অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 595 বার পঠিত

[বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বর্তমান ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম (যশোর)। তিনি যশোরের কেশবপুরে অবস্থিত হাজী আব্দুল মোতালেব মহিলা কলেজে অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন। ‘যুবসংঘ’-এর ১৯৮৪-৮৭ সেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে তার সাংগঠনিক জীবন শুরু। তার পর থেকে নানা উত্থান-পতনের মধ্যেও একাধারে সুদীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশের ছায়াতলে থেকে দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানার জন্য অত্র সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাওহীদের ডাক-এর নির্বাহী সম্পাদক আসাদুল্লাহ আল-গালিব। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল]

তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে ভাল আছি। আল্লাহ পাক সুস্থ রেখেছেন।

তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও বেড়ে উঠা সম্পর্কে জানতে চাই।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : আমার জন্ম ১৯৬০ সালের ১৯শে ডিসেম্বর সোমবার বিকালে নানার বাড়ীতে। বাংলা সন অনুযায়ী ৪ঠা পৌষ ১৩৬৭। আমার পিতার নাম মুহাম্মাদ আনোয়ার আলী। আমি পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে। আমার তিন বোন আছে। আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়া আহলেহাদীছ অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে স্বনামধন্য অনেক আহলেহাদীছ আলেম আসতেন। বিশেষ করে আমার পিতা কাকভাঙ্গা মাদ্রাসায় পড়াশুনার সুবাদে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারের পিতা মাওলানা আহমাদ আলীর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ফলে তিনি আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের অনেক এলাকায় সফর করতেন। এছাড়াও মাওলানা মতিউর রহমান সালাফী, মাওলানা আব্দুল্লাহ ইবনে ফযল, মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানী, মাওলানা আব্দুর রঊফসহ অনেক আলেমে দ্বীনকে ছোটবেলায় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁদের দ্বীনী আলোচনা খুব ভাল লাগত।

তাওহীদের ডাক : আপনার পড়াশোনা ও ছাত্রজীবন কিভাবে কেটেছিল।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : আমার পড়াশোনা ও ছাত্রজীবন শুরু হয় গ্রামের মাদ্রাসায়। সেখানে প্রথমে মক্তব ও পরে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ি। তারপর শ্যামনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে কেশবপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেটি বর্তমানে সরকারী পাইলট স্কুল এ্যান্ড কলেজ হিসেবে পরিচিত। সেখান থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসি পাশ করি। এরপর ১৯৮২ সালে কেশবপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর একই সনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হই। ১৯৮৬ সালে অনার্স পাশ করি। ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগ থেকে আধুনিক আরবী সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করি। ১৯৮৯ সালে ইসলামিক স্টাডিজে প্রিভিয়াস ও ১৯৯০ সালে এম. এ শেষ করি। ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এস.এস প্রিভিয়াস ও ১৯৯৩ সালে এম.এস.এস সম্পন্ন করি। এভাবেই আমার প্রতিষ্ঠানিক পড়াশুনা শেষ হয়।

তাওহীদের ডাক : আপনার কর্মজীবন কিভাবে শুরু হয়েছিল? এখন কোথায় কর্মরত আছেন?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : ১৯৮৯ সালের ২রা সেপ্টেম্বর যশোরের ভবদহ কলেজে যোগদানের মাধ্যমে আমার কর্মজীবন শুরু হয়। কলেজটা ছিল আমাদের পার্শ্ববর্তী উপযেলায়। বাড়ী থেকে কলেজ দুরে হওয়ায় বাইসাইকেল যোগে সেখানে যেতে হত। বাড়ী থেকে কলেজ ছিল পূর্ব দিকে। আর মণিরামপুর ও আশে-পাশের শাখাগুলো ছিল পশ্চিম-উত্তর দিকে। অর্থাৎ কলেজের প্রায় উল্টা দিকে। কলেজের আন্দোলন করতে সাংগঠনিক কাজে একটা প্রতিকূল অবস্থা তৈরী হয়। কিন্তু প্রায় ছয় বছর পর ১৯৯৫ সালের ১০ই এপ্রিল বর্তমান প্রতিষ্ঠান হাজী আব্দুল মোতালেব মহিলা কলেজে যোগদান করায় আমার জন্য সাংগঠনিক কাজে সময় দেয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। তখন থেকে অদ্যবধি আমি অত্র প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি।

তাওহীদের ডাক : আপনি কীভাবে যুবসংঘের সাথে জড়িত হ’লেন?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : ১৯৭৮ সালের দিকে আমি প্রচলিত একটি ইসলামী সংগঠনের সাথে যুক্ত হই। তাদের সাংগঠনিক পরিবেশ আমার কাছে খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল তারা অন্ধভাবে একটি মাযহাব অনুসরণ করাকে অপরিহার্য মনে করত। এজন্য তাদের সঙ্গে আমার প্রায়শই মতদ্বৈততা দেখা দিত। আমি যেহেতু আহলেহাদীছ সেজন্য এর বিরুদ্ধে যথারীতি সোচ্চার ছিলাম। তারা আমাকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করত। কিছু আমার মন সেটা মানতে পারত না। তবুও অল্প সময়ের মধ্যে পড়াশোনা করে তাদের ক্যাডারভুক্ত কর্মী ও দায়িত্বশীল হয়ে গেলাম। মনের মাঝে একটা খটকা নিয়েই তাদের সাথে চলতে হ’ত। এমন সময় শুনলাম ১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকার ৭৮নং উত্তর যাত্রাবাড়ীতে এক যুব সম্মেলনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গঠিত হয়েছে। কথাটা শুনেই খুশিতে মনের ভিতর একটা আন্দোলন তৈরী হ’ল। ১৯৭৯ সালের প্রথম দিকেই যশোরে ‘যুবসংঘ’-এর শাখা গঠন করা শুরু করি। প্রথম শাখা গঠন করা হ’ল মণিরামপুর উপযেলার মুজগুন্নিতে। এভাবে আমার যুবসংঘের সাথে সাংগঠনিক জীবন শুরু হয়।

