তওবা
নাজমুন নাঈম
আব্দুর রহীম 457 বার পঠিত
ঞ. মু‘আবিয়া ইবনে হাকামের অনুশোচনা : মু‘আবিয়া ইবনে হাকাম তার দাসীকে একটি থাপ্পড় মেরেছিল। তাতেই অনুতপ্ত হয়ে তিনি দাসীকে মুক্ত করে দেন। যেমন হাদীছে এসেছে, মু‘আবিয়া ইবনে হাকাম হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, أَتَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ كَانَتْ لِي جَارِيَةٌ تَرْعَى غَنَمًا لِي قِبَلَ أُحُدٍ وَالْجَوَّانِيَّةِ فَاطَّلَعْتُ ذَاتَ يَوْمٍ فَإِذَا الذِّئْبُ قَدْ ذَهَبَ بِشَاةٍ مِنْ غَنَمِنَا وَأَنَا رَجُلٌ مِنْ بَنِي آدَمَ آسَفُ كَمَا يَأْسَفُونَ لَكِنْ صَكَكْتُهَا صَكَّةً فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَظَّمَ ذَلِكَ عَلَيَّ قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ أفَلا أُعتِقُها؟ قَالَ: ائتِني بهَا؟ فأتيتُه بِهَا فَقَالَ لَهَا: أَيْنَ اللهُ؟ قَالَتْ: فِي السَّمَاءِ قَالَ: مَنْ أَنَا؟ قَالَتْ: أَنْتَ رَسُولُ الله قَالَ: أعتِقْها فإنَّها مؤْمنةٌ-
‘আমার এক দাসী উহুদ পাহাড় ও জাওওয়ানিয়্যাহ-এর অঞ্চলে মেষ পাল চরাত। একদিন আমি তার কাছে গিয়ে দেখলাম যে, আমাদের একটি মেষ নেকড়ে বাঘ নিয়ে চলে গেছে। আমি অতি সাধারণ মানুষ বিধায় তাদের মত আমিও ক্রোধ সংবরণ করতে ব্যর্থ হয়ে তাকে চপেটাঘাত করে ফেলি। অতঃপর আমি (ভারাক্রান্ত হৃদয়ে) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে এতদসম্পর্কে বর্ণনা করলাম। তিনি আমার এ কাজকে গুরুতর অন্যায় বলে মনে করলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি কি তাকে মুক্ত করতে পারব? তিনি বললেন, তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি তাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বল তো আল্লাহ কোথায়? সে বলল, আকাশমন্ডলীতে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বল তো আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তিনি আমাকে বললেন, হ্যাঁ, একে মুক্ত করতে পার। কারণ সে মুমিনা’।[1]
২. মুমিন পরকালেও নিজ গুনাহ স্বীকার করে সফল হবে : নিজ গুনাহ স্বীকার করে অনুতপ্ত হওয়া একটি ইবাদত। এর সুফল বান্দা পরকালেও পাবে। যেমন হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ يُدْنِي الْمُؤْمِنَ، فَيَضَعُ عَلَيْهِ كَنَفَهُ أي ستره وَيَسْتُرُهُ فَيَقُولُ: أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا؟ أَتَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا؟ فَيَقُولُ: نَعَمْ أَيْ رَبِّ، حَتَّى إِذَا قَرَّرَهُ بِذُنُوبِهِ وَرَأَى فِي نَفْسِهِ أَنَّهُ هَلَكَ، قَالَ: سَتَرْتُهَا عَلَيْكَ فِي الدُّنْيَا، وَأَنَا أَغْفِرُهَا لَكَ الْيَوْمَ، فَيُعْطَى كِتَابَ حَسَنَاتِهِ، وَأَمَّا الْكَافِرُ وَالْمُنَافِقُونَ، فَيَقُولُ الأَشْهَادُ: هَؤُلاءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى رَبِّهِمْ أَلا لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الظَّالِمِينَ- ‘আল্লাহ তা‘আলা মুমিন ব্যক্তিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন এবং তার উপর স্বীয় আবরণ দ্বারা তাকে ঢেকে নিবেন। তারপর বলবেন, অমুক পাপের কথা কি তুমি জান? তখন সে বলবে, হ্যাঁ, হে আমার প্রতিপালক! এভাবে তিনি তার কাছ হ’তে তার পাপগুলো স্বীকার করিয়ে নিবেন। আর সে মনে করবে যে, তার ধ্বংস অনিবার্য। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আমি পৃথিবীতে তোমার পাপ গোপন করে রেখেছিলাম। আর আজ আমি তা মাফ করে দিব। তারপর তার নেক আমলনামা তাকে দেয়া হবে। কিন্তু কাফির ও মুনাফিকদের সম্পর্কে সাক্ষীরা বলবে, এরাই তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিল। সাবধান, যালিমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত’।[2]
