সাংবাদিকতায় আহলেহাদীছ জামা‘আতের অবদান (৪র্থ কিস্তি)
ড. নূরুল ইসলাম
ভূমিকা : পবিত্র মাহে রামাযান সমাগত। মুমিন-মুসলমানের জন্য রামাযানের প্রতিটি মুহূর্ত যেন ভরে উঠে রহমত, বরকত, মাগফিরাতের উষ্ণ আভায়। রামাযান একজন মুমিন বান্দার জন্য নিজেকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। হাদীছে ছিয়ামকে মানুষের জন্য ঢালস্বরূপ বলা হয়েছে। যে সমস্ত কাজ ছায়েমকে জাহান্নামে নিয়ে যায়, এমন গর্হিত অপরাধ থেকে রক্ষা করার জন্য ছিয়াম ঢাল হিসাবে কাজ করে। প্রবৃত্তির চাহিদা ও যৌনাকাঙ্ক্ষা অবদমিত করে আল্লাহভীরু হওয়ার প্রশিক্ষণ প্রদান করে। আলোচ্য প্রবন্ধে রামাযান মাস কেন্দ্রীক গুরুত্বপূর্ণ আমল ও তার ইলাহী প্রাপ্তি সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ!
রামাযানের আহবান : রামাযানের ছিয়াম পালন করা সামর্থবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরয। মহান আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হ’ল, যেমন তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)।
রামাযানের আমল :
১. চাঁদ দেখার দো‘আ পাঠ : চাঁদ দেখার দো‘আ পাঠের মাধ্যমে রামাযান মাসকে স্বাগত জানাতে হয়। নতুন চাঁদ দেখে নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়তে হয়-اَللهُ أَكْبَرُ اَللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ وَالْإِيْمَانِ وَالسَّلاَمَةِ وَالْإِسْلاَمِ وَالتَّوْفِيْقِ لِمَا تُحِبُّ وَتَرْضَى، رَبِّىْ وَرَبُّكَ اللهُ-উচ্চারণ : আল্ল-হু আকবার, আল্ল-হুম্মা আহিল্লাহূ ‘আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমা-নি, ওয়াস্সালা-মাতি ওয়াল ইসলা-মি, ওয়াততাওফীক্বি লিমা তুহিববু ওয়া তারযা; রববী ওয়া রববুকাল্ল-হ।
অর্থ : ‘আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের উপরে চাঁদকে উদিত করুন শান্তি ও ঈমানের সাথে, নিরাপত্তা ও ইসলামের সাথে এবং আমাদেরকে ঐ সকল কাজের ক্ষমতা দানের সাথে, যা আপনি ভালবাসেন ও যাতে আপনি খুশী হন। (হে চন্দ্র!) আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ’।[1]
২. ছিয়ামের নিয়ত করা : মহান আল্লাহ বলেন,فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ، ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (রামাযানের) এ মাস পাবে, সে যেন ছিয়াম রাখে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)।
ফজরের পূর্বে ফরয ছিয়ামের নিয়ত করতে হবে’।[2] ‘নিয়ত’ অর্থ, মনন করা বা সংকল্প করা। অতএব মনে মনে ছিয়ামের সংকল্প করাই যথেষ্ট। ছালাত-ছিয়াম বা অন্য কোন ইবাদতের শুরুতে আরবী বা অন্য কোন ভাষায় মুখে নিয়ত পড়া বিদ‘আত।
৩. সাহারী খাওয়া : মুমিন মুসলমানগণ ছিয়াম পালনের উদ্দেশ্যে শেষ রাতে ফজরের পূর্বে যে আহার করে থাকেন তাকে সাহারী বলা হয়। সাহারী করা অপরিহার্য। কেননা অন্যান্য জাতি-ধর্মের অনুসারীরা ছিয়াম রাখলেও তারা সাহারী করে না। আমর ইবনু আস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ، أَكْلَةُ السَّحَرِ ‘আমাদের ও কিতাবীদের ছিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হ’ল সাহারী খাওয়া’।[3] সাহারী খাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ- ‘আর তোমরা খানাপিনা কর যতক্ষণ না রাতের কালো রেখা থেকে ফজরের শুভ্র রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়। অতঃপর ছিয়াম পূর্ণ কর রাত্রির আগমন পর্যন্ত’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)।
৪. মিথ্যা ও বাজে কাজ পরিহার করা : ছিয়ামরত অবস্থায় মিথ্যা ও বাজে কাজে জড়িত ব্যক্তির ছিয়াম কোন কাজে আসবে না। কেননা হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ- হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[4]
৫. ছিয়াম অবস্থায় দো‘আ : রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দো‘আ আল্লাহ ফেরত দেন না। (১) ছায়েমের দো‘আ ইফতারের সময়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। (২) ন্যায়পরায়ণ শাসকের দো‘আ ও (৩) মযলুমের দো‘আ’।[5]
৬. দান-খায়রাত করা : আল্লাহর পথে দানের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। রাসূল (ছাঃ) এ মাসে প্রবাহিত বাতাসের ন্যায় দান-খায়রাত করতেন। এ বিষয়ে হাদীছে এসেছে, ‘নবী (ছাঃ) ধন সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রামাযানে জিব্রীল (আঃ) যখন তাঁর সাথে দেখা করতেন, তখন তিনি আরও অধিক দান করতেন। রামাযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল (আঃ) তাঁর সাথে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী (ছাঃ) তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিব্রীল (আঃ) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি বায়ুর চেয়েও অধিক গতিতে ধন-সম্পদ দান করতেন’।[6]
