মূল্যহীন দুনিয়ার প্রতি অনর্থক ভালোবাসা (২য় কিস্তি)
আব্দুর রহীম
উপস্থাপনা : মহান আল্লাহ মানবজাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন (যারিয়াত-৫৬)। আর ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাতে যাওয়ার চেষ্টা করাই প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। তথাপি এমন কিছু পাপ কর্ম রয়েছে যা একজন ব্যক্তির সৎআমলগুলোকে বিনষ্ট করে দেয়। সুতরাং প্রত্যেকেরই আমল বিনষ্টকারী পাপসমূহ জানা ও সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা অত্যাবশ্যক। আলোচ্য প্রবন্ধে সে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হ’ল।
১. কুফরী : ‘কুফর’ অর্থ ঢেকে দেওয়া। পারিভাষিক অর্থ- আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত ইসলামী শরী‘আতকে অস্বীকার করা। যার বিপরীত হ’ল ঈমান। সুতরাং কুফরী একটি মারাত্মক পাপ। আর সেটা হ’তে পারে ব্যক্তির কথা বা আমলের মাধ্যমে। জেনে রাখা আবশ্যক যে, কুফরী দুই প্রকার।
ক. কুফরে আকবার : যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘কুফরে আকবার হ’ল আল্লাহ ও রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন না করা অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করা বা সংশয় রাখা অথবা আল্লাহ কিংবা রাসূল (ছাঃ)-কে অস্বীকার করা’।[1]
খ. কুফরে আছগার : যা দ্বীন ইসলাম থেকে বের করে দেয় না। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ- ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী ও পরস্পরে যুদ্ধ করা কুফরী’।[2] এই কুফরী অর্থ মহাপাপ। যা তওবা ব্যতীত মাফ হয় না।
কুফরীকর্ম মরীচিকা তুল্য : আল্লাহ সুবাহানাহু তা‘আলা কুফরী কর্মকে মরীচিকার সাথে তুলনা করে বলেন,وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍ بِقِيعَةٍ يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً حَتَّى إِذَا جَاءَهُ لَمْ يَجِدْهُ شَيْئًا وَوَجَدَ اللهَ عِنْدَهُ فَوَفَّاهُ حِسَابَهُ وَاللهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ- ‘পক্ষান্তরে যারা অবিশ্বাসী, তাদের কর্মসমূহ মরুভূমির বুকে মরীচিকা সদৃশ। তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি যাকে পানি মনে করে। অবশেষে যখন সে তার নিকটে আসে, তখন সেখানে কিছুই পায় না। কিন্তু আল্লাহকে পায়। অতঃপর আল্লাহ তার পূর্ণ কর্মফল দিয়ে দেন। অর্থাৎ জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী’ (নূর ২৪/৩৯)।
কুফরীকর্ম ছাই তুল্য : আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা কাফেরদের কর্ম ছাইয়ের সাথে তুলনা করেছেন। প্রচন্ড বাতাস হ’লে ছাইয়ের অস্তিত্ব যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। তদ্রুপ কুফরী করলে সৎআমল খুঁজে পাওয়া যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,مَثَلُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ أَعْمَالُهُمْ كَرَمَادٍ اشْتَدَّتْ بِهِ الرِّيحُ فِي يَوْمٍ عَاصِفٍ لَا يَقْدِرُونَ مِمَّا كَسَبُوا عَلَى شَيْءٍ ذَلِكَ هُوَ الضَّلَالُ الْبَعِيدُ- ‘যারা তাদের পালনকর্তাকে অস্বীকার করে, তাদের সৎকর্ম সমূহ হ’ল ছাইয়ের মত, ঝড়ের দিনের প্রচন্ড বায়ু যাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তারা যা উপার্জন করে তার কিছু্ই তাদের কাজে লাগাতে পারে না। আর এটাই হ’ল তাদের সুদূর ভ্রষ্টতা’ (ইব্রাহীম ১৪/১৮)।