তাওহীদের ডাক : ‘যুবসংঘ’-এর সাথে সাংগঠনিক জীবনের শুরুটা আপনার কেমন ছিল?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : ১৯৭৯ সালে যখন শুনলাম ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ নামে আমাদের একটা সংগঠন গঠিত হয়েছে ঠিক তখন থেকেই আমাদের এলাকায় শাখা গঠন করা শুরু করে দিয়েছিলাম। প্রায় ১৬টা শাখা গঠনের পর শাখা দায়িত্বশীলদের নিয়ে কেশবপুরে একটা বৈঠক হ’ল। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হ’ল আমরা এখন থেকে কেশবপুর-মণিরামপুরে যুবসংঘ-এর সাংগঠনিক দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করব। উক্ত বৈঠকেই যেলা কমিটি গঠন করা হ’ল। সবাই আমাকে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করলেন।

তাওহীদের ডাক : মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কিভাবে?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : কেন্দ্রের সঙ্গে তখনও আমাদের কোন যোগাযোগ হয়নি। শুনেছিলাম কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটি গঠন হয়েছে। আহবায়ক হলেন মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। তাঁর বাড়ী সাতক্ষীরা যেলায়। তাঁকে দেখা, কথা বলা ও সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লাম। অবশেষে ১৯৮০-৮১ সালের দিকে খুলনায় এক প্রোগ্রামে দেখা হ’ল। সাংগঠনিক বিষয়ে অনেক কিছু আলোচনা হ’ল। আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংগঠন পৌঁছে দেবার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় হ’ল। তারপর সবচেয়ে বড় বিষয় হ’ল গ্রামাঞ্চলে মুরববী ও যুবকদের পক্ষ থেকে ‘যুবসংঘ’-এর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন পেতে থাকলাম।

এরপর আমীরে জামা‘আতকে আমাদের সাংগঠনিক যেলায় প্রশিক্ষণের দাওয়াত দিলে তিনি সানন্দে গ্রহণ করলেন। কেশবপুর বাজারের পাশে এক মসজিদে প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হ’ল। অনেক শাখা হ’তে অসংখ্য যুবক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। সেই দিনের প্রধান প্রশিক্ষক আমীরে জামা‘আত যেভাবে প্রশিক্ষণ দিলেন তাতে যুবকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বহু গুণে বৃদ্ধি পেল। কারণ দীর্ঘদিন যাবত আহলেহাদীছ গ্রামগুলোতে কোন সফর হয়নি। কোন রকম তাবলীগ ও তারবিয়াতের ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি যুবকদের মধ্যে আহলেহাদীছ সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা ছিলনা। বলতে গেলে যাদের যৎসামান্য সাংগঠনিক জ্ঞান ছিল, তারা নিজ ঘরের পরিবর্তে অন্যের ঘরে আলো জ্বালাচ্ছিল।

তাওহীদের ডাক : ‘জমঈয়তে আহলেহাদীস’ ‘যুবসংঘ’-এর সাথে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণার পর সাংগঠনিক পরিস্থিতি কেমন ছিল?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : ১৯৮৯ সালের ২১শে জুলাই যখন ‘জমঈয়তে আহলেহাদীস’ ‘যুবসংঘ’-এর সাথে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করে, তখন প্রথম দিকে সাংগঠনিক পরিস্থিতি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। কারণ ‘জমঈয়তে আহলেহাদীস’ ‘যুবসংঘ’-কে বিভক্ত করার জন্য বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন রকম কুটকৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এতে তারা কিছুটা সফলও হয়। তারা দায়িত্বশীল পর্যায়ের দু’জনকে নিয়ে ১৯৮৯ সালের ২৮শে নভেম্বর ‘শুববানে আহলেহাদীস’ গঠনের মাধ্যমে যুবকদেরকে বিভক্ত করেন। সবচেয়ে বড় কথা তারা ‘যুবসংঘ’-কে খতম করার জন্য চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের যে জাল বিস্তার করেছিল, সেটা আজ অবধি ভাবতেও অবাক লাগে। এ প্রসঙ্গে দু‘একটা ঘটনা না বললেই নয়। ‘যুবসংঘ’-এর বিভিন্ন এলাকা ও যেলার দায়িত্বশীল-কর্মীদের উপরে ঐ সময়ে চলেছে অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন। যেমন :

(১) কুমিল্লাতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই ৬ জন ‘যুবসংঘ’-এর কর্মীকে অত্যন্ত নির্দয় ও নির্মমভাবে বেধড়ক পিটানো হয়। (২) ফায়যুল ইসলাম নামে ‘যুবসংঘ’-এর এক কর্মীকে সাইকেল চাপা দেয়। যার ফলে তার মলদ্বার দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়। সে ২৬ ঘণ্টা হাসপাতালে অজ্ঞান ছিল। (৩) যশোর যেলার কেশবপুর মসজিদ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত প্রায় ১৫,০০০ হাযার টাকার বই ও দু’খানা সাইকেল তারা লুট করে। সেখানে তারা আমাদের ইফতার মাহফিলের গরু ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এমনকি ইফতার মাহফিলের দিনে তারা আমাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিলে আমাদেরকে রাস্তায় বসে ইফতার করতে হয়েছে। (৪) রাজশাহী রাণীবাজার মাদ্রাসা মার্কেট থেকে আমাদের কেন্দ্রীয় অফিস উৎখাতের জন্য বিভিন্ন ধরনের হিংসাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় অফিসের দু’টি সাইনবোর্ড খুলে নেওয়া হয়। বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দেয়। ট্যাপ থেকে পানি নিতেও তারা নিষেধ করে। প্রচন্ড গরমে অসীম ধৈর্য ধরে সব কিছু হযম করে সেসময় আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয়েছে। কোন রকম চক্রান্ত ও চাপের কাছে ‘যুবসংঘ’ নতি স্বীকার করেনি। আল্লাহর সন্তষ্টি যাদের লক্ষ্য মানুষের অসমুতষ্টিতে তাদের কী আসে যায়। সুতরাং সাংগঠনিক পরিবেশ পরিস্থিতি যাই থাক, কাজ থেমে থাকেনি।-ফালিল্লাহিল হামদ!