৭. ইফতার করা : ছিয়াম পালনকারী নির্দিষ্ট সময়ে ইফতার করার জন্য অপেক্ষায় থাকে। এ বিষয়ে হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ ‘লোকেরা যতদিন যাবৎ সময় হওয়া মাত্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে’।[7] রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ছিয়াম রাখে, তখন সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। আর সে যদি খেজুর না পায়, তবে সে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে, কেননা পানি পবিত্র’।[8]
৮. জামা‘আতের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় :
রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَمَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، ‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির (নফল) ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল (ছগীরা) গোনাহ মাফ করা হয়’।[9]
আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক রামাযানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিয়াম পালন করলাম, সে রামাযানে নবী করীম (ছাঃ) আমাদের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করলেন না, যতদিন পর্যন্ত না মাসের সাতদিন অবশিষ্ট রইল; তখন তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহর ছালাত আদায় করলেন। তাতে রাতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়ে গেল। তারপর যখন ছয়দিন বাকি রইল, তখন তিনি আমাদের নিয়ে তারাবীহর ছালাত আদায় করলেন না। পরে যখন পাঁচ দিন বাকি রইল আবার তিনি আমাদের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করলেন এবং তাতে রাতের প্রায় অর্ধেক অতিবাহিত হয়ে গেল। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে সম্পূর্ণ রাত তারাবীহর ছালাত আদায় করতেন। তিনি বললেন, কোন ব্যক্তি যখন ইমাম সালাম ফিরিয়ে ছালাত হ’তে বের হওয়া পর্যন্ত তার সাথে ছালাত আদায় করে, তার জন্য এক পূর্ণ রাত ছালাত আদায় করার ছওয়াব লেখা হয়। অতঃপর যখন চারদিন বাকি রইল তিনি তখন আমাদেরকে নিয়ে তারাবীহর ছালাত আদায় করলেন না। অতঃপর যখন মাসের তিনদিন বাকি রইল, তিনি তাঁর কন্যা এবং স্ত্রীদের কাছে লোক পাঠালেন এবং ছাহাবাগণকে একত্র করলেন এবং আমাদের নিয়ে তারাবীহর ছালাত এমনিভাবে আদায় করলেন যে, আমরা ভয় পেয়ে গেলাম সাহারী-এর সময় না হারিয়ে ফেলি। এরপর তিনি আমাদের নিয়ে ঐ মাসের আর কোনদিন তারাবীহর ছালাত আদায় করেননি’।[10]
৯. ই‘তিক্বাফ : ই’তিকাফ সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি রামাযানে দশদিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি মারা যান, সে বছর বিশ দিন ই‘তিকাফ করেন’।[11]
১০. লায়লাতুল ক্বদর জাগরণ : লায়লাতুল ক্বদর হ’ল রামাযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রি। হযরত আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِى الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ ‘তোমরা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে ক্বদরের রাত্রি তালাশ কর’।[12]
১১. যাকাতুল ফিৎর আদায় করা : রাসূল (ছাঃ) ছাদাক্বাতুল ফিতর ফরয করেছেন। অশ্লীল কথা ও বেহুদা কাজ হ’তে (রামাযানের) ছিয়ামকে পবিত্র করতে এবং মিসকীনদের খাদ্যের ব্যবস্থার করার জন্য ছাদাক্বাতুল ফিৎর আদায় করতে হয়। যে ব্যক্তি (ঈদের) ছালাতের পূর্বে তা আদায় করে সেটা কবুল ছাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ছালাতের পরে আদায় করে, তা সাধারণ দান হিসাবে গৃহীত হবে’।[13] যা ঈদুল ফিৎরের ছালাতে বের হওয়ার আগেই মাথা প্রতি এক ছা‘ পরিমাণে দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হ’তে প্রদান করতে হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,فَرَضَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِّنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِّنْ شَعِيرٍ (صَاعًا مِّنْ طَعَامٍ) عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيرِ وَالْكَبِيرِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ، وَأَمَرَ بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, পুরুষ ও নারী, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ খেজুর, যব ইত্যাদি (অন্য বর্ণনায়) খাদ্যবস্ত্ত ফিৎরার যাকাত হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আমাদেরকে আদায় করার নির্দেশ দান করেছেন’।[14] রাসূল (ছাঃ) বলেন, عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ فَرَضَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِّلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطُعْمَةً لِّلْمَسَاكِينِ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকাতুল ফিৎর ফরয করেছেন ছায়েমকে অনর্থক কথা ও বাজে কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং অভাবগ্রস্তদের খাদ্যের জন্য’।[15]