কুফরী আমল বিনষ্ট করে : ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘কুফরী ছাড়া আমল বিনষ্ট হয় না। যে ব্যক্তি ঈমান নিয়ে মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যদিও সে নেকীর অধিক পাপ হওয়ার কারণে জাহান্নামে যায়। আর যদি তার সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। তাহ’লে সে কখনই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না’।[3] নিম্নে কয়েকটি কুফরী তুলে ধরা হ’ল যা পূর্ববর্তী আমলকে বিনষ্ট করে দেয়।
(ক) ঈমানকে অস্বীকার করা : ঈমানকে অস্বীকার করা ‘কুফর আকবার’ যার মাধ্যমে আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘আর যে ব্যক্তি ঈমানকে অস্বীকার করে, তার আমল নিষ্ফল হবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (মায়েদাহ ৫/৫)।
(খ) আল্লাহর আয়াত সমূহ ও তাঁর সাক্ষাৎকে অস্বীকার করা :
যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে, তাঁর প্রেরিত রাসূল ও তাঁদের উপর আনীত কিতাবকে অস্বীকার করে এবং পরকালীন জীবনে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করে তারা কুফরী করে। তাদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا- ‘ওরা হ’ল তারাই, যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করে। ফলে তাদের সকল কর্ম নিস্ফল হয়ে যায়। ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাদের জন্য দাঁড়িপাল্লা খাঁড়া করব না’ (কাহাফ ১৮/১০৫)।
অন্যত্র তিনি বলেন,إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَشَاقُّوا الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى لَنْ يَضُرُّوا اللهَ شَيْئًا وَسَيُحْبِطُ أَعْمَالَهُمْ- ‘নিশ্চয়ই যারা কুফরী করে ও মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে এবং তাদের নিকট হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও রাসূলের বিরোধিতা করে, তারা কখনোই আল্লাহর কোনরূপ ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ সত্বর তাদের সকল কর্ম বিনষ্ট করবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩২)।
২. শিরক : شرك অর্থ শরীক করা। পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর সত্তা অথবা গুণাবলীর সাথে অন্যকে শরীক করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শিরকের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهْوَ خَلَقَكَ ‘আল্লাহর জন্য অংশীদার সাব্যস্ত করা, অথচ তিনি (আল্লাহ) তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’।[4] শিরকের সংজ্ঞায় আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, ‘শিরক হ’ল আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ গ্রহণ করা এবং তাকে আল্লাহর মত ভালবাসা’।[5]
শিরক সর্বাধিক ভয়ানক পাপ : মহান আল্লাহ বলেন, وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُورًا ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৫/২৩)।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন আমরা মাসীহ-দাজ্জাল সম্পর্কে একে অপরের মাঝে আলোচনা করছিলাম। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে এসে বললেন, সাবধান! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যাপারে অবগত করব না যা আমার নিকট তোমাদের জন্য মাসীহ-দাজ্জাল হ’তেও অধিক ভয়ানক? আমরা বললাম, হ্যা, বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, তা হ’ল গোপনীয় শিরক অর্থাৎ কোন ব্যক্তি ছালাতে দাঁড়িয়ে এজন্য ছালাতকে দীর্ঘায়িত করে যে, তার ছালাত কোন ব্যক্তি দর্শন করছে’।[6]
