ফযীলতপূর্ণ আমলসমূহ (৪র্থ কিস্তি)
মুহাম্মাদ আবুল কালাম
২১. সালাম বিনিময় করা : সালাম মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাষণ। সালামের দ্বারা মানুষের মধ্যে ভালবাসা ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় ফলে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সালাম জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম। কেননা আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘হে মানবমন্ডলী! তোমরা সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য খাওয়াও। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর। রাতে ছালাত আদায় কর, মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তাহ’লে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[1] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَوَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى شَىْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلاَمَ بَيْنَكُمْ- ‘তোমরা ততক্ষণ জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না ঈমান আনবে। আর তোমরা ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের খবর দিব না, কোন বস্ত্ত তোমাদের মধ্যে ভালবাসাকে দৃঢ় করবে? তোমরা তোমাদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও’।[2] তবে সালাম প্রদানের উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি। কাউকে খুশি করা বা কারও কাছে কোন কিছু পাওয়ার জন্য নয়। পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড় সকলকে সালাম প্রদান করতে হবে। জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ইসলামে উত্তম কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘তোমরা অন্যকে খাওয়াবে এবং পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম প্রদান করবে’।[3]
২২. কুরআন হিফযকারী ও সংরক্ষণকারী : কুরআনের হাফেয ও যথাযথভাবে সংরক্ষণকারী জান্নাতে যাবে। যারা কুরআন পড়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদের জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ إِذَا دَخَلَ الْجَنَّةَ اقْرَأْ وَاصْعَدْ فَيَقْرَأُ وَيَصْعَدُ بِكُلِّ آيَةٍ دَرَجَةً حَتَّى يَقْرَأَ آخِرَ شَيْءٍ مَعَهُ- ‘কুরআন সংরক্ষণকারী যখন জান্নাতে যাবে তখন তাকে বলা হবে কুরআন পাঠ করতে থাক এবং এক এক স্তর করে আরোহণ করতে থাক। তখন সে প্রত্যেক আয়াত পাঠের মাধ্যমে একেক স্তর করে আরোহণ করবে। এমনকি তার সংরক্ষিত (মুখস্থকৃত) সর্বশেষ আয়াত পাঠ করে সে তার নির্দিষ্ট স্থানে আরোহণ করবে এবং সেটাই তার ঠিকানা হবে’।[4]
২৩. দ্বীনী ইলম শিক্ষাকারী : আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনের জ্ঞান অন্বেষণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত দান করবেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ- ‘যে ব্যক্তি দ্বীনী ইলম অর্জনের জন্য পথ চলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন’।[5] দ্বীনী জ্ঞান বিতরণকারী একজন সত্যিকারের আল্লাহভীরু আলেমের জন্য আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আসমান-যমীনের অধিবাসীরা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া এবং পানির মাছ পর্যন্ত দো‘আ করে।[6]
ইলমে দ্বীন অর্জন যদি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, তাহ’লে যেমন পরকালে মুক্তি রয়েছে তেমনি দুনিয়াতেও সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আবেদের উপর আলেমের মর্যাদা ঠিক তেমন, যেমন তোমাদের সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার মর্যাদা’।[7] তবে ইলম অর্জন যেন মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করা বা মূর্খদের সাথে বিতর্ক করার উদ্দেশ্যে না হয়। যদি এমনটি হয় তাহ’লে বিনিময়ে ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে। কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ الله النَّارَ- ‘যে ব্যক্তি আলেমদের সাথে তর্ক-বাহাছ করা অথবা মূর্খদের সাথে বাক-বিতন্ডা করার জন্য এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইলম অধ্যয়ন করেছে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।[8]
