উটের মহানুভবতা
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 310 বার পঠিত
অনেক দিন আগের কথা। একটি পুরাতন অব্যবহৃত বাড়িতে দীর্ঘদিন যাবৎ কিছু পিঁপড়া বসবাস করছিল। একদিন সে বাড়ির দেয়ালের ফাটলে ভীমরুল বাসা বাঁধল। পিঁপড়া ও ভীমরুলগুলো নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকত। সাধারণত গ্রীষ্মকালে পিঁপড়াগুলো বাগান, অলি-গলি ও নির্জন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ত। দিন-রাত পরিশ্রম করে খাদ্য সংগ্রহ করত। সে খাদ্য গুদামজাত করে গুদাম কানায় কানায় পূর্ণ করত। শীতকালে তারা অবসর জীবনযাপন করত।
একদিন একটা ভীমরুল সেই বাড়ির দেয়ালে বসেছিল। সে দেখল একটা পিপড়া শুষ্ক একটি তুত ফলের দানা কামড়ে ধরে নিজের বাসার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তার শক্তি ছিল না বিধায় উল্টে পড়ে গেল। পুনরায় দানাটিকে ঠেলতে ঠেলতে দেয়ালে উঠতে যাচ্ছিল। যখনি অর্ধেক রাস্তায় পৌঁছাল তুতের দানাটি মুখ থেকে পড়ে গেল। এভাবে বেশ কয়েকবার দানাটি মাঝপথে এসে পিঁপড়ার মুখ থেকে পড়ে যায়। অবশেষে পিঁপড়া দানাটি উপরে তুলতে সক্ষম হ’ল। সেটাকে রেখে ক্লান্তির স্বরে বলল, আহ! হে আল্লাহ! ক্লান্ত হয়ে গেছি।
ভীমরুল পিঁপড়ার ধৈর্য ও মনোবল দেখে আশ্চর্য হ’ল। সে উড়ে এসে পিঁপড়ার পাশে বসে বলল, ক্লান্ত হয়ো না। তুমি হয়ত জানো আমি তোমার প্রতিবেশী। আমরা এই বাড়ির দেয়ালের ফাটলে বাসা বেঁধেছি।
পিঁপড়া বলল, ধন্যবাদ, আমি জানি। সবাই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত।
ভীমরুল বলল, হ্যাঁ, এটাই দুনিয়ার নিয়ম। কিন্তু তোমরা এটা কী কাজ কর?
পিঁপড়া বলল, কোন কাজ? আমরা কী করব? ভীমরুল বলল, তোমরা সারা বছর এখানে সেখানে দানা খুঁজে বেড়াও, সেটাকে বাসায় গুদামজাত কর, হাযার রকম কষ্ট কর। আমি আশ্চর্য হই যে, তোমাদের ছোট্ট পেট অথচ তোমরা কত খাদ্য লোভী।
পিঁপড়া বলল, তুমি কী বলতে চাচ্ছ আমি বুঝতে পারছি না। এই কাজ ছাড়া কি আমাদের অন্য কোন কাজ আছে? আমরা গ্রীষ্মকালে কাজ করি আর শীতকালে আরাম করি। নিজেদের প্রয়োজন মত খাবার খাই। কিন্তু তোমরা কী কর?