মাকিল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেন, ‘আমি আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর সাথে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনি বলেন, হে আবু বকর! নিশ্চয় শিরক পিপীলিকার পদচারণা থেকেও সন্তর্পণে তোমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। আবু বকর (রাঃ) বলেন, কারও আল্লাহর সাথে অপর কিছুকে ইলাহরূপে গণ্য করা ছাড়াও কি শিরক আছে? নবী করীম (ছাঃ) বলেন, সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! শিরক পিপীলিকার পদধ্বনির চেয়েও সূক্ষ্ম। আমি কি তোমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দেব না, তুমি যা বললে শিরকের অল্প ও বেশী সবই দূর হয়ে যাবে? তিনি বলেন, তুমি বল,اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لا أَعْلَمُ-‘হে আল্লাহ! আমি সজ্ঞানে তোমার সাথে শিরক করা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই এবং যা আমার অজ্ঞাত তা থেকেও তোমার কাছে ক্ষমা চাই’।[7]
শিরক আমল বিনষ্ট করে : কোন ব্যক্তি শিরকে আকবারে লিপ্ত হ’লে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে এবং তার সমস্ত আমল বাতিল হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- ‘তবে যদি তারা শিরক করত, তাহ’লে তাদের সব কাজকর্ম নিস্ফল হয়ে যেত’ (আন‘আম ৬/৮৮)।
মহান আল্লাহ বলেন, مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَنْ يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ بِالْكُفْرِ أُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ- ‘মুশরিকরা আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করার অধিকার রাখে না, যখন তারা নিজেরাই নিজেদের কুফরীর সাক্ষ্য দিচ্ছে। ওদের সকল আমল বরবাদ হয়েছে এবং ওরা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে’ (তওবাহ ৯/১৭)।
মহান আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘অথচ নিশ্চিতভাবে তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের (নবীদের) প্রতি (তাওহীদের) প্রত্যাদেশ করা হয়েছে। অতএব যদি তুমি শিরক কর, তাহ’লে তোমার সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৩৯/৬৫)।
৩. নিফাক্ব : নিফাক্ব কুফরীর মত। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, নিফাক্ব কুফরীর মতই। বড় নিফাক্ব ও ছোট নিফাক্ব। এ কারণেই অধিকাংশ সময়ে বলা হয়ে থাকে, কোন কুফরী আছে যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় আবার কোনটা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে না। অনুরূপভাবে নিফাক্বও দু ধরনের, যথা- নিফাক্বে আকবর বা বড় নিফাক, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। নিফাক্বে আছগর বা ছোট নিফাক যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে না ’।[8]
নিফাক্বের পরিণতি : নিফাক্বী কর্মের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,لاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوْا وَيُحِبُّونَ أَنْ يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا فَلاَ تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ- ‘যেসব লোকেরা তাদের কৃতকর্মে খুশী হয় এবং তারা যা করেনি এমন কাজে প্রশংসা পেতে চায়, তুমি ভেব না যে, তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। বস্ত্ততঃ তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক আযাব’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)।
