আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ) প্রদত্ত্ব ভাষণ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শী 320 বার পঠিত
সাধারণতঃ মনে করা হয়, ডক্টর মুহাম্মদ ইকবাল সর্বপ্রথম ভারত-উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করিয়াছিলেন আর তাঁহার কল্পলোকের চিত্রকে বাস্তব মানচিত্রে পরিণত করিয়াছেন কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাক-ভারত উপমহাদেশের বিংশ শতকের ইতিহাস আমাদিগকে উপরিউক্ত সন্ধানই দিয়া থাকে। কিন্তু এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মাত্র পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় আর অর্ধশতাব্দীকালের পূর্ববতী যুগগুলিতে মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক জীবন কোন সময়েই আড়ষ্ট ও নিস্পন্দ হইয়া যায় নাই।
পাকভারতের মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত হইয়াছিল পলাশীযুদ্ধের অব্যবহিতকাল পর হইতেই। ভারতের ইতিহাস বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভংগী লইয়া রচিত হইয়াছে, কিন্তু জানিনা একথা কয়জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে যে, পলাশীর পর ক্লাইভের মুষ্টিমেয় সেনাবাহিনী যখন মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করিতেছিল, ঠিক সেই সময়ে বালাজীরাও এর জ্ঞাতিভ্রাতা সদাশিব রাও ভাও ১৩ লক্ষ সৈন্য সমভিব্যাহারে দিল্লী অধিকার করিয়া লইয়াছিল। আজ চেয়ারে ঠেশ দিয়া বসিয়া এরূপ নিষ্ঠুর অবাস্তব উক্তি উচ্চারণ করা অত্যন্ত সহজ যে, মুসলমানরা অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ হইতে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত রাজনৈতিক মুক্তি আন্দোলনে কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ করে নাই। আমাদের জাতীয় জীবনের দেড়শত বংসরের ইতিহাস দূর্ভাগ্যবশতঃ আজ পর্যন্ত স্বাধীন দৃষ্টিভংঙ্গী সহকারে আর নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক পদ্ধতির অনুসরণে লিখিত হয় নাই বলিয়াই এক শ্রেণীর উচ্ছিষ্ট ভোজী ও গতানুগতিকতার অনুসারী ব্যক্তিরা এরূপ দায়িত্বহীন অভিমত প্রকাশ করার সুযোগ লাভ করিয়াছে। ১৭৫৭-৫৮ সনে সমগ্র পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ যে প্রলয়কান্ডের সম্মুখীন হইয়াছিল আর তাহাদের নেতৃবর্গ জাতির অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখার জন্য তখন যেসকল উপায় অবলম্ব^ন করিয়াছিলেন, পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করার পক্ষে তাহা অবগত হওয়া আবশ্যক।
১৭৩৯ সনে নাদির শাহের আক্রমণের ফলে মুগল সাম্রাজ্যের দেহ প্রাণহীন হইয়া পড়িয়াছিল। বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্ণররা কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া ফেলিয়াছিলেন। অযোধ্যায় সাআদত আলী খান, বাঙলায় আলীওয়ার্দী খান, দাক্ষিণাত্যে নিযাম স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছিলেন। পাঞ্জাবে শিখদের প্রতিপত্তি দিনদিন বাড়িয়া চলিয়াছিল। পশ্চিম দক্ষিণ অঞ্চলসমূহে মারহাট্টারা শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিল। বাঙলা বিহার ও উড়িষ্যার এই মারহাট্টা বর্গীদুস্যদের উপদ্রবের কাহিনী শিশুদের ঘুমপাড়ানো ছড়াতেও স্থান লাভ করিয়াছে :
‘‘ছেলে ঘুমোলো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এল দেশে,
টুনটুনিতে ধান খেয়েছে খাজ্না দেব কিসে?’’