২৪. জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন ও আমীরের আনুগত্য : জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের বিনিময় জান্নাত লাভ করা যায়। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,عَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ وَإِيَّاكُمْ وَالْفُرْقَةَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ الْوَاحِدِ وَهُوَ مِنَ الِاثْنَيْنِ أَبْعَدُ، وَمَنْ أَرَادَ بُحْبُوْحَةَ الْجَنَّةِ فَعَلَيْهِ بِالْجَمَاعَةِ- ‘অবশ্যই তোমরা জামা‘আতবদ্ধ হয়ে বসবাস করবে এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে সতর্ক থাকবে। কারণ শয়তান একজনের সাথে থাকে এবং দু’জন থেকে সে অনেক দূরে থাকে। যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন অবশ্যই জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করে’।[9]
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করতে হ’লে অবশ্যই একজন আমীরের প্রয়োজন আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহভীরু ও ন্যায়পরায়ণ আমীরের আনুগত্য করবে তার বিনিময়েও জান্নাত রয়েছে। হযরত আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,اتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ وَصَلُّوا خَمْسَكُمْ وَصُومُوا شَهْرَكُمْ وَأَدُّوا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ وَأَطِيعُوا ذَا أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ- (১) তোমরা তোমাদের প্রভু আল্লাহকে ভয় কর (২) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর (৩) রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর (৪) তোমাদের সম্পদের যাকাত প্রদান কর এবং (৫) আমীরের আনুগত্য কর; তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ কর’।[10]
২৫. ন্যায়পরায়ণ বিচারক ও শাসক : ন্যায়পরায়ণ বিচারক ও শাসক জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘পৃথিবীতে তিন শ্রেণীর বিচারক রয়েছে। তন্মধ্যে এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতে যাবেন যে হক বুঝে ও তদনুযায়ী ফায়ছালা করে’।[11] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[12]
২৬. আল্লাহভীরু এবং চরিত্রবান : অধিক আল্লাহভীরু ও সৎচরিত্রবান ব্যক্তিরা জান্নাতে যাবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হ’ল কোন আমলের কারণে সর্বাধিক লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে? তিনি বললেন, تَقْوَى اللهُ وَحُسْنُ الْخُلُقِ ‘আল্লাহভীতি ও উত্তম চরিত্র’।[13] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চে একটি ঘর নিয়ে দেওয়ার জন্য যিম্মাদার হব, لِمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ যে তার চরিত্রকে সুন্দর করবে’।[14]
২৭. সত্যবাদিতা অবলম্বনকারী : সর্বদা সত্য কথা বলা এবং সত্য পথ অবলম্বন করা জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। আব্দুল্লাহ (রাঃ) নবী (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِى إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِى إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يَكُونَ صِدِّيقًا ‘সত্যবাদিতা ব্যক্তিকে নেকীর দিকে পরিচালিত করে আর নেকী তাকে জান্নাতের পথ দেখায়। আর মানুষ সত্য কথা বলতে বলতে অবশেষে সত্যবাদীর মর্যাদা লাভ করে’।[15] প্রত্যেক মুমিনের উচিত দুঃখে-সুখে সর্বদায় সত্যাব্রতী হওয়া। কখনো মজা করেও মিথ্যা বলা বা ছলনা করা থেকে বিরত থাকা। কেননা এরূপ আচরণ থেকে বিরত থাকার ফল জান্নাত। আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মাঝামাঝি একটি ঘর নিয়ে দেওয়ার জন্য যামিনদার, যে মিথ্যা পরিহার করে ঠাট্টা করে হ’লেও’।[16]
২৮. লজ্জাশীলতা অবলম্বনকারী : লজ্জা মানুষের অমূল্য ভূষণ। কোন মানুষ যদি লজ্জাশীল হয় তাহ’লে আল্লাহ তাকে তার বিনিময়ে জান্নাত দান করবেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,الْحَيَاءُ مِنَ الْإِيمَانِ وَالْإِيمَانُ فِي الْجَنَّةِ، وَالْبَذَاءُ مِنَ الْجَفَاءِ وَالْجَفَاءُ فِي النَّار ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের বিনিময় হ’ল জান্নাত। পক্ষান্তরে নির্লজ্জতা দুশ্চরিত্রের অঙ্গ। আর দুশ্চরিত্রতার স্থান জাহান্নাম’।[17]