নিফাক্বী আমল বিনষ্ট করে : মহান আল্লাহ বলেন,أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ فَإِذَا جَاءَ الْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنْظُرُونَ إِلَيْكَ تَدُورُ أَعْيُنُهُمْ كَالَّذِي يُغْشَى عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ فَإِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوكُمْ بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَى الْخَيْرِ أُولَئِكَ لَمْ يُؤْمِنُوا فَأَحْبَطَ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا- ‘তারা তোমাদের ব্যাপারে ঈর্ষাবোধ করে। অতঃপর যখন যুদ্ধ উপস্থিত হয়, তখন তুমি দেখবে যে, মৃত্যুভয়ে হুঁশহারা ব্যক্তির মত এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। অতঃপর যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় তখন তারা গণীমতের লোভে তোমাদেরকে তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। ওরা ঈমান আনেনি। তাই আল্লাহ তাদের কর্মসমূহ নিস্ফল করে দিয়েছেন। আর এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ’ (আহযাব ৩৩/১৯)।
মহান আল্লাহ বলেন,وَيَقُولُ الَّذِينَ آمَنُوا أَهَؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَأَصْبَحُوا خَاسِرِينَ- ‘আর মুসলমানেরা বলবে, আরে এরাই তো তারা যারা আল্লাহর নামে দৃঢ় শপথ করত যে তারা তোমাদের সাথেই আছে। বস্ত্ততঃ তাদের সমস্ত কর্ম নিষ্ফল হ’ল। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল’ (মায়েদাহ ৫/৫৩)।
৪. আল্লাহর অবতীর্ণ বিষয়কে অপসন্দ করা : আমল বিনষ্টকারী অন্যতম একটি নিকৃষ্ট কর্ম হ’ল আল্লাহর অবতীর্ণ বিষয়কে অপসন্দ করা। মহান আল্লাহ বলেন,ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ- ‘এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তারা তা পসন্দ করে না। ফলে তিনি তাদের সকল কর্ম ব্যর্থ করে দিবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৯)।
৫. আল্লাহ্ যা পছন্দ করেন তা অপসন্দ না করা : আমল বিনষ্টকারী অপর নিকৃষ্টকর্ম হ’ল আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়কে অপসন্দ করা। মহান আল্লাহ বলেন,ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ ‘এটা এজন্য যে, যে কাজ আল্লাহকে ক্রুদ্ধ করে, তারা সেই কাজের অনুসরণ করে। আর তারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করে। ফলে তিনি তাদের সকল কর্ম নিস্ফল করে দেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৮)।
৬. আহলে কিতাবদের মত পথভ্রষ্ট হওয়া : কোন ব্যক্তি যদি আহলে কিতাবদের মত পথভ্রষ্ট হয় তাহ’লে তার আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,كَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ كَانُوا أَشَدَّ مِنْكُمْ قُوَّةً وَأَكْثَرَ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا فَاسْتَمْتَعُوا بِخَلَاقِهِمْ فَاسْتَمْتَعْتُمْ بِخَلَاقِكُمْ كَمَا اسْتَمْتَعَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ بِخَلَاقِهِمْ وَخُضْتُمْ كَالَّذِي خَاضُوا أُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ- ‘তোমাদের অবস্থা তোমাদের পূর্বেকার লোকদের ন্যায়। তারা তোমাদের চাইতে অধিক শক্তিশালী ছিল এবং অধিক ধন-সম্পদ ও সন্তানাদির মালিক ছিল। তারা তাদের অংশ মত ভোগ করেছে। অতঃপর তোমরাও তোমাদের অংশ মত ভোগ করছ, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীরা তোমাদের পূর্বে ভোগ করেছে। আর তোমরাও খেল-তামাশায় মত্ত রয়েছ যেমন তারাও খেল-তামাশায় মত্ত থাকত। দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট হয়েছে। আর তারাই হ’ল ক্ষতিগ্রস্ত’ (তাওবাহ ৯/৬৯)।
উম্মতে মুহাম্মাদী যে পূর্ববর্তী উম্মতের হুবহু পদাঙ্ক অনুসরণ করবে সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ، شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ دَخَلُوا فِي جُحْرِ ضَبٍّ لَاتَّبَعْتُمُوهُمْ قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ آلْيَهُودَ وَالنَّصَارَى؟ قَالَ: فَمَنْ- ‘অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অনুসরণ করবে বিঘত-বিঘত এবং হাত-হাত (সম) পরিমাণ। এমনকি তারা যদি সাপের গর্তে প্রবেশ করে, তাহ’লে তোমরাও তাদের পিছনে পিছনে যাবে। ছাহাবাগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি ইহুদী ও নাছারাদের অনুকরণের কথা বলছেন’? তিনি বললেন, তবে আবার কার?[9]
অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আবু ওয়াক্বেদ আল-লাইছী বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে আমরা হুনাইনের পথে বের হ’লাম। তখন আমরা কুফরের নিকটবর্তী (সদ্য নও-মুসলিম) ছিলাম। মক্কা বিজয়ের দিন মুসলিম হয়েছিলাম। (পথে) মুশরিকদের একটি কুল গাছ ছিল; যার নিকটে ওরা ধ্যানমগ্ন হ’ত এবং (বরকতের আশায়) তাদের অস্ত্র-শস্ত্রকে তাতে ঝুলিয়ে রাখত; যাকে ‘যা-তে আনওয়াত্ব’ বলা হ’ত। সুতরাং একদা আমরা সে কুল গাছের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম। (তা দেখে) আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য একটি ‘যা-তে আনওয়াত্ব’ করে দিন যেমন ওদের রয়েছে। (তা শুনে) তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! তোমরা সেই কথাই বললে, যে কথা বনু ইস্রাঈল মূসাকে বলেছিল, اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ‘আমাদের জন্য একটা দেবতা গড়ে দিন, যেমন ওদের অনেক দেবতা রয়েছে’ (‘আরাফ ৬/১৩৮)! তোমরাও তো সেরূপ কথা বললে, সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয় তোমরা ঐ সকল লোকদের পথ অনুকরণ করে চলবে, যারা তোমাদের আগে অতীত হয়ে গেছে’।[10]
৭. রাসূলের বিরোধিতা করা : রাসূলের প্রতিটি নির্দেশনা মুমিন ব্যক্তির জন্য শিরোধার্য। এতে কারও ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই। আল্লাহ বলেন, وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ- ‘আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে তাদের নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।
সুতরাং কোনভাবে যদি রাসূলের বিরোধিতা করা হয় তাহ’লে তার আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا- ‘আর যে ব্যক্তি রাসূলের বিরোধিতা করে সুপথ স্পষ্ট হওয়ার পর এবং মুমিনদের বিপরীত পথে চলে, আমরা তাকে ঐদিকেই ফিরিয়ে দেই যেদিকে সে যেতে চায় এবং তাকে আমরা জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। আর সেটা অতীব নিকৃষ্ট ঠিকানা’ (নিসা ৪/১১৫)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَشَاقُّوا الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى لَنْ يَضُرُّوا اللَّهَ شَيْئًا وَسَيُحْبِطُ أَعْمَالَهُمْ- ‘নিশ্চয়ই যারা কুফরী করে ও মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে এবং তাদের নিকট হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাবার পরেও রাসূলের বিরোধিতা করে, তারা কখনোই আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ সত্বর তাদের সকল কর্ম বিনষ্ট করে দিবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩২)।
রাসূল (ছাঃ) হ’লেন সর্বাবস্থায় অনুকরণীয় ব্যক্তি। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে যা প্রাপ্ত হয়েছেন তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। কুরআনের ভাষায়,وَمَاآتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا، ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)।
সুতরাং কথা বা কাজ কোনভাবেই রাসূলের সাথে বেআদবী করা যাবেনা; অন্যথায় সকল আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু কর না এবং তোমরা পরস্পরে যেভাবে উঁচুস্বরে কথা বল, তার সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বল না। এতে তোমাদের কর্মফলসমূহ বিনষ্ট হবে। অথচ তোমরা বুঝতে পারবে না’ (হুজুরাত ৪৯/২)।