দিল্লীতে ইরানী, তুরানী জাতীয়তার কলহ চরম সীমায় উপনীত হইয়াছিল। হতভাগ্য উমারার দল পরস্পরকে পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে মারহাট্টাদের শরণাপন্ন হইত। ক্রমে ক্রমে মারহাট্টাদের প্রভাব দিল্লীর উপকণ্ঠ পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল। সপ্তদশ শতকের শেষভাগ হইতে মারহাট্টাদের উত্থান আরম্ভ^ হয়। পুনা, সাট্টারা, কোলহাপুর, গোয়ালিয়র, নাগপুর, গুজরাট ও ইন্দোরে তাহারা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী রাজত্ব স্থাপন করে। ১৬৪৮ খৃষ্টাব্দে শাহজীর পুত্র শিবাজী মুগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া প্রকাশ্যে লুটতারাজ আরম্ভ করিয়া দেয় আর ১৬৫৯ সনে বিশ্বাসঘাতকতার সহিত মুগল সেনাপতি আফযল খানকে হত্যা করে। শিবাজী মৃত্যুকাল পর্যন্ত (১৬৮০ খৃঃ) মুঘল ও বিজাপুর রাজ্যের অনেকগুলি দুর্গ জয় করিয়া লয় আর মারহাট্টাদের এক বিশাল রাজত্ব গঠন করে।
শিবাজীর পৌত্র শাহুজীকে সম্রাট আলমগীর নযরবন্দী করিয়া রাখিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার ওফাতের সঙ্গে সঙ্গেই (১৭০৭ খৃঃ) তদীয় পুত্র বাহাদুর শাহ শাহুকে মুক্ত করিয়া দেন। বালাজী বিশ্বনাথের সাহায্যে শাহু শিবাজীর উত্তরাধিকারী হয়।
তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন ব্রাহ্মণ-সন্ততান বালাজী ‘পেশওয়া’ রাজবংশের স্রষ্টা। তদীয় পুত্র বাজীরাও ১৭৩১ সনে গুজরাটে ‘গায়কোয়ার’ রাজবংশ স্থাপিত করে। তাহার সেনাপতিগণের মধ্যে হোলকার, সিন্ধিয়া ও ভোঁসলা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইহারা কর্ণাটক ও ত্রিচিনাপল্লী হস্তগত করে আর ১৭১১ খৃষ্টাব্দে মুগল-সাম্রাজ্যের উত্তরাংশ দখল করিয়া লয়। ১৭৩৭ সনে তাহারা গয়া, মথুরা, কাশী ও এলাহাবাদ অধিকার করে।
১৭৪০ সনে শাহু নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হইলে বাজীরাও-এর পুত্র বালাজীরাও শাহুর স্থানে উপবেশন করে। তাহার ভ্রাতা রঘুনাথ বা রাঘবারাও ও রাওহোলকার উত্তরাঞ্চলে মারহাট্টা রাজ্য প্রসারিত করার জন্য ব্রতী হয় এবং জাঠদের[1] সাহায্য গ্রহণ করিয়া ১৭৫৮ সনে দিল্লি আক্রমণ করিয়া বসে। নজীবুদ্দওয়ালা[2] নিরুপায় অবস্থা মারহাট্টাদের সহিত তখনকার মত সন্ধি স্থাপন করিতে বাধ্য হয়। এই সনে তাহারা লাহোর দখল করিয়া লয়। দাতাজী সিন্ধীয়া পাঞ্জাব অধিকার করিয়া সতাজী সিন্ধীয়াকে গভর্ণর নিযুক্ত করে অতঃপর মারহাট্টারা রোহিলখন্ড আক্রমণ করিতে উদ্যত হয়। বালাজীর জ্ঞাতিভ্রাতা সদাশিব রাও ভাও ৩ লক্ষ সৈন্য সমভিব্যাবহারে দিল্লী অধিকার করে। এই সদাশিবের দিল্লী লুণ্ঠনের যে বিবরণ ইতিহাসে স্থানলাভ করিয়াছে শুজাউদ্দওলার মুখ হইতে তাহা শ্রবণ করা উচিত।
مردم از دست شان بجان آمده برای پاس ناموس و آبری خود...