তাওহীদের ডাক : তৎকালীন সময়ে আপনি ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল হিসাবে ‘জমঈয়ত’ ও ‘যুবসংঘ’-এর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির কোন কোন কারণ দেখেছেন?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : আমি কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল হিসাবে এ বিষয়গুলো খুব কাছ থেকেই লক্ষ্য করেছি। এর মধ্যে আমার কাছে আদর্শিক দূরত্বটাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। যেমন : (১) আদর্শিক চেতনা বিলুপ্ত হওয়া : ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীস’-এর গঠনতন্ত্রের ৮নং ধারায় মুহাম্মাদী জামা‘আতের প্রবেশ ও আহলেহাদীছ আন্দোলনে যোগদান করার যোগ্যতা শিরোনাম দিয়ে (গ) দফায় বলা হয়েছে, যে সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আক্বীদা আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কর্মপন্থা ও নেতৃত্ব আহলেহাদীছ আন্দোলন হইতে ভিন্ন, তাহার কোন সদস্য বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীছের শ্রেণিভুক্ত হইতে পারিবেন না (বাংলদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীস: লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও গঠনতন্ত্র; ৯৮, নওয়াবপুর রোড, ঢাকা-১, তৃতীয় সংস্করণ:১৯৮০, পৃ:৭)। কিন্তু কেন্দ্র থেকে শুরু করে করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত কোথাও এই নীতি বাস্তবায়িত হ’ত না, এখনও হয় না। ফলে জমঈয়ত পরিণত হয়েছিল একটি বংশীয় আহলেহাদীছদের সংগঠন, যাতে আমীন বলা আর রফঊল ইয়াদাইন ছাড়া আহলেহাদীছদের আর সকল বৈশিষ্ট্য প্রায় বিলুপ্তই হয়ে পড়ছিল। এভাবে জমঈয়ত তাদের গঠনতান্ত্রিক আদর্শ থেকেই বহু দূরে সরে পড়েছিল। কিন্তু একটি আদর্শিক সংগঠন হিসাবে সচেতন যুবকদের মেধা ও ইখলাছকে সাথী করে ‘যুবসংঘ’ শুরু থেকেই তার আদর্শিক চেতনায় মযবুত ছিল। কখনই তারা বাতিলের সাথে আপোষ করাকে সুদৃষ্টিতে দেখেনি। ফলে জমঈয়ত নেতৃবৃন্দের রোষানলে তারা পড়ে যান।

(২) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সংগঠনের সঙ্গে থাকা : ‘জমঈয়ত’-এর অনেক নেতা-কর্মী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তারা এটাকে ছোট-খাট জিনিস মনে করতেন। অথচ প্রকৃত আহলেহাদীছের চরিত্র কখনই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে একাত্ম হতে পারে না। বরং তাদের সুদৃঢ় অবস্থান হ’ল কিতাব ও সুন্নাতের সর্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পক্ষে।

(৩) তাক্বলীদে শাখছী বা অন্ধ ব্যক্তি পূজার সাথে আপোষকামিতা : এই চরিত্র ‘জমঈয়ত’-এর ভিতরে পাওয়া যায়। যার প্রমাণ তারা এখনো বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ছহীহ হাদীছ পেয়েও নিজে তার উপরে আমল করে না। এমনকি করতেও দেয় না। যুবসংঘ-এর বহু কর্মী এমন আছেন যাদেরকে কেবলমাত্র ছালাতে সম্মিলিত মুনাজাত না করার অপরাধে মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

তাওহীদের ডাক : ‘জমঈয়ত’-এর সাথে ‘যুবসংঘ’-এর এই আদর্শিক দূরত্ব কমাতে আপনাদের কী ভূমিকা ছিল?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : প্রায় ১২ বছরের প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-কে পৃথক করে ‘জমঈয়ত’ যে ফাটল সৃষ্টি করেছিল সেটা নিরসন করার জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। আমি নিজে কয়েকবার অনেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। একটি পদক্ষেপের কথা এখানে উল্লেখ করছি। ১৯৮৯ সালের ১৯শে নভেম্বর। সম্পর্কচ্ছিন্নতা ঘোষণার প্রায় চার মাস পরের ঘটনা। ঐদিন আমার নিকট স্মরণীয় একটি দিন। এর দু’দিন আগে আমরা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের পাঁচজন দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিলাম ‘জমঈয়ত’ সভাপতির সাথে দেখা করার। রাজশাহী হ’তে ঢাকা যাওয়ার পথে কুয়াশা কারণে ফেরী বন্ধ থাকায় অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হলাম।। অবশেষে পরদিন মাগরিবের সময় গন্তব্য পৌঁছলাম। ‘জমঈয়ত’ সভাপতি ড. আব্দুল বারী স্যার তখন ইউ.জি.সি চেয়ারম্যান। উনার অফিসেই বসার ব্যবস্থা হ’ল। মনে করেছিলাম উনার সঙ্গে যখন বসতে পেরেছি তখন সমস্যার একটা সমাধান হবে। কিন্তু কি আশ্চর্য! তাঁর অনাকাঙ্খিত অহমিকার প্রদর্শনীর কাছে সবকিছু বাতিল হয়ে গেল। আমি বিনয়ের সাথে একটা কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন এবং বললেন, এই শ্রীমান! খুব বেড়ে গেছে। ‘জমঈয়ত’ সভাপতিকে অনুরোধ করলাম, স্যার, আপনি আমাদের প্রধান উপদেষ্টা। আপনি যা বলবেন তাই মেনে নিব। আপনি নতুন করে ‘শুববান’ গঠন করবেন না! তিনি ‘জমঈয়ত’-এর দোহাই দিয়ে বললেন, এগুলো ‘জমঈয়ত’-এর ব্যাপার। আমরা বারবার অনুরোধ করলাম যেন আমাদের ভিতর কোন বিশৃংখলা সৃষ্টি না হয়। সেখানে প্রফেসর আযহার উদ্দীন ছাহেবসহ আরো কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তারাও আমাদের অনুভূতি বুঝতে পেরে আমাদের সঙ্গে একমত হয়ে কথা বলছিলেন। সন্ধ্যা ৭.৪৫ মিনিট হ’তে ৯.৪৫ মিনিট প্রায় দু’ঘন্টা আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হ’ল। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হ’ল ‘যুবসংঘ’-এর দোষ কী? কী তাদের অপরাধ? সে ব্যাপারে কিছুই বলা হ’ল না। কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে তার বিচার হ’তে পারে। কিন্তু তাই বলে একটা নির্ভেজাল তাওহীদের আন্দোলনকে স্রেফ যিদ এবং অহমিকার কারণে পর্যুদস্ত করতে হবে, ধ্বংস করতে হবে- এটা কোন ধরনের মানসিকতা! আমরা সেদিন ভীষণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফেরৎ এসেছিলাম।