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা মুমিন ব্যক্তিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন এবং তার উপর স্বীয় আবরণ দ্বারা তাকে ঢেকে নিবেন। সকল সৃষ্টজীব থেকে আড়াল করে নিবেন। এরপর তাকে ঐ আড়ালের মধ্যেই বলবেন, তোমার আমলনামা পড়, সে ছওয়াবের অংশ পাঠ করা শুরু করবে এবং তাতে তার মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং তার হৃদয় উদ্বেলিত হবে। আল্লাহ বলবেন, হে আমার বান্দা! তুমি কি এগুলো চেন? সে বলবে, হ্যাঁ। আল্লাহ বলবেন, এগুলো আমি কবুল করেছি। তখন সে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। তিনি বলবেন, মাথা উঠাও এবং আমলনামা পাঠ করতে থাক। এবার সে গুনাহের অংশ পাঠ করতে থাকবে। এতে তার চেহারা কালো হয়ে যাবে, অন্তর প্রকম্পিত হবে এবং তার শিরাগুলো কাঁপতে থাকবে। আর এতে সে চরম লজ্জায় পতিত হবে যা তার রব ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। তিনি বলবেন, হে আমার বান্দা! অমুক পাপের কথা কি তুমি জান? তখন সে বলবে, হ্যাঁ, হে আমার প্রতিপালক! আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আজ আমি তোমার গুনাহসমূহ মাফ করে দিলাম। এতে সে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। আর লোকেরা কেবল তাকে সিজদায় দেখতে পাবে এবং পরস্পর বলাবলি করবে, এই বান্দার জন্য কতই না আনন্দ সে কখনো তার রবের অবাধ্য হয়নি। অথচ তার এবং রবের মধ্যে সাক্ষাতে কত কী হয়ে গেল তারা তার কিছুই জানবে না’।[3]
৩. নিজ গুনাহকে ভুলে না যাওয়া : কোন কারণে গুনাহ হয়ে গেলে মুমিন সেটা ভুলে যাবে না বা অস্বীকার করবে না বা হঠকারিতা করবে না। বরং বার বার স্মরণ করবে এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ‘যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করলে কিংবা নিজের উপর কোন যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে। অতঃপর স্বীয় পাপসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ব্যতীত পাপসমূহ ক্ষমা করার কে আছে? আর যারা জেনে শুনে স্বীয় কৃতকর্মের উপর হঠকারিতা করেনা’ (আলে ইমরান ৩/১৩৫)। যারা নিজের পাপের কথা ভুলে যায় তাদের ধমক দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ فَأَعْرَضَ عَنْهَا وَنَسِيَ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ إِنَّا جَعَلْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَنْ يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا وَإِنْ تَدْعُهُمْ إِلَى الْهُدَى فَلَنْ يَهْتَدُوا إِذًا أَبَدًا ‘তার চাইতে অধিক যালেম আর কে আছে, যাকে তার প্রতিপালকের আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশ দেওয়া হয়, অতঃপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সে তার (মন্দ) কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়। আমরা তাদের হৃদয়সমূহের উপর আবরণ টেনে দিয়েছি, যেন তারা তা (কুরআন) বুঝতে না পারে এবং তাদের কানগুলোতে বধিরতা এনে দিয়েছি। যদি তুমি তাদেরকে সুপথের দিকে আহবান কর, তারা কখনই সুপথ পাবে না’ (কাহাফ ১৮/৫৭)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, গুনাহের কথা ভুলে যাওয়া ক্ষমাপ্রাপ্ত না হওয়ার কারণ। আমরা নিজেরা নিজেদের গুনাহের কথা ভুলে গেলেও