৮. আল্লাহর উপর ও তাঁর আয়াতসমূহের উপর মিথ্যারোপ করা : আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা হ’ল বড় যুলুম। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয় কিংবা তাঁর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে, তার চেয়ে বড় যালেম আর কে আছে? নিশ্চয়ই যালেমরা কখনো সফলকাম হয় না’ (আন‘আম ৬/২১)।
আল্লাহর উপর ও তাঁর আয়াত বা নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপের নানাবিধ পরিণতি রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হ’ল আমল বিনষ্ট হয়ে যাওয়া। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَلِقَاءِ الْآخِرَةِ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ هَلْ يُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- ‘যারা আমাদের আয়াত সমূহে এবং আখেরাতে (আমার সাথে) সাক্ষাৎ লাভে মিথ্যারোপ করে, তাদের সকল আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। তারা তো কেবল তাদের কৃতকর্ম অনুযায়ীই বদলা পাবে’ (আ‘রাফ ৭/১৪৭)।
৯. দ্বীন ত্যাগ : দ্বীন ত্যাগ দ্বারা ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে মুরতাদ হয়ে যায়। ফলে তার আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। এসম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ- ‘আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বধর্ম ত্যাগ করবে, অতঃপর কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কর্ম বিনষ্ট হয়ে যাবে। তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে এবং সেখানেই চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২১৭)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ- ‘বলে দাও, তবে কি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর আয়াতসমূহকে নিয়ে এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে উপহাস করছিলে’? ‘তোমরা কোন ওযর পেশ কর না। তোমরা অবশ্যই কুফরী করেছ ঈমান আনার পরে’ (তাওবাহ ৯/৬৫-৬৬)।
১০. ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে হত্যাকারী : মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পর সমাজ সংস্কারের জন্য আর কোন নবী আসবেন না। তবে সমাজ সংস্কারের জন্য ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির আগমন ঘটবে। সুতরাং এই ব্যক্তিকে যদি হত্যা করা হয় তাহ’লে হত্যাকারীর আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَيَقْتُلُونَ الَّذِينَ يَأْمُرُونَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ- أُولَئِكَ الَّذِينَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ- ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে ও অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করে এবং লোকদের মধ্যে যারা ন্যায়ের আদেশ দেয় তাদেরকে হত্যা করে, তুমি তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও’। ‘এরাই হ’ল সেই সব লোক, দুনিয়া ও আখেরাতে যাদের সকল আমল বরবাদ হয়ে গেছে। আর তাদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (আলে ইমরান ৩/২১-২২)।
১১. পার্থিব জীবনে জাঁকজমক কামনাকারী : দুনিয়ায় মুমিন ব্যক্তির জীবন কণ্টকাকীর্ণ। যদি কোন ব্যক্তি দুনিয়ার মোহে পড়ে যায় তাহ’লে তার আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা করে, আমরা তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই পূর্ণভাবে দিয়ে দেব। সেখানে তাদের কোনই কমতি করা হবে না’। ‘এরা হ’ল সেইসব লোক যাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই। দুনিয়াতে তারা যা কিছু (সৎকর্ম) করেছিল আখেরাতে তা সবটাই বরবাদ হবে এবং যা কিছু উপার্জন তারা করেছিল সবটুকুই বিনষ্ট হবে’ (হূদ ১১/১৫-১৬)।