২৯. জিহবা ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করা : জিহবা ও লজ্জাস্থান মানুষের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এ দু’টি অঙ্গের মাধ্যমে মানুষ বিপথগামী হয়। তাই যে ব্যক্তি এ দু’টিকে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করবে তার জন্য জান্নাত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি আমার কাছে তার দুই চোয়ালের মধ্যস্থিত বস্ত্ত (জিহবা) ও তার দু’পায়ের মধ্যস্থিত বস্ত্তর (লজ্জাস্থানের) যিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যিম্মাদার হব’।[18] অন্যত্র তিনি বলেন,اِضْمَنُوْا لِيْ سِتًّا مِنْ أَنْفُسِكُمْ، أَضْمَنْ لَكُمُ الْجَنَّةَ، اُصْدُقُوْا إِذَا حَدَّثْتُمْ، وَأَوْفُوْا إِذَا وَعَدْتُمْ، وَأَدُّوْا إِذَا ائْتُمِنْتُمْ، وَاحْفَظُوْا فُرُوْجَكُمْ، وَغُضُّوْا أَبْصَارَكُمْ، وَكُفُّوْا أَيْدِيَكُمْ- ‘তোমরা নিজেদের পক্ষ হ’তে আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের যামিন হও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের যামিন হব। (১) যখন তোমরা কথা বলবে, তখন সত্য বলবে। (২) যখন ওয়াদা করবে, তা পূর্ণ করবে। (৩) তোমাদের কাছে আমানত রাখলে, তা আদায় করবে। (৪) নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাযত করবে। (৫) স্বীয় দৃষ্টিকে অবনমিত রাখবে এবং (৬) স্বীয় হস্তকে (অন্যায় কাজ হ’তে) বিরত রাখবে’।[19]
জিহবা মানব দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ জিহবার অনুগামী হয়। প্রতিদিন সকালে মানব দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহবাকে সোজা পথে দৃঢ় থাকার ব্যাপারে অনুরোধ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষ সকালে ঘুম হ’তে উঠার সময় তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনীতভাবে জিহবাকে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর। আমরা তো তোমার সাথে সম্পৃক্ত। তুমি যদি সোজা পথে দৃঢ় থাক তাহ’লে আমরাও দৃঢ় থাকতে পারি। আর তুমি যদি বাঁকা পথে যাও তাহ’লে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য’।[20]
৩০. রোগাক্রান্তকে দেখতে যাওয়া : একজন মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের হক্ব বা কর্তব্য হ’ল সে অসুস্থ হ’লে শারীরিক পরিচর্যা করা। কেননা ক্বিয়ামতের ময়দানে রুগ্ন ব্যক্তির পক্ষে মহান আল্লাহ নিজেই ফরিয়াদী হয়ে আদম সন্তানকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি রুগ্ন ছিলাম তুমি পরিচর্যা করনি’।[21] রুগ্ন ব্যক্তির সেবার মাধ্যমেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
রোগীর পরিচর্যা করা এবং খোঁজ-খবর নেওয়া ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একজন ব্যক্তি যখন অসুস্থ হয় তখন সে কয়েকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১. সে শরীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২. আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৩. সে যদি উপার্জনক্ষম একা হয় তাহ’লে পরিবার নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রোগীর পরিচর্যা ও খোঁজ-খবর নেওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন এবং রোগীর পরিচর্যকারীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَعُودُ مُسْلِمًا غُدْوَةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُمْسِىَ وَإِنْ عَادَهُ عَشِيَّةً إِلاَّ صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُصْبِحَ وَكَانَ لَهُ خَرِيفٌ فِى الْجَنَّةِ- ‘যখন কোন মুসলমান সকাল বেলায় কোন মুসলমান রোগীকে দেখতে যায়, তখন তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাযার ফেরেশতা দো‘আ করে। আর সন্ধ্যা বেলায় কোন রোগী দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত তার জন্য সত্তর হাযার ফেরেশতা দো‘আ করে। আর তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান নির্ধারিত হয়ে যায়’।[22] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন রোগীর পরিচর্যা করে, সে রহমতের মধ্যে ডুব দেয়, এমনকি সে যখন সেখানে বসে পড়ে, তখন তো রীতিমত রহমতের মধ্যেই অবস্থান করে’।[23] আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِى اللَّهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الْجَنَّةِ مَنْزِلاً- ‘কোন ব্যক্তি কোন রুগ্ন ব্যক্তির পরিচর্যা করলে অথবা আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করলে, একজন আহবানকারী তাকে ডেকে বলে, তুমি উত্তম কাজ করেছ, তোমার পদচারণা উত্তম হয়েছে এবং জান্নাতে তুমি একটি ঘর তৈরি করে নিয়েছ’।[24]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন, ‘মুসলমান যখন তার অসুস্থ মুসলমান ভাইকে দেখতে যায়, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের ‘খুরফার’ মধ্যে অবস্থান করতে থাকে। জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! জান্নাতের খুরফা কী? উত্তর দিলেন, তাঁর ফলমূল’।[25]