রামাযানে ইলাহী প্রাপ্তি :
১. ক্ষমা ও রহমতের দরজা খোলা হয় : রামাযানে বহু বান্দাকে ক্ষমা করা হয় এবং রহমতের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।[16]
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَفِيْ رِوَايَةٍ : فُتِحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ، وَسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ وَفِيْ رِوَايَةٍ : فُتِحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ- ‘যখন রামাযান মাস আগমন করে তখন আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়’। আরেক বর্ণনায় এসেছে, রহমতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়’।[17]
২. আসমানের দরজা খোলা হয় : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ- ‘যখন রামাযান মাস আগমন করে তখন আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়’।[18]
৩. জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম : রামাযানের আমলই শেষ আমল হলে জান্নাত। হাদীছে এসছে,عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ أَسْنَدْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم إِلَى صَدْرِى فَقَالَ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ قَالَ حَسَنٌ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ خُتِمَ لَهُ بِهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ صَامَ يَوْماً ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ خُتِمَ لَهُ بِهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ خُتمَ لَهُ بِهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ-
হুযাইফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা নবী (ছাঃ)-কে আমার বুকে লাগালাম। অতঃপর তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ বলে এবং সেটাই তার শেষ কথা হয় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ছিয়াম রাখে এবং সেটাই তার শেষ আমল হয় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কিছু ছাদাক্বা করে এবং সেটা তার শেষ কর্ম হয় তবে সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[19]
৪. জাহান্নামের দূরে অবস্থান বাড়ানো হয় : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ صَامَ يَوْمًا فِى سَبِيلِ اللَّهِ بَعَّدَ اللَّهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় এক দিনও ছিয়াম পালন করে, আল্লাহ তার মুখমন্ডলকে (অর্থাৎ তাকে) দোযখের আগুন থেকে সত্তর বছরের রাস্তা দূরে সরিয়ে নেন’।[20]
অপর হাদীছে এসেছে,عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ صَامَ يَوْمًا فِى سَبِيلِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ بَاعَدَ اللهُ مِنْهُ جَهَنَّمَ مَسِيرَةَ مِائَةِ عَامٍ- উক্ববা ইবনু আমের (রাঃ) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন ছিয়াম পালন করবে আল্লাহ তা‘আলা তার থেকে জাহান্নামকে একশত বছরের দূরত্বে সরিয়ে রাখবেন’।[21]
অপর হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبَى أُمَامَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ يَوْمًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ جَعَلَ اللهُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ النَّارِ خَنْدَقًا كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ- আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একদিন ছিয়াম পালন করবে আল্লাহ তা‘আলা সেই ব্যক্তি ও জাহান্নামের মাঝে একটি পরিখা সৃষ্টি করে দিবেন। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের দূরত্বের পরিমাণ’।[22]
৫. শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয় : ‘বড় শয়তানগুলো শৃঙ্খলিত হয়’ এবং ‘প্রতি রাতে আহবানকারী ফেরেশতা মানুষকে আহবান করেন’। বিষয়গুলো অদৃশ্য জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। জিন ও ফেরেশতা মানুষের চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না। এ সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا كَانَتْ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِّنْ رَّمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ وَفُتِحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ وَنَادَى مُنَادٍ يَا بَاغِىَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِىَ الشَّرِّ أَقْصِرْ وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ فِى كُلِّ لَيْلَةٍ- ‘যখন রামাযানের প্রথম রাত্রি আগমন করে, তখন বিতাড়িত শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়, জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়; তার কোন দরজা খোলা থাকে না। আর একজন আহবানকারী ডেকে বলেন, ‘হে কল্যাণের অভিযাত্রী এগিয়ে চল! হে অকল্যাণের অভিসারী থেমে যাও! এ মাসে বহু জাহান্নামীকে মুক্ত করা হয়। এরূপ প্রত্যেক রাত্রিতে করা হয়’।[23]