আমর ইবনু আওফ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,فَوَاللَّهِ مَا الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلَكِنْ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا، كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا وَتُلْهِيَكُمْ كَمَا أَلْهَتْهُمْ- ‘আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের সম্পর্কে দারিদ্রতার ভয় করি না; কিন্তু আমি ভয় করি যে, তোমাদের ওপর দুনিয়াকে প্রশস্ত করে দেয়া হবে যেমনি প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। আর তোমরা তা লাভ করার জন্য ঐরূপ প্রতিযোগিতা করবে যেরূপ তারা এ ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করেছিল। ফলে এটা তোমাদেরকে ধ্বংস করবে যেরূপ তাদেরকে ধ্বংস করেছিল’।[11]
তবে যদি কোন ব্যক্তি অঢেল সম্পদ অর্জন করার পরেও সেখান থেকে আল্লাহর পথে ব্যয়, ইয়াতীম-মিসকীনদের সাহায্য সহযোগিতা করে তাহ’লে সে ব্যক্তি সফলকাম হবে। হাদীছে এসেছে, আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বারে দাঁড়ালেন এবং বললেন, আমি আমার পর তোমাদের জন্য ভয় করি এ ব্যাপারে যে, তোমাদের জন্য দুনিয়ার কল্যাণের (মঙ্গলের) দরজা খুলে দেয়া হবে। তারপর তিনি দুনিয়ার নে‘মতের উল্লেখ করেন। এতে তিনি প্রথমে একটির কথা বলেন, পরে দ্বিতীয়টির বর্ণনা করেন। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! কল্যাণও কি অকল্যাণ বয়ে আনবে? তিনি নীরব রইলেন। আমরা বললাম, তাঁর উপর অহী নাযিল হচ্ছে। সমস্ত লোকও এমনভাবে নীরবতা অবলম্বন করল, যেন তাদের মাথার উপর পাখি বসে আছে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুখের ঘাম মুছে বললেন, এখনকার সেই প্রশ্নকারী কোথায়? তা কী কল্যাণকর? তিনি তিনবার এ কথাটি বললেন। কল্যাণ কল্যাণই বয়ে আনে। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বসন্তকালীন উদ্ভিদ (পশুকে) ধ্বংস অথবা ধ্বংসোন্মুখ করে ফেলে। কিন্তু যে পশু সেই ঘাস এই পরিমাণ খায় যাতে তাঁর ক্ষুধা মিটে, তারপর রোদ পোহায় এবং মলমূত্র ত্যাগ করে, এরপর আবার ঘাস খায়। নিশ্চয়ই এ মাল সবুজ শ্যামল সুস্বাদু। সেই মুসলিমের সম্পদই উত্তম যে ন্যায় সঙ্গতভাবে তা উপার্জন করেছে এবং আল্লাহর পথে, ইয়াতীম ও মিসকীন ও মুসাফিরের জন্য খরচ করেছে। আর যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে অর্জন করে তার দৃষ্টান্ত এমন ভক্ষণকারীর ন্যায় যার ক্ষুধা মিটে না এবং তা ক্বিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে’।[12]
এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ لَا يَظْلِمُ مُؤْمِنًا حَسَنَةً، يُعْطَى بِهَا فِي الدُّنْيَا وَيُجْزَى بِهَا فِي الْآخِرَةِ، وَأَمَّا الْكَافِرُ فَيُطْعَمُ بِحَسَنَاتِ مَا عَمِلَ بِهَا لِلَّهِ فِي الدُّنْيَا، حَتَّى إِذَا أَفْضَى إِلَى الْآخِرَةِ، لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَةٌ يُجْزَى بِهَا- ‘একটি নেকীর ক্ষেত্রেও আল্লাহ তা‘আলা কোন মুমিন বান্দার প্রতি যুলুম করবেন না। বরং তিনি এর বিনিময় দুনিয়াতে প্রদান করবেন এবং আখিরাতেও প্রদান করবেন। আর কাফির ব্যক্তি পার্থিব জগতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে নেক আমল করে এর বিনিময়ে তিনি তাকে জীবনোপকরণ প্রদান করেন। অবশেষে আখিরাতে প্রতিদান দেয়ার মত তার নিকট কোন নেকীই থাকবে না’।[13]