আল্লাহ তা‘আলা রেকর্ড করে রাখেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا أَحْصَاهُ اللَّهُ وَنَسُوهُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ ‘যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে পুনরুত্থিত করবেন। অতঃপর তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন। আল্লাহ তাদের কর্মের হিসাব রেখেছেন। অথচ তারা তা ভুলে গেছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছুর উপরে সাক্ষী থাকেন’ (মুজাদালা ৫৮/০৬)। তিনি আরো বলেন, وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ওরাই হ’ল অবাধ্য’ (হাশর ৫৯/১৯)। অন্যত্র এসেছে, وَقِيلَ الْيَوْمَ نَنْسَاكُمْ كَمَا نَسِيتُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا وَمَأْوَاكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِنْ نَاصِرِينَ ‘আর সেদিন তাদের বলা হবে, আজ আমরা তোমাদের ভুলে গেলাম যেমন তোমরা এদিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিলে। আর তোমাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (জাছিয়া ৪৫/৩৪)।
৪. পরকালীন শাস্তির ভয় থাকা : গুনাহের কারণে জাহান্নামের ভয় থাকা গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যম। কারো মধ্যে যদি পরকাল, কবর বা জাহান্নামের ভয় থাকে তাহ’লে সে গুনাহে লিপ্তই হবে না। যেমন কাফেররা তাদের দাবী মানতে নবী বা রাসূলগণকে অনুরোধ জানালে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)- কে শিখিয়ে দেন- قُلْ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ ‘বলে দাও, আমি মহাদিবসের শাস্তিকে ভয় পাই, যদি আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হই’ (আন‘আম ৬/১৫)। আদম (আঃ)-এর বড় ছেলে কাবীল ছোট ছেলেকে হত্যা করতে চাইলে তিনি বলেন, لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ ‘যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যার জন্য হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৮)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ المُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ، وَإِنَّ الفَاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلَى أَنْفِهِ؛ فَقَالَ بِهِ هَكَذَا ‘মুমিন নিজের গুনাহকে (এত বড়) মনে করে যেন সে কোন পাহাড়ের নীচে বসে আছে, যা তার উপর ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অপরদিকে গুনাহ্গার ব্যক্তি নিজের গুনাহকে দেখে একটি মাছির মত, যা তার নাকের উপর বসল, আর তা সে হাত নাড়িয়ে তাড়িয়ে দিল’।[4] হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَعِزَّتِيْ لاَ أَجْمَعُ عَلَى عَبْدِيْ خَوْفَيْنِ وَأَمْنَيْنِ إِذَا خَافَنِيْ فِيْ الدُّنْيَا أَمَنْتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَإِذَا أَمِنَنِيْ فِيْ الدُّنْيَا أَخَفْتُهُ فِيْ الْآَخِرَةِ ‘আমার মর্যাদার কসম! আমি আমার বান্দার মাঝে দু’টি ভয় ও দু’টি নিরাপত্তা এক সাথে জমা করি না। যদি দুনিয়াতে আমাকে ভয় করে, আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন নিরাপত্তা দিব। আর যদি দুনিয়াতে আমার ব্যাপারে নিরাপদ থাকে, তাহ’লে আমি তাকে পরকালে ভীত-সন্ত্রস্ত করব’।[5]