তাওহীদের ডাক : আপনি কখন ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়েছিলেন? আপনার সভাপতি থাকাকালীন সাংগঠনিক প্রতিকূলতা কেমন ছিল?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : আমি ১৯৯৩-৯৫ সেশনে ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলাম। এ সময় সাংগঠনিক অনেক প্রতিকূলতা লক্ষ্য করেছি। প্রত্যেক যেলায় গেলে একটি প্রশ্ন করা হ’ত, সংগঠন কেন বিভক্ত হ’ল। আর এর জন্য আমাদেরকে দায়ী করা হ’ত। যখন তাদেরকে প্রকৃত বিষয় তুলে ধরা হ’ত তখন তারা বুঝতেন। এই পরিস্থিতিটা খুবই প্রতিকূল ছিল। যদিও এর মধ্য দিয়ে সংগঠন এগিয়ে গেছে। কখনই ময়দান থেকে পিছু হটেনি। যার সবচেয়ে বড় নির্দশন হিসাবে ২৩শে সেপ্টেম্বর’৯৪ শুক্রবার আমাদের মুরববী সংগঠন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও শিশু সংগঠন ‘সোনামণি’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যে সংগঠনদ্বয় মাঠে ময়দানে তখন থেকেই তাদের কর্মতৎপরতা আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।

তাওহীদের ডাক : ১৯৮৪-৯৫ দীর্ঘ ১২ বছর ‘যুবসংঘ’-এর সাংগঠনিক জীবনে আপনি কোন সময়ে সবচেয়ে বেশী প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন? যদি তা বিস্তারিত আমাদের জানাতেন।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : সাংগঠনিক জীবনের সমস্তটাই আমার কাছে প্রতিকূল পরিস্থিতি মনে হয়েছে। শুরু থেকেই ‘জমঈয়ত’ এক অজানা কারণে ‘যুবসংঘ’-এর প্রতি একটা বাঁকা দৃষ্টি রেখে আসছিল। যেমন- ১৯৮৪ সালের ৪ঠা মে রাজশাহী রাণীবাজার মাদ্রাসা মার্কেটে কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থানান্তরিত করা হয়। এর আগে ১৯৮১ সালের ১লা নভেম্বর ‘জমঈয়ত’-এর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ‘যুবসংঘ’-কে ‘জমঈয়ত’-এর অঙ্গ সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি দানের জন্য ‘যুবসংঘ’-এর পক্ষ হ’তে আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত আবেদন পেশ করা হয়। আবেদনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন মাওলানা আব্দুস সামাদ (কুমিল্লা), মাওলনা আব্দুল্লাহ ইবনে ফযল (জামালপুর), অধ্যাপক আব্দুল গণী (জামালপুর) প্রমুখ। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বিশেষ করে ১৯৮৪ সালের ৩১শে আগস্ট শুক্রবার, কেন্দ্রীয় এডহক কমিটি বাতিল করে দু’বছরের জন্য মজলিসে শূরা ও কর্মপরিষদ গঠিত হ’ল। তখন যেলাসমূহ গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন যেলায় যুবকদের ভিতরে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও মুরববীদের সহযোগিতা পাওয়া যায়। সবাই খুশিতে বাগবাগ হয়ে উঠল। কিন্তু একটি মহলকে সব সময় বিভিন্ন কূটতর্কের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করতে দেখা গেল। ভালভাবে প্রশ্নের উত্তর দিলেও তাদের মনঃপূত হয় না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন আরো জটিল করে তোলার চেষ্টা করে।

১৯৮৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী, ১লা ও ২রা মার্চ মোট ৩দিন ব্যাপী ‘জমঈয়ত’-এর ৫ম জাতীয় কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হ’ল ঢাকার ৭৮, উত্তর যাত্রাবাড়ী জমঈয়ত মিলনায়তন প্রাঙ্গনে। পবিত্র কাবা ও মসজিদে নববীর সম্মানিত ইমামগণ, ‘রাবেতায়ে আলম ইসলামী’-এর সেক্রেটারী জেনারেল, ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি)-এর সহকারী সেক্রেটারী, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরসহ সঊদী আরব, কুয়েত, পাকিস্তান হ’তে প্রায় ২৬জন সম্মানিত মেহমান উক্ত সম্মেলনে এসেছিলেন। সম্মেলনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তা হলেন ‘পাকিস্তান জমঈয়তে আহলেহাদীছ’-এর সেক্রেটারী জেনারেল আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর। তিনি উর্দুতে বক্তৃতা করলেন। বাংলায় অনুবাদ করলেন আমার শ্রদ্ধেয় স্যার ড. মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান। জনাব যহীর বক্তৃতার এক পর্যায়ে দুঃখ করে বললেন, আমি কয়েকটা ভাষায় বক্তৃতা করতে পারি। তবে আপনাদের ভাষা জানিনা। বিধায় আমার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করতে হচ্ছে। যদি আগামীতে আবার আসার সৌভাগ্য হয়, তবে আপনাদের ভাষায় বক্তৃতা করব ইনশাআল্লাহ!