৬. সাহারী গ্রহণকারীর জন্য ফেরেশতাদের দো‘আ : রামাযানে সাহারী ভক্ষণে ফেরেশতার দো‘আ লাভ করা যায়। যা হাদীছে এসেছে,عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ ইবনু উমার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ তাদের প্রতি করুণা বর্ষণ করেন, যারা সাহারী খায় আর ফেরেশতাবর্গও তাদের জন্য দো‘আ করে থাকেন’।[24]
৭. ছায়েমের জন্য ‘রাইয়ান’ নামক দরজার আহবান : হযরত সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,فِى الْجَنَّةِ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابٍ، فِيهَا بَابٌ يُسَمَّى الرَّيَّانَ لاَ يَدْخُلُهُ إِلاَّ الصَّائِمُونَ- ‘জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। তার একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। ছায়েম ব্যতীত ঐ দরজা দিয়ে কেউ প্রবেশ করবে না’।[25]
এর দ্বারা কেবল রামাযানের ছিয়াম নয়, অন্য সময় নফল ছিয়াম পালনকারীদেরকেও বুঝানো হয়েছে। এতে ছিয়ামের ফযীলত ও ছায়েমদের উচ্চ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে (মিরক্বাত)। অতঃপর একই ব্যক্তি যখন ছায়েম ও ক্বায়েম হবে, তখন তাদের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে।
৮. ছিদ্দীক ও শহীদদের কাতারে শামিল :
হযরত আমর বিন মুর্রাহ আল-জুহানী (রাঃ) বলেন,جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَرَأَيْتَ إِنْ شَهِدْتُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَنَّكَ رَسُولُ اللهِ، وَصَلَّيْتُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ وَأَدَّيْتُ الزَّكَاةَ وَصُمْتُ رَمَضَانَ وَقُمْتُهُ، فَمِمَّنْ أَنَا؟ قَالَ: مِنَ الصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ- ‘জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি কালেমা শাহাদাত পাঠ করি, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করি, যাকাত প্রদান করি এবং রামাযানের ছিয়াম ও ক্বিয়াম করি, তাহ’লে আমি কাদের মধ্যে গণ্য হব? তিনি বললেন, তুমি ছিদ্দীক ও শহীদগণের মধ্যে গণ্য হবে’।[26]
৯. লায়লাতুল ক্বদরের মহাপ্রাপ্তি : হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ هَذَا الشَّهْرَ قَدْ حَضَرَكُمْ وَفِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حُرِمَهَا فَقَدْ حُرِمَ الْخَيْرَ كُلَّهُ وَلاَ يُحْرَمُ خَيْرَهَا إِلاَّ مَحْرُومٌ- ‘এই মাস তোমাদের নিকট উপস্থিত হয়েছে, যার মধ্যে এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাযার মাসের চাইতে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হ’ল, সে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হ’ল। আর হতভাগাই কেবল এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়’।[27]
ক্বদর রাত্রি জাগরণ করে ছওয়াবের আশায় ইবাদত করতে হবে। এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় লায়লাতুল ক্বদর-এ ইবাদতে রাত্রি জাগরণ করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে’।[28]
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ أَحْيَا اللَّيْلَ وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ وَجَدَّ وَشَدَّ الْمِئْزَرَ ‘রামাযানের শেষ দশ দিন শুরু হওয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সারা রাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তিনি নিজেও ইবাদতের জন্য জোর প্রস্তুতি নিতেন’।[29]
১০. চাঁদ দেখে ছিয়াম শেষ করা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِنْ غُمِّىَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلاَثِينَ- ‘তোমরা চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখ ও চাঁদ দেখে ছিয়াম ভঙ্গ কর। যদি চাঁদ তোমাদের নিকটে আচ্ছন্ন থাকে, তাহ’লে শা‘বান ত্রিশ দিন পূর্ণ কর’।[30]
উপসংহার : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের সকলের ছিয়াম সাধনা পূর্ণ ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে পালন করার তাওফীক দান করুন। আর ছিয়ামের মাসের নানাবিধ আমল করার মাধ্যমে নিজেদের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে নিয়ে একনিষ্ঠ জান্নাতপিয়াসী আল্লাহভীরু মানুষ হওয়ার তাওফীক দান করুন।-আমীন!