৫. গুনাহ মিটানোর জন্য অধিক পরিমাণে সৎকর্ম করা : কোন মুমিনের দ্বারা গুনাহ সংঘটিত হলে সে সঙ্গে সঙ্গে নেকির কাজ করবে। যেমন হাদীছে এসেছে,عَنْ عُقْبَةَ بن عَامِرٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ مَثَلَ الَّذِي يَعْمَلُ السَّيِّئَاتِ، ثُمَّ يَعْمَلُ الْحَسَنَاتِ كَمَثَلِ رَجُلٍ كَانَتْ عَلَيْهِ دِرْعٌ ضَيِّقَةٌ قَدْ خَنَقَتْهُ ثُمَّ عَمِلَ حَسَنَةً فَانْفَكَّتْ حَلَقَةٌ ثُمَّ عَمِلَ أُخْرَى فَانْفَكَّتْ حَلَقَةٌ أُخْرَى حَتّٰـى يَخْرُجَ إِلَى الأَرْضِ- ‘উক্ববাহ বিন আমের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন পাপ করার পরপরই পুণ্যকর্ম করে, সেই ব্যক্তির উপমা এমন একজনের মত যার দেহে ছিল সংকীর্ণ বর্ম; যা তার শ্বাস রোধ করে ফেলেছিল। অতঃপর সে যখন একটি পুণ্যকর্ম করে, তখন বর্মের একটি আংটা খুলে যায়। তারপর আর একটি পুণ্য করলে আরও একটি আংটা খুলে যায়। ফলে সে সংকীর্ণতার কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে’।[6] আল্লাহ তা‘আলা আল কুরআনে বলেন, وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ ‘আর তুমি ছালাত কায়েম কর দিনের দুই প্রান্তে ও রাত্রির কিছু অংশে। নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ মন্দ কর্মসমূহকে বিদূরিত করে। আর এটি (অর্থাৎ কুরআন) হ’ল উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য (সর্বোত্তম) উপদেশ’ (হূদ ১১/১১৪)।
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رضي الله عنه أَنَّ رَجُلًا أَصَابَ مِنَ امْرَأَةٍ قُبْلَةً فَأَتَى النَّبِي صلى الله عليه وسلم فَأَخْبَرَهُ فَأَنْزَلَ اللَّهُ ﴿وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ﴾ فَقَالَ الرَّجُلُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَلِي هَذَا؟ قَالَ: لِجَمِيعِ أُمَّتِي كُلِّهِمْ-
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি এক মহিলাকে চুমা দিয়ে ফেলে। পরে সে নবী (ছাঃ)-এর নিকট এসে বিষয়টি জানায়। তখন আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেন, দিনের দু’প্রান্ত সকাল ও সন্ধ্যায় এবং রাতের প্রথম ভাগে নামায কায়েম কর। নিশ্চয়ই পুণ্যরাশি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়। লোকটি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! এ কি শুধু আমার জন্য? তিনি বললেন, না, এটা আমার সকল উম্মতের জন্য’।[7]
আল্লাহ বলেন, إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا ‘তবে তারা ব্যতীত, যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে। আল্লাহ তাদের পাপসমূহকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’ (ফুরক্বান ২৫/৭০)। হাদীছে এসেছে- আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেন,اتَّقِ اللَّهِ حَيْثُمَا كُنْتَ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ- ‘তুমি যেখানেই থাক আল্লাহ্কে ভয় কর, পাপ করলে সাথে সাথে পুণ্যও কর; যাতে পাপ মোচন হয়ে যায় এবং মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার কর’।[8] আর সৎকর্মগুলোর মধ্যে যেগুলো প্রথমেই রয়েছে সেগুলো হ’ল :
(ক) ছালাত হেফাযত করা : মুমিনের গুনাহ হয়ে গেলে অধিক পরিমাণে ভাল কাজ করবে। আর ভালো কাজগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হ’ল ছালাত আদায় করা। আল্লাহ বলেন, وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ‘নিশ্চয়ই ছালাত যাবতীয় অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম হ’তে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই হ’ল সবচেয়ে বড় বস্ত্ত। আল্লাহ জানেন যা কিছু তোমরা করে থাক’ (আনকাবুত ২৯/৪৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا مِنَ امْرِئٍ مُسْلِمٍ تَحْضُرُهُ صَلَاةٌ مَكْتُوبَةٌ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهَا وَخُشُوعَهَا وَرُكُوعَهَا، إِلَّا كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا قَبْلَهَا مِنَ الذُّنُوبِ مَا لَمْ يُؤْتِ كَبِيرَةً وَذَلِكَ الدَّهْرَ كُلَّهُ ‘যে মুসলিম ফরয ছালাতের সময় হলে উত্তমভাবে ওযূ করে, বিনয় ও ভয় সহকারে রুকূ করে ছালাত আদায় করে, সেটা তার ছালাতের পূর্বের গুনাহের কাফ্ফারাহ (প্রায়শ্চিত্ত) হয়ে যায়, যতক্ষণ না সে কবীরা গুনাহ করে থাকে। আর এভাবে সর্বদাই চলতে থাকবে’।[9]
অন্য হাদীছে এসেছে, তিনি বলেন, أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهْرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ، هَلْ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ؟ قَالُوا: لَا يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ، قَالَ: فَذَلِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللهُ بِهِنَّ الْخَطَايَا ‘আচ্ছা তোমরা বল তো, যদি কারোর বাড়ির দরজার সামনে একটি নদী থাকে, যাতে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তাহ’লে তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে কি? ছাহাবীরা বললেন, (না) কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের উদাহরণও সেইরূপ। এর দ্বারা আল্লাহ পাপরাশি নিশ্চিহ্ন করে দেন’।[10]
(খ) অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার পাঠ করা : মুমিন পাপে জড়িয়ে পড়লে অনুতপ্ত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইস্তিগফার শুরু করে দিবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَحِيمًا ‘যে কেউ মন্দকর্ম করে অথবা স্বীয় জীবনের প্রতি অবিচার করে, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয়, সে আল্লাহ্কে ক্ষমাশীল ও দয়ালু হিসাবে পাবে’ (নিসা ৪/১১০)। হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا عِبَادِي إِنَّكُمْ تُخْطِئُونَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ، وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا، فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ، ‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা রাত ও দিনে ভুল কর, আমি তোমাদের সকল পাপ মোচন করি, অতএব আমার নিকট ক্ষমা চাও আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করব’।[11]
হাদীছে কুদসীতে আরও এসেছে, يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلَا أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ، وَلَا أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لَا تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً ‘হে আদম সন্তান! তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকবে এবং ক্ষমার আশা রাখবে, আমি ততক্ষণ তোমাকে ক্ষমা করব। তোমার অবস্থা যা-ই হোক না কেন, আমি কোন পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে থাকে অতঃপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, আমি কোন পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার কাছে উপস্থিত হও এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে থাক, তাহ’লে আমি পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার নিকট উপস্থিত হব’।[12]