‘যুবসংঘ’-এর কর্মীরা উনার বক্তৃতায় উৎসাহিত হ’ল। ‘যুবসংঘ’-এর সম্মেলনে তাঁকে আনার জন্য সবাই মত ব্যক্ত করল। ‘জমঈয়ত’-এর কাছে অনুমতি চাওয়া হ’ল। কিন্তু অনুমতি পাওয়া গেল না। অবশেষে ১৯৮৭ সালে লাহোর আহলেহাদীছ ইয়ুথ কনফারেন্সে টাইম বোমা বিস্ফোরণে তিনিসহ ১১জন আলেম নিহত হন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেঊন)

শুধু এতটুকু নয়। জমঈয়ত কনফারেন্স-এর এক পর্যায়ে দেখা গেল আমাদের একটি ব্যানার ময়দানে নেই। তাদেরই একজন ব্যানারটা নিয়ে গেছে। অনেক দেন-দরবার করে পাওয়া গেল। তবে বুঝা গেল তারা ‘যুবসংঘ’-এর উপর সন্তুষ্ট নয়। শুরু হ’ল নির্যাতন। বিভিন্ন চক্রান্তের মাধ্যমে সংগঠনকে স্থবির ও বাধাগ্রস্ত করার পাঁয়তারা চলল। যুবসংঘ-এর সুনাম ও আদর্শিক দৃঢ়তাকে ‘জমঈয়ত’ সবসময় সন্দেহের চোখে দেখেছে। ফলে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর ভাগ্যে তাই হ’ল, যা যে কোন আদর্শিক সংগঠনকে বরণ করতে হয়। কিন্তু তাতে কী! যাদের একমাত্র লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, দুনিয়াবী চক্রান্তে তাদের কী আসে যায়। ফলে হাযারো বাধার মধ্যেও সংগঠনের আগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। ফালিল্লাহিল হামদ।

তাওহীদের ডাক : আপনি ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। নানা বাধার মধ্যেও এমন কোন বিষয় আছে যেটা আপনাকে নিরন্তর প্রেরণা জোগায়?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : ‘আন্দোলন’-এর দাওয়াতী প্লাটফর্মে অনেক বিষয় রয়েছে যা সত্যিই আমাকে নিরন্তর উৎসাহ উদ্দীপনা জাগায়। শত নির্যাতন ও বাধার মুখেও যখন নিম্নের হাদীছটি পড়লাম তখন ‘আন্দোলন’-এর বিষয়ে আরো দৃঢ় স্পৃহা জাগ্রত হ’ল। হযরত ছুহায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মুমিনের ব্যাপারটি বড়ই বিস্ময়কর! তার সমস্ত বিষয়টিই কল্যাণকর। মুমিন ব্যতীত আর কারো জন্য এরূপ নেই। যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে তখন সে শুকরিয়া আদায় করে। ফলে এটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে ধৈর্য ধারণ করে। ফলে এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৯৭)

অত্র হাদীছ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মুমিনের সব বিষয় কল্যাণকর। নবী রাসূলগণ শত অত্যাচার-নির্যাতনের মুখেও ধৈর্য ধরেছেন। ছাহাবীরা অসীম ধৈর্য ধরে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। উত্তপ্ত পাথর বুকে চাপালেও ঈমান বিসর্জন দেননি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আহাদ! আহাদ! শব্দ উচ্চারণ করেছেন। তবুও বাতিলের সঙ্গে কোন আপোষ করেননি। আর এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের পরীক্ষার মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এ বিষয় চিন্তা করে দাওয়াতী ময়দানে আমার কর্মস্পৃহা আরও বেড়ে যায়।

তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতির কথা যদি বলতেন!

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : আমীরে জামা‘আতের সাথে আমার অনেক উল্লেখযোগ্য স্মৃতি রয়েছে। কিছু স্মৃতির কথা না বললেই নয়।

(১) আমি ১৯৭৯ সালে শুধু ‘যুবসংঘ’-এর নাম শুনেই কেশবপুর মনিরামপুর শাখা গঠনের কাজ শুরু করি। তখন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কর্মসূচী, কর্মপদ্ধতি কিছুই জানিনা। আহবায়কের নাম শুনেছি। কিন্তু তার সঙ্গে কোন পরিচয় নেই। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হ’ল ১৯৮০ সালে খুলনায় এক বৈঠকে। আমীরে জামা‘আত সংগঠনের সার্বিক দিক উপস্থাপন করলেন। আমি আগে জানতাম না যে, আহলেহাদীছ কেবল একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যধারী জনগোষ্ঠীর নাম নয় বরং একটি সংস্কার আন্দোলনের নাম। স্যারের আলোচনায় আমার কাছে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল।

(২) আমরা ১৯৮০ সালে কেশবপুর মণিরামপুর সাংগঠনিক যেলা গঠন করি। এরপর যুবকদের জন্য একটা প্রশিক্ষণের আয়োজন করি। দায়িত্বশীল ও কর্মীদের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। সুতরাং প্রশিক্ষণে আমীরে জামা‘আতকে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। স্যার দাওয়াত গ্রহণ করলেন। কেশবপুর বায়শা (নূরপুর) আহলহাদীছ জামে মসজিদে প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হ’ল। সেদিন আমীরে জামা‘আত যে দিক-নির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তা আজও আমার মনের মুকুরে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। আমাদের এলাকার যুবকদের মধ্যে তখন থেকে উদ্দীপনা এবং কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে গেল।

