কুধারণা
দিলাওয়ার হোসাইন
আব্দুর রহীম 994 বার পঠিত
ভূমিকা : গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। তবে মুমিন প্রকাশ্যে বা গোপনে কোন গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়লে অনুতপ্ত হয়ে তা স্বীকার করবে এবং কালবিলম্ব না করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী, আর ভুলকারীর মধ্যে উত্তম সে যে তওবা করে’।[1] আল্লাহ তা‘আলা বান্দার অনুতপ্ত হওয়া এবং ক্ষমা প্রার্থনা করাকে পছন্দ করেন। আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা প্রার্থনা করাকে এতটাই পছন্দ করেন যে, লোকেরা যদি কোন পাপই না করত তাহ’লে তিনি আরেকটি জাতি সৃষ্টি করতেন যারা পাপ করত ও পাপে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সেই মহান সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! যদি তোমরা পাপ না কর, তাহ’লে আল্লাহ তোমাদেরকে অপসারিত করবেন এবং এমন জাতির আবির্ভাব ঘটাবেন যারা পাপ করবে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইবে। আর তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন’।[2]
সমাজে কিছু মানুষ আছে যারা অপরাধ করে কিন্তু তা স্বীকার করে না, অনুতপ্ত হয় না বা অনুশোচনাও করে না। এই প্রকৃতির লোকেরাই মূলতঃ দুর্ভাগা। অথচ আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাশীল। তার কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করেন যদিও তার গুনাহ পাহাড়সম হয়। সুতরাং মুমিনের উচিত প্রথমতঃ গুনাহ থেকে বিরত থাকা। দ্বিতীয়তঃ গুনাহ হয়ে গেলে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া। আলোচ্য প্রবন্ধে গুনাহে পতিত মুমিনের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল-
১. নিজের কৃত পাপ স্বীকার করা : মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। তবে ভুল হয়ে গেলে হঠকারিতা না করে মুমিন অনুশোচনা করবে এবং উক্ত পাপ যেন তার মাধ্যমে আর না হয় সে ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَآخَرُونَ اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلًا صَالِحًا وَآخَرَ سَيِّئًا عَسَى اللهُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘আর কিছু লোক রয়েছে, যারা তাদের অপরাধসমূহ স্বীকার করেছে। তারা তাদের কর্মে ভাল ও মন্দ মিশ্রিত করেছে। অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু’ (তওবা ৯/১০২)।
রাসূল (ছাঃ) আয়েশা (রাঃ)-কে বলেন, আর যদি তুমি কোন গুনাহে জড়িয়ে থাক, তাহ’লে আল্লাহর নিকট তওবা ও ইসতিগফার কর। কেননা ‘বান্দা নিজের পাপ স্বীকার করে তওবা করলে তার আল্লাহ তওবা কবুল করেন’।[3]
অন্য হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,قَالَ لِى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَا عَائِشَةُ إِنْ كُنْتِ أَلْمَمْتِ بِذَنْبٍ فَاسْتَغْفِرِى اللَّهَ فَإِنَّ التَّوْبَةَ مِنَ الذَّنْبِ النَّدَمُ وَالاِسْتِغْفَارُ- ‘রাসূল (ছাঃ) আমাকে বলেন, হে আয়েশা! যদি তুমি কোন গুনাহে জড়িয়ে থাক, তাহ’লে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা গুনাহ থেকে তওবা হ’ল অনুশোচনা করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা’।[4]
আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ صَاحِبَ الشِّمَالِ لِيَرْفَعُ الْقَلَمَ سِتَّ سَاعَاتٍ عَنِ الْعَبْدِ الْمُسْلِمِ الْمُخْطِئِ أَوِ الْمُسِيءِ، فَإِنْ نَدِمَ وَاسْتَغْفَرَ اللهَ مِنْهَا أَلْقَاهَا، وَإِلا كُتِبَتْ وَاحِدَة- ‘নিশ্চয় বামের ফেরেশতা পাপী বা অপরাধী মুসলিমের উপর থেকে ছয় ঘন্টা কলম তুলে রাখেন। অতঃপর সে যদি পাপে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তাহ’লে তা উপেক্ষা করেন। নচেৎ একটি পাপ লেখা হয়’।[5]