১২. মুজাহিদের পরিবারের সাথে খেয়ানতকারী : বুরায়দা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ঘরে অবস্থানকারী পুরুষগণের নিকট মুজাহিদের সহধর্মিণীদের সম্মান ও মর্যাদা তাদের মাতৃসম। যদি ঘরে অবস্থানকারী কোন ব্যক্তি কোন মুজাহিদের পরিবারের তত্ত্বাবধানে থেকে তাদের ব্যাপারে খিয়ানাত করে, তবে খিয়ানাতকারীকে ক্বিয়ামতের দিন আটকিয়ে মুজাহিদকে বলা হবে তুমি তার নেক আমল যত পরিমাণ ইচ্ছা আদায় করে নাও। তিনি বললেন, এবার তোমাদের কি ধারণা? অর্থাৎ সে কি আর কম নেবে? সমুদয় ছওয়াবই সে কেড়ে নিয়ে যাবে’।[14]
১৩. দুর্নীতি ও অন্যায়-অত্যাচারকারী : পার্থিব জীবনে কোন ব্যক্তি দুর্নীতি, অন্যায়-অত্যাচার করে তার শাস্তি দুনিয়াতে না হ’লে ক্বিয়ামতের দিন সে বিচারের সম্মুখীন হবে। সেদিন দুর্নীতিবাজ, অন্যায়-অত্যাচারকারী ব্যক্তির সৎআমলগুলো অত্যাচারিত ব্যক্তিকে দেওয়ার ফলে তার সৎআমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তোমরা কি জান, নিঃস্ব কে? তাঁরা বললেন, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যার কাছে কোন দিরহাম এবং কোন আসবাবপত্র নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব তো সেই ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম ও যাকাতের নেকী নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু
এর সাথে সাথে সে এ অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারও প্রতি মিথ্যারোপ করেছে, কারও (অবৈধরূপে)
মাল ভক্ষণ করেছে, কারও রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। অতঃপর অত্যাচারিতকে তার নেকী দেওয়া হবে। পরিশেষে যদি তার নেকী অন্যান্যদের দাবী পূরণ করার পূর্বেই শেষ হয়ে যায়, তাহ’লে তাদের পাপরাশি নিয়ে তার উপর নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[15]
১৪. আছরের ছালাত পরিত্যাগকারী : ফরয ছালাতের প্রত্যেকটি ওয়াক্তই গুরুত্বপূর্ণ। তন্মধ্যে আছরের ছালাতের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ- ‘তোমরা ছালাত সমূহের ব্যাপারে ও বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আছরের) ছালাতের ব্যাপারে যত্নবান হও এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দন্ডায়মান হও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)।
হাদীছে এসেছে, আবু মালীহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক মেঘলা দিনে আমরা বুরায়দা (রাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি বললেন, শীঘ্র ছালাত আদায় করে নাও। কেননা নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَرَكَ صَلَاةَ الْعَصْرِ، فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ ‘যে ব্যক্তি আছরের ছালাত ছেড়ে দেয় তার সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে যায়’।[16]
(ক্রমশঃ)
[লেখক : পিয়ারপুর, ধুরইল, মোহনপুর, রাজশাহী]
[1]. মাজমু‘ ফাতাওয়া ১২/৩৩৫ পৃ.।
[2]. বুখারী হা/৪৮; মুসলিম হা/৬৪; মিশকাত হা/৪৮১৪।
[3]. আছ-ছারেমুল মাসলূল, ৫৫ পৃ.।
[4]. বুখারী হা/৪৪৪৭।
[5]. মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৩৯; মাসিক আল-বায়ান, সংখ্যা ৬৯, নভেম্বর ১৯৯৭।
[6]. ইবনু মাজাহ হা/৪২০৪; মিশকাত হা/৫৩৩৩; ছহীহুত তারগীব হা/৩০।
[7]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭১৬; আহমাদ হা/১৯৬২২; ছহীহুত তারগীব হা/৩৬।
[8]. মাজমু‘ঊল ফাতাওয়া ৭/৫২৪ পৃ.।
[9]. বুখারী হা/৩৪৫৬; মুসলিম হা/২৬৬৯; মিশকাত হা/৫৩৬১।
[10]. তিরমিযী হা/২৩৮০; ইবনু হিববান হা/৬৭০২; মিশকাত হা/৫৪০৮।
[11]. বুখারী হা/৩১৫৮; মুসলিম হা/২৯৬১; মিশকাত হা/৫১৬৩।
[12]. বুখারী হা/২৮৪২; মুসলিম হা/১০৫২; মিশকাত হা/৫১৬২।
[13]. মুসলিম হা/২৮০৮; মিশকাত হা/৫১৫৯।
[14]. মুসলিম হা/১৮৯৭; মিশকাত হা/৩৭৯৮।
[15]. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭।
[16]. বুখারী হা/৫৯৪; নাসাঈ হা/৪৭৪; মিশকাত হা/৫৯৫।