কুরআন মুমিনের জন্য আলোকবর্তিকা

ইহসান ইলাহী যহীর 26134 বার পঠিত

ভূমিকা : পৃথিবীর বুকে যে মহাগ্রন্থ ক্বিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে, সেটি হ’ল পবিত্র কুরআন মাজীদ। এই মহাগ্রন্থের আলোকেই আলোকোজ্জ্বল হয়েছিল আরব-অনারব সকল মানবগোষ্ঠী। হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ এই কিতাবে কোনই সন্দেহ নেই। যা মুমিনদের জন্য হেদায়াতের আলোকবর্তিকা। নিম্নে পবিত্র কুরআনের কতিপয় মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্য আলোকপাতের প্রয়াস পাব, যা মুমিন জীবনে আলোকবর্তিকা স্বরূপ হবে ইনশাআল্লাহ।-

১. কুরআন আল্লাহর অবতীর্ণ বাণী : আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকট জিব্রীল মারফত নাযিল করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ هَذَا الْقُرْآنُ أَنْ يُّفْتَرَى مِنْ دُونِ اللهِ وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ الْكِتَابِ لاَ رَيْبَ فِيهِ مِنْ رَّبِّ الْعَالَمِينَ- ‘আর এই কুরআন এমন নয় যে, তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ রচনা করেছে। বরং এটি বিগত আসমানী কিতাব সমূহের সত্যায়নকারী এবং বিধান সমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানকারী। এতে কোনই সন্দেহ নেই। এটি জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ’ (ইউনুস ১০/৩৭)

আর প্রত্যেক জাতি স্ব স্ব এলাহী গ্রন্থ অনুসরণেই সাফল্য অর্জন করেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا، وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ এই কিতাবের মাধ্যমে অনেক জাতির উত্থান সাধন করবেন এবং এরই কারণে অনেক জাতির পতন ঘটাবেন’।[1]

অপর হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ رَسُولِهِ ‘আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি দু’টি বস্ত্ত। যতদিন তোমরা এ দু’টি বস্ত্ত অাঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’।[2]

সুতরাং মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে সার্বিক জীবনে ধারণের মাধ্যমেই একজন মুসলিম দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য অর্জণ করতে পারবে।

২. চির সংরক্ষিত কিতাব : পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতগণ তাদের স্ব স্ব ঐশী গ্রন্থ পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে নিজেরা যেমন পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করেছে। কিন্তু লওহে মাহফূযে সংরক্ষিত এই কুরআন ক্বিয়ামতের আগ পর্যন্ত কুরআনের পাতায় পাতায়, হাফেযদের বুকে বুকে এবং মুসলমান সমাজে কুরআনী বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমে চির সংরক্ষিত থাকবে। যার সংরক্ষণকারী স্বয়ং মহান আল্লাহ। কুরআনের ভাষায়إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ- ‘আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর হেফাযতকারী’ (হিজর ১৫/৯)

সুতরাং এই চির সংরক্ষিত কুরআন দ্বারা মানুষ সর্বাবস্থায় অন্ধকার থেকে আলোর পথ বেছে নিতে পারবে।

৩. হেদায়াতের পথনির্দেশিকা : পবিত্র কুরআন হ’ল হক্ব ও বাতিলের পার্থক্যকারী মানদন্ড ও হেদায়াতের পথনির্দেশিকা। যেমন আল্লাহ বলেন, فَقَدْ جَآءَكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَهُدًى وَّرَحْمَةٌ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَّبَ بِآيَاتِ اللهِ وَصَدَفَ عَنْهَا سَنَجْزِي الَّذِينَ يَصْدِفُونَ عَنْ آيَاتِنَا سُوءَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يَصْدِفُونَ- ‘তোমাদের নিকট এসে গেছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে সুস্পষ্ট প্রমাণ, পথনির্দেশ ও অনুগ্রহ। অতঃপর তার চাইতে বড় যালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যারোপ করে ও তা এড়িয়ে চলে? যারা আমাদের আয়াতসমূহকে এড়িয়ে চলে, সত্বর আমরা তাদেরকে এড়িয়ে চলার শাস্তিস্বরূপ মর্মন্তুদ শাস্তি প্রদান করব’ (আন‘আম ৬/১৫৭)