৩১. রোগের উপর ধৈর্যধারণ করা : আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দার ঈমান পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি দিয়ে থাকেন। রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন রোগের উপর ধৈর্যধারণ করে, বিনিময়ে আল্লাহ তাকে জান্নাত উপহার দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অধৈর্য হয়, সে এমন ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়। আত্বা ইবনু আবু রাবাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনু আববাস (রাঃ) আমাকে বললেন, ‘আমি কি তোমাকে একজন জান্নাতী মহিলা দেখাব না? আমি বললাম, অবশ্যই। তখন তিনি বললেন, এই কালো রঙের মহিলাটি, সে নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসেছিল। তারপর সে বলল, আমি মৃগী রোগে আক্রান্ত হই এবং এ অবস্থায় আমার লজ্জাস্থান প্রকাশ হয়ে যায়। সুতরাং আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন। নবী (ছাঃ) বললেন, তুমি যদি চাও ধৈর্যধারণ করতে পার। তোমার জন্য জান্নাত আছে। আর তুমি যদি চাও, তাহ’লে আমি আল্লাহর কাছে দো‘আ করি, যেন তোমাকে আরোগ্য করেন। স্ত্রীলোকটি বলল, আমি ধৈর্যধারণ করব। কিন্তু সাথে এ আবেদনও করছি যে, এ রোগে আক্রান্ত হ’লে আমার সতর খুলে যায়। আপনি আমার জন্য দো‘আ করুন যাতে আর সতর না খুলে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য এ দো‘আ করলেন’।[26]
৩২. অন্ধত্বের উপর ধৈর্যধারণ করা : অন্ধত্ব আল্লাহর এক কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করবে আল্লাহ তাকে তার অন্ধত্বের বিনিময়ে জান্নাত দান করবেন। আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ বলেন,إِذَا ابْتَلَيْتُ عَبْدِي بِحَبِيبَتَيْهِ فَصَبَرَعَوَّضْتُهُ مِنْهُمَا الْجَنَّةَ আমি যখন আমার কোন প্রিয় বান্দাকে তার দু’টি প্রিয় অঙ্গ (চোখ দ্বারা) পরীক্ষা করি, আর সে তাতে ধৈর্যধারণ করে তখন এর বিনিময়ে আমি তাকে জান্নাত দান করি’।[27]
৩৩. কষ্টদায়ক বস্তু রাস্তা থেকে দূর করা : একজন মুমিনের উচিত অন্য ভাইয়ের কষ্টকে দূর করে দেওয়া। বিপদে-আপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللّٰهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ- ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দুনিয়াতে কোন কষ্টকে দূর করে দিবে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কষ্টমূহের কোন একটি কষ্টকে দূর করে দিবেন’।[28]
একজন প্রকৃত মুসলিম কাউকে কষ্ট দিবে না এটা তার ঈমানী দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম হ’ল তাওহীদের ঘোষণা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং সর্বনিমণ হ’ল রাস্তা হ’তে কষ্টদায়ক বস্ত্ত দূর করা’।[29]
এই ঈমানী দায়িত্ব নিয়ে কোন মুমিন যদি মানুষের কষ্টকর চলার পথকে সহজ করে দেয় তাহ’লে যে জান্নাত লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الشَّجَرَةَ كَانَتْ تُؤْذِي الْمُسْلِمِينَ فَجَاءَ رَجُلٌ فَقَطَعَهَا فَدَخَلَ الْجَنَّةَ- ‘একটি গাছ মুসলমানদেরকে কষ্ট দিচ্ছিল। তখন এক ব্যক্তি এসে তা কেটে দিল। এর বিনিময়ে সে জান্নাত লাভ করল’।[30]
৩৪. সৎকর্মে অবিচল ব্যক্তি : জান্নাতী ব্যক্তিদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল তারা সর্বদা সৎকর্মের উপর দৃঢ় থাকবে। কখনো সৎআমলের সাথে শিরক ও বিদ‘আত মিশ্রিত করবে না। প্রকাশ্য ও গোপন শিরক হ’তে মুক্ত থেকে নির্ভেজাল তাওহীদে বিশ্বাস এবং শরী‘আত অনুমোদিত নেক আমল করবে। আল্লাহ বলেন,فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا- ‘অতএব যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাৎ কামনা করে। সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)।