‘জনসাধারন মারহাট্টাদের পাশবিক অত্যাচারে ওষ্ঠাগত প্রাণ হইয়া পড়িয়াছিল’।[3] সিয়ারুল মুতাআখ্খেরীনে কথিত হইয়াছে,
دناءت و تنگ چشمی بہ او باین مرتبه بود که سقف دیوان خاص را که از نقره میناکار بود کنده مسکوک ساخت وآلات طلا و نقره مزار اقدام نبوى ومقبره نظام الدين اولياء و مرقد محمدشاه مثل عود سوز وشمع دان وقناديل وغيره طلبیده مسکوک نمود-
‘‘বাহাও এরূপ পিশাচ ও অর্থগৃধণু ছিল যে, দিল্লীর ‘‘দিওয়ানে খাসের’’ ছাতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মন্ডিত যে সকল কারুকার্য ছিল সেগুলি উপড়াইয়া আর ‘‘কদমে রসূল’’ নিজামুদ্দীন আওলিয়া ও মুহাম্মদ শাহ প্রভৃতি রাজপুরুষ ও সাধুসজ্জনদের সমাধিতে যেসকল স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈজসপত্র শামাদান, ঝাড়, ফানুস আর সুগন্ধি জ্বালাইবার পাত্র ছিল, সমস্তই গলাইয়া লইয়াছিল’’ (১১২ পৃ.)। শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস বলিয়াছেন, প্রথমে নাদির শাহ পরে মারহাট্টা ও জাঠদের বিরামহীন লুণ্ঠন, শোষণ আর অত্যাচার ও পীড়নের ফলে শেষ পর্যন্ত দিল্লীর নাগরিকরা স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদের লইয়া জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে ঝাপাইয়া পড়িয়া ভস্মীভূত হইবার সংকল্প করিয়াছিল।[4]
ভারতের রাষ্ট্রীয় পতনযুগের এই নিদারুণ সন্ধিক্ষণে দিল্লীর মুগলসাম্রাজ্য যখন বালকদের হস্তের ক্রীড়নকে পরিণত হইয়াছিল, ঘরে-বাহিরে সর্বত্র স্বার্থলোলুপতার ষড়ষন্ত্র জাল বিস্তার হইয়া পড়িয়াছিল, জনগণের মধ্যে নৈরাশ্য ও মানসিক দীনতা গোটা সমাজকে স্থবির ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করিয়া ফেলিয়াছিল, শাসকগোষ্ঠী বিলাসব্যসনে ও আমোদ-প্রমোদে আকণ্ঠ ডুবিয়া কাপুরুষতার চরমসীমায় উপস্থিত হইয়াছিল, আমীর-উমারা ও সেনানায়করা দলাদলির বিষ ছড়াইয়া রাজ প্রসাদ হইতে রাস্তাঘাট পর্যন্ত কলুষিত করিয়া তুলিয়াছিল, সামরিক বাহিনী বিশৃংখল ও বিশ্বাসঘাতক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল। অপদার্থ বাদশাহরা শত্রুদের প্রতিরোধ করিতে অক্ষম হইয়া টাকার বিনিময়ে তাহাদের নিকট হইতে সন্ধি ক্রয় করিতে বাধ্য হইতেছিল, ঠিক সেই সময়ে দিল্লীর এক মহাপ্রজ্ঞাবান আলিম, যিনি সচরাচর একজন মুহাদ্দিস, সুফী ও সমাজ সংস্কারকরূপে আখ্যাত হইয়া থাকেন, জাতির রক্ষাকল্পে আর মুসলমানদের রাজ্যকে মারাঠা, জাঠ ও শিখ আততায়ী দস্যুদের কবল হইতে পুনরুদ্ধার করার উদ্দেশ্যে আগাইয়া আসিয়াছিলেন।
তিনি সেই সংকট মুহূর্তে যে অতুলনীয় ও কুশাগ্র রাজনৈতিক প্রতিভার পরিচয় দিয়াছিলেন, আযাদ পাকিস্তানের নাগরিকদের পক্ষে তাহার কথা বিস্মৃত হওয়া অমার্জনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। পাকিস্তানের যে প্রথম মহান নেতার কথা আমরা বলিতে চাই, তিনি হইলেন ভূবনবিখ্যাত বিদ্বান, মহাযশস্বী দার্শনিক, মুহাদ্দিস ও অর্থনীতিবিশারদ শাহ ওলীউল্লাহ দেহলভী (রহঃ)। আমরা তৎকালীন ধর্মীয় ও নৈতিক পতনের কাহিনী এবং এ বিষয়ে হযরত শাহ সাহেবের সংস্কার আন্দোলনের বিবরণ এই নিবন্ধে আলোচনা করিব না। শুধু তাঁহার রাজনৈতিক তৎপরতার কিঞ্চিৎ পরিচয় প্রদান করিয়াই ক্ষান্ত হইব।
মুগলগৌরব সম্রাট আলমগীর ১৭০৭ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার ওফাতের ৫ বৎসর পূর্বে অর্থাৎ ১৭০৩ খৃষ্টাব্দে (১১১৩ হিঃ) শাহ ওলীউল্লাহ জন্মগ্রহণ করিয়া শাহ আলম বাদশাহর রাজত্বের ৭ম বর্ষে আর পলাশীযুদ্ধের ৮ বৎসর পর ১৭৬৫ সনে জান্নাতবাসী হন। শাহ সাহেব তাঁহার জীবদ্দশায় দিল্লীর সিংহাসনে বার জন বাদশাহকে উপবেশন করিতে দেখিয়াছিলেন। যথা- আলমগীর, বাহাদুর শাহ, জাঁহাদার শাহ, ফররুখসিয়র, নেকোসিয়র, রফীউদ্দরজাত, মুহাম্মদ শাহ, মুহাম্মদ ইব্রাহীম, আহমদ শাহ, দ্বিতীয় আলমগীর ও শাহ আলম। মোটের উপর শাহ সাহেব মুগল সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা গৌরবান্বিত ও সর্বাপেক্ষা অধঃপতিত যুগদ্বয়ের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেলষণের সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। মুগল সাম্রাজ্যের পতন ও সামাজিক দুরাবস্থার তিনি ভিন্ন ভিন্ন কারণ নিরূপিত করিয়াছেন। ধর্মীয় মতবাদ ও আচারব্যবহারে মুসলমানদের অবহেলা আর ধর্মীয় শিক্ষার অভাবকে তিনি সামাজিক দুরাবস্তার মূল কারণ আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে মুগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তিনি দায়ী স্থির করিয়াছিলেন। এসকল বিষয়ে তিনি তাহার জগতবরেণ্য ‘‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’’ ‘‘তাফহীমাতে ইলাহিয়া’’ প্রভৃতি গ্রন্থে পুংখানুপুংখ আলোচনা করিয়াছেন।
তিনি ‘‘হুজ্জাতুল্লাহ’’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, ‘‘দেশের বর্তমান র্দুগতি ও অধঃপতনের প্রধান কারণ দুইটি : প্রথমতঃ রাষ্ট্রের কোষাগারে অর্থের অভাব। লোকদের বিনা পরিশ্রমে সৈন্য বা বিদ্বান হইবার দাবীতে সরকারী কোষাগার হইতে অর্থসংগ্রহ করার অভ্যাস। বাদশাহদের অনর্থক পুরস্কার ও বৃত্তি দেওয়ার রীতি; সুফী, দরবেশ ও কবিদের ওযীফা। রাষ্ট্রের কোন সেবা না করিয়াই ইহারা সরকারী কোষাগার হইতে জীবিকা সংগ্রহ করিয়া থাকে। এই শ্রেণীটি নিজেদের আর অন্যদের উপার্জনের পথ সংকুচিত করিয়া ফেলিয়াছে। আর দেশবাসীর ঘাড়ে বোঝা হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
‘‘দ্বিতীয় কারণ, কৃষিজীবী, শিল্পী আর ব্যবসায়ীদের উপর গুরুভার ট্যাক্স আরোপ আর কঠোর উপায়ে সেই ট্যাক্স আদায়ের ব্যবস্থা। ইহার ফলে যাহারা রাষ্ট্রের অনুগত প্রজা, তাহারা সরকারী নির্দেশ পালন করিতে গিয়া সর্বস্বান্ত হইতেছে আর অবাধ্য বাকীদাররা অধিকতর অবাধ্য হইয়া পড়িতেছে আর বাকীর পরিমাণও বাড়িয়া চলিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে দেশের সুখশান্তি আর রাষ্ট্রের শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে হালকা ট্যাক্স-ব্যবস্থার উপর, আর যে পরিমাণ সৈন্য ও সরকারী র্কমচারী না রাখিলে নয়, কেবল সেই পরিমাণ সৈন্য ও সরকারী কর্মচারী নিয়োগ-ব্যবস্থার উপর। রাজনৈতিক নেতাদের এই বিষয়গুলি উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করা উচিত।’’ (৪৪ পৃষ্ঠা)।