৪. সরল পথের সন্ধানদাতা : পবিত্র কুরআনই একমাত্র সরল পথের সন্ধানদাতা। আর সে পথই মুমিন বান্দাকে জান্নাত পানে নিয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا- ‘নিশ্চয় এই কুরআন এমন পথের নির্দেশনা দেয় যা সবচেয়ে সরল। আর তা সৎকর্মশীল মুমিনদের সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৯)

৫. কুরআন আলোর দিশারী : পবিত্র কুরআন মাজীদ সমস্ত মানবমন্ডলীকে গোমরাহীর অন্ধকার হ’তে হেদায়াতের আলোর দিকে দিশা দিতে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন,الر كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ- ‘আলিফ লাম র-।

আমরা এই কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে অন্ধকার হ’তে আলোর পথে বের করে আনতে পার তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। মহা পরাক্রান্ত ও মহা প্রশংসিত আল্লাহর পথে’ (ইব্রাহীম ১৪/১)

৬. অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস : বিগত সকল কিতাব ও ছহীফাসমূহ নবীদের মৃত্যুবরণের পর তাদের অনুসারীদের হাতেই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে গেছে। অথচ কুরআন অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস। যাতে বাতিলের কোন প্রবেশাধিকার নেই। কেননা আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِالذِّكْرِ لَمَّا جَآءَهُمْ وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ- لاَ يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ- ‘নিশ্চয়ই (কাফেররা) যাদের নিকটে কুরআন আসার পর তা প্রত্যাখ্যান করে। আর নিঃসন্দেহে এটি মহাপরাক্রান্ত এক কিতাব। এর সামনে বা পিছন থেকে কোন মিথ্যা এতে প্রবেশ করে না। এটি প্রজ্ঞাময় ও প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ’ (হা মীম সাজদাহ ৪১/৪১-৪২)

৭. সকল বিষয়ের বর্ণনা : কুরআন এমন এক মহাগ্রন্থ যাতে মুমিন বান্দার সকল প্রয়োজনীয় বিষয় উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَّهُدًى وَّرَحْمَةً وَّبُشْرَى لِّلْمُسْلِمِينَ- ‘আর আমরা সকল কিছুর বিশদ বর্ণনা, সঠিক পথনির্দেশ, রহমত এবং মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ হিসাবে তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি’ (নাহল ১৬/৮৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ، ‘এই কিতাবে আমরা কোন কিছুই ছাড়িনি’ (আন‘আম-মাক্কী ৬/৩৮)

উল্লেখ্য যে, ‘সকল কিছুর বিশদ ব্যাখ্যা’ বলতে ‘অতীত ও ভবিষ্যতের সকল উপকারী জ্ঞানের বিশদ বর্ণনা এবং সকল প্রকারের হালাল-হারামের বর্ণনা। এতে মানুষের জন্য দুনিয়া-আখেরাত এবং জীবন-জীবিকার বিশদ ব্যাখ্যা সমূহ রয়েছে’।[1]

৮. মানবজাতির জ্ঞানভান্ডার : পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য সমস্ত জ্ঞানের ভান্ডার। কেননা এতে সকল বিষয়ের সঠিক সিদ্ধান্তসমূহ রয়েছে। বিশেষকরে মুমিনদের জন্য দন্ডবিধি, বিধি-বিধান, বৈজ্ঞানিক আলোচনা, আখেরাত ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞানভান্ডার হিসাবে বিবেচিত। যেমন আল্লাহ বলেন,هَذَا بَصَآئِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَّرَحْمَةٌ لِّقَوْمٍ يُّوقِنُونَ- ‘এটি মানব জাতির জন্য জ্ঞানভান্ডার এবং দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য হেদায়াত ও রহমতস্বরূপ’ (জাছিয়াহ ৪৫/২০)