আরেকটি হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتّٰـى تَعْلُوَ قَلْبَهُ وَهُوَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللهُ كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ- ‘মুমিন যখন কোন পাপ করে, তখন তার হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর সে যদি তওবা করে, পাপ থেকে বিরত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহ’লে তার হৃদয় পরিষ্কার হয়ে যায়। আর যদি আরও বেশী পাপ করে, তাহ’লে সেই দাগ তার হৃদয়কে গ্রাস করে নেয়। এই হ’ল সেই জং, যার কথা আল্লাহ তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন’।[6]
নিজের পাপ স্বীকারের কিছু নমুনা :
ক. হযরত আদম (আঃ) : হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ) জান্নাতে থাকা অবস্থায় আল্লাহর বিধান অমান্য করে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে নেন। যখন তাদের শরীর থেকে জান্নাতের পোষাক খুলে পড়ে তখন তারা অনুতপ্ত হৃদয়ে নিজেদের পাপকে যুলুম মনে করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন,رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ-‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছি। এক্ষণে যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তাহ’লে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আ‘রাফ ৭/২৩)।
খ. হযরত ইউনুস (আঃ) : হযরত ইউনুস (আঃ) আল্লাহর অনুমতি না নিয়ে তার জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রেখে এলাকা ছেড়ে চলে যান এবং বিপদে পতিত হন। অন্যদিকে তার জাতির লোকেরা আল্লাহর শাস্তির ভয়ে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। অন্য দিকে ইউনুস (আঃ)-কে সাগরের বুকে মাছ খেয়ে ফেললে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন,لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ‘(হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। যখন তিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে নাজাত দিলেন। আল্লাহ বলেন, فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِينَ অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি’ (আম্বিয়া ২১/৮৮)।
গ. হযরত মূসা (আঃ) : হযরত মূসা (আঃ) যুবক বয়সে জনৈক কিবতীকে ঘুষি দ্বারা আঘাত করলে সে তাতেই মারা যায়। তিনি তাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনিচ্ছা সত্তেবও মানব হত্যার মত পাপ করে ফেলে। এজন্য অনুতপ্ত হয়ে মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দো‘আ করলেন,رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার নিজের উপর যুলুম করেছি। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর! ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (কাছাছ ২৮/১৬)।
ঘ. বনু ইস্রাঈলের জনৈক ব্যক্তির উদাহরণ : জনৈক ব্যক্তি ১০০ জনকে হত্যা করার পর নিজ পাপের জন্য অনুশোচনা করে ও ক্ষমা প্রার্থনা করে। জনৈক আলেম তার পাপ স্বীকার করা দেখে তার নিজ এলাকা ত্যাগ করে সৎকর্মশীল লোকেরা বসবাস করে এমন এলাকায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। পথিমধ্যে সে মারা যায় এবং সৎকর্মশীল লোকদের এলাকা থেকে অনেক দূরেই সে ছিল। কিন্তু তার অনুশোচনার কারণে আল্লাহ তা‘আলা ঐ দেশকে (যেখান থেকে সে আসছিল তাকে) আদেশ করলেন যে, তুমি দূরে সরে যাও এবং এই সৎকর্মশীলদের দেশকে আদেশ করলেন যে, তুমি নিকটবর্তী হয়ে যাও। অতঃপর বললেন, তোমরা এ দু’য়ের দূরত্ব মাপ। সুতরাং তাকে সৎকর্মশীলদের দেশের দিকে এক বিঘত বেশী নিকটবর্তী পেলেন। যার ফলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হ’ল’।[7]