শাহ সাহেব মুগল সাম্রাজ্যের পতনের ৫টি কারণ নির্ণয় করিয়াছিলেন। ১. সরকারি ভূমির অপর্যাপ্ততা; ২. রাজস্বের স্বল্পতা; ৩. জায়গীরদারদের প্রাচুর্য; ৪. ইজারাদারির কুফল; ৫. সৈন্যদের প্রাপ্য নিয়মিতভাবে পরিশোধ না করা। মুগল রাজত্বের পতনের যেসব কারণ দিল্লীর রহীমিয়া মাদরাসার উস্তায নির্ণয় করিয়াছিলেন, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের অর্থবিশারদরা আজ দুইশত বৎসর পরও সেগুলির কোন একটি দফারও সংশোধন করিতে পারেন নাই। জাতীয় উত্থান ও পতনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করিতে গিয়া শাহ সাহেব তাঁহার অমর গ্রন্থে যে বিস্তারিত ও বিস্ময়কর মন্তব্য করিয়াছেন, তাহার সংক্ষিপ্ত সার এই যে, ‘‘কোন জাতির তমুদ্দনিক প্রগতি অবিচলিত থাকিলে তাহাদের শিল্প আর কারিগরীও উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিতে বাধ্য। কিন্তু শাসকগোষ্ঠি সুখ সম্ভোগ, বিলাসপরায়ণতা আর বাহবড়ম্বরে অভ্যস্ত হইয়া পড়িলে তাহাদের সমস্ত বোঝা শিল্পী, কৃষক আর কারিগরদের স্কন্ধেই পতিত হয়। ইহার ফলে সমাজের বৃহত্তর দল পশুর মত জীবনযাপন করিতে বাধ্য হইয়া থাকে। জনগণকে অর্থনৈতিক সংকটে যবরদস্তীভাবে নিক্ষেপ করিলে তাহারা গরু-গাধার মত কেবল রুটি উপার্জনের জন্যই পরিশ্রম করিতে থাকিবে। দেশবাসী এরূপ দুরবস্থার সম্মুখীন হইলে তাহাদের উদ্ধারকল্পে আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান সমাজের স্কন্ধ হইতে এই অবৈধ শাসনের বোঝা অপসারিত করার জন্য বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করিয়া দেয়’’ (হুজ্জাতুল্লাহ ২০৮ ও ২৯২ পৃ:)।
শাহ ওলীউল্লাহর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতবাদে এক বিরাট বাহিনী তাঁহার জীবদ্দশাতেই দীক্ষিত হইয়াছিল। শাহ আলম বাদশাহকে তিনি যে সুদীর্ঘ পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতেও তাহার গঠনমূলক পরিকল্পনাগুলির সুসম্পন্ন ইংগিত রহিয়াছে। শাহ সাহেব মুগল শাসকগোষ্ঠির প্রতি কোনদিন শ্রদ্ধাশীল ছিলেননা। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, অনতিকাল মধ্যেই মুগল সাম্রাজ্য উপমহাদেশ হইতে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে। কিন্তু মুগলদের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে মুসলমানদের অস্তিত্বও চিরতরে নির্মূল হইয়া যাউক আর ভারত উপমহাদেশে হিন্দু, জাঠ, মারাঠা আর শিখদের রাজত্ব স্থাপিত হউক, ইসলামি তমদ্দুন, মতবাদ আর ধর্ম ভারতের বুক হইতে নির্বাসিত হইয়া পড়ুক, জাতির এই মহান নেতা তাহা বরদাশত করিতে প্রস্ত্তত ছিলেন না। মুগল বাদশাহ শাহ আলমকে তিনি পুনঃপুনঃ হুঁশিয়ার করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার বিরুদ্ধে তিনি উত্থান করেন নাই। কারণ তাহাতে বিভ্রাটের মাত্রাই শুধু বর্ধিত হইতনা, ইহার ফলে শত্রুপক্ষরাও সুবিধা ও প্রশ্রয় লাভ করিত। তাহারা শুধু মুগলদের বিরুদ্ধেই সমরসজ্জা করিয়া ক্ষান্ত থাকে নাই, পাঞ্জাবের শিখরা সমুদয় মুসলমানের সহিত যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছিল। আততায়ীদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত দিল্লীর নিরপরাধ আবালবৃদ্ধবনিতার করুণ ক্রন্দনে শাহ সাহেব অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িয়া ছিলেন বটে, কিন্তু দিশাহারা হন নাই। তাই সকল কাজ পরিহার করিয়া তিনি সর্বাগ্রে দৃঢ়হস্তেত মারহাট্টা আততায়ীদের দমন করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন ।
