপছন্দ করে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে অথচ মু’মিনের পক্ষে ফেৎনায় পতিত হওয়ার চেয়ে মৃত্যু অনেক উত্তম। আর সে মাল-সম্পদের স্বল্পতাকে অপছন্দ করে অথচ মালের স্বল্পতায় (পরকালে) হিসাবনিকাশ কম হয়’।[20]
১১. অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি ও ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না : সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা সম্পর্কে সৃষ্টির জ্ঞান ও দৃষ্টি সীমানার বাহিরে। কোন সৃষ্টি জীব এ বিষয়ে সঠিক ধারনা পোষণ করতে পারে না। অনুরূপভাবে হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ হ’তেই এসে থাকে। তিনিই তাঁর নেক বান্দাদের অন্তরে সুপথ গ্রহণের শক্তি ও যোগ্যতা দান করেন। এটা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, إِنَّكَ لاَ تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ‘আপনি যাকে চান, তাকে হেদায়াত করতে পারেন না। বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়াত দান করেন এবং হেদায়াতপ্রাপ্তদের বিষয়ে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞান রাখেন’ (ক্বছাছ ২৮/৫৬)। যদিও আল্লাহ তা‘আলা হেদায়াত গ্রহণের ফিৎরাতগত (স্বভাবগত) যোগ্যতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দান করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ দ্বীনের সরল পথের ওপর দৃঢ়চিত্ত না হয়ে এই স্বভাবটাকে প্রবৃত্তিতে পরিবর্তন করে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে। অথচ আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ ‘তুমি তোমার চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে ধর্মের উপরে দৃঢ় রাখ। এটাই হ’ল আল্লাহর দেয়া স্বভাবধর্ম (ফিৎরাত), যার ওপরে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই হ’ল সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানেনা’ (রূম ৩০/৩০)। ফিৎরাত দ্বারা স্বভাবগত দ্বীন ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। উদ্দেশ্য হ’ল আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মানুষকে প্রকৃতিগতভাবে মুসলিম ফিৎরাতের ওপর সৃষ্টি করেছেন। যদি পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশগত কোন কিছুর মন্দ প্রভাব না পড়ে, তবে প্রতিটি জন্মগ্রহণকারী শিশু ভবিষ্যতে মুমিন মুসলমান হবে। কিন্তু পারিবারিক অভ্যাসগতভাবেই পিতা-মাতা তাকে ইসলাম বিরোধী বিষয়াদি শিক্ষা দেয়। ফলে ফিৎরাতের স্বভাব পরিবর্তন হয় এবং সে ইসলামের উপর কায়েম হ’তে পারে না। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ مَوْلُوْدٍ إِلَّا يُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ كَمَا تُنْتَجُ الْبَهِيْمَةُ بَهِيْمَةً جَمْعَاءَ هَلْ تُحِسُّوْنَ فِيْهَا مِنْ جَدْعَاءَ ثُمَّ يَقُوْلُ (فِطْرَةَ اللهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ). ‘সকল মানব শিশুরই ফিৎরাত (ইসলাম)-এর ওপর জন্ম হয়। তারপর তার পিতা ও মাতা তাকে ইয়াহূদী, নাছারা অথবা অগ্নি উপাসক করে ফেলে। যেমন জানোয়ার পূর্ণ বাচ্চার জন্ম দেয়। তোমরা কি তার মধ্যে কোন ত্রুটি পাও? পরে তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। আল্লাহর প্রকৃতির (ফিৎরাতের) অনুসরণ কর, তিনি যে ফিৎরাত (প্রকৃতি) মোতাবেক মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দ্বীন’।[21] ফিৎরাত বলে যোগ্যতা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে স্রষ্টাকে চেনার ও তাঁকে মেনে চলার যোগ্যতা নিহিত রেখেছেন। এর ফলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে যদি সে যোগ্যতাকে কাজে লাগায়’ (ফাতহুল কাদীর; কুরতুবী)।