ঙ. হযরত আবুবকর (রাঃ) : আবুবকর (রাঃ) যখন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে দো‘আ শিখতে চাইলেন তখন তিনি এমন একটি দো‘আ শিখিয়ে দিলেন যাতে রয়েছে নিজে অনুতপ্ত হওয়ার কথা, রয়েছে নিজের প্রতি চরম যুলুম করার কথা। যেমন হাদীছে এসেছে, আবুবকর (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি দো’আ বলে দিন যা আমি ছালাতে (তাশাহুদের পর) পড়ব। উত্তরে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এ দো‘আ পড়বে,اللَّهُمَّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كَثِيرًا، وَلا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً مِنْ عِنْدِكَ وَارْحَمْنِي، إِنَّك أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আমার নফসের উপর অনেক যুলুম করেছি। তুমি ছাড়া গুনাহ মাফ করার কেউ নেই। অতএব আমাকে তোমার পক্ষ থেকে মাফ করে দাও। আমার ওপর রহম কর। তুমিই ক্ষমাকারী ও রহমতকারী’।[8]
চ. হযরত উমর (রাঃ) : রাসূল (ছাঃ) ৬ষ্ঠ হিজরীতে ১৪শত ছাহাবী নিয়ে ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। কিন্তু হুদায়বিয়া নামক স্থানে যেতে না যেতেই মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে বাধা চলে আসে। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, এবার হজ্জ না করেই ফিরে যেতে হবে। রাসূল (ছাঃ) সেখানেই মাথা মুন্ডন ও কুরবানী করার নির্দেশ দেন। কোন ছাহাবী তা মেনে নিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে ওমর (রাঃ) হতাশ হয়ে পড়েন এবং রাসূল (ছাঃ) কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল!أَلَسْنَا عَلَى الْحَقِّ وَهُم عَلَى الْبَاطِلِ ‘আমরা কি হক্ব-এর উপরে নই এবং তারা বাতিলের উপরে?’ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। ওমর বললেন,أَلَيْسَ قَتْلاَنَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلاَهُمْ فِي النَّارِ؟ ‘আমাদের নিহতরা কি জান্নাতী নয় এবং তাদের নিহতরা জাহান্নামী?’ রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। ওমর বললেন, ‘তাহ’লে কেন আমরা দ্বীনের ব্যাপারে ছাড় দেব এবং ফিরে যাব? অথচ আল্লাহ পাক এখনো আমাদের ও তাদের মাঝে কোনরূপ ফায়ছালা করেননি?’ জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، إِنِّى رَسُولُ اللهِ، وَلَنْ يُضَيِّعَنِى اللهُ أَبَدًا ‘হে ইবনুল খাত্ত্বাব! আমি আল্লাহর রাসূল। কখনোই আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করবেন না।
অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, إِنِّي رَسُولُ اللهِ، وَلَسْتُ أَعْصِي رَبِّي، وَهُوَ نَاصِرِي ‘আমি আল্লাহর রাসূল। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি না। তিনিই আমার সাহায্যকারী। তখন ওমর (রাঃ) বললেন,أَوَ لَيْسَ كُنْتَ تُحَدِّثُنَا أَنَّا سَنَأْتِي الْبَيْتَ، فَنَطُوفُ بِهِ؟ ‘আপনি কি আমাদের বলেননি যে, সত্ত্বর আমরা আল্লাহর ঘরে গমন করব ও তাওয়াফ করব? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তবে আমি কি তোমাকে বলেছিলাম যে, আমরা এ বছরই সেটা করব? ওমর বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَإِنَّكَ تَأْتِيْهِ، فَتَطُوفُ بِهِ ‘তাহ’লে অবশ্যই তুমি আল্লাহর ঘরে আসবে ও তাওয়াফ করবে।