৩৫. প্রার্থনায় ধৈর্যধারণকারী : যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। সেই সাথে চাওয়া বিষয় পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না; বরং ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা এই বলে প্রার্থনা করে যে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের স্ত্রীদের ও সন্তানদের মাধ্যমে চক্ষুশীতলকারী বংশধারা দান কর এবং আমাদেরকে আল্লাহভীরুদের জন্য আদর্শ বানাও। তাদেরকে তাদের ধৈর্যের প্রতিদানস্বরূপ জান্নাতের কক্ষ দেওয়া হবে এবং তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা দেওয়া হবে অভিবাদন ও সালাম সহকারে’ (ফুরক্বান ২৫/৭৫-৭৬)।
৩৬. নবী, শহীদ, ছিদ্দীক (সত্যবাদী) ও নবজাত শিশু : নবী, শহীদ, ছিদ্দীক, মৃত্যুবরণকারী নবজাতক শিশু ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতকারী জান্নাতী হবে। কা‘ব বিন উজরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি কি জান্নাতী পুরুষদের কথা তোমাদেরকে বলব না? নবী, শহীদ, ছিদ্দীক, মৃত্যুবরণকারী নবজাতক শিশু, দূর থেকে স্বীয় মুসলিম ভাইকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দেখতে আসে এমন ব্যক্তি জান্নাতী’।[31]
৩৭. ৪টি গুণ বিশিষ্ট নারী : ৪টি গুণ বিশিষ্ট নারী জান্নাতে প্রবেশ করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا صلَّتِ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا وَصَامَتْ شَهْرَهَا وَحَصَّنَتْ فَرْجَهَا وَأَطَاعَتْ بَعْلَهَا دَخَلَتْ مِنْ أَيِّ أَبْوابِ الجَنَّةِ شَاءَتْ ‘যে মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে, রামাযান মাসে ছিয়াম পালন করে, স্বীয় লজ্জাস্থানের হেফাযত করে, স্বামীর আনুগত্য করে সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে খুশী প্রবেশ করবে’।[32]
৩৮. স্বামী ভক্ত ও অধিক সন্তান জন্মদানে কষ্ট সহ্যকারী নারী : কা‘ব বিন উজরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِنِسِائِكُمْ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ؟ اَلْوَلُوْدُ الْوَدُوْدُ الَّتِيْ إِذَا ظَلَمَتْ هِيْ أَوْ ظُلِمَتْ قَالَتْ : هَذِهِ يَدِيْ فِيْ يَدِكَ، لَا أَذُوْقُ غَمَضًا حَتَّى تَرْضى ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী মহিলাদের ব্যাপারে অবগত করব না? স্বীয় স্বামী ভক্ত, অধিক সন্তান প্রসবে ধৈর্যধারণকারিণী, ঐ পবিত্রা নারী যে তার স্বামীর অত্যাচারে ধৈর্যধারণ করে বলে যে, আমার হাত তোমার হাতে; আমি ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষান্ত হব না, যতক্ষণ না তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হও’।[33]
৩৯. অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাত হওয়াতে ধৈর্যধারণকারিণী মহিলা : যে নারী অনিচ্ছাকৃত ও অকালে গর্ভপাত হওয়াতে ধৈর্যধারণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ক্বিয়ামতের দিন বাচ্চাটি তার মাকে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবে। মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ! إِنَّ السِّقْطَ لَيَجُرُّ أُمَّهُ بِسَرَرِهِ إِلَى الْجَنَّةِ إِذَا احْتَسَبَتْهُ ‘ঐ সত্ত্বার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ। অনিচছাকৃত গর্ভপাতের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ বাচ্চা, তার মায়ের নাভিরজ্জু ধরে টেনে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তবে এ শর্তে যে, ঐ মহিলা ছওয়াবের আশায় তাতে ধৈর্যধারণ করেছিল’।[34]
৪০. শিশু সন্তানের মৃত্যুতে ধৈর্যধারণকারিণী : বিপদে ধৈর্যধারণ করার কোন বিকল্প নাই। তবে কিছু কিছু বিপদ এমন আছে, যেগুলোর উপর ধৈর্যধারণ করা খুবই কষ্টকর ও কঠিন। যেমন সন্তানের মৃত্যুবরণ। তারপরও যে ব্যক্তি অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাচ্চার মৃত্যুতে ধৈর্যধারণ করবে, তার জন্য জান্নাত রয়েছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদল আনছারী মহিলাকে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,لَا يَمُوتُ لِإِحْدَاكُنَّ ثَلَاثَةٌ مِنْ الْوَلَدِ فَتَحْتَسِبَهُ إِلَّا دَخَلَتْ الْجَنَّةَ فَقَالَتْ امْرَأَةٌ مِنْهُنَّ أَوْ اثْنَيْنِ يَا رَسُولَ اللهُ قَالَ أَوْ اثْنَيْنِ- ‘তোমাদের মধ্যে যার তিনটি সন্তান মৃত্যুবরণ করে, আর সে তাতে ছওয়াবের আশা নিয়ে ধৈর্যধারণ করে সে জান্নাতী হবে। তাদের মধ্যে এক মহিলা জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি দু’জন মৃত্যুবরণ করে? তিনি বললেন, দু’জন মৃত্যুবরণ করলেও’।[35]