৯. কুরআন আত্মিক উন্নয়নের মহিসোপান : হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الَّذِي لَيْسَ فِي جَوْفِهِ شَيْءٌ مِّنَ القُرْآنِ كَالبَيْتِ الخَرِبِ- ‘যার ভিতর কুরআনের কিছুই নেই, তা বিরান ঘরের ন্যায়’।[2] আর কুরআন তেলাওয়াতকারী ও তার উপর আমলকারীদের মধ্যে যে ঈমানী নূর ও বরকত দেখা যায়, অন্যদের ক্ষেত্রে তা শূণ্যের কোঠায়। একজন মুমিন বান্দা কুরআন যত পাঠ করবে ও তদনুযায়ী আমল করবে, ব্যক্তি জীবনে তার ততধিক আত্মিক উন্নয়ন সাধন হবে।

১০. অন্তরের ব্যাধি থেকে মুক্তি : কুরআনে তেলাওয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে উপদেশ হাছিল করা যায়। সে অনুপাতে জীবন গঠন করে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করা যায়। কুফরী ও নিফাকীর ভয়াবহ গ্রাস থেকে অন্তর্জগৎ মুক্ত থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন,يَآأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَآءَتْكُمْ مَّوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَشِفَآءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ- ‘হে মানবমন্ডলী! তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে এসে গেছে উপদেশ সম্বলিত কুরআন এবং অন্তরের ব্যাধিসমূহের উপশম। আর এটি ঈমানদারদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)

১১. কুরআন শ্রবণে রহমত প্রাপ্তি : কোন মুমিন বান্দা যদি কুরআন শ্রবণ করে তাহ’লে সে আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমত প্রাপ্ত হবেন। আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ- ‘আর যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাকো, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হ’তে পার’ (আ‘রাফ ৭/২০৪)। তিনি বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَّعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ- ‘মুমিন কেবল তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)

অন্যত্র তিনি বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَأَقَامُوا الصَّلاَةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَّعَلاَنِيَةً يَّرْجُونَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُورَ- ‘যারা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে, ছালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে যারা গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে। তারা এমন ব্যবসার আশা করে, যা কখনো ধ্বংস হয় না’ (ফাত্বির ৩৫/২৯)

১২. আসমান ও যমীনের বরকতের দুয়ার উন্মুক্তকারী : ঈমান আনায়নের পাশাপাশি আল্লাহকে ভয় করে অহির বিধানের আলোকে সার্বিক জীবন ঢেলে সাজাতে পারলে দুনিয়াতেই আল্লাহ আসমান ও যমীনের বরকতের দুয়ার উন্মোচিত করে দিবেন। আকাশ উপকারী বৃষ্টি বর্ষণ করবে এবং যমীন সুস্বাদু ফলমূল উৎপাদন করবে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ- ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনয়ন করত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের উপর আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যাপ্রতিপন্ন করল। ফলে তাদের অপকর্মের দরুণ আমরা তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)

১৩. কুরআনী বরকত প্রাপ্তি : কুরআনের আলোকে সার্বিক জীবন ঢেলে সাজানোর বরকত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَهَذَا كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ- ‘আর বরকতমন্ডিত এই কিতাব আমরা নাযিল করেছি। অতএব তোমরা এটির অনুসরণ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হ’তে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৫)। এখানে ‘বরকতমন্ডিত’ বলে যারা কুরআনের যথার্থ অনুসরণ করে এবং তার ভিত্তিতে জীবন গঠন করে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতে বরকতমন্ডিত জীবন লাভের বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে’।[3]

১৪. বিনম্র ব্যক্তিত্ব গঠন : যে মুমিন যতবেশী কুরআন তিলাওয়াত করবে, সে তত বিনম্র আল্লাহওয়ালা হবে। আল্লাহ বলেন,اَللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ، كِتَابًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ، ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللهِ، ذَالِكَ هُدَى اللهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَّشَآءُ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ- ‘আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছেন। যা পরস্পরে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বারবার তেলাওয়াত করা হয়। এতে তাদের দেহচর্ম ভয়ে শিহরিত হয়, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে। অতঃপর তাদের দেহ ও মন আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটা হ’ল আল্লাহর হেদায়াত। এর মাধ্যমে তিনি যাকে চান পথপ্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার পথপ্রদর্শক কেউ নেই’ (যুমার ৩৯/২৩)। তিনি বলেন, وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ؟ ‘আর নিশ্চয়ই আমরা কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করেছি। অতএব আছে কি কেউ উপদেশ গ্রহণকারী?’ (ক্বামার ৫৪/১৭)