পূর্বেই বলা হইয়াছে, শাহ সাহেব বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন, মারহাট্টাদিগকে বিতাড়িত আর দেশকে তাহাদের প্রভাব হইতে মুক্ত করা মুগল বাদশাহদের সাধ্যায়ত নয়। দেশের ভিতরেও এই দুঃসাধ্য কার্য সমাধা করার যোগ্য কোন শক্তিমান পুরুষ ছিলনা। মুগল উমারা আর সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করারও কোন উপায় ছিলনা। এইরূপ সংগীন পরিস্থিতিতেও শাহ ওলীউল্লাহ দমিয়া না গিয়া মারহাট্টা ও জাঠদের বিরুদ্ধে জনমত কেন্দ্রীভূত করার জন্য তাঁহার ছাত্র ও ভক্ত-অনুরক্তগণের শক্তিশালী একটি জোট গঠন করিয়া ফেলিলেন। ইহাদের মধ্যে নওয়াব নজীবুদ্দওলা, সাআদুল্লাহ খান, হাফেয রহমতুল্লাহ, আহমদ খান বঙ্গশ, নওয়াব মজদুদ্দওলা, মওলানা সৈয়দ আহমদ, ছন্দী খান, নজীব খান, সৈয়দ মা‘সূম, আবদুস্সত্তার খান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইহাদের মধ্যে নওয়াব নজীবুদ্দওলা সম্বন্ধে ডক্টর যদুনাথ সরকার মন্তব্য করিয়াছেন, স্বয়ং আহমদ শাহ আব্দালী ছাড়া সে যুগে নজীবুদ্দওলার সমকক্ষ কেহই ছিলনা। He had no equal in that age except Ahmad Shah Abdali (Fall of the Mughal Emp Vol, ii P.P 4/5)। শাহ সাহেবের নির্দেশ ও উৎসাহ ক্রমেই এই নজীবুদ্দওলা দিল্লীতে সর্বপ্রথম রঘুনাথরাও এর প্রতিরোধ করিয়াছিলেন। শাহ সাহেবের সহচরবৃন্দের বিস্তৃত পরিচয়ের জন্য একখানা স্বতন্ত্র গ্রন্থ সংকলিত হওয়া আবশ্যক। -(ক্রমশঃ)
[1]. Tod তাঁর ‘‘রাজস্থানের ইতিহাসে’’ জাঠদিগকে ডেনমার্কের পুরাতন অধিবাসী Getoe দের বংশধর বলিয়া অনুমান করিয়াছেন। ভারতবর্ষে আসিয়া ইহারা প্রথমে যমুনার তীরে বসবাস করিত এবং কৃষিকার্য করিয়া জীবিকার্জন করিত। যদুনাথ সরকার আওরাংযীবের ইতিহাসে লিখিয়াছেন, উত্তর ভারত হইতে সম্রাটের অনুপস্থিতির সর্বপ্রথম সুযোগ জাঠরাই গ্রহণ- করিয়াছিল। তাহারা সেনাবাহিনী গঠন করিয়া মুগল ফওজের মুকাবিলা শুরু করিয়া দেয়। প্রত্যেকজন জাঠ বাধ্যতামুলকভাবে অসিচালনা শিক্ষা করে ও তাহাদের মধ্যে বন্দুক বিতরণ করা হয়। আক্রমণ আর লুটের মাল সুরক্ষিত করার জন্য নিবিড় জঙ্গলে তাহারা মাটির বহু দুর্গ নির্মাণ করে। এই মাটির দুর্গগুলি গড় নামে কথিত হইত আর সেগুলি তোপের প্রতিরোধ করিতে পারিত। মুগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের সময়ে জাঠদের নেতা চুড়ামন অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে পরাক্রান্ত হইয়া উঠে। তাহার পৌত্র সুরজমল দীগ ও কুন্তেরের দুর্গ নির্মাণ করে এবং ভরতপুর রাজধানী রূপে নির্বাচিত হয়। এই পুরলমলই ৩০ হাজার জাঠ সৈন্য লইয়া আহমদ শাহ আব্দালীর বিরুদ্ধে মারহাট্টাদের পক্ষাবলম্বন করিয়াছিল। (History of Indie H. Beveridge III P. P. 784 & Histroy of Aurangzib V.P.P. ২৯৬-৯৭).