৪১. কন্যা সন্তান লালন-পালনকারী : দুই বা দুইয়ের অধিক কন্যাকে লালন-পালন করে সুশিক্ষা দানকারী এবং বালেগা হওয়ার পর তাদেরকে সু-পাত্রে পাত্রস্থকারী ব্যক্তি জান্নাতী হবে। আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ وَضَمَّ أَصَابِعَهُ ‘যে ব্যক্তি দুইজন কন্যাকে তাদের প্রাপ্তবয়স্কা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করল, ক্বিয়ামতের দিন আমি ও ঐ ব্যক্তি এভাবে একত্রে উপস্থিত হব। একথা বলে তিনি তাঁর দুই আঙ্গুলকে একত্রিত করে দেখালেন’।[36]
৪২. ইয়াতীম লালন-পালনকারী : ইয়াতীমের লালন-পালনকারী জান্নাতে যাবে। শুধু তাই না ইয়াতীমের লালন-পালনকারী জান্নাতে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে থাকবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ইয়াতীমের লালন-পালনকারী তার আত্মীয় হোক আর অনাত্মীয় হোক আমি জান্নাতে এ দুই আঙ্গুলের ন্যায় এ বলে তিনি তাঁর দুই আঙ্গুলকে একত্রিত করে দেখালেন যে এভাবে এক সাথে থাকব’।[37] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِى الْجَنَّةِ هَكَذَا وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى، وَفَرَّجَ بَيْنَهُمَا شَيْئًا ‘আমি এবং ইয়াতীমকে লালন-পালনকারী ব্যক্তি জান্নাতে কাছাকাছি থাকব এবং তার শাহাদাত অঙ্গুল এবং মধ্যমা আঙ্গুলদ্বয় একত্রিত করে ইঙ্গিত করলেন এবং দুইয়ের মাঝে একটু ফাঁক করলেন’।[38]
৪৩. অন্যায়ভাবে নিহত ব্যক্তি : অন্যায়ভাবে বা নির্যাতিত হয়ে যদি কোন ব্যক্তি নিহত হয়, তাকে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত দান করবেন। যেমন- কোন ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে অন্যায়ভাবে নিহত হ’ল, তাকেও জান্নাত দান করা হবে। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قُتِلَ دُونَ مَالِهِ مَظْلُومًا فَلَهُ الْجَنَّةُ ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে অন্যায়ভাবে নিহত হ’ল সে জান্নাতী’।[39]
৪৪. কর্য প্রদানকারী : কর্য বা ঋণ প্রদানের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। এজন্য সম্পদশালী ব্যক্তিদের উচিত বেশী বেশী ঋণ প্রদান করা। অসহায় মানুষের পাশে থেকে দয়ার হাতকে বাড়িয়ে দেয়া। যাতে করে গরীব মানুষেরা সূদমুক্ত জীবন যাপন করতে পারে।
ঋণ প্রদানকারীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করে দেখল জান্নাতের দরজায় লেখা আছে দানের নেকী দশ গুণ, আর কর্য প্রদানের নেকী আঠারো গুণ’।[40] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তিকে অবকাশ দিবে অথবা ঋণ ক্ষমা করে দিবে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন দুঃখ-কষ্ট হ’তে মুক্তি দিবেন।[41] আবু ইয়াসার (রাঃ) বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا أَوْ وَضَعَ عَنْهُ أَظَلَّهُ الله فِى ظِلِّهِ ‘যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তিকে অবকাশ দিবে অথবা ঋণ মাফ করে দিবে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন রহমতের এক বিশেষ ছায়া দান করবেন’।[42] তবে ঋণ গ্রহীতার উচিত, ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হ’লেই তা পরিশোধ করা। কোন ভাবে ঋণ পরিশোধে বাহানা করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَطْلُ الْغَنِىِّ ظُلْمٌ ‘ঋণ পরিশোধে বাহানাকারী যালেমের অন্তর্ভুক্ত’।[43]
৪৫. মসজিদ নির্মাণ করা : পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান হ’ল মসজিদ। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘর মসজিদ নির্মাণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلَّهِ بَنَى اللهُ لَهُ فِي الْجَنَّةِ مِثْلَهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ বানাবে আল্লাহ তার জন্য অনুরূপ একটি ঘর জান্নাতে নির্মাণ করবেন’।[44]