আল্লাহ বলেন,اَللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللهِ، ذَالِكَ هُدَى اللهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَّشَآءُ وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ- ‘আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছেন, যা পরস্পরে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং (যার উপদেশ সমূহ) পুনঃ পুনঃ বর্ণিত। যা (ধমকের আয়াত সমূহ) পাঠে তাদের দেহচর্ম ভয়ে শিহরিত হয় যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে। অতঃপর যার (রহমতের আয়াত সমূহ) পাঠে তাদের দেহ-মন আল্লাহর স্মরণে বিনীত হয়। এটা হ’ল আল্লাহর পথপ্রদর্শন। এর মাধ্যমে তিনি যাকে চান পথপ্রদর্শন করেন। আর যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন, তাকে পথ দেখাবার কেউ নেই’ (যুমার ৩৯/২৩)

১৫. কুরআন মুমিনের পক্ষে সাক্ষ্যদানকারী : কুরআনের উপর যথাযথ আমলকারী হ’লে কুরআন তার পক্ষে ক্বিয়ামতের দিন সুফারিশ করবে। অন্যথায় এই কুরআনই মানুষের বিপক্ষে সাক্ষী দিবে। যেমন (ক) হযরত আবু মালেক আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,اَلطُّهُوْرُ شَطْرُ الإِيْمَانِ، والْحَمْدُ للهِ تَمْلأُ الْمِيْزَانَ، وَسُبْحَانَ اللهِ والْحَمْدُ للهِ تَمْلَآنِ أَوْ تَمْلَأُ مَا بَيْنَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ، والصَّلاَةُ نُوْرٌ، والصَّدَقةُ بُرْهَانٌ، والصَّبْرُ ضِيَاءٌ، وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَّكَ أَوْ عَلَيْكَ، كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوْبِقُهَا- ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ মানুষের আমলের পাল্লা পূর্ণ করে দেয়। ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ’ মানুষের আমলনামা নেকী দিয়ে পরিপূর্ণ করে। ছালাত হ’ল জ্যোতি। দান হ’ল দাতার পক্ষে ঈমানের দলীল। ধৈর্য হ’ল জ্যোতি। কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে প্রমাণ হিসাবে দাঁড়াবে। প্রত্যেক মানুষ সকালে উঠে তার নফসের ক্রয়-বিক্রয় করে। হয়তোবা সে তার নফসকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে অথবা সেটিকে ধ্বংস করে দেয়’।[4]

(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ كَائِنٌ لَّكُمْ أَجْرًا وَكَائِنٌ لَكُمْ ذِكْرًا وَكَائِنٌ عَلَيْكُمْ وِزْرًا، اِتَّبِعُوا الْقُرْآنَ وَلاَ يَتَّبِعْنكُمُ الْقُرْآنُ، فَإِنَّهُ مَنْ يَّتَّبِعِ الْقُرْآنَ يَهْبِطْ بِهِ فِي رِيَاضِ الْجَنَّةِ، وَمَنِ اتَّبَعَهُ الْقُرْآنُ يَزُخُّ فِي قَفَاهُ فَيَقْذِفُهُ فِي جَهَنَّمَ- ‘নিশ্চয়ই এ কুরআন হ’ল তোমাদের জন্য ছওয়াব অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। এটি যিকিরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং তোমাদের পক্ষে বোঝা বহনকারী। সুতরাং তোমরা এই কুরআনের যথার্থ অনুসরণ কর। আর এ কুরআন (থেকে বিমুখ হওয়ার কারণে) তা যেন তোমাদের বিপক্ষে না যায়। কেননা যে ব্যক্তি কুরআনের যথাযথ অনুসরণ করবে, এর মাধ্যমে সে জান্নাতের বাগীচা সমূহে অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি তা থেকে বিমুখ হবে, কুরআন তার ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে’।[5]

উপরোক্ত হাদীছদ্বয় থেকে জানতে পারলাম যে, যদি নিয়মিত আমরা কুরআন তেলাওয়াত করি এবং তদনুযায়ী আমল করি, তবে ক্বিয়ামতের দিন কুরআন তার তেলাওয়াতকারীর পক্ষে সুফারিশ করবে। অন্যথায় কুরআন তার বিরুদ্ধে দলীল উপস্থাপন করবে।