(৩) ১৯৮৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আমীরে জামা‘আত শহীদ শামসুজ্জোহা হলের হাউজ টিউটর। স্যারের রুমেই আমার থাকার জায়গা হ’ল। মাঝে মাঝে রুমে বৈঠকের আয়োজন করা হ’ত। আমাদের আশেপাশের হলগুলো থেকে অনেকেই বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেন। একদিনের কথা স্মৃতির পাতায় বার বার ভেসে উঠে। আমাদের পাশের হল নবাব আব্দুল লতীফ। ঐ হলে থাকতেন ড. আব্দুল বারী স্যারের ছোট ছেলে হাবীব। তাকে বৈঠকে দাওয়াত দিলাম। বৈঠকে এসে আমীরে জামা‘আতের আলোচনা শুনে তিনি মুগ্ধ হলেন। চলে যাওয়ার সময় বললেন- এ রকম প্রোগ্রামই হওয়া উচিত।

(৪) ১৯৮৫ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর হ’তে ২৪শে ডিসেম্বর পর্যন্ত নাটোর, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি যেলায় সফরে ছিলাম। স্যার আমাকে বললেন, জুমারবাড়ী (গাইবান্ধা) আমার প্রোগ্রাম আছে ঐদিন তুমি ওখানে আসবে। আমীরে জামা‘আতের কথা অনুযায়ী ঐ দিন জুমারবাড়ী উপস্থিত হলাম। অনেক জায়গা থেকে লোক সমবেত হয়েছে। আমরা যে রুমে ছিলাম তার এক পাশে আমীরে জামা‘আত বিশ্রাম নিচ্ছেন। অন্য পাশে মাওলানা আব্দুল কাদের, অধ্যাপক শুজাউল হক (উনি মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদ্রাসার প্রভাষক ছিলেন) এবং আমি বসেছিলাম।

আমরা ‘আন্দোলন’-এর নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। তখন একজন যুবক আমাদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিল। শুজাউল ছাহেব এবং আমি তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু যুবক প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই চলেছে। প্রশ্নের ধরন ছিল এমন যে, আপনারা কিভাবে রাষ্ট্র চালাবেন? কিভাবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন? ইত্যাদি। তার প্রশ্ন করাটা অনেকটা অশালীন কায়দায় ছিল। কিন্তু আমরা ধৈর্য সহকারে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। যতই উত্তর দেই ততই যুবক উত্তেজিত হয়ে আরো প্রশ্ন উত্থাপন করে। ঐ যুবক ছিল মাওলানা আব্দুল কাদের ছাহেবের ছাত্র। উনি গম্ভীর কন্ঠ বললেন, ‘হে যুবক, আমি কি তোমার উস্তাদ নই? যুবক বলল, হ্যাঁ উস্তাদজী। তিনি বললেন, তুমি এখন যে ক্লাসে পড় তা পাস করে যে ক্লাসে ভর্তি হবে, সে ক্লাসে উনি হবেন তোমার শিক্ষক। অর্থাৎ শুজাউল হক ছাহেবের কথা বললেন। মাওলানা আব্দুল কাদের বললেন, যে সংগঠন তোমাকে এই বেয়াদবি করা শিখিয়েছে, সে সংগঠন আগে পরিত্যাগ কর।

একটু পর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত বিশ্রাম থেকে উঠে বললেন, আজ এর উপরেই বক্তৃতা হবে। সত্যিই সেই দিনের সেই সারগর্ভ ও তেজোদৃপ্ত বক্তৃতা আজও আমার কানে বাজে এবং চির অম্লান হয়ে রয়েছে।

(৫) মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সঙ্গে পাবনার শালগাড়িয়ায় প্রোগামে গিয়ে রবীউল ছাহেবের বাড়ীতে উঠেছি। তাঁর সঙ্গে অনেক আলোচনা হ’ল। প্রোগ্রাম শেষ করে গাড়ীতে উঠেছি। গাড়ীতে ভীষণ জোরে গানের শব্দে বসা মুশকিল। আমীরে জামা‘আত আমাকে বললেন, বন্ধ করতে বল। আমি দু’এক বার ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে গান বন্ধ করার কথা বললাম। ড্রাইভার গানের শব্দে আমার কথা শুনতে পেল না। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে বললাম, হে ড্রাইভার! গান বন্ধ কর! গাড়ীর সমস্ত লোক আমার দিকে তাকাল। ড্রাইভার আমার জলদ গম্ভীর আওয়ায শুনে গান বন্ধ করে দিল।

মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে এ রকম আমার যত স্মৃতি আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু স্মৃতির কথা বলতে গেলেও শেষ করা মুশকিল। শুধু এতটুকু বলব, উনি আমার কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সঠিক পথের পরিচালক। যুগে যুগে আল্লাহ যে সমস্ত সমাজ সংস্কাকরদের প্রেরণ করেন উনি তাদের অন্যতম। আল্লাহ আমাকে এবং আমাদের সকল সাথী ভাইদেরকে তাঁর দ্বীনের মুখলিছ খাদেম হিসাবে কবুল করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাঊস দান করুন।- আমীন!

তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে সংগঠনের উপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল সেই সময়ের কথা যদি কিছু বলতেন?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : ২০০৫ সালে সংগঠনের উপর একটা কঠিন পরীক্ষা নেমে এসেছিল। তাবলীগী ইজতেমার সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হয়েছে। এমন সময় আমীরে জামা‘আত সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হ’ল। এটা সংগঠনের জন্য চরম বিপর্যয় তাতে সন্দেহ নেই। তবে এর মাধ্যমে সংগঠনের কর্মীদের ঈমানের পরীক্ষাও হয়েছে। আমরাসহ দেশবাসী জানত বাংলা ভাই কে? শায়খ আব্দুর রহমান কে? তবুও আমাদেরকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হ’ল। জঙ্গীবাদের সাথে আমাদের কোন সংশ্লিষ্টতার কোন প্রশ্নই ওঠে না। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত বহু পূর্ব থেকে এদের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছেন। বিভিন্ন স্থানে তাঁর সুস্পষ্ট ভাষণ ও আমাদের সাংগঠনিক বিবৃতি এর বাস্তব প্রমাণ। অথচ ঘুরেফিরে আমাদের উপরই নির্যাতনের স্টীম রোলার চালানো হ’ল। মুহাতারাম আমীরে জামা‘আতকে জঘন্যতম ১০টি মামলা দেওয়া হ’ল। সামান্য বিবেকবান মানুষও এটা বরদাশত করতে পারবে না। আমাদের দায়িত্বশীল ও কর্মীদের কারাগারে অমানবিক নির্যাতন করা হ’ল। যাদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হ’ল তাদের বাড়ীঘরে তল্লাশী করা ছাড়াও কর্মস্থলে হানা দিয়ে নাজেহাল করা হ’ল। মিথ্যার উপর ভিত্তি করে কত নির্যাতনই না চালানো হ’ল। এতদসত্ত্বেত্ত আন্দোলন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত এগিয়ে চলেছে। চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যারা জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে।

আমেরিকায় প্রেরিত এক গোপন রিপোর্টে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য উদ্বৃত হয়েছে যে, the BDGM is committed to building a strong legal case against Ghalib and the others to ensure long-term convictions". We want him at least 14 years to let this movement die down. ‘গালিব ও অন্যদের বিরুদ্ধের দীর্ঘ মেয়াদী কারাবাস নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকার শক্তিশালী আইনী মামলা তৈরী করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। (তারা বলেন,) আমরা চাই তাকে কমপক্ষে ১৪ বছর জেলে রাখতে, যাতে এই আন্দোলন নিঃশেষ হয়ে যায়’। কিন্তু আল্লাহ তা হতে দেন নি। বরং চক্রান্তকারীদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেছেন এবং আমাদের হেফাজত করেছেন। ২০.০২.২০০৮ বুধবার হাই কোর্ট স্পষ্টই জানিয়ে দেয় যে, There is no material no record to show that Ahlehadis movement is militant Islamic organization connected with the J.M.B. ‘সাক্ষ্য প্রমাণে এমন কোন উপাদান নেই যা প্রমাণ বহন করে যে, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ জেএমবির সাথে সম্পৃক্ত একটি জঙ্গী সংগঠন’।

তাওহীদের ডাক : আপনি ‘যুবসংঘ’-এর দীর্ঘদিনের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল এবং বর্তমানে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। এই দীর্ঘ সাংগঠনিক সম্পাদকের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘যুবসংঘ’-এর কর্মীদেরকে উজ্জীবিত করতে কোন বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেয়াকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : আমি মনে করি ‘যুবসংঘ’-এর কর্মীদের সবার আগে নিজেকে গঠন করতে হবে। আমি যদি নির্ভেজাল না হই তবে আমার দাওয়াতে কেউ পরিবর্তন হবে না। এজন্য অন্ততপক্ষে কয়েকটা গুণাবলী অর্জন করতে হবে।

১. ইখলাছ : নিজের ভিতর খুলূছিয়াত থাকতে হবে। নিয়তের পরিশুদ্ধিতা ছাড়া কোন আমল কবুল হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল’ (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হাদীছ হা/১)। নিয়তের বিশুদ্ধতা ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব নয়।

২. ইলম : ইলম অর্জন করতে হবে। হেরা গুহায় অবতীর্ণর্ প্রথম আয়াতেই ইলম অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘পড় তুমি তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক্ব ৯৬/১)। সুতরাং ইলম অর্জন ব্যতীত সঠিক রাস্তায় চলা আদৌ সম্ভব নয়।

৩. আমল : আমল ব্যতীত ইলম অর্জন করে লাভ নেই। প্রকৃত ফায়েদা লাভ করতে হ’লে অবশ্যই আমল করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং ছালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। আর এটাই হ’ল সরল দ্বীন’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৫)

৪. আমীরের প্রতি আনুগত্য : নেতাবা আমীরের প্রতি আনুগত্য ব্যতীত কোন ইসলামী সমাজ গঠন সম্ভব নয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা করল। আর যে আমীরের (নেতার) আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমারই অবাধ্যতা করল’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬১)

৫. দায়িত্ববোধ : দায়িত্ববোধ ব্যতীত কর্ম সম্পাদন করা যায় না। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৩৪)। দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘মনে রেখ তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৮৫)। সুতরাং এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে চললে বলিষ্ঠ কর্মী হওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি ইনশাআল্লাহ।

তাওহীদের ডাক : আপনার জীবনের বিশেষ কোন স্মরণীয় স্মৃতি যদি উল্লেখ করতেন?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : সাংগঠনিক জীবনে অনেক ঘটনাই স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে আছে। তবে দু’টি ঘটনা সব সময় মনের ভিতর নাড়া দেয়।