অতঃপর ওমর (রাঃ) রাগতঃভাবে বেরিয়ে আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন ও একইরূপ অভিযোগ করলেন। তিনিও তাকে রাসূল (ছাঃ)-এর ন্যায় জবাব দিলেন এবং বললেন,إِنَّهُ رَسُولُ اللهِ، وَلَنْ يُضَيِّعَهُ اللهُ أَبَدًا নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল এবং কখনোই আল্লাহ তাকে ধ্বংস করবেন না। তিনি আরও বলেন,أَيُّهَا الرَّجُلُ إِنَّهُ رَسُولُ اللهِ، وَلَيْسَ يَعْصِي رَبَّهُ، وَهُوَ نَاصِرُهُ، فَاسْتَمْسِكْ بِغَرْزِهِ، حَتَّى تَمُوتَ، فَوَاللهِ إِنَّهُ عَلَى الْحَقِّ- ‘হে লোক! নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল। তিনি তার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করেন না। তিনিই তাকে সাহায্যকারী। অতএব তুমি আমৃত্যু তার পথ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাক। আল্লাহর কসম! তিনি অবশ্যই হক্ব-এর উপরে আছেন’।[9]
কয়েক ঘন্টা পরে সূরা ফাতহের ১-৩ আয়াত নাযিল হ’লে রাসূল (ছাঃ) ওমরের কাছে লোক পাঠিয়ে আয়াতটি শুনিয়ে দিলেন। তখন ওমর এসে বললেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَوَ فَتْحٌ هُوَ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি বিজয় হ’ল? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি খুশী হলেন ও ফিরে গেলেন’।[10]
ওমর (রাঃ) তার ঐদিনের বাড়াবাড়ির কারণে দারুণভাবে লজ্জিত হন। তিনি বলেন,مَا زِلْتُ أَصُومُ وَأَتَصَدَّقُ وَأُصَلِّى وَأَعْتِقُ مِنَ الَّذِى صَنَعْتُ مَخَافَةَ كَلاَمِى الَّذِى تَكَلَّمْتُ بِهِ يَوْمَئِذٍ حَتَّى رَجَوْتُ أَنْ يَكُونَ خَيْراً ‘আমি এজন্য অনেক সৎকর্ম করেছি। সর্বদা ছাদাক্বা করেছি, ছিয়াম রেখেছি, নফল ছালাত আদায় করেছি, দাস-দাসী মুক্ত করেছি। শুধু ঐদিন ঐ কথাগুলো বলার গুনাহের ভয়ে। এখন আমি মঙ্গলের আশা করছি’।[11]
ছ. হযরত আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) : তিনি একদিন তার দাসকে মেরেছিলেন। অন্যায়ভাবে দাসকে আঘাত করার বিষয়টিকে তিনি পাপ মনে করলেন এবং তাতে অনুতপ্ত হয়ে সেই দাসকে মুক্ত করে দেন। যেমন হাদীছে এসেছে- আবু মাসঊদ আল আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كُنْتُ أَضْرِبُ غُلَامًا لِي، فَسَمِعْتُ مِنْ خَلْفِي صَوْتًا: اعْلَمْ، أَبَا مَسْعُودٍ، لَلَّهُ أَقْدَرُ عَلَيْكَ مِنْكَ عَلَيْهِ، فَالْتَفَتُّ فَإِذَا هُوَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، هُوَ حُرٌّ لِوَجْهِ اللهِ، فَقَالَ: ্রأَمَا لَوْ لَمْ تَفْعَلْ لَلَفَحَتْكَ النَّارُ، أَوْ لَمَسَّتْكَ النَّارُ- ‘আমি স্বীয় দাসকে প্রহাররত অবস্থায় আমার পেছন হ’তে উচ্চস্বরে একটি আওয়াজ শুনলাম, হে আবু মাসঊদ! সাবধান! তুমি তোমার দাসের ওপর যতটুকু ক্ষমতা রাখ আল্লাহ তদপেক্ষা তোমার ওপর অধিক ক্ষমতার অধিকারী। অতঃপর আমি পিছন ফিরে দেখি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (এ কথাটি) বলছেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাকে আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত করে দিলাম। তখন তিনি বললেন, তুমি যদি এটা না করতে তবে জাহান্নামের আগুন তোমাকে ঝলসিয়ে দিত’।[12]
