মাওলানা বেলাল হোসাইন (পাবনা)
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
[জনাব শামসুল আলম (যশোর) ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীর সিনিয়র সহকারী (বাংলা) শিক্ষক। এছাড়াও তিনি ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ড-এর সম্মানিত সচিব। দ্বীনের পথে নিজেকে ধরে রাখতে আইনপেশার চাকচিক্যময় রঙিন জগৎ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ছায়াতলে। ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আধুনিকতার জোয়ারে গা না ভাসিয়ে এদেশের অনন্য দ্বীনী যুবসংগঠন ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর ব্যানারে ছাত্রদের মধ্যে অহি-র দাওয়াত প্রচার করেছেন নির্ভীকচিত্তে, সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে। তার দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনের নানা স্মৃতি সম্পর্কে জানার জন্য অত্র সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তাওহীদের ডাক-এর নির্বাহী সম্পাদক আসাদুল্লাহ আল-গালিব। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হ’ল]
তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন?
শামসুল আলম : আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি ভাল আছি।
তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
শামসুল আলম : সঠিক জন্মসন বা তারিখ জানা নেই। তবে স্কুলের সার্টিফিকেট অনুযায়ী ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৬৯ খ্রি. আমার জন্মতারিখ। তবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছু স্মৃতি আমার মনে পড়ে। সে হিসাবে আমার বয়স আরও দুই তিন বছর বেশী হওয়ার কথা। যশোরের চৌগাছা উপযেলার ফুলসারা গ্রামে আমার জন্ম।
আমার দাদার নাম রইচউদ্দীন দফাদার। তিনি এলাকার সম্ভ্রান্ত ও সবচেয়ে ধনাঢ্য মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে অত্র এলাকার প্রথম হজ্জ