মূল্যহীন দুনিয়ার প্রতি অনর্থক ভালোবাসা (২য় কিস্তি)
আব্দুর রহীম
উপস্থাপনা : সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সান্নিধ্য ও সাহচর্য লাভের চেয়ে বড় সৌভাগ্যের বিষয় আর কী হ’তে পারে? সেজন্য এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম ছাহাবায়ে কেরাম। তাঁদের পর তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’ল, সর্বোত্তম লোক কে? তিনি বললেন, قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ‘আমার যুগের মানুষ সর্বোত্তম। তারপর তাদের পরবর্তী যুগের লোকেরা এবং এরপর তাদের পরবর্তী যুগের লোকেরা’।[1]
বর্তমান সময়েও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মত হিসাবে কিছু আমলী গুণের মধ্য দিয়ে উত্তম মানুষ হওয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ও হাদীছে মুহাম্মাদ (ছাঃ) বিভিন্ন প্রসঙ্গে কিছু বিশেষ গুণের অধিকারী মানুষকে উত্তম ব্যক্তি আখ্যা দিয়েছেন। নিম্নে উত্তম মানুষ হওয়ার উপায়গুলো উল্লেখিত হ’ল।
১. দ্বীনী জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি : জ্ঞান হ’ল মানুষের জীবন চলার পথের আলো। প্রদীপের আলো ছাড়া যেমন কেউ পথ চলতে পারে না, তেমনি জ্ঞানের আলো ছাড়া মানুষের কোন মূল্য থাকে না। সেজন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ ‘তুমি বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? বস্ত্ততঃ জ্ঞানীরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে’ (যুমার ৩৯/০৯)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, লোকদের মধ্যে অধিক সম্মানিত ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে অধিক আল্লাহভীরু। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমরা আপনাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিনি। তিনি বললেন, তা’হলে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হ’লেন আল্লাহর নবী ইউসুফ বিন ইয়াকুব বিন ইসহাক বিন ইব্রাহীম (আঃ)। তারা বললেন, আমরা এ সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করিনি। তিনি বললেন, তবে কি তোমরা আমাকে আরবদের উচ্চ বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ? তারা বলল, হ্যাঁ। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন,فَخِيَارُكُمْ فِى الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِى الإِسْلاَمِ إِذَا فَقِهُوا ‘যারা জাহেলিয়াতের যুগে তোমাদের মাঝে উত্তম ছিল, ইসলামেও তারা উত্তম যদি তারা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী হয়’।[2]
অপর হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরআন শিক্ষাকারী ও কুরআন শিক্ষা প্রদানকারীকে উত্তম ব্যক্তি বলেছেন। তিনি বলেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম যে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিখায়’।[3] সুতরাং দ্বীনী জ্ঞানার্জনের পর তদানুযায়ী আমলের মাধ্যমে উত্তম মানুষে পরিণত হওয়া সম্ভব।
২. আল্লাহর পথে দাওয়াত দানকারী : আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদানকারী ব্যক্তি সর্বোত্তম। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ- وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ- ‘ঐ ব্যক্তির চাইতে কথায় উত্তম আর কে আছে, যে (মানুষকে) আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে সৎকর্ম করে এবং বলে যে, নিশ্চয়ই আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। অপর এক আয়াতে এসেছে, ‘ভাল ও মন্দ কখনো সমান হ’তে পারে না। তুমি উত্তম দ্বারা (অনুত্তমকে) প্রতিহত কর। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে যেন (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৩-৩৪)।
৩. ফিৎনার যুগে উপবিষ্ট ব্যক্তি : ওছমান (রাঃ)-এর আমলের ফিৎনাকালীন সময়ে একদা সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেছিলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন,إِنَّهَا سَتَكُونُ فِتْنَةٌ القَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ القَائِمِ، وَالقَائِمُ خَيْرٌ مِنَ المَاشِي، وَالمَاشِي خَيْرٌ مِنَ السَّاعِي- অচিরেই এমন ফিৎনা আসবে যে সে সময় উপবিষ্ট ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তি থেকে উত্তম হবে। দাঁড়ানো ব্যক্তি চলমান ব্যক্তি থেকে উত্তম হবে, চলমান ব্যক্তি ফিৎনা প্রয়াসী ব্যক্তি থেকে উত্তম হবে’।[4]