জ. হযরত আবু লুবাবা আনছারী (রাঃ) : অবরুদ্ধ বনু কুরায়যা গোত্র আত্মসমর্পণের পূর্বে পরামর্শের উদ্দেশ্যে ছাহাবী আবু লুবাবা বিন আব্দুল মুনযির (রাঃ)-কে তাদের নিকটে প্রেরণের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে প্রস্তাব পাঠায়। কেননা আবু লুবাবার বাগ-বাগিচা, সন্তান-সন্ততি এবং গোত্রীয় লোকেরা ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় তার সাথে তাদের সখ্যতা ছিল। অতঃপর আবু লুবাবা সেখানে উপস্থিত হ’লে পুরুষেরা ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। নারী ও শিশুরা করুণ কণ্ঠে ক্রন্দন করতে থাকে। এতে তার মধ্যে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়।
অতঃপর ইহূদীরা বলল, হে আবু লুবাবা! আপনি কি যুক্তিযুক্ত মনে করছেন যে, বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আমরা মুহাম্মাদের নিকটে অস্ত্র সমর্পণ করি। আবু লুবাবা বললেন, হ্যাঁ। বলেই তিনি নিজের কণ্ঠনালীর দিকে ইঙ্গিত করলেন। যার অর্থ ছিল হত্যা। কিন্তু এতে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, এ কাজটি খেয়ানত হ’ল। তিনি ফিরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে না গিয়ে সরাসরি মসজিদে নববীতে গিয়ে খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলেন ও শপথ করেন যে, রাসূল (ছাঃ) নিজ হাতে তার বন্ধন না খোলা পর্যন্ত নিজেকে মুক্ত করবেন না এবং আগামীতে কখনো বনু কুরায়যার মাটিতে পা দেবেন না। ওদিকে তার বিলম্বের কারণ সন্ধান করে রাসূল (ছাঃ) যখন প্রকৃত বিষয় জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, যদি সে আমার কাছে আসত, তাহ’লে আমি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতাম। কিন্তু যেহেতু সে নিজেই একাজ করেছে, সেহেতু আল্লাহ তার তওবা কবুল না করা পর্যন্ত আমি তাকে বন্ধনমুক্ত করতে পারব না। আবু লুবাবা এভাবে ছয় দিন মসজিদের খুঁটির সাথে বাঁধা থাকেন। ছালাতের সময় তার স্ত্রী এসে বাঁধন খুলে দিতেন। পরে আবার নিজেকে বেঁধে নিতেন। এই সময় একদিন প্রত্যুষে তার তওবা কবুল হওয়া সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে অহি নাযিল হয়। তিনি তখন উম্মে সালামাহর ঘরে অবস্থান করছিলেন। আবু লুবাবা বলেন, এ সময় উম্মে সালামা নিজ কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে ডাক দিয়ে বললেন,يَا اَبَا لُبَابَةَ! اَبْشِرْ فَقَدْ تَابَ اللهُ عَلَيْكَ ‘হে আবু লুবাবা, সুসংবাদ গ্রহণ কর! আল্লাহ তোমার তওবা কবুল করেছেন। একথা শুনে ছাহাবীগণ ছুটে এসে আমার বাঁধন খুলতে চাইল। কিন্তু আমি অস্বীকার করি। পরে রাসূল (ছাঃ) ফজর ছালাতের জন্য বের হয়ে এসে আমার বাঁধন খুলে দেন’।[13] ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, আবু লুবাবার তওবার ব্যাপারে কুরআনের দু’টি আয়াত নাযিল হয়। একটি সূরা আনফালের ২৭ আয়াত ও সূরা তওবার ১০২ আয়াত’।[14]
জ. হযরত কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) : তাবূক যুদ্ধের প্রস্ত্ততি শুরু হ’লে কা‘ব বিন মালেক (রাঃ)ও পূর্ণ প্রস্ত্ততি নেন। রাসূল (ছাঃ) যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে রওয়ানা হ’লেন। কা‘ব বিন মালেক যুবক ছিলেন। তিনি মনে করলেন আগামী দিন বের হ’লেও তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে যোগদান করতে পারবেন। কিন্তু অলসতাবশতঃ তিনি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলেন না। রাসূল (ছাঃ) বিজয়ী বেশে ফিরে আসলে পশ্চাৎগামী দুর্বল মুসলমানরা বিভিন্ন ওযর পেশ করে ছাড় নিয়ে নিলেন। কিন্তু কা‘ব বিন মালেকসহ তিনজন ছাহাবী নিজের পাপের কথা স্বীকার করলেন এবং অনুতপ্ত হ’লেন। কা‘ব বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর পিছনে থেকে যাওয়া লোকদের মধ্য থেকে আমাদের তিনজনের সাথে কথা বলা সকল মুসলমানের জন্য নিষেধ করে দিলেন। কাজেই লোকেরা আমাদেরকে এড়িয়ে চলতে লাগল। তাদের অবস্থা এত পরিবর্তন হয়ে গেল যে, তারা যেন আমাদেরকে চিনেইনা।