(১) যশোর যেলার অন্তগর্ত কেশরপুর উপযেলা সদরের আহলেহাদীছ জামে মসজিদে আমরা নিয়মিত বৈঠক করতাম। ১৯৮৯ সালের ২১শে জুলাই ‘জমঈয়ত’ কর্তৃক ‘যুবসংঘ’-এর সাথে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণার পর দেশের সর্বত্র একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হ’ল। তার সূত্র ধরে আমাদের বৈঠকের দিন মসজিদে তালা দিয়ে রাখল। চাবির খোঁজ একজনের কাছে পেলাম কিন্তু তিনি চাবি দিলেন না। আমরা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পরে মসজিদের জমিদাতা চাচা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমরা বললাম, অমুকের কাছে চাবি আছে কিন্তু তিনি চাবি দিলেন না। তখন তিনি মসজিদের একটা কপাট মযবুত না থাকায় সেটা একটা লাঠি দিয়ে খুলে দিলেন। আমরা মসজিদের ভিতরে বৈঠক শুরু করলাম। তারপর যেটা হ’ল সেটা ছিল ভয়াবহ কায়দায় নির্যাতন। তারা মসজিদে আগমন করে বলল, আমাদের মসজিদে ১টা দেয়াল ঘড়ি কেন? অনেকগুলো ছিল। তোমরা চুরি করেছ? ঘড়ি এনে দাও! ‘জমঈয়ত’ তোমাদের বহিষ্কার করেছে। তাই তোমরা এই মসজিদে আসবে না। তখন একজন বলল, ওরা কি নামায পড়তে পারবে? একজন বলল, নামায পড়তে পারবে। কিন্তু মসজিদে অপেক্ষা করতে পারবে না! ইত্যাদি ইত্যাদি। যে আচরণ সেদিন তারা করেছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়।

(২) এই সময়ে আমার গ্রামের একটি ঘটনা। আমাকে কি করে গ্রাম থেকে বের করা যায় সেই প্রচেষ্টা শুরু হ’ল। কে রাতের অন্ধকারে একজনকে ইট মারল। আসামী করা হ’ল আমাকে। বিচার করার জন্য খুলনায় বসবাসরত আমাদের গ্রামের একজন ধনী ব্যক্তিকে আনা হ’ল। তার উপরে কথা বলার মতো ঐ সময়ে গ্রামের কেউ ছিল না। তিনি যা বলবেন তাই আমাকে মেনে নিতে হবে। যদি তার কথার প্রতিবাদ করি তবে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হবে। আমার এক হিতাকাঙ্খী গোপন সিন্ধান্ত আমাকে জানালো এবং আমাকে কিছু না বলার জন্য বলা হ’ল। ছোট ছোট ছেলেদের কাছে বাঁশের লাঠি দেয়া হ’ল এবং বলা হ’ল ‘আমরা যখন হুমকি দিব তখন তোরা মারা শুরু করবি’। যাহোক, তারা অনেক অশ্লীল, অশ্রাব্য গালিগালাজ করলেন, আমি নীরবতা পালন করলাম। আল্লাহই হেফাযত করলেন। এ সমস্ত ঘটনা সবসময় স্মৃতিতে ভাসে। মনে মনে চিন্তা করি নিরপরাধ মানুষদের উপর যারা অত্যাচার চালায় তার কোন প্রকৃতির মুসলমান!

তাওহীদের ডাক : যুবকদের উদ্দেশ্যে আপনার আর কোন নছীহত আছে কি?

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : যুবকদের উদ্দেশ্যে আমার নছীহত হ’ল-তাদেরকে সর্বপ্রথম তাওহীদ বুঝতে হবে। তারপর শিরক, বিদ‘আত এবং প্রচলিত রাজনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে হবে। নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রসারে একজন নিবেদিত যোগ্য কর্মীর ভূমিকায় কাজ করতে হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে আমরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করি। আমরা জান্নাত পেতে চাই। আমীরে জামা‘আতের প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে সংগঠনের কাজ আন্তরিকতার সাথে পালন করতে হবে। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ একটি নির্ভেজাল তাওহীদী সংগঠন। একমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণে জীবন গঠনই এ সংগঠনের লক্ষ্য। এজন্য সিলেবাস অধ্যয়ন করে পরীক্ষা দিয়ে উপযুক্ত কর্মীর মানে উন্নীত হ’তে হবে। সাংগঠনিক জীবনে পরীক্ষা আসলে সেটা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে মোকাবিলা করতে হবে। ‘ইহতেসাব’ সংরক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখতে হবে। আল্লাহ পাক যুবকদের এ নছীহতগুলো পালনের তাওফীক দান করুন।-আমীন!

তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : দ্বি মাসিক ‘তাওহীদের ডাক’ হ’ল ‘যুবসংঘ’-এর মুখপাত্র। পত্রিকাটি খুবই যুগোপযোগী এবং গবেষণাধর্মী। এই পত্রিকার পাঠকদের ভালভাবে পাঠে মনোযোগী হ’তে বলব। প্রকাশিত সকল প্রবন্ধ এবং লেখাগুলো পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মানদন্ডে রচিত। মুরববীদের সাক্ষাৎকার পত্রিকাটিকে আরও প্রাণবন্ত করেছে। এর ফলে তাঁদের জীবনের বিভিন্ন দিক বিশেষ করে সাংগঠনিক নানা প্রতিকূলতা জেনে যুবকেরা উজ্জীবিত হবে। পত্রিকাটি মাসিক হিসাবে বের করলে আরও ভাল হবে। এটি প্রচার ও প্রসারে যুবকদের ব্যাপক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। পাঠকদের অনুরোধ করব তারাও যেন এটির প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখেন। পরিশেষে ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনা করছি।

তাওহীদের ডাক : আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম : জাযাকুমুল্লাহ খায়রান! মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমরা আমীরে জামা‘আতের নেতৃত্বে একটি নির্ভেজাল তাওহীদের ঝান্ডাবাহী ‘আন্দোলন’-এর প্লাটফর্মে পরিচালিত হচ্ছি। যে আন্দোলনের একমাত্র মানদন্ড কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা। সমাজে খাঁটি ইসলাম প্রতিষ্ঠাই যার একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য আমাদের স্লোগান ‘আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি!’ ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার সকল দায়িত্বশীল ও শুভাকাঙ্খীদের আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক মোবারকবাদ ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পরিশেষে মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকল প্রচেষ্টা কবুল করুন এবং সকলকে জান্নাতুল ফিরদাঊস যাওয়ার তৌফিক দান করুন।-আমীন!



বিষয়সমূহ: সাক্ষাৎকার
আরও