এসব ফিৎনা বিভিন্ন ধরনের হ’তে পারে। পার্থিব আকাঙ্খা, ধন-সম্পদ, পরিবার, ভোগ-বিলাস, সমাজ, পরিবেশ-পরিস্থিতি, যুগ, সময় ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ধন-সম্পদকে উম্মাহর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ফিতনা বলেছেন।
যেমন হাদীছে এসেছে, কা‘ব ইবনু ইয়ায (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, إِنَّ لِكُلِّ أُمَّةٍ فِتْنَةً وَفِتْنَةُ أُمَّتِي المَالُ- ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোন না কোন ফিৎনা রয়েছে। আর আমার উম্মতের ফিতনা হ’ল ধন-সম্পদ’।[5] সুতরাং উত্তম মানুষ হওয়ার জন্য যাবতীয় দুনিয়াবী ফিৎনা থেকে দূরে থাকতে হবে।
৪. নেতৃত্ব ও শাসনের ব্যাপারে অনাসক্ত ব্যক্তি : নেতৃত্বের প্রতি আসক্তি এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। নেতৃত্বের মোহ অন্তরঙ্গ সম্পর্কের মধ্যেও ফাটল সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের প্রতি আসক্ত ব্যক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, স্বার্থ হাছিলের জন্য খুন-খারাবি, হিংসা, বিশৃঙ্খলা, এমনকি মরণাস্ত্রের ব্যবহার করতেও দ্বিধাবোধ করেনা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ عَلَى الإِمَارَةِ وَسَتَكُونُ نَدَامَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘নিশ্চয়ই তোমরা শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য খুব আগ্রহী হবে। কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তা লজ্জা (ও আফসোসের) কারণ হবে’।[6]
পক্ষান্তরে নেতৃত্বের প্রতি নির্লোভ ব্যক্তি সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,تَجِدُونَ النَّاسَ مَعَادِنَ، خِيَارُهُمْ فِى الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُهُمْ فِى الإِسْلاَمِ إِذَا فَقِهُوا، وَتَجِدُونَ خَيْرَ النَّاسِ فِى هَذَا الشَّأْنِ أَشَدَّهُمْ لَهُ كَرَاهِيَةً- ‘তোমরা মানুষকে খনির মত পাবে। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের উত্তম ব্যক্তিগণ ইসলাম গ্রহণের পরও তারা উত্তম যখন তারা দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করে। আর তোমরা শাসন ও নেতৃত্বের ব্যাপারে লোকদের মধ্যে উত্তম ঐ ব্যক্তিকে পাবে যে এই ব্যাপারে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক অনাসক্ত’।[7] সুতরাং উত্তম মানুষ হওয়ার জন্য নেতৃত্বের প্রতি কোন প্রকার আসক্তি ত্যাগ করা অপরিহার্য।
৫. দীর্ঘ জীবন ও সুন্দর আমলের অধিকারী ব্যক্তি : জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন কিংবা বার্ধক্যে ধাপে ধাপে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে জীবনের স্বাদ আস্বাদন করান। তবে সবার জীবন এমন স্বাভাবিক নিয়মে কাটে না। অনেকেই জীবনের সর্বশেষ স্তরে পৌঁছার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চিরস্থায়ী ঠিকানায় চলে যান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,اللهُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ ضَعْفٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ ضَعْفٍ قُوَّةً ثُمَّ جَعَلَ مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ ضَعْفًا وَشَيْبَةً يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَهُوَ الْعَلِيمُ الْقَدِيرُ- ‘আল্লাহ তোমাদের দুর্বলরূপে সৃষ্টি করেন, অতঃপর দুর্বলতার পর তিনি শক্তি দান করেন, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান’ (রূম ৩০/৫৪)।
পৃথিবীতে দীর্ঘ অথবা স্বল্প আয়ু যা-ই হোক, সৎকর্মের মাধ্যমে ব্যক্তির উভয় জগতের কল্যাণ হয়। আবু বকর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘কোন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, مَنْ طَالَ عُمُرُهُ، وَحَسُنَ عَمَلُهُ ‘যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল সুন্দর হয়েছে’। সে আবার প্রশ্ন করল, মানুষের মধ্যে কে নিকৃষ্ট? তিনি বললেন, مَنْ طَالَ عُمُرُهُ وَسَاءَ عَمَلُهُ ‘যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে এবং তার আমল খারাপ হয়েছে’।[8]