এ অবস্থায় আমরা পঞ্চাশটি রাত কাটালাম। আমার অন্য ভাই দু’জন ঘরের মধ্যে বসে গেলেন এবং ক্রন্দন শুরু করলেন। আমি যেহেতু গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে যুবক ও শক্তিশালী ছিলাম, তাই আমি ঘর থেকে বের হতাম এবং মুসলমানদের সাথে ছালাতে যোগ দিতাম এবং বাজারে ঘুরাফেরা করতাম। রাসূল (ছাঃ) যখন ছালাতের পর লোকদেরকে নিয়ে বসতেন, তখনও আমি তার কাছে গিয়ে সালাম দিতাম। আমি মনে মনে ভাবতাম, আমার সালামের জবাবে তার ঠোঁট নড়লো কি না? অতঃপর আমি তার কাছে দাঁড়িয়ে ছালাত পড়তাম এবং বাঁকা দৃষ্টিতে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতাম। আমি লক্ষ্য করতাম যে, আমি যখন ছালাতে মশগুল থাকি, তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আবার আমি যখন তার দিকে চাইতাম, তখন তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতেন।
এভাবে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত লোকদের বিমুখতা যখন আমাকে দিশেহারা করে দিল, তখন একদিন আমার চাচাত ভাই আবু কাতাদার বাগানের দেয়াল টপকে তার কাছে আসলাম। সে ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বেশী প্রিয়। আমি তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম! সে আমার সালামের জবাব দিলনা। আমি বললাম, হে আবু ক্বাতাদা! আল্লাহর কসম দিয়ে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জানো না আমি আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভালবাসি? সে চুপ করে থাকল। আমি আবার আল্লাহর নামে কসম খেয়ে তাকে এ প্রশ্ন করলাম। সে এবারও চুপ থাকল। আমি তাকে তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করলাম। এবার সে জবাব দিল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। এ কথা শুনে আমার দু’চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল। আমি দেয়াল টপকে চলে আসলাম।
একদিন আমি মদীনার বাজারে হাঁটছিলাম। এসময় সিরিয়ার একজন খৃষ্টান ব্যবসায়ী মদীনার বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে এসেছিল। সে বলতে লাগল-কে আমাকে কা‘ব বিন মালেকের ঠিকানা বলে দিতে পারে? লোকেরা আমার দিকে ইশারা করে তাকে বলে দিতে লাগল। সে আমার কাছে এসে গাস্সানের বাদশার একটি চিঠি আমার হাতে দিল। চিঠিতে বাদশা লিখছেন, আমি জানতে পেরেছি যে, আপনার নেতা আপনার উপর নির্যাতন চালাচ্ছেন। অথচ আল্লাহ আপনাকে লাঞ্জনা ও অবমাননাকর অবস্থায় রাখেননি। আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন। আমরা আপনাকে মর্যাদা ও আরামের সাথে রাখব। পত্রটি পড়ে আমি বললাম, এটাও আর একটা পরীক্ষা। পত্রটি নিয়ে আমি চুলার নিকট গেলাম এবং তা পুড়িয়ে ফেললাম।
এভাবে পঞ্চাশ দিনের মধ্যে চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। এমন সময় রাসূল (ছাঃ)-এর একজন দূত আমার কাছে এসে বললেন, আল্লাহর রাসূল তোমাকে তোমার স্ত্রী থেকে আলাদা থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি বললাম, তালাক দিব? না অন্য কিছু করব? তিনি বললেন, না; বরং তার থেকে আলাদা থাক এবং তার কাছে যেও না। আর আমার অন্য দু’জন সাথীর কাছেও অনুরূপ বার্তা পাঠালেন। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি নিজের আত্মীয়দের কাছে চলে যাও। আল্লাহ আমার ব্যাপারে কোন ফায়ছালা না দেয়া পর্যন্ত তাদের কাছে অবস্থান করতে থাক। কা‘ব বিন মালেক বলেন, হেলাল বিন উমাইয়ার স্ত্রী রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! হেলাল ইবনে উমাইয়া অতি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে। তার কোন খাদেম নেই। আমি যদি তার খেদমত করে দেই, তাতে কোন অসুবিধা আছে কি? জবাবে তিনি বললেন, কোন ক্ষতি নেই। তবে সে যেন তোমার কাছে না আসে। হেলাল বিন উমাইয়ার স্ত্রী বললেন, আল্লাহর কসম! তার মধ্যে এ ধরণের কোন আকাঙ্খা নেই। আল্লাহর কসম! যেদিন থেকে এ ঘটনা ঘটেছে সেদিন থেকে সে কেঁদে চলছে এবং আজও সে কাঁদছে।