(গ) হজ্জের সাথে ওমরা পালন করা : হজ্জের সাথে ওমরা পালন করলে গুনাহসমূহ দূর হয়ে যায়। যেমন হাদীছে এসেছে, تَابِعُوا بَيْنَ الحَجِّ وَالعُمْرَةِ، فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الكِيرُ خَبَثَ الحَدِيدِ، وَالذَّهَبِ، وَالفِضَّةِ، وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ المَبْرُورَةِ ثَوَابٌ إِلَّا الجَنَّةُ ‘তোমরা ধারাবাহিক হজ্জ ও উমরা আদায় করতে থাক। এ দু’টি আমল দারিদ্র ও গুনাহ বিদূরিত করে দেয়। যেমন ভাটার আগুনে লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা-জং দূরীভূত হয়ে থাকে। একটি কবুল হজ্জের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়’।[13]
(ঘ) মাঝে মধ্যে ওমরা পালন করা : এক ওমরা হ’তে আরেক ওমরার মধ্যবর্তী গুনাহ ক্ষমা হয়ে যায়। এজন্য অর্থ থাকলে এবং সুযোগ হ’লে ওমরা পালনে ব্রতী হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا ، وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ ‘এক ওমরাহর পর আর এক ওমরাহ, উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের (গুনাহের) জন্য কাফফারা। আর জান্নাতই হ’ল হজ্জে মাবরূরের প্রতিদান’।[14]
(ঙ) ছাদাকা করা : মুমিনের গুনাহ হয়ে গেলে ক্ষমা পাওয়ার আশায় সে অধিক পরিমাণে ছাদাকা করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَلَا أَدُلُّكَ عَلَى أَبْوَابِ الخَيْرِ: الصَّوْمُ جُنَّةٌ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ المَاءُ النَّارَ، ‘আমি কি তোমাকে কল্যাণের দ্বারসমূহ বলে দেব না? ছাওম ঢালস্বরূপ, ছাদাক্বাহ গুনাহ নিশ্চিহ্ন করে; যেমন পানি আগুনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়’।[15]
উপসংহার : আল্লাহ তা‘আলা নিজ নামের সাথে গাফ্ফার তথা অধিক ক্ষমাশীল গুণবাচক নামটি চয়ন করেছেন। যার মাধ্যমে মানুষকে তার ক্ষমাশীলতার বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। মুমিন গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যেমন সালাফে ছালেহীন তথা আমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলগণের অবস্থা ছিল। কারো ব্যক্তিগত জীবনে কোন পাপ সংঘটিত হয়ে গেলে তা বন্ধু-বান্ধবের সামনে প্রকাশ না করে কেবল আল্লাহর সামনে প্রকাশ করে ক্ষমা চাইবে। আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাকে ক্ষমা করার আশ্বাস দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের যাবতীয় পাপ কর্ম থেকে হেফাযতে থাকার তাওফীক দান করুন এবং পাপ সংঘটিত হয়ে গেলে সালাফদের অনুসরণ করে তওবা করে দুনিয়ায় গুনাহ মুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিন।-আমীন!
লেখক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
[1]. মুসলিম হা/৫৩৭; মিশকাত হা/৩৩০৯।
[2]. বুখারী হা/২৪৪১; ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৯৪।
[3]. আবুল কাসেম খাতলী, আদ-দীবাজ হা/০৯; ইমাম আহমাদ, আয-যুহুদ হা/৯৬৬, সনদ হাসান।
[4]. বুখারী হা/৬৩০৮; মিশকাত হা/২৩৫৮।
[5]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৪০; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩৭৬; ছহীহাহ হা/২৬৬৬।
[6]. আহমাদ হা/১৭৩৪৫; ছহীহাহ হা/২৮৫৪।
[7]. বুখারী হা/৫২৬; মিশকাত হা/৫৬৬।
[8]. তিরমিযী হা/১৯৮৭; মিশকাত হা/৫০৮৩।
[9]. মুসলিম হা/২২৮; মিশকাত হা/২৮৬।
[10]. মুসলিম হা/৬৬৭; মিশকাত হা/৫৬৫।
[11]. মুসলিম হা/২৫৭৭; মিশকাত হা/২৩২৬।
[12]. তিরমিযী হা/৩৫৪০; মিশকাত হা/২৩৩৬; ছহীহাহ হা/১২৭।
[13]. তিরমিযী হা/৮১০; মিশকাত হা/২৫২৪; ছহীহাহ হা/১১৮৫।
[14]. বুখারী হা/১৭৭৩; মিশকাত হা/২৫০৮।
[15]. তিরমিযী হা/৬১৪; মিশকাত হা/২৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৫১৩৬।