৪৬. আযানের উত্তর প্রদানকারী : মুওয়ায্যিন যখন আযান দেন তখন তার উত্তর প্রদান করা অত্যন্ত নেকীর কাজ। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাভীতির সাথে আযানের উত্তর দেয় তাহ’লে আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন। ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন মুওয়ায্যিন বলে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ যদি তোমাদের কেউ বলে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ অতঃপর যখন মুওয়ায্যিন বলে, ‘আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সেও বলে, ‘আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, মুওয়ায্যিন বলে, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ সেও বলে, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’, এরপর মুওয়ায্যিন বলে, ‘হাইয়া আলাছ ছালাহ’ সেও বলে, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’, পুনরায় যখন মুওয়ায্যিন বলে, ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ সে বলে, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’, পরে যখন মুওয়ায্যিন বলে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ সেও বলে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’। অতঃপর যখন মুওয়ায্যিন বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, সেও বলে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আর এই বাক্যগুলো মনে প্রাণে ভয়-ভীতি নিয়ে বলে, তাহ’লে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[45]
৪৭. সকাল-সন্ধ্যায় সাইয়িদুল ইস্তেগফার পাঠ করা : যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় সাইয়িদুল ইস্তেগফার পাঠ করবে এবং সেদিন বা রাতে মৃত্যুবরণ করবে আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন। সাদ্দাদ ইবনু আওস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে এই দো‘আ পাঠ করবে,اللهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার পালনকর্তা। তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমার দাস। আমি আমার সাধ্যমত তোমার নিকটে দেওয়া অঙ্গীকারে ও প্রতিশ্রুতিতে দৃঢ় আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট হ’তে তোমার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আমার উপরে তোমার দেওয়া অনুগ্রহকে স্বীকার করছি এবং আমি আমার গোনাহের স্বীকৃতি দিচ্ছি। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর। কেননা তুমি ব্যতীত পাপসমূহ ক্ষমা করার কেউ নেই’। সে যদি দিনে পাঠ করে রাতে মারা যায় কিংবা রাতে পাঠ করে দিনে মারা যায়, তাহ’লে সে জান্নাতী হবে’।[46]
৪৮. সূরা ইখলাছের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনকারী : সূরা ইখলাছের মাঝে তাওহীদের মর্মবাণী লুকিয়ে আছে। এজন্য সূরা ইখলাছের প্রতি ভালবাসার গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আনাস (রাঃ) বলেন, একদা এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এই সূরা ‘কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ভালবাসি। রাসূলুল্লাহ বললেন, إِنَّ حُبَّكَ إِيَّاهَا يُدْخِلُكَ الْجَنَّةَ ‘উহার প্রতি তোমার ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে’।[47]
৪৯. সূরা মুলক পাঠ করা : সূরা মুলক তেলাওয়াতকারী কবরের আযাব থেকে মুক্তি লাভ করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতি রাতে তাবারাকাল্লাযী অর্থাৎ সূরা মুলক পড়বে, এর জন্য আল্লাহ তাকে কবরের আযাব থেকে মুক্ত রাখবেন।[48]
৫০. তাসবীহ পাঠ করা : তাসবীহ মুমিনের হৃদয় জগৎকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে। তাসবীহ পাঠের মাধ্যমে একজন মুমিন গুনাহ মুক্ত হয়ে যায়। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি দৈনিক একশত বার বলবে, سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ সুবহা-নাল্লা-হি ওয়াবিহামদিহী (অর্থাৎ আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করি তাঁর প্রশংসার সাথে) তার গুনাহসমূহ মাফ করা হবে, যদিও তা সমুদ্র ফেনার ন্যায় অধিক হয়।[49] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমার নিকট সমস্ত পৃথিবী অপেক্ষাও প্রিয়তর হচ্ছে, سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ ‘সুবহানাল্লাহ, আলহাম দু লিল্লা-হ, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ও আল্লাহু আকবার’ বলা।[50] উপর্যুক্ত তাসবীহগুলো ছাড়াও আরও অনেক তাসবীহ রয়েছে যা নিয়মিত আমল করলে গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়া যায়। যা জান্নাতের পথকে সুগম করে।
উপসংহার : একজন মানুষের জীবন তখনই স্বার্থক হবে যখন সে জান্নাতুল ফেরদাঊস লাভে ধন্য হবে। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো যথাযথ পালনের মাধ্যমে জান্নাতের উচ্চ মাকাম লাভের তাওফীক দান করুন।- আমীন!
