বলিভিয়ার মিখাইল তানসার ইসলাম গ্রহণ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
[সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘুরতে আসা দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় ইউটিউবার দাঊদ কিমের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম ও ঢাকার লালবাগে উঠানো দু’টি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩১ বছর বয়সী এই যুবকের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার শেওনানে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও তিউনিশিয়ার মত দেশগুলোর মুসলিম ভক্তদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দাঊদ ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর দাঊদ ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা নগরী ভ্রমণ করেন। সেখানকার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ ও আধ্যাত্মিক আবহ তার মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি তৈরি করে। মুসলিম দেশগুলো ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি ইসলামের ভ্রাতৃত্বকে আরও প্রবলভাবে অনুধাবন করেন। নিম্নে তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হ’ল।-নির্বাহী সম্পাদক]
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : দাঊদ কিম ১৯৯২ সালের ৯ই জানুয়ারী দক্ষিণ কোরিয়ার শেওনানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জে কিম নামে পরিচিত ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর নিজের নাম পরিবর্তন করে নবী দাঊদ (আঃ)-এর নামের সাথে মিল রেখে দাঊদ কিম রেখেছেন। প্রাথমিক জীবনে তিনি কোরিয়ার একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরিবেশ গবেষণা এবং রাজনীতিতে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু স্কুল জীবন থেকেই তার পপ সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। বিধায় সঙ্গীত বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর পপ গানকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ২০১৩ সালের ২৩ আগষ্ট তিনি ইউটিউবে যুক্ত হয়ে তার দৈনন্দিন জীবন ধারার বিভিন্ন ভিডিও ও ব্লগ তৈরীর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক। তার স্ত্রীও ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
ইসলাম গ্রহণ : দাঊদ ২০১৯ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের কারণ হিসাবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত ইসলাম সম্পর্কে আমার প্রথম স্মৃতিই হচ্ছে ‘নাইন ইলেভেন’। ঐ সময়ে আমার বয়স প্রায় আট বছর। আমি টিভিতে দেখলাম একটি অনেক বড় বিল্ডিং ধসে পড়ল। আর তখনই প্রথমবারের মত ‘ইসলাম’ নামক শব্দটি আমি শুনেছিলাম। আমি ততটা জানতাম না কিন্তু ভেবে নিয়েছিলাম ইসলাম মানেই ভয়ংকর কিছু। কারণ মিডিয়া সর্বদাই ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ছবিগুলো দেখাচ্ছিল। তাই আমিও ভেবেছিলাম মুসলিমরা ভয়ংকর এবং কঠোর স্বভাবের।
আমি একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিলাম। আমার ধর্ম সম্পর্কে কোনই আগ্রহ ছিল না। শুধু নিজের জীবন কাটাতেই ব্যস্ত ছিলাম। একদিন ইসলাম সম্পর্কে আমার সমস্ত খারাপ ধারণার অবসান ঘটে। আমি কোরিয়াতে একজন গায়ক হিসাবে পরিচিতি হচ্ছিলাম। একবার ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় একটি গানের লাইভ শো করার সুযোগ পাই। ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান এতই কম ছিল যে, ইন্দোনেশিয়াতে যে মুসলিমরা বসবাস করে আমি সেটা জানতাম না। ইন্দোনেশিয়ায় মূলত দু’টি জিনিস আমাকে অনেক অবাক করেছে। প্রথমটি হ’ল, আমি যতটুকু আশা করেছিলাম এর চেয়েও অনেক বেশী তারা দয়ালু ছিল। দ্বিতীয়টি হ’ল, পর্দাবৃত কিছুসংখ্যক মেয়েকে দেখেছিলাম। তখন ‘হিজাব’ শব্দটার সাথেও পরিচিত ছিলাম না। কৌতূহলবশত হিজাব পরা একটি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কেন তোমার চেহারা ওড়নায় আবৃত করে রেখেছ? কেউ কি তোমাকে জোর করেছে? উত্তরে মেয়েটি বলল, আমি হ’লাম হীরা, অনেক মূল্যবান। তাই আমি চাই না আমার চেহারা কেউ দেখুক। আমাকে কেউ জবরদস্তি করে নি। এটি আমার স্বাধীনতা এবং আমি এটি নিয়ে অনেক গর্বিত। এই উত্তর শুনে আমি বিস্মিত হয়ে যাই। আমি ভেবেছিলাম এটা হয়ত যুলুম কিন্তু তারা এটা নিয়ে সত্যিই গর্বিত। কোন জিনিসটা মেয়েটাকে গর্বিত করেছিল তখন আমি বুঝি নি। কেননা আমি জানতাম না পর্দা করা ধর্মীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।
আমি কোরিয়াতে ফিরে আসলাম। হঠাৎ আমার বাবার চাকরি চলে গেল। আমি গান ছেড়ে ইউটিউবে কাজ করা শুরু করলাম। আমি একটি কঠিন সময় পার করছিলাম। কারণ আমার জীবনের লক্ষ্যই ছিল সঙ্গীত। কিন্তু সেটাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। তাই আমি আমার জীবনের প্রেরণা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি পুরোপুরিভাবে হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে কোন শান্তি ছিল না। আমি সৃজনশীল কিছু করতে চাইছিলাম। সেজন্য ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমদের সম্পর্কে আমার স্মৃতিতে থাকা কথাগুলো যথেচ্ছভাবে ইউটিউবে বলতে থাকি। আচমকা অনেক মানুষ আমার ভিডিওগুলো দেখা শুরু করল। এভাবেই আশ্চর্যজনকভাবে ইউটিউব আমাকে ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ করে দেয়। আমি কিছু মুসলিমের সাথে সাক্ষাৎ করি। সত্যিকারের মুসলিম, মিডিয়ার বানানো মুসলিম নয়। আমি তাদের কাছে পেয়েছিলাম এবং ইসলাম সম্পর্কে আমার অজানা বিষয়গুলো খুঁজতে লাগলাম। কেন তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে? কেন তারা প্রার্থনা করে? হালাল কী আর হারাম কী? কেন তারা শুকর খায় না, মদ্যপান করে না? আর মুহাম্মাদ (ছাঃ) কে? আমি কুরআন পড়া শুরু করলাম। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনী পাঠ করলাম। রামাযানের এক মাস ছিয়াম রাখলাম।
আর এসব কিছু ঘটেছে মাত্র কয়েক মাসে। অল্প অল্প করে যতই আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছিল ততই আমার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বাড়ছিল। তিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, পরিচালিত করছেন, তিনি চিরস্থায়ী, পরম করুণাময়, দয়ালু। যখন আমি ছিয়াম রেখেছিলাম, তখন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুধাবন করতে পেরেছি এবং আমি বুঝেছি আল্লাহই আমার মনে শান্তি দিতে পারেন। অবশেষে আমি আমার বিশ্বাস সম্পর্কে নিশ্চিত হই। তাই আমি একজন মুসলিম হওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করতে থাকি। তবুও আমি দীর্ঘসময় দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। অবশেষে আমি এভাবে চিন্তা করতে লাগলাম, আমি কেন নিজেকে চাপের মধ্যে ফেলছি। ইসলাম একটি ধর্ম যা আল্লাহ এবং আমার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করবে, অন্য কারও সাথে নয়। যদি আল্লাহ আমার জন্য কোন পরিকল্পনা করে রাখেন তাহ’লে আল্লাহই আমাকে সমাধান দিতে পারেন। এটাই সেই জিনিস যেটাকে আমি খুঁজছিলাম। এই বিষয়ে জানার জন্য আমি মসজিদে গেলাম এবং আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার এখন কি করা উচিত?