আল্লাহর জ্ঞানের পরিধি মানুষ কল্পনা করে শেষ করতে পারবে না। তিনি সর্বোজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী এবং সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাবান। তিনি প্রতিপালক হিসেবে পাথর ও মৃতদেরকে জীবন দান করেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় অধিকাংশ মানুষ স্ববিরোধিতা করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলাকে স্রষ্টা ও প্রতিপালক হিসেবে স্বীকার করার পরেও তারা মূর্তিদের প্রয়োজন পূরণকারী, ক্ষমতাবান ও ইবাদতের যোগ্য মনে করে শিরক করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন কর, ‘কে আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দ্বারা যমীনকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করেন’? তবে তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। বল, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর’। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বুঝে না’ (আনকাবূত ২৯/৬৩)। অথচ আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের প্রতিফল দিবসে প্রত্যেককে তার ভাল ও মন্দ কর্ম অনুযায়ী পরিপূর্ণ প্রতিদান শান্তি ও শাস্তি প্রদান করবেন এবং সেইদিন সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই ন্যাস্ত থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا وَالأَمْرُ يَوْمَئِذٍ للهِ. ‘সেদিন (ক্বিয়ামত দিবসে) কেউ কারু কোন উপকারে আসবে না। বরং সকল কর্তৃত্ব থাকবে একমাত্র আল্লাহর’ (ইনফিতার ৮২/১৯)।
আল্লাহ একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। সবকিছুই তাঁর সৃষ্টি এবং তিনিই একমাত্র রায্যাক ও মহাব্যবস্থাপনায় একক; তাঁর কোন শরীক নেই। আকাশকে এত উঁচু ও সুন্দর করে সৃষ্টিকারী ও চলমান গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টিকারী অনুরূপ পৃথিবী ও তার মাঝে পাহাড়, নদ-নদী, সমুদ্র, গাছ-পালা, ফল-ফসল, নানা প্রকারের পশু-পক্ষী সৃষ্টিকারী, আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করে সুন্দর বাগান উৎপাদনকারী কে? সেই প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাঁর ক্ষমতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, أَمَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ لَكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنْبَتْنَا بِهِ حَدَائِقَ ذَاتَ بَهْجَةٍ مَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُنْبِتُوا شَجَرَهَا أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ يَعْدِلُونَ- أَمَّنْ جَعَلَ الْأَرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلَالَهَا أَنْهَارًا وَجَعَلَ لَهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ. ‘বরং তিনি (আল্লাহ শ্রেষ্ঠ), যিনি আসমানসমূহ ও যমীনকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য তিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। আল্লাহর সাথে কি অন্য কোন ইলাহ আছে? বরং তারা এমন এক কওম যারা শিরক করে। কিংবা তিনি, যিনি পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন। আর যমিনে প্রবাহিত করেছেন নদ-নদী ও পাহাড়-পর্বত স্থাপন করে তা সুদৃঢ় করেছেন এবং দুই সাগরের মধ্যখানে অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো ইলাহ আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই (মানুষ) জানে না’ (নামল ২৭/৬০-৬১)। সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহকে রব, মুহাম্মাদ (ছাঃ) নবী এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মেনে নেয়া উচিৎ। তাহ’লে অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হবেন।
পরিশেষে আল্লাহ মানবজাতিকে কেন এবং কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, তা যদি মানুষ উপলব্ধি করত, তবে সে দেরী না করে তার রবের দিকে দ্রুত ফিরে যেত। কিন্তু আফসোস অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির উদ্দেশ্য তালাশ করে না। ফলে মানুষ আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (ইউসুফ বলল) ‘আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকুবের দ্বীন অনুসরণ করি। আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়। এটা আমাদের এবং সমস্ত মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না’ (ইউসুফ ১২/৩৮)।