১৬. কুরআনের ছাড়া ব্যক্তি জীবন অন্তঃসারশূণ্য : নিয়মিত পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা ও কুরআনের কিছু অংশ মুখস্থ করা মুসলমানদের জন্য আবশ্যক কর্তব্য। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় যার ভিতরে কুরআনের কিছুই নেই, সে জন-মানবশূন্য বিরান ঘরের ন্যায়’।[6] এজন্য একজন মুমিন জীবনে সর্বক্ষেত্রে কুরআনকে আকড়ে ধরার চেষ্টা করে থাকে।

১৭. উপলব্ধির জন্য কুরআন : কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করা ও তা উপলব্ধি করার জন্যই আল্লাহ আরবী ভাষায় এটি নাযিল করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّآ أَنْزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ- ‘নিশ্চয়ই আমরা নাযিল করেছি এই কিতাব আরবী কুরআন হিসাবে, যাতে তোমরা উপলব্ধি করতে পার’ (ইউসুফ ১২/২)

১৮. কুরআনী আমল না করার পরিণতি : কুরআন তেলাওয়াতের সাথে সাথে কুরআন অনুযায়ী আমল করা যরূরী। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,...وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ : فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ... ‘আর যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করেছে এবং অপরকে তা শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন তেলাওয়াত করেছে। তাকে আল্লাহর দরবারে হাযির করা হবে। আল্লাহ প্রথমে তাকে দেওয়া তাঁর নে‘মত সমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সেও তা স্বীকার করবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি এ সকল নে‘মতের বিনিময়ে কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি ও অপরকে তা শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার জন্য কুরআন তেলাওয়াত করেছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এজন্য ইলম শিখেছিলে, যাতে তোমাকে ‘আলেম’ বলা হয় এবং এজন্য কুরআন পড়েছিলে যাতে তোমাকে ‘ক্বারী’ বলা হয়। আর তা তোমাকে দুনয়িাতে বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[7]

কুরআন পরিত্যাগের কারণেই আজ মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত। আল্লামা ইকবাল তাঁর জওয়াবে শিকওয়াতে বলেন,

وہ زمانے میں معزز تھے مسلماں ہو کر

اور تم خوار ہوئے تارک قرآں ہو کر

তারা ছিল সম্মানিত হয়ে মুসলমান

তোমরা হ’লে নিপীড়িত ছেড়ে পাক কুরআন।

১৯. কুরআন অনুধাবন করা যরূরী : পবিত্র কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য পড়া, বুঝা, অনুধাবন করা ও সেই সাথে বাস্তব জীবনে মেনে চলা চলা যরূরী। যেমন আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلاَوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمَنْ يَّكْفُرْ بِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ- ‘আমরা যাদেরকে কিতাব প্রদান করেছি, যারা তা যথার্থভাবে তেলাওয়াত করে, তারা তার উপরে ঈমান আনয়ন করে। আর যারা তাতে ঈমান আনে না, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’ (বাক্বারাহ ২/১২১)

হোযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, كَانَ إِذَا مَرَّ بِآيَةِ خَوْفٍ تَعَوَّذَ وَإِذَا مَرَّ بِآيَةِ رَحْمَةٍ سَأَلَ، إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيْها تَنْزِيْهُ اللهِ سَبَّحَ- ‘নবী করীম (ছাঃ) কুরআন তেলাওয়াত করে ভয়ের আয়াতে পৌঁছে আযাব থেকে আশ্রয় চাইতেন এবং রহমতের আয়াতে পৌঁছে রহমত কামনা করতেন। যখন এমন আয়াত আসত, যাতে আল্লাহর পবিত্রতার উল্লেখ আছে, তখন সেখানে তাসবীহ পাঠ করতেন’।[8] আল্লাহ বলেন, وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا- ‘আর (কুরআন তেলাওয়াতকালে) তারা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়-নম্রতা আরও বৃদ্ধি পায়’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/১০৯)