কা‘ব বললেন, আমার পরিবারের কেউ কেউ আমাকে বলল, রাসূল (ছাঃ) হেলাল বিন উমাইয়ার স্ত্রীকে তার স্বামীর খেদমত করার জন্য যেমন অনুমতি দিয়েছেন তেমন তুমিও তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে একটা অনুমতি নিয়ে আসতে পার। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে অনুমতি আনতে যাব না। আমি জানি না রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এ ব্যাপারে অনুমতি চাইতে গেলে কী বলবেন। আর আমি তো একজন যুবক।
এরপর আমি দশ রাত কাটালাম। রাসূল (ছাঃ) আমাদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের পঞ্চাশ দিন পূর্ণ হয়ে গেল। পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হওয়ার পর ফজরের ছালাত পড়লাম। ছালাত শেষে আমি আমাদের ঘরের সামনে বসেছিলাম। এ সময় আমার অবস্থা সে রকমই ছিল যেমন আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বর্ণনা করেছেন। আমার জীবন আমার নিকট যন্ত্রনাদায়ক হয়ে গেল। পৃথিবী বিশাল হওয়া সত্ত্বেও তা আমার নিকট অত্যন্ত সংকীর্ণ মনে হচ্ছিল। তখন আমি একটা আওয়াজ শুনলাম। সালা পাহাড়ের উপর থেকে কে একজন চিৎকার করে বলল, হে কা‘ব বিন মালেক! সুসংবাদ গ্রহণ কর। কা‘ব বলেন, এ কথা শুনে আমি সিজদায় পড়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার কষ্ট কেটে গেছে।
ফজরের ছালাতের পর রাসূল (ছাঃ) আমাদের তওবা কবুল হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। লোকেরা আমাদের কাছে এসে সুসংবাদ দিতে লাগল। আমার অপর দু’জন সাথীর কাছে গিয়েও সুসংবাদ ও মুবারকবাদ দিতে লাগল। একজন তো ঘোড়ায় চড়ে এক দৌড়ে আমার কাছে আসলেন। আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তি দৌড়িয়ে পাহাড়ে উঠলেন। তার কথা অশ্বারোহীর চেয়েও দ্রুততর হ’ল। আমি যেই সুসংবাদ গ্রহণকারীর আওয়াজ শুনেছিলাম, তিনি যখন আমার কাছে আসলেন তখন আমি এতো খুশী হলাম যে, আমার পোষাক জোড়া খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম। আল্লাহর কসম! তখন আমার কাছে ঐ কাপড় জোড়া ছাড়া আমার কোন কাপড় ছিল না। তারপর আমি এক জোড়া কাপড় ধার করে নিলাম এবং পরিধান করে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে বের হ’লাম। চলার পথে লোকেরা দলে দলে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে লাগল। তওবা কবুল হওয়ার কারণে আমাকে মুবারকবাদ জানাতে লাগল। তারা বলতে লাগল, আল্লাহ তোমার তওবা কবুল করেছেন এবং তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এজন্য তোমাকে মুবারকবাদ।