আর যারা মনে করবে অনর্থক সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করবেন এবং জাহান্নামে ঢুকাবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا بَاطِلًا ذَلِكَ ظَنُّ الَّذِينَ كَفَرُوا فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ كَفَرُوا مِنَ النَّارِ ‘আমি আকাশ, পৃথিবী এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোন কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করিনি। অনর্থক সৃষ্টি করার ধারণা তাদের যারা কাফির, কাজেই কাফিরদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের দুর্ভোগ’ (সোয়াদ ৩৮/২৭)। মানুষ সৃষ্টির মৌলিক উদ্দেশ্য আল্লাহর দাসত্ব করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি জিন ও ইনসানকে কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)।
আল্লাহ অধিক সিজদাকারীকে পছন্দ করেন এবং ভালবাসেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নবী ও রাসূল (ছাঃ)-কে বিশেষভাবে প্রত্যাদেশ করেন, فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِيْنَ، وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ. ‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসা বর্ণনা কর এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। আর তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর, যতক্ষণ না মৃত্যু তোমার নিকট উপস্থিত হয়’ (হিজর ১৫/৯৮-৯৯)। জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম পন্থা হ’ল আল্লাহর প্রতি সিজদায় অবনত হওয়া। আল্লাহর সাথে শরীককারীর প্রতি তিনি যেমন রাগান্বিত হোন তেমনি তিনি সিজদাকারীর প্রতি অধিক খুশি হোন। রাবী‘আহ ইবনে কা‘ব (রাঃ) বলেন, আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ওটা ছাড়া আর কিছু চাও কি? আমি বললাম, এটাই চাই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَأَعِنِّى عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ ‘তাহ’লে বেশী বেশী সিজদার দ্বারা তুমি এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কর’।[22] সিজদার মাধ্যমে মানুষ জান্নাতে যেতে পারে এটা সহজ সরল পন্থাগুলোর অন্যতম। আর অধিকাংশ মানুষ যদি আল্লাহর সাথে শরীক না করে বেশী বেশী সিজদা করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, তাহ’লে ক্ষতিগ্রস্থ অধিকাংশ মানুষই আখেরাতে আল্লাহ বিশেষ রহমতে জান্নাতে যেতে সক্ষম হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ সহজভাবে বুঝার জ্ঞান দান করুন এবং জেনে বুঝে আমল করার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।
লিলবর আল-বারাদী
[লেখক : যশপুর, তানোর, রাজশাহী ]
[1].তিরমিযী হা/১৯৭৭, হাসান হাদীছ।
[2].বুখারী হা/৬০৪৬; মিশকাত হা/৫৮১১।
[3].বুখারী হা/ ৪৩২৬; মুসনাদের আহমাদ হা/১৪৯৯; সনদ ছহীহ।
[4].বুখারী হা/৭২৮০; মিশকাত হা/১৪৩।
[5].বুখারী হা/২৯৫৭; মিশকাত হা/৩৬৬১; ছহীহুল জামি‘ হা/৪৫১৩।
[6]. বুখারী হা/৭২৮১, ‘কুরআন ও সান্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১৪৪।
[7].বুখারী হা/৩১৬৬।
[8]. ইবনু মাজাহ হা/২৬০; হাসান হাদীছ।
[9]. আবূ দাঊদ হা/৩৬৬৪; মিশকাত হা/২২৭; আহমাদ হা/৮৪৩৮; ইবনু হিববান হা/৭৮।
[10]. বুখারী হা/৬০৫৬; মুসলিম হা/১০৫; মিশকাত হা/৪৮২৩।
[11]. আবুদাউদ হা/৪২১২; ছহীহুত তারগীব হা/২০৯৭; ছহীহ হাদীছ।
[12]. মুসলিম হা/১৭৩৮; মিশকাত হা/৩৭২৭ ‘নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা’ অধ্যায়।
[13]. মুসলিম হা/১৪২; সূনানে দারেমী হা/২৭৯৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬৩১।
[14]. বুখারী হা/৪৯১৮; মুসলিম হা/২৮৫৩; তিরমিযী হা/২৬০৫; মিশকাত হা/৫১০৬।
[15]. বুখারী হা/৫১৯৬; মুসলিম হা/২৭৩৬; মিশকাত হা/৫২৩৩; ছহীহুল জামি‘ হা/৪৪১১।
[16]. বুখারী হা/৩২৪১; মুসলিম হা/২৭৩৭; তিরমিযী হা/২৬০২; মিশকাত হা/৫২৩৪।
[17]. আহমাদ হা/১১৭৭১; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৯০০; সনদ ছহীহ।
[18]. তিরমিযী হা/২৩৫৩; মিশকাত হা/৫২৪৩।
[19]. তিরমিযী হা/২৩৫৪, সনদ হাসান ছহীহ।
[20]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫২৫১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮১৩।
[21]. বুখারী হা/১৩৫৮, ৪৭৭৫; মিশকাত হা/৯০।
[22]. মুসলিম হা/৪৮৯; মিশকাত হা/৮৩৬।