২০. যে আয়াতগুলি তেলাওয়াত করে প্রার্থনা করলে দো‘আ কবুল করা হয় : কুরআন মাজীদের কতিপয় আয়াত পূর্ববর্তী কোন নবী-রাসূলকে প্রদান করা হয়নি। আয়াতগুলি নাযিল করা হয়েছে আসমানের এক বিশেষ দরজা দিয়ে। যা পূর্বে কোনদিন খোলা হয়নি। আয়াতগুলি এমন একজন ফেরেশতা নিয়ে এসেছিলেন, যিনি ইতিপূর্বে আর কোনদিন যমীনে আসেননি।

যেমন হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে উক্ত বিষয়ে বলেন, بَيْنَمَا جِبْرِيْلُ قَاعِدٌ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَمِعَ نَقِيْضًا مِّنْ فَوْقِهِ فَرَفَعَ رَأْسَهُ فَقَالَ هَذَا بَابٌ مِّنَ السَّمَاءِ فُتِحَ الْيَوْمَ لَمْ يُفْتَحْ قَطُّ إِلاَّ الْيَوْمَ فَنَزَلَ مِنْهُ مَلَكٌ، فَقَالَ هَذَا مَلَكٌ نَزَلَ إِلَى الْأَرْضِ لَمْ يَنْزِلْ قَطُّ إِلاَّ الْيَوْمَ فَسَلَّمَ وَقَالَ: أَبْشِرْ بِنُوْرَيْنِ أُوتِيْتَهُمَا لَمْ يُؤْتَهُمَا نَبِيٌّ قَبْلَكَ فَاتِحَةُ الْكِتَابِ وَخَوَاتِيْمُ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ لَنْ تَقْرَأَ بِحَرْفٍ مِنْهُمَا إِلاَّ أُعْطِيْتَهُ- ‘একদা জিব্রীল (আঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় উপর দিক থেকে একটি দরজা খোলার আওয়ায শুনলেন। তিনি উপরের দিকে মাথা উঠালেন এবং বললেন, আসমানের এই যে দরজাটি আজ খোলা হল, এই দরজা আজকের পূর্বে আর কোন দিন খোলা হয়নি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, সে দরজা থেকে একজন ফেরেশতা যমীনে নামলেন। তখন জিব্রীল (আঃ) বললেন, ঐ যে যমীনে এক্ষুণি ফেরেশতা নামলেন। তিনি আজ ব্যতীত ইতিপূর্বে আর কখনো যমীনে নামেননি। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে সালাম দিলেন। অতঃপর বললেন, দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। যা আপনাকে দেওয়া হয়েছে এবং আপনার পূর্বে কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। যেগুলি হ’ল সূরা ফাতিহা ও সূরা বাক্বারার শেষাংশ। আপনি তার যে কোন বাক্য তেলাওয়াত করে প্রার্থনা করুন না কেন, নিশ্চয়ই আপনাকে তা দেওয়া হবে’।[9] উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত আয়াতগুলি পড়ে আল্লাহর নিকট যা প্রার্থনা করা হবে, তিনি তাই কবুল করবেন।

২১. তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম নয় : আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) আমাকে বলেন,اِقْرَأِ الْقُرْآنَ فِي كُلِّ شَهْرٍ، قَالَ قُلْتُ : إِنِّي أَجِدُ قُوَّةً، قَالَ : فَاقْرَأْهُ فِي عِشْرِينَ لَيْلَةً، قَالَ قُلْتُ : إِنِّي أَجِدُ قُوَّةً، قَالَ : فَاقْرَأْهُ فِي سَبْعٍ وَلاَ تَزِدْ عَلَى ذَلِكَ- ‘তুমি প্রতি মাসে একবার করে সম্পূর্ণ কুরআন তেলাওয়াত করে শেষ কর। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশী তেলাওয়াতের সক্ষমতা রাখি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে তুমি বিশ দিনে কুরআন তেলাওয়াত করে শেষ কর। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশী তেলাওয়াতের সক্ষমতা রাখি। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে প্রতি সাত দিনে একবার খতম করো এবং এর চেয়ে কম সময়ে নয়’।[10] একই রাবী থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে,لَمْ يَفْقَهْ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فِي أَقَلَّ مِنْ ثَلاَثٍ- ‘যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে পূর্ণাঙ্গ কুরআন তেলাওয়াত করে শেষ করল, সে তার কিছুই অনুধাবন করতে সক্ষম হ’ল না’।[11]

