কর্মী সম্মেলন ২০১৮
ড. নূরুল ইসলাম
মেডিটেশন, ধ্যান, যোগব্যায়াম, কোয়ান্টাম মেথড, মনের শক্তি, অন্তর্দৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে আধুনিক সমাজের বিশেষত শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে আত্মার প্রশান্তি খোঁজার নতুন ট্রাডিশন বেশ চালু হয়ে গেছে। ফেইসবুক, ইউটিউব খুললেই নানা জাত ও বর্ণের মোটিভেশনাল স্পিকার, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম তথাকথিত জ্ঞানতাপসদের ভীষণ বিজ্ঞজনোচিত বক্তব্য, মন্তব্য, কোটেশন, কবিতাংশ আমাদের আলোড়িত করে। একজন মানুষ মারা গেলে সুশীল শ্রেণী, এমনকি যারা নাস্তিক তারাও বলে ‘অমুকের আত্মা শান্তি পাক’ (RIP)। মুসলিম-অমুসলিম, আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলের জন্যই এই বাক্য বরাদ্দ। এই আত্মার শান্তি খুঁজে দেয়া এবং খুঁজে ফেরা মানুষগুলো প্রাচীনকালের মরমীবাদ, আধ্যাত্মিকতাবাদ, গুরুবাদ, ছূফীবাদের আধুনিকায়ন করে সর্বধর্ম সমন্বয়ী এক আপাত প্রলুব্ধকর ও দৃঢ় ভিত্তিও দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের কথা, চিন্তাধারা, কর্মসূচি, কর্মপদ্ধতি অনেক সময় মানুষকে সত্যিই মানসিক শান্তির যোগান দেয় এবং তাদের জীবনে উৎসাহ ও কর্মস্পৃহা ফিরিয়ে আনে। এজন্য ভারতের সদগুরু কিংবা বাংলাদেশের মহাজাতকদের রমরমা আধ্যাত্মিক বাণিজ্যের প্রসার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রিয় পাঠক! আসলে এই আত্মার শান্তি কী ধরণের বস্ত্ত? কেন আমরা এটা খুঁজি? মানুষ কি চাইলেই এসব গুরুদেব, অনুপ্রেরণাদায়ী বাকশিল্পীদের দেয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে আত্মার শান্তি নামক সোনার হরিণের খোঁজ পেতে পারে? মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য কি এই আত্মার শান্তি প্রযোজ্য? কিয়ামতের দিন ‘হে প্রশান্ত আত্মা!’ বলে আল্লাহ কাদের সম্বোধন করবেন? এসবের উত্তর আমাদের জানা প্রয়োজন।
মূলতঃ আত্মার প্রশান্তি আল্লাহর দেয়া এক মহা নে‘মত। মানুষ চেষ্টা করলে একসময় হয়ত তার দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার সবকিছুই পেতে পারে, কিন্তু আত্মার প্রশান্তি? সেটা কি চাইলেই পাওয়া সম্ভব? না, কখনই সম্ভব নয়, যদি না আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই নে‘মত আসে। আর সেই নে‘মত মহা অনুগ্রহশীল আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর বান্দাদের মধ্যে শর্তসাপেক্ষে ভাগ করে দেন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে। তবে চূড়ান্ত বিচারে প্রকৃত প্রশান্তি কেবল প্রকৃত মুমিন হৃদয়ের জন্যই প্রযোজ্য, যা কেবল দুনিয়াবী জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং চিরস্থায়ী পারলৌকিক জীবনও আলোকিত করে। পরকালে ‘হে প্রশান্ত আত্মা!’ সম্বোধন পাওয়ার যোগ্য কেবল তারাই। তবে অন্যদের পক্ষেও এই প্রশান্তির কিছু অংশ লাভ করা সম্ভব; কিন্তু তার সীমানা দুনিয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। পরলোকে তাদের জন্য কোন অংশ নেই। সুতরাং প্রকৃত ঈমানসমৃদ্ধ হৃদয় অর্জন করাই আত্মার চিরন্তন প্রশান্তি লাভের একমাত্র মাধ্যম। এটাই মৌলিক কথা। আর এই ঈমানসমৃদ্ধ হৃদয় অর্জন করা মোটেই সহজ কোন বিষয় নয়। বরং এর জন্য মৌলিক কিছু শর্ত পূরণ করা অপরিহার্য। যা নিম্নরূপ-