[2]. পেশোয়ারের ২৫ ক্রোশ দূরে মন্রী গ্রামে ১৭০৭ খৃষ্টাব্দে নজীবুদ্দওলা জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। জীবিকার সন্ধানে ১৭৪৩ সনে আওলায় আসিয়া আলী মুহাম্মদ খানের অধীনে দ্বাদশ অশ্বারোহীর কাপ্তেন নিযুক্ত হন এবং দ্রুত উন্নতিলাভ করিয়া কয়েকশত অশ্বারোহীর নায়ক পদ লাভ করেন। সম্রাট কর্তৃক আলী মুহাম্মদ খান সরহিন্দের শাসনকর্তা নিযুক্ত হইলে নজীবুদ্দওলা তাঁহার অনুসরণ করেন। এই সময়ে তাঁহার কর্মকুশলতা ও যোগ্যতা সর্বজনবিদিত হইয়া পড়ে। প্রত্যাবর্তন করার পর তাঁহার শ্বশুর ছন্দেখান জামাতাকে চাঁদপুর, নগীনা ও বিজনোর প্রভৃতি অঞ্চল সমর্পণ করেন। সফ্দরজং আর মারহাট্টারা মিলিতভাবে আফগানদের উপর চড়াও করিলে নজীব অশেষ বীরত্বের পরিচয় দেন এবং হাফিয রহমতুল্লাহ তাঁহাকে সহস্র অশ্বারোহীর অধিনায়কত্ব সমর্পণ করেন। ১৭৫৩ সনে সফদর জঙ্গের বিরুদ্ধে তিনি ১ হাজার সৈন্য সমভিব্যাহারে বাদশাহর সমর্থনে দিল্লী যাত্রা করেন এবং পথিমধ্যে প্রায় ১০ হাজার রোহিলা সৈন্য তাঁহার অনুগামী হয়। দিল্লীর সম্রাট তাঁহাকে ‘‘নজীবুদ্দওলা’’ খেতাব দেন আর পাঁচহাজারী মনসবদারের পদ অর্পণ করেন। সফদর জঙ্গের সহিত যুদ্ধে তিনি যে বিক্রম ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহার বিনিময়ে সম্রাট নজীবের বাহিনীর বেতন বাবত তাঁহাকে নদীর মধ্যবর্তী ইলাকা দান করেন। চারমাস পর নজীবুদ্দওলা দিল্লী হইতে ফিরিয়া আসিলে তাঁহার অবস্থা সম্পূর্ণ বদলাইয়া যায়। মুগল দরবারের সহিত তাঁহার সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দেখিতে দেখিতে রাজধানীর সকল প্রকার রাজনীতির তিনি কর্ণধারে পরিণত হন। ১৭৬১ হইতে ১৭৭০ পর্যন্ত তিনি দিল্লীর বিশিষ্টতম পুরুষ ছিলেন।
প্রচলিত শিক্ষার দিক দিয়া নজীব উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু কঠোর অধ্যবসায়, বিশ্বস্ততা আর অভিজ্ঞতা দ্বারা মানুষ যে শিক্ষালাভ করিয়া থাকে, সেদিক দিয়া তাঁহার কেহ জুড়ি ছিল না। ইহার পর ১৭৫৩ সন হইতে হযরত শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর সাহচর্য সোনায় সোহাগার মত তাঁহার মধ্যে স্বজাতিবাৎসল্য ও ধর্মপরায়ণতার অপূর্ব সমাবেশ ঘটাইয়া দেয়। সলজোকীরা আববাসী খিলাফত রক্ষা করার জন্য যাহা করিয়াছিল, তাঁহার নেতৃত্বে রোহিলারাও মুগল সাম্রাজ্যের রক্ষাকল্পে ঠিক তাহাই করিয়াছিল।
