দজলায় ভাসে গোলামের রিয্ক
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
অনেক দিন আগের কথা। এক ব্যক্তি কোন এক খলীফার পক্ষ থেকে একটি শহরের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিল। সে মানুষের সাথে যুলুম করত। নিজের পকেট ভর্তি করার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখত না। একবার গভর্নর এক অসহায় ব্যক্তির নামে খলীফার কাছে মিথ্যা অভিযোগ দেয়। অতঃপর সে লোকের একটি বাগান দখল করে তাকে জেলখানায় আটক করে।
কিছুদিন পর লোকটি জেলখানা থেকে পালিয়ে খলীফার দরবারে আসে। কিন্তু প্রাসাদে তার পরিচিত কেউ ছিল না। ফলে নিজের সাথে হওয়া যুলুমের কথাও খলীফা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল না। পরবর্তীতে সে গভর্নরের অত্যাচার ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের পূর্ণ বিবরণ দিয়ে খলীফা বরাবর চিঠি পাঠায়। খলীফা চিঠি পেয়ে গভর্নরকে হুমকি দিয়ে মাযলূমের জমিসহ বাগান ফেরত দেওয়ার জন্য আদেশ জারী করেন। ঐ লোকটি সে আদেশনামা সংগ্রহ করে এক বুক আশা-ভরসা নিয়ে নিজের শহরের পথে রওনা দেয়।
এরপর লোকটি গভর্নরের নিকট এসে খলীফার আদেশনামা দেখায়। গভর্নর আদেশনামা পড়া মাত্রই ঐ লোকটিকে ধরে একশ‘ ঘা চাবুক মেরে পুনরায় জেলে বন্দি করে ফেলে। গভর্নর জেলের বদ্ধ দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘হে আহাম্মক! খলীফার কাছে আমার নামে নালিশ কর। জানো না! এই প্রদেশের রাজত্ব ও সিংহাসন আমার? আমি যদি এই রাজ্যের সকল হিসাব-নিকাশ খলীফাকে দিই তাহ’লে কি আমার সব কথা চলবে? আমি ভাল মানুষ বলে এখনো তোমাকে নাস্তানাবুদ করিনি। এখন বসে বসে জেলের ভাত খাও’।
লোকটি বেশ কিছুদিন জেলেই থাকল। অতঃপর দ্বিতীয়বার পালানোর সুযোগ পেয়ে সরাসরি খলীফার নিকট পৌঁছানোর চেষ্টা করতে লাগল। একদিন খলীফা শিকারে বের হ’লেন। ঐ লোকটি সুযোগ পেয়েই খলীফার ঘোড়ার সামনে এসে বসে পড়ল। খলীফা তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমি কি চাও?’ সে বলল, ‘আমি সেই লোক, যে আপনার কাছে অমুক গভর্নরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলাম। ফলে আপনি তার বিরুদ্ধে ফরমান জারী করেছিলেন। আমি সে ফরমান নিয়ে তার কাছে গেলে সে আমাকে চাবুক মেরে আবারো জেলে বন্দি করে। আমি আবারও আপনার কাছে আভিযোগ নিয়ে এসেছি। হয় আমাকে এই যালেমের অত্যাচার থেকে রক্ষা করুন অন্যথায় আমার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিন। নতুবা আমি এই ঘটনা সবাইকে বলে দিব। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমি হাল ছাড়ব না’।
খলীফা লোকটির সাহস দেখে রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘তুমি অভিযোগ করেছিলে আমি তার সমাধান করে দিয়েছি। এখন আমার আর কি করার আছে? যাও, যেখানে ইচ্ছা সেখানে গিয়ে মাথা ঠুকে মর’।
মাযলূম লোকটি নিজের জীবনের কোন পরোয়া না করে খলীফাকে বলল, ‘আপনি আমার জন্য কি করবেন? আমার জন্য কিছুই করতে হবে না। বরং নিজের জন্য কিছু করুন, যাতে আপনার আদেশ-নিষেধ প্রজারা মান্য করে। আমাকে বললেন মাথা ঠুকে মরবো? আমি নই, আপনি মাথা ঠুকে মরুন! কারণ আপনি এমনই এক অযোগ্য দুর্ভাগা শাসক, যার নিযুক্ত গভর্নররাই তার হুকুম মত কাজ করে না। খলীফা লোকটির কথাগুলো শুনে লজ্জা পেয়ে গেলেন। তিনি তখনই সেই গভর্নরকে পদচ্যুত করার ঘোষণা দিলেন। অতঃপর তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে যুলুমের অধ্যায় সমাপ্ত করলেন। এই দৃষ্টান্ত স্থাপনের কারণে বহু বছর মানুষ গভর্নরের অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছিল।
[ গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত।]
শিক্ষা : গল্পটিতে বর্তমান সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠেছে। বর্তমান সময়ের জনপ্রতিনিধিরাও দুর্বল, অসহায় মানুষদের সম্পদ গ্রাস করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুঁলে কলাগাছ হচ্ছে। যুলুমের শিকার হয়ে কত শত মাযলূম পথে বসে ডুকরে কাঁদছে। নির্বাক পৃথিবীর বাকরুদ্ধ মানুষগুলো প্রতিনিয়ত সেগুলো দেখছে। নিজের অধিকার আদায়ের জন্য মাযলূমের অন্তরাত্মা হুংকার দিয়ে উঠছে। কিন্তু পদযুগল থরথর করে কাঁপছে। কারণ যালেমের বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিক ও শারিরীক শক্তি তার নেই। তাকে সাহায্য করার জন্য পাশে কেউ নেই। যখনই কেউ প্রতিবাদ করছে তখন তার উপরই নেমে আসছে অত্যাচারের খড়গহস্ত। সেজন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। দু’একটি প্রতিবাদ সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির কানে পৌঁছলেও কোন ফল হয় না। কারণ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে না। এভাবেই শাসকদের অত্যাচারে কেটে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। এ গল্পটি সে সমস্ত শাসকদের জন্য যারা তাদের প্রতিনিধিদের অন্যায় আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে অক্ষম এবং যারা নিজের ক্ষমতা স্থায়ী রাখতে অন্যায় দেখেও নিশ্চুপ থাকেন। হাদীছের ভাষ্য অনুযায়ী মাযলূমের ও দো‘আ আর আল্লাহর মধ্যে কোন ব্যবধান থাকে না। সুতরাং মাযলুমের বদ দো‘আ থেকে বেঁচে থাকতে এ গল্প থেকে যুলুম প্রতিকারের শিক্ষা নিতে হবে। তবেই ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসাবে শেষ বিচারের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ার নীচে স্থান পাওয়া সম্ভব। যে দিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না (বুখারী হা/৬৬০)।
[অনুবাদক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।]