ক. আক্বীদা ও বিশ্বাসের শুদ্ধতা : একজন প্রকৃত ঈমানদারের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হ’ল, সে তাওহীদকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবন করে এবং তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিজের জীবনের প্রতিটি কর্ম ও চিন্তাধারাকে সাজিয়ে নেয়। সেখানে কোন কুফর, শিরক ও নিফাকের দুর্গন্ধ প্রবেশ করতে দেয় না। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত প্রতিটি তথ্য ও নির্দেশনার প্রতি সেভাবেই বিশ্বাস স্থাপন করে, যেভাবে আল্লাহ বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেছেন। কখনও নিজের বুঝ ও বিবেকের উপর যিদ, হঠকারিতা তাকে গ্রাস করতে পারে না। বরং আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণের প্রবৃত্তি তাকে বিনায়বনত রাখে। ছাহাবীদের অনুসৃত আদর্শ তাকে সত্যপথে দৃঢ়পদ সৈনিক বানায়। মানুষ যতই বিজ্ঞতা ও স্থিতধী প্রজ্ঞাই অর্জন করুক, মানবিক কর্মকান্ডে তাক লাগানো প্রশংসা কুড়াক না কেন, যদি সে সত্যাশ্রয়ী না হয়, মহান রবের দেখানো পথের অনুসারী না হয়, যদি সে তাওহীদবাদী মুসলিম না হয়, সে কখনই চূড়ান্ত বিচারে আত্মার প্রশান্তি পেতে পারে না।
কোন গুরুদেব তার ব্যক্তিগত আধ্যাত্মবোধ আর মরমী চেতনায় দুনিয়াবী জীবনের তুচ্ছতা, নিরেট বাস্তবতা অনুভব করে হয়ত কিছু মানসিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে বটে, কিন্তু কখনই চূড়ান্ত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। এ কেবল বরাদ্দ প্রকৃত ঈমানদার মুসলিমদের জন্যই। এজন্যই আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন। যাতে তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বেড়ে যায়। বস্ত্ততঃ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়’ (ফাৎহ ৪৮/৪)। ঈমানদার ব্যতীত এই প্রশান্তির স্বাদ কেউ কখনও খুঁজে পেতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে আর আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। মনে রেখ, আল্লাহর স্মরণেই কেবল হৃদয় প্রশান্ত হয়’ (রা’দ ১৩/১৮)। এমনকি যারা ঈমান আনার পর শিরক করে, তারাও কখনও এই প্রশান্তির পথ পাবে না। কেননা তারা মহান রবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পরও তাঁর প্রকৃত মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে (হজ্জ ৭৪; যুমার ৬৭)। সুতরাং কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রকৃত অর্থে আত্মার প্রশান্তি অর্জন কখনই সম্ভব নয়।
খ. ইবাদত ও মুআ‘মালাতের শুদ্ধতা : বিশ্বাসের শুদ্ধতার পরই আসে বিশ্বাস বাস্তবায়নের পন্থা শুদ্ধ হওয়া। রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পদ্ধতিতে ইবাদত এবং মু‘আমালাতের ক্ষেত্রে তাঁর কর্তৃক নির্ধারিত হালাল ও হারামের সীমারেখা মেনে চলার মাধ্যমেই সেই বিশ্বাস বাস্তবে পূর্ণতা পায়।