নজীবুদ্দওলা কর্তৃক ৯শত বিদ্বান প্রতিপালিত হইতেন সর্বনিম্ন হইতে সর্বোচ্চশ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেকেই ৫ টাকা হইতে ৫ শত টাকা মাসিক বৃত্তি পাইতেন। হযরত শাহ সাহেবের রহীমিয়া মাদরাসার নিয়মানুসারে তিনি নজীবাবাদেও একটি বিরাট শিক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। রহীমিয়া মাদরাসার মত এই মাদরাসাটিও শাহ সাহেবের রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল, নজীবুদ্দওলা প্রত্যেক দুরূহ সমস্যায় শাহ সাহেবের শরণাপন্ন হইতেন এবং তাঁহার পরামর্শ ও সাহায্য চাহিতেন। মারহাট্টা, শিখ আর জাঠদের মিলিত শক্তি যখন দিললী চড়াও করে, তখন তাঁহারই পরামর্শক্রমে নজীবুদ্দওলা এই ত্রিশক্তির এককভাবে সম্মুখীন হইয়াছিলেন। আহমদ শাহ আব্দালীকে ভারতাগমনের জন্য শাহ সাহেব যে আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন, নজীবুদ্দওলা উক্ত ব্যাপারে শাহ সাহেবের সহচর ছিলেন এবং পানিপথের সমরক্ষেত্রে এ্যাডভান্স গার্ডের তিনিই প্রধান পরিচালক ছিলেন। আব্দালীর ভারতাগমন, নজীবুদ্দওলার সহিত তাঁহার যোগাযোগ, পানিপথের সংগ্রাম, মারহাট্টাশক্তির পতন, নজীবের আমীরুল উমারা পদে নিয়োগ সমস্তই শাহ ওলীউল্লাহর চেষ্টাতেই হইয়া ছিল। যদুনাথ সরকার লিখিয়াছেন, নজীবুদ্দওলার কোন গুণের যে সবচাইতে অধিক প্রশংসা করা যায়, একজন ঐতিহাসিকের পক্ষে তাহা নির্ণয় করা বাস্তবিক দুঃসাধ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁহার বিস্ময়কর নেতৃত্বের, না বিপদে তাঁহার দূরদর্শিতা ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার, না তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ সদগুণাবলীর, যাহার ফলে সম্পর্ণ প্রতিকুল অবস্থাও তাঁহার অনুকূল ধারণ করিত? Fall of the Mughal Empire P. P. 416
১৭৭০ খৃষ্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর নজীবুদ্দওলা পরলোকবাসী হন- ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
[3]. বাঙলার কবি গঙ্গারাম এই মারহাট্টা কুক্করদের পাশবিক অত্যাচারের যে ভয়াবহ কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, ড. যদুনাথ সরকার তাঁহার Fall of the Mughal Empire গ্রন্থে তাহা উধৃত করিয়াছেন। কবি লিখিয়াছেন, বর্গীরা গ্রামাঞ্চলে লুটতারাজ শুরু করিরা দেয়। তাহারা লোকদের নাসিকা ও কর্ণ আর হস্ত ছেদন করিতে থাকে। সুন্দরী রমণীদের তাহারা দড়িতে রাঁধিয়া লইয়া যায়। এক বর্গী এক রমণীর সহিত বলাৎকার করার পর অপরাপর বর্গীরা তাহার সহিত পর্যায়ক্রমে বলাৎকার করিতে থাকে আর অসহায়া নারীর হৃদয়বিদারক চীৎকারে আকাশ কম্পিত হয়। তাহারা গৃহস্থদের বাড়ীঘর জ্বালাইয়া দেয় আর এইভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র লুঠমার করিয়া বেড়াইতে থাকে। V. I. P. P. 89
[4]. মালফযতে শাহ আব্দুল আযীয।