৬. স্ত্রী ও পরিবারের নিকটে উত্তম ব্যক্তি : পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ‘আর তোমরা (স্ত্রীদের) সঙ্গে উত্তম ব্যবহার কর। (আন-নিসা ৪/১৯)। স্ত্রীর কাছে উত্তম ব্যক্তিকে ইসলাম উত্তম ব্যক্তি হিসাবে ঘোষণা করেছে। হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَكْمَلُ المُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا، وَخَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِنِسَائِهِمْ- ‘তোমাদের মধ্যে ঈমানে পরিপূর্ণ মুসলিম হচ্ছে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। যেসব ব্যক্তি নিজেদের স্ত্রীদের নিকট উত্তম তারাই তোমাদের মধ্যে অতি উত্তম’।[9]
ঠিক তেমনি পরিবারের নিকটে ভাল ব্যক্তি উত্তম। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي ‘তোমাদের মাঝে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার পরিবারের নিকট উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের নিকট উত্তম’।[10]
৭. জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদকারী : জীবন ও সম্পদ দু’টিই মানুষের নিকটে প্রিয়। এই জীবন ও সম্পদ আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে পারাটাই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির অন্যতম মাধ্যম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ- تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে?’ ‘সেটা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে তোমাদের মাল ও জান দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ। (বিনিময়ে) তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন এক উদ্যানে, যার পাদদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয় এবং (প্রবেশ করাবেন ‘আদন’ নামক) স্থায়ী জান্নাতের উত্তম বাসগৃহসমূহে। আর এটাই হ’ল মহা সাফল্য’ (ছফ ৬১/১০-১২)।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিজ্ঞেস করা হ’ল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মধ্যে কে উত্তম? আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,مُؤْمِنٌ يُجَاهِدُ فِى سَبِيلِ اللهِ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ ‘সেই মুমিন যে নিজ জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে (সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে) জিহাদ করে’।[11]
৮. মুসলিম ভাইকে আগে সালাম দেওয়া ব্যক্তি : সালাম পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَا تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا، وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا، أَوَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ؟ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ- ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না ঈমানদার হবে। আর তোমরা ঈমানদার হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না পরস্পর ভালবাসা স্থাপন করবে। আমি কি এমন একটি কাজের কথা তোমাদেরকে বলে দিব না, যখন তোমরা তা করবে, পরস্পর ভালবাসা স্থাপিত হবে? তোমরা একে অপরের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও’।[12]
সালামের বিনিময়ে যেমন ভালবাসা বৃদ্ধি পায়, তেমনি আগে সালামের বদৌলতে উত্তম মানুষ হওয়া যায়। হাদীছে এসেছে, আবু আইয়ুব আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَحِلُّ لِرَجُلٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثِ لَيَالٍ، يَلْتَقِيَانِ فَيُعْرِضُ هَذَا وَيُعْرِضُ هَذَا، وَخَيْرُهُمَا الَّذِى يَبْدَأُ بِالسَّلاَمِ- ‘কোন লোকের জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাইয়ের সাথে তিন দিনের অধিক এমনভাবে সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে যে, দু’জনে দেখা হলেও একজন এদিকে, আরেকজন ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখবে। তাদের মধ্যে যে আগে সালাম দিবে, সে-ই উত্তম লোক’।[13]