বিশ্বাসের এই পূর্ণতার পথই হ’ল আত্মার শান্তির পথ। যদি কেউ ছালাত, ছিয়াম তথা ইসলামের নির্ধারিত ইবাদত পদ্ধতি বাদ দিয়ে ধ্যান, যোগব্যায়াম, মনছবি ইত্যাদির মাধ্যমে মনের শান্তি পেতে চায়, তবে তা নিঃসন্দেহে অগ্রহণযোগ্য হবে। অন্যদিকে মুআ‘মালাতের ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও আনুগত্যের সাথে যাবতীয় হারাম ও অন্যায়কে পরিহার করা এবং সততা, সদাচরণ, ন্যায়, নিষ্ঠা, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, সম্মানবোধ, আমানতদারিতা প্রভৃতির মত সুদৃঢ় নৈতিক ঢাল অবলম্বন করার মাধ্যমেই সে প্রকৃত প্রশান্তি পেতে পারে। যদি কেউ কথায়, চিন্তায়, আচরণে অসৎ হয়; মুনাফিক, যালিম বা পাপাচারী হয়; তবে সে ঈমানী দুর্বলতার কারণে আত্মিক প্রশান্তি পায় না। আবার কেউ যদি ঈমানের শুদ্ধতা নিশ্চিত না করে সৎকর্ম করে, তবুও তা প্রকৃত শান্তির কারণ হয় না। কেননা সেই সৎকর্মের কোন মূল্য যে আল্লাহর কাছে নেই (ফুরকান ২৩; কাহাফ ১০৩)। সুতরাং ইবাদত ও মু‘আমালাতে শুদ্ধতা অর্জন তথা ‘মা আনা আলাইহে ও আছহাবীহী’ নীতি অবলম্বনে ধারাবাহিকভাবে ছিরাতুল মুস্তাকীমের পথে অটল থাকাই আত্মার শান্তি অর্জনের দ্বিতীয় পন্থা।
গ. পরিবেশের শুদ্ধতা : আত্মার প্রশান্তি ধরে রাখতে পরিবেশের গুরুত্বও কম নয়। সঠিক জ্ঞানার্জন ও সঠিক মানুষের সাহচর্যের মাধ্যমে নিজের পারিপার্শিক পরিবেশটাকে আদর্শরূপে গড়ে তোলা যরূরী। এজন্যই আদর্শ পরিবার ও আদর্শ সমাজ গঠনের গুরুত্ব এত বেশী। নিজেকে ফিৎনা-ফাসাদ ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার হাত থেকে বাঁচাতেই আদর্শ পরিবার ও সমাজ গড়ার সংগ্রামে আমাদের নিরত হ’তে হয়। এজন্যই আল্লাহ জ্ঞানার্জনের উপর এত বেশী গুরুত্বারোপ করেছেন। কেননা জ্ঞানই অজ্ঞতা ও ভ্রান্ত ধারণার হাত থেকে রক্ষা করে মানুষকে ফিৎনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি যোগায়। সঠিক পরিবেশের জন্য ইবরাহীম (আঃ) তাঁর সন্তান ইসমাঈল (আঃ)-কে কা‘বা গৃহের পার্শ্বে রেখে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদেরকে ফল-ফসলহীন উপত্যকায় তোমার পবিত্র গৃহের নিকট বসবাসের জন্য রেখে গেলাম। হে আমাদের প্রতিপালক তারা যেন ছালাত কায়েম করে’ (ইবরাহীম ৩৭)।
এমনকি ইসলামে এমন এলাকায় বসবাস করতে নিষেধ করা হয়েছে, যেখানে ঈমান ঠিক রাখা যায় না (আবুদাউদ হা/২৬৪৫)। একই কারণে মুসলমাদেরকে জামা‘আতবদ্ধ থাকতেও বলা হয়েছে। যেন শয়তানের প্ররোচনায় তারা পথভ্রষ্ট না হয়ে যায় এবং অন্তর যেন তাদেরকে প্রবৃত্তির পথে পরিচালিত না করে (তিরমিযী হা/২১৬৫; ইবনু মাজাহ হা/২৪৯৮)। আত্মিক প্রশান্তির জন্য জ্ঞানার্জন, সমাজ সংস্কার, জামা‘আতবদ্ধতা প্রভৃতি উপায়ে নিজের চিন্তাধারা ও পরিবেশকে নিরাপদ রাখা অতীব যরূরী।
সর্বোপরি, একজন প্রকৃত ঈমানদার তাঁর তাওহীদী দর্শনের বিশালতায় আত্মার প্রশান্তি খোঁজে। কোন অতীন্দ্রিয়বাদী ধ্যানধারণা, গুরুবাদী দর্শন, পীর-বুযুর্গের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, মোটিভেশনাল স্পিকারের অন্তরজুড়ানো বক্তব্য তার কাছে মুক্তির দিশারী নয়, যদি তা তাওহীদী দর্শনের বিপরীত হয়। অতএব তথাকথিত এসব ভ্রান্ত দর্শন ও চিন্তাধারার প্রতি আকর্ষিত হয়ে আমরা যেন আমাদের মহামূল্য ঈমান হারিয়ে না ফেলি এবং ঈমান আনার পর পুনরায় পথভ্রষ্ট না হয়ে যাই। আমরা যেন আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পথে চলতে পারি এবং এর মাঝেই আত্মার প্রকৃত প্রশান্তির অনুসন্ধান করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!