২২. কুরআনের বাহকের সুরক্ষা : সূরা লাহাব নাযিল হ’লে আবু লাহাবের স্ত্রী ‘আওরা উম্মে জামীল বিনতে হার্ব পাথরভর্তি হাতে রাসূল (ছাঃ)-কে আক্রমণের উদ্দেশ্যে কবিতা বলতে বলতে এগিয়ে আসে। আর এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) কা‘বা ঘরের পাশে উপবিষ্ট ছিলেন। আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মহিলাটি এগিয়ে আসছে। আমি আশঙ্কা করছি যে, সে আপনাকে দেখে ফেলবে এবং আক্রমণ করবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সে আমাকে কখনোই দেখতে পাবে না। তখন রাসূল কুরআন থেকে কতিপয় আয়াত তেলাওয়াত করলেন।[12] অতঃপর পাঠ করলেন,وَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ جَعَلْنَا بَيْنَكَ وَبَيْنَ الَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ حِجَابًا مَّسْتُورًا- ‘আর তুমি যখন কুরআন তেলাওয়াত কর, তখন আমরা তোমার ও যারা আখেরাতে বিশ্বাসী নয় তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য আবরণ রেখে দেই’।[13]

উপরোক্ত আয়াত প্রমাণ করে যে, কুরআন তেলাওয়াতকারী ঈমানদার বাহককে বেঈমানদের থেকে আল্লাহ বিশেষভাবে হেফাযত করেন। এই কুরআন হ’ল দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভের অন্যতম মাধ্যম। সেকারণ কুরআন তেলাওয়াতকারীর সম্মান আসমানে ও যমীনে ছড়িয়ে যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি তার হৃদয়কে কুরআনের পথে ও আল্লাহর অভিমুখে পরিচালিত করবে, মহান আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদাবান করবেন। ফলে তেলাওয়াতকারীর কর্তৃত্ব ও প্রভাব তার অজান্তেই সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং কুরআনের মাধ্যমে সে আল্লাহর কাছে এবং তাঁর সৃষ্টির কাছে মহাসম্মানিত হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নিয়মিত পবিত্র কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত ও তার যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে মুমিনগণ দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত হবেন। আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত ও পঠন-পাঠনের মাধ্যমে উভয় জগতে সর্বোচ্চ কল্যাণ আহরণের তাওফীক দান করুন।- আমীন!


[1].মুসলিম হা/৮১৭; মিশকাত হা/২১১৫।

[2]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮, সনদ হাসান; মিশকাত হা/১৮৬।

[3].তাফসীর ক্বাসেমী; ইবনু কাছীর, সূরা নাহল ৮৯ আয়াতের ব্যাখ্যা।

[4].দারেমী হা/৩৩০৬; তিরমিযী হা/২৯১৩; মিশকাত হা/২১৩৫।

[5].তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা আন‘আম ১৫৫ আয়াতের ব্যাখ্যা।

[6].মুসলিম হা/২২৩; মিশকাত হা/২৮১।

[7].মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৪৮২১; বায়হাক্বী শো‘আব হা/১৮৬৬; দারেমী হা/৩৩২৮ সনদ ছহীহ।

[8]. হাকেম হা/২০৩৭; দারেমী হা/৩৩০৬ সনদ হাসান।

[9].মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত হা/২০৫।

[10].আহমাদ হা/২৩৩৫৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৭৮২।

[11].মুসলিম হা/৮০৬; মিশকাত হা/২১২৪।

[12].মুসলিম হা/১১৫৯ (১৮৪); বুখারী হা/৫০৫২; মিশকাত হা/২০৫৪।

[13].আবুদাঊদ হা/১৩৯৪; তিরমিযী হা/২৯৪৯; মিশকাত হা/২২০১।

[14].আলবানী, ছহীহুস সীরাহ আন-নববিইয়াহ ১৩৮ পৃ.।

[15].বনী ইস্রাঈল ১৭/৪৫; হাকেম হা/৩৩৭৬ সনদ ছহীহ; মুসনাদ আবী ইয়া‘লা হা/৫৩।

 



বিষয়সমূহ: কুরআন
আরও