[লেখক : ছাত্র, দাওরায়ে হাদীছ (২য় বর্ষ), আল-মারকাযুল ইসলামী আ-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।]
[1]. তিরমিযী হা/৩৪৫১; দারেমী হা/১৬৮৭-৮৮; মিশকাত হা/২৪২৮; ছহীহাহ হা/১৮১৬।
[2]. তিরমিযী হা/৭৩০; মিশকাত হা/১৯৮৭।
[3]. মুসলিম হা/১০৯৬; আবু দাঊদ হা/২৩৪৩; মিশকাত হা/১৯৮৩।
[4]. বুখারী হা/১৯০৩; মিশকাত হা/১৯৯৯।
[5]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৩৪২৮।
[6]. বুখারী হা/১৭৮১।
[7]. বুখারী হা/১৯৫৭; মুসলিম হা/১০৯৮; মিশকাত হা/১৯৮৪।
[8]. আবূদাঊদ হা/২৩৫৫; হাকেম হা/১৫৭৫।
[9]. বুখারী হা/৩৮, ৩৭; মুসলিম হা/৭৬০, ৭৫৯; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[10]. আবূদাঊদ হা/১৩৭৫; নাসাঈ হা/১৩৬৪; মিশকাত হা/১২৯৮।
[11]. বুখারী হা/২০৪৪; মিশকাত হা/২০৯৯।
[12]. বুখারী হা/২০১৭; মুসলিম হা/১১৬৯; মিশকাত হা/২০৮৩।
[13]. আবূদাঊদ হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ হা/১৮২৭; হাকেম হা/১৪৮৮।
[14]. বুখারী হা/১৫০৩, ১৫০৬; মুসলিম হা/৯৮৬; মিশকাত হা/১৮১৫-১৬।
[15]. আবূদাঊদ হা/১৬০৯, সনদ হাসান।
[16]. বুখারী হা/৩৮, ৩৭; মুসলিম হা/৭৬০, ৭৫৯; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[17]. মুসলিম হা/১০৭৯; বুখারী হা/১৮৯৯; মিশকাত হা/১৯৫৬।
[18]. মুসলিম হা/১০৭৯; বুখারী হা/১৮৯৯; মিশকাত হা/১৯৫৬।
[19]. আহমাদ হা/২৩৩২৪।
[20]. বুখারী হা/২৮৪০; মুসলিম হা/১১৫৩; মিশকাত হা/২০৫৩।
[21]. নাসাঈ হা/২২৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৩০; ছহীহাহ হা/২৫৬৫।
[22]. তিরমিযী হা/১৬২৪; ছহীহাহ হা/৫৬৩; মিশকাত হা/২০৬৪।
[23]. তিরমিযী হা/৬৮২; ইবনু মাজাহ হা/১৬৪২; মিশকাত হা/১৯৬০।
[24]. ইবনু হিববান হা/৩৬৬৭; ছহীহ আত-তারগীব হা/১০৫৩।
[25]. বুখারী হা/৩২৫৭; মিশকাত হা/১৯৫৭।
[26]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৪৩৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/১০০৩।
[27]. ইবনু মাজাহ হা/১৬৪৪; মিশকাত হা/১৯৬৪।
[28]. বুখারী হা/৩৫, ২০১৪; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[29]. বুখারী হা/২০২৪; মুসলিম হা/১১৭৪; মিশকাত হা/২০৯০।
[30]. মুসলিম হা/১০৮১; বুখারী হা/১৯০৯; মিশকাত হা/১৯৭০।