ভীমরুল বলল, আমরা কখনোই দানা সংগ্রহ করে গুদামজাত করার মত কষ্টকর কাজ করি না। আমরা গ্রীষ্ম মৌসুমে ভাল খাদ্য খাই। এত পরিমাণ খাই যে, শীতকাল পর্যন্ত পরিতৃপ্ত থাকি। এভাবে পুনরায় গ্রীষ্মকাল চলে আসে।
পিঁপড়া বলল, অনেক ভাল। তোমরা শক্তিশালী। আমরা এমনই। সবাইকে তো এক রকম হ’তে হবে এমনটা নয়। সবারই নিজস্ব অভিরুচি ও রীতি-নীতি রয়েছে। তোমরা পরিশ্রম না করে মানুষের খাদ্য খাও। মানুষও তোমাদের হাত থেকে রক্ষা পায় না। সবাই তোমাদেরকে খারাপ বলে। আমরা শস্যক্ষেতের দানা, পড়ে থাকা চিনি, পশু-পাখির রেখে যাওয়া শিকারের অংশ খেয়ে থাকি। মানুষের সাথে আমাদের কোনই সম্পর্ক নেই।
ভীমরুল বলল, তোমরা কারও ক্ষতি কর না এবং মানুষ তোমাদের প্রশংসা করে বলে আনন্দিত হও। কিন্তু তোমরা জীবনের কিছুই বুঝ না। কখনো কসাইয়ের দোকানের গোশত খাওনি, মাচায় ঝুলন্ত আঙ্গুরের স্বাদ গ্রহণ কর নি। একদিন তোমার জীবনকাল শেষ হবে, তুমি মারা যাবে। কিন্তু জীবনের কিছুই উপভোগ করতে পারবে না। আমরা মারা গেলে হেরে যাই না। আমরা দুনিয়ায় আরাম-আয়েশ করি। আবার কামড় দিয়ে দুশমনের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করি। আমাদের একদিনের আয়ুর মূল্য তোমাদের এক বছরের আয়ুর চেয়েও বেশী।
পিঁপড়া বলল, তোমরা কি দোকান থেকে গোশত কিনে খাও?
ভীমরুল বলল, বাহ! যদি এ বিষয়ে কিছু না জানো তবে আমার সাথে আজ আস, তাহ’লে দেখতে পাবে আমরা কী করি।
পিঁপড়া বলল, আমি তো তোমার মত উড়তে পারি না। যদি সত্যিই যেতে হয় তবে আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল।
দাম্ভিক ভীমরুল পিঁপড়াকে কামড় দিয়ে ধরে কসাইয়ের দোকানে নিয়ে গেল। অতঃপর দোকানে ঝুলানো ভেড়ার গোশতের উপর উড়ে এসে বসল। যখন কসাই দোকানে গোশত নিতে আসে তখন ভীমরুল ভয়ে উড়ে পালায়। কিন্তু কসাই ভীমরুলের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে যায়। সে গোশত কাটার ছুরি দিয়ে ভেড়ার গোশতে বসে থাকা ভীমরুলদের আঘাত করে। এতে কিছু গোশত ও ভীমরুলদের অর্ধেক মাটিতে পড়ে যায়। পড়ে থাকা ভীমরুলদের মধ্যে পিঁপড়ার প্রতিবেশী ভীমরুলটাও ছিল। ঐ সময় দূরে বসে থাকা পিঁপড়াটি আস্তে আস্তে সামনে আসে। তার বন্ধু ভীমরুলকে খুঁজে বের করে বলে, খুবই দুঃখিত, যেখানে সব সময় জীবনের ভয় থাকে সে জীবন আমরা পসন্দ করি না। কিন্তু ভীমরুল কোন উত্তর দিল না। কারণ সে ততক্ষণে মারা গিয়েছিল। পিঁপড়া ভীমরুলের পা ধরে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে আসে। অতঃপর সেই শুকনো তুতের দানার পাশে রেখে অন্য পিঁপড়াদের খরব দেয়। বলে, সবাই এদিকে আস, এই ভীমরুলের শরীর আলাদা কর। তার বিষ দূরে ফেলে দাও। গোশতটা গুদামে নিয়ে যাও। শীতকালে আমাদের কাজে আসবে।
শিক্ষা : অলসতা একটি মারাত্মক ব্যাধি। যা ইহকাল ও পরকালের সফলতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম কারণ। একজন কৃষক যদি ফসলের মৌসুমে অলসতা করে জমিতে শস্য বীজ রোপণ না করে, তাহ’লে ফসল কাটার সময় সে শুষ্ক মাঠ ছাড়া কিছুই পাবে না। এটাই চিরাচরিত নিয়ম। পরিশ্রম ছাড়া অলস-অকর্মণ্য কোন ব্যক্তি সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেছে এমন কোন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। সেকারণে এই গল্প আমাদেরকে সময়ের কাজ সময়ে করার প্রতি উৎসাহ দান করছে। যদি আমরা সময়ের কাজ সময়ে না করে নিজের অলস জীবন নিয়ে আত্মম্ভরিতা করি তাহ’লে আমাদের অবস্থা পরিশেষে ভীমরুলের মতই হবে।
[অনুবাদক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।]