[লেখক : কেন্দ্রীয় সহ-পরিচালক, সোনামণি]
[1]. তিরমিযী হা/২৪৮৫; ইবনু মাজাহ হা/১৩৩৪।
[2]. মুসলিম হা/৫৪; মিশকাত হা/৪৬৩১।
[3]. বুখারী হা/২৮; মুসলিম হা/৩৯; মিশকাত হা/৪৬২৯।
[4]. ইবনু মাজাহ হা/৩৭৮০।
[5]. মুসলিম হা/২৬৯৯; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; মিশকাত হা/২০৪।
[6]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩।
[7]. দারেমী হা/২৮৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/৮১।
[8]. তিরমিযী হা/২৬৫৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/১০৬।
[9]. তিরমিযী হা/২১৬৫; আহমাদ হা/২৩১৯৪।
[10]. তিরমিযী হা/৬১৬; মিশকাত হা/৫৭১।
[11]. আবুদাঊদ হা/৩৫৭৩; তিরমিযী হা/১৩২২; মিশকাত হা/৩৭৩৫।
[12]. মুসলিম হা/২৮৬৫; মিশকাত হা/৪৯৬০।
[13]. তিরমিযী হা/২০০৪; মিশকাত হা/৪৮৩২।
[14]. আবুদাঊদ হা/৪৮০০; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৩।
[15]. বুখারী হা/৬০৯৪; মুসলিম হা/২৬০৭।
[16]. আবুদাঊদ হা/৪৮০০; আত-তারগীব হা/৪১৭৯।
[17]. তিরমিযী হা/২০০৯; ইবনু মাজাহ হা/৪১৮৪; মিশকাত হা/৫০৭৭।
[18]. বুখারী হা/৬৪৭৪; মিশকাত হা/৪৮১২।
[19]. আহমাদ হা/২২৮০৯; মিশকাত হা/৪৮৭০।
[20]. তিরমিযী হা/২৪০৭; মিশকাত হা/৪৮৩৮।
[21]. মুসলিম হা/২৫৬৯; মিশকাত হা/১৫২৮।
[22]. তিরমিযী হা/৯৬৯; আবুদাঊদ হা/৩০৯৮; মিশকাত হা/১৫৫০।
[23]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫২২।
[24]. তিরমিযী হা/২০০৮; ছহীহুত তারগীব হা/২৫৭৮।
[25]. মুসলিম হা/২৫৬৮; ইবনু হিববান হা/২৯৫৭; আহমাদ হা/২২৪৯৮।
[26]. বুখারী হা/৫৬৫২; মুসলিম হা/২৫৭৬।
[27]. বুখারী হা/৫৬৫৩; মিশকাত হা/১৫৪৯।
[28]. আবুদাঊদ হা/৪৯৪৬; তিরমিযী হা/১৯৩০; ইবনু মাজাহ হা/২২৫।
[29]. বুখারী হা/৯; মুসলিম হা/৩৫; মিশকাত হা/৫।
[30]. বুখারী হা/৬৫২; মুসলিম হা/১৯১৪।
[31]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮৭।
[32]. ইবনু হিববান হা/৪১৬৩।
[33]. ছহীহুল জামে‘ হা/২৬০৪; সিলসিলা ছহীহহা হা/৩৩৮০।
[34]. ইবনু মাজাহ হা/১৬০৯; ছহীহুত তারগীব হা/২০০৮।
[35]. মুসলিম হা/২৬৩২; মিশকাত হা/১৭৩০।
[36]. মুসলিম হা/২৬৩১; মিশকাত হা/৪৯৫০।
[37]. মুসলিম হা/২৯৮৩।
[38]. বুখারী হা/৫৩০৪; ছহীহুত তারগীব হা/২৫৪১।
[39]. নাসাঈ হা/৪০৮৬; আহমাদ হা/৭০৮৪।
[40]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৮১।
[41]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৯০৩।
[42]. মুসলিম হা/৩০০৬; মিশকাত হা/২৯০৪।
[43]. বুখারী হা/২৪০০; মুসলিম হা/৫১৬৪।
[44]. বুখারী হা/৪৫০; মুসলিম হা/৫৩৩।
[45]. মুসলিম হা/৩৮৫; মিশকাত/৬৫৮।
[46]. বুখারী হা/৬৩০৬; আবুদাঊদ হা/৫০৭০; মিশকাত হা/২৩৩৫।
[47]. তিরমিযী হা/২৯০১; মিশকাত হা/২১৩০।
[48]. হাকেম, ছহীহুত তারগীব হা/১৫৮৯, সনদ হাসান।
[49]. বুখারী হা/৬৪০৫; মুসলিম হা/২৬৯১; মিশকাত হা/২২৯৬।
[50]. মুসলিম ২৬৯৫; তিরমিযী ৩৫৯৭; মিশকাত হা/২২৯৫।