আশ্চর্যজনকভাবে আমার চিন্তাগুলো পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেল। আমি উপসংহার পেয়ে গেলাম, আমার আর দ্বিধায় ভোগা উচিত নয়। আমার অন্য কারও মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই। কারণ আমার জীবন শুধু আমারই, অন্য কারও নয়। আল্লাহর সাথে সম্পর্কটাও শুধু আমারই। তারা আমার জীবনের কোন দায়িত্ব নিবে না, এমনকি আমার বাবা-মাও নিবে না। আমি মনে করেছিলাম, আমি মুসলিম হ’তে পারব না। কারণ আমি ভীত ছিলাম আমার ভবিষ্যৎ পাপ বা ভুলগুলোর জন্য। কিন্তু পরে আমার মনে হ’ল এটি শুধুমাত্র আমার নিজের জন্য একটি অযুহাত। তাই আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম এবং ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করলাম।
সত্য বলতে ইসলাম নিয়ে আমার মনে এক প্রকার কুসংস্কার ছিল। দাড়ি, পাগড়ি, জুববা, বোরকা, হিজাব অদ্ভুত লাগত আমার কাছে। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় যখন আমার ফ্যানদের সাথে দেখা করেছিলাম, বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। আমার কুসংস্কার কর্পুরের মত উবে গেল। দেখলাম মুসলিমরা খুব দয়ালু ও নম্র। তাদের আচার-আচরণ মুগ্ধ করার মত। ঠিক যেমনটা আমি পছন্দ করি। আমি ভাবতাম জীবন একটা প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই হ’ল সফলতা। আমি ভাবতাম আমাকে লড়তে হবে এবং জিততে হবে। কিন্তু তারা ভিন্ন ছিল। তারা সর্বদাই অন্যকে সাহায্য করত। যা তাদেরকে দেয়া হত, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকত। তাদের জীবনাদর্শ আমাকে অনেক মুগ্ধ করে।
আমার এক মুসলিম বন্ধু বলেছে, জীবন প্রতিযোগিতা নয় বরং এটি একটি ভ্রমণ। এই ভ্রমণের লক্ষ্য হ’ল ছিরাতে মুস্তাকীমের পথে চলা তথা রবের দেখানো পথে চলা। যদি তুমি আল্লাহকে অনুসরণ করে সরল পথে চল তাহ’লে এই ভ্রমণ শেষে তোমার জন্য বিশাল কিছু একটা অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ, এটাই জান্নাত। যখন আমি এটা শুনলাম তখন আমার মনে হ’ল কেউ জোরেশোরে আমার চেহারায় একটি কিল মারল। এই বিশ্বাসের ভিত্তি এটাই যে, তুমি সত্য পথের উপর চলছ। এই বিষয়টা আমাকে স্পর্শ করে এবং আমার হৃৎপিন্ডকে ধাক্কা দেয়। এখন আমি দাঊদ এবং এর জন্য আমি খুবই গর্বিত। আমি একা একটি ছোট নৌকায় অন্ধকার এবং বিশাল সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। আমি ভাবছিলাম কিন্তু জানতাম না কোথায় আমাকে যেতে হবে। কিন্তু পরম করুণাময় আল্লাহ আমায় শনাক্ত করলেন। অবশেষে আমি জানি আল্লাহর আনুগত্যই এই ভ্রমণের আসল লক্ষ্য। এখন আমি জানি আমাকে কোথায় যেতে হবে। তিনি আমাকে আলোর সন্ধান দিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে পবিত্র উপহার।
ইসলাম গ্রহণের পর দাঊদ বলেন, ‘আসসালামুয়ালাইকুম। আমি ইসলামের প্রতি আগ্রহী হওয়ার পর থেকে আমার জীবনের অনেক কিছুই বদলে গেছে। আসলে আমি পুরোপুরি প্রস্ত্তত নই, তবে ধাপে ধাপে ভাল মুসলিম হওয়ার চেষ্টা করব। যদিও আমি আগে অনেক পাপ করেছি, তবুও আমার গুনাহ থেকে তওবা করে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই। যদিও আমি জন্মগতভাবে মুসলিম নই, তবুও আমি জানি আল্লাহ সর্বদা আমার সাথে আছেন। আমাকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ্কে ধন্যবাদ। আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর রাসূল’।
দাঊদ কিম ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল ওমরাহ পালন করেন। এ সময় পবিত্র কা‘বা চত্বরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘অবশেষে আমি মক্কায় পৌঁছালাম। আমি সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাকে বেছে নিয়েছেন এবং তিনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। পৃথিবীর পবিত্রতম শহরে আসার সুযোগ দেয়ার জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। সকল মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য দো‘আ করেছি। আল্লাহ আমাদের গুনাহ মাফ করুন এবং আমাদের দো‘আ কবুল করুন’।
ইসলামী সংগঠন সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে কিম বলেন, ‘মুসলিম সংগঠন সম্পর্কে আমি খুব বেশী জানি না। তবে ইতাইওনে একটি মুসলিম সংগঠন আছে, তারা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। আমি প্রত্যাশা করি কোরিয়ানরা বিশ্বাস করুক মুসলিমরা টেরোরিস্ট নয়, সভ্য নাগরিক। কারণ সেখানে মুসলিমদের সম্পর্কে ভাল তথ্য জানা খুব দুষ্কর। মিডিয়া সারাক্ষণ বিস্ফোরণ, তালেবান এবং আইএসআই নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এই মিথ্যা নিউজ তাদের মস্তিষ্কে ধোঁয়ার মত সব সত্যকে আড়াল করে দেয়’।
[সূত্র : ইন্টারনেট]