৯. পাওনাদারের পাওনা পরিশোধকারী ব্যক্তি : ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে সব মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বরং একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমেই এগিয়ে চলে মানুষের সামাজিক জীবন। প্রয়োজনের সময় ঋণ আদান-প্রদান করাও সমাজ জীবনের অনিবার্য এক অনুষঙ্গ। ইসলামেও ঋণের লেনদেন বৈধ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا تَدَايَنْتُمْ بِدَيْنٍ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَاكْتُبُوهُ وَلْيَكْتُبْ بَيْنَكُمْ كَاتِبٌ بِالْعَدْلِ وَلَا يَأْبَ كَاتِبٌ أَنْ يَكْتُبَ كَمَا عَلَّمَهُ اللهُ فَلْيَكْتُبْ وَلْيُمْلِلِ الَّذِي عَلَيْهِ الْحَقُّ وَلْيَتَّقِ اللهَ رَبَّهُ وَلَا يَبْخَسْ مِنْهُ شَيْئًا- ‘হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ কর। তোমাদের মধ্যেকার কোন লেখক যেন তা ন্যায়সঙ্গতভাবে লিপিবদ্ধ করে। আর লেখক যেন লিখতে অস্বীকার না করে। কেননা আল্লাহ তাকে লেখা শিক্ষা দিয়েছেন। অতএব সে যেন লিখে দেয়। আর যার উপর দায়িত্ব (অর্থাৎ ঋণ গ্রহীতা) যেন লেখার বিষয়বস্ত্ত বলে দেয়। এ সময় যেন সে তার পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করে এবং বলার মধ্যে কোন বেশ-কম না করে’ (বাক্বারাহ ২/২৮২)।
প্রয়োজনের সময় আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) নিজেও ঋণ নিয়েছেন এবং উত্তমরূপে তা পরিশোধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি উট ঋণ করে আনেন। অতঃপর এর থেকে বড় একটি উট তাকে দিয়ে বলেন, خِيَارُكُمْ مَحَاسِنُكُمْ قَضَاءً ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম, যে উত্তমভাবে ঋণ শোধ করে’।[14]
১০. পরোপকারী ব্যক্তি : পরোপকার মানবীয় মহৎ গুণ। সমাজ জীবনে একজন মানুষ অপর মানুষের সাথে চাল-চলনে, কথা-বার্তায়, লেন-দেনে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত থাকে। মানুষ সমাজ জীবনে পরস্পরের সুখে-দুঃখে পরস্পর সহযোগী। বিপদে একজন অপরজনকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। মানুষের সাথে মানুষের এ সহযোগিতামূলক কাজকে পরোপকার বলা হয়। আর যিনি মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন তিনিই হ’লেন পরোপকারী ব্যক্তি। সামাজিক হ’তে হ’লে পরোপকারী হ’তে হবে। পরোপকারী ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্য করে, আল্লাহও ততক্ষণ তাঁর বান্দার সাহায্য করে’।[15] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ ‘যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ (ক্বিয়ামতের দিন) তার অভাব পূরণ করবেন।[16]
কে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি? এমন এক প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ ‘আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয় যে মানুষের সবচেয়ে বেশী উপকার করে’।[17] (ক্রমশঃ)
মুহাম্মাদ আব্দুন নূর
লেখক : কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ।
[1]. বুখারী হা/৬৬৫৮; মুসলিম হা/২৫৩৩; ইবনু মাজাহ হা/২৩৬২।
[2]. বুখারী হা/৩৩৭৪; মুসলিম হা/২৩৭৮; মিশকাত হা/৪৮৯৩।
[3]. বুখারী হা/৫০২৭; আবুদাঊদ হা/১৪৫২; মিশকাত হা/২১০৯।
[4]. তিরমিযী হা/২১৯৭; দারাকুৎণী হা/৩২৫১; হাকেম হা/৮৩৬১।
[5]. তিরমিযী হা/২৩৩৬; মিশকাত হা/৫১৯৪।
[6]. বুখারী হা/৭১৪৮; আহমাদ হা/৯৭৯০; মিশকাত হা/৩৬৮১।
[7]. বুখারী হা/৩৪৯৩; মুসলিম হা/২৫২৬; আহমাদ হা/১০৮০১।
[8]. তিরমিযী হা/২৩৩০; মিশকাত হা/৫২৮৫; আহমাদ হা/২০৪৩১।
[9]. তিরমিযী হা/১১৬২; মিশকাত হা/৩২৬৪।
[10]. তিরমিযী হা/৩৮৯৫; ইবনু মাজাহ হা/১৯৭৭; মিশকাত হা/৩২৫২।
[11]. বুখারী হা/২৭৮৬; আহমাদ হা/১১৫৫২।
[12]. বুখারী হা/২৭৮৬; আহমাদ হা/১১৫৫২।
[13]. বুখারী হা/৬০৭৭; মুসলিম হা/২৫৬০; আবু দাঊদ হা/৪৯১১।
[14]. মুসলিম হা/১৬০১।
[15]. আবু দাঊদ হা/৪৯৪৬।
[16]. বুখারী হা/২৪৪২।
[17]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৬০২৬; ছহীহাহ হা/৯০৬।