কা‘ব বলেন, আমি যখন মসজিদে গেলাম, তখন দেখলাম, রাসূল (ছাঃ) বসে আছেন। লোকেরা চার পাশ থেকে তাকে ঘিরে বসে আছে। এ সময় তালহা বিন উবায়দুল্লাহ আমার দিকে দৌড়ে এসে আমার সাথে মুছাফাহা করলেন এবং আমাকে মুবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম! মুহাজিরদের মধ্য হ’তে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ আমার নিকট এসে মুবারকবাদ দেননি। তালহার এই আচরণ আমি কখনই ভুলতে পারব না। কা‘ব বলেন, তারপর আমি রাসূল (ছাঃ)-কে সালাম দিলাম। তখন তার চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বললেন, হে কা‘ব! তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর। আজকের দিনটি তোমার জন্য মুবারক হৌক, যা তোমার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত অতিক্রান্ত দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল। কা‘ব বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ হ’তে? না আল্লাহর পক্ষ হ’তে? তিনি বললেন, না; বরং তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে। আর রাসূল (ছাঃ) যখন খুশী হতেন তখন তার চেহারা মুবারক চাঁদের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আর আমরা চেহারা দেখে তার খুশী বুঝতে পারতাম। আমি তার সামনে বসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার তওবা কবুলের শুকরিয়া স্বরূপ আমি আমার সমস্ত সম্পদ আল্লাহ ও তার রাসূলের পথে ছাদাক্বা করতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সম্পদের কিছু নিজের জন্য রেখে দাও। তাতে তোমার ভাল হবে। আমি বললাম, তাহ’লে আমি শুধু খায়বারের অংশটুকু আমার জন্য রাখলাম’।[15]
ঝ. জুহায়না নারীর অনুশোচনা : জুহায়না গোত্রের একজন নারী আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হ’ল। সে অবৈধ মিলনে গর্ভবতী ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি দন্ডনীয় অপরাধ করে ফেলেছি তাই আপনি আমাকে শাস্তি দিন! সুতরাং আল্লাহর নবী (ছাঃ) তার আত্মীয়কে ডেকে বললেন, তুমি একে নিজের কাছে যত্ন সহকারে রাখ এবং সন্তান প্রসবের পর একে আমার নিকট নিয়ে এসো। সুতরাং সে তাই করল (অর্থাৎ, প্রসবের পর তাকে রাসূল (ছাঃ) এর কাছে নিয়ে এল)। আল্লাহর নবী (ছাঃ) তার কাপড় তার (শরীরের) উপর মযবুত করে বেঁধে দেওয়ার আদেশ দিলেন। অতঃপর তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার আদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি তার জানাযার ছালাত পড়লেন। ওমর (রাঃ) তাকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এই মেয়ের জানাযার ছালাত পড়লেন, অথচ সে ব্যভিচার করেছিল? তিনি বললেন, (ওমর! তুমি জান না যে,) এই স্ত্রী লোকটি এমন বিশুদ্ধ তওবা করেছে, যদি তা মদীনার ৭০টি লোকের মধ্যে বন্টন করা হ’ত তা তাদের জন্য যথেষ্ট হত। এর চেয়ে কী তুমি কোন উত্তম কাজ পেয়েছ যে, সে আল্লাহর জন্য নিজের প্রাণকে কুরবান করে দিল’? [16]
(ক্রমশঃ)
আব্দুর রহীম
লেখক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
[1]. তিরমিযী হা/২৪৯৯; ছহীহুত তারগীব হা/৩১৩৯।
[2]. মুসলিম হা/২৭৪৯; মিশকাত হা/২৩২৮।
[3]. বুখারী হা/২৬৬১; ছহীহাহ হা/২৫০৭।
[4]. আহমাদ হা/২৬৩২২; ছহীহাহ হা/১২০৮।
[5]. তাবারাণী হা/৭৭৬৫; ছহীহাহ হা/১২০৯; ছহীহুল জামে‘ হা/২০৯৭।
[6]. তিরমিযী হা/৩৩৩৪; ইবনু হিববান হা/২৭৮৭, সনদ ছহীহ।
[7]. বুখারী হা/৩৪৭০; মুসলিম হা/২৭৬৬।
[8]. বুখারী হা/৮৩৪; মুসলিম হা/২৭০৫।
[9]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২, সনদ ছহীহ।
[10]. বুখারী হা/৪৮৪৪; মুসলিম হা/১৭৮৫; ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৭৯১৪।
[11]. আহমাদ হা/১৮৯৩০।
[12]. মুসলিম হা/১৬৫৯; মিশকাত হা/৩৩৫৩।
[13]. ইবনু হিশাম ২/২৩৭; বায়হাক্বী হা/১৩৩০৭; আল-বিদায়াহ ৪/১১৯ সনদ মুরসাল; তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৩৮১।
[14]. তাফসীরে ইবনু কাছীর ৩/১২১, ৪/৩৬-৩৭।
[15]. বুখারী হা/৪৪১৮; তিরমিযী হা/৩১০২।
[16]. মুসলিম হা/১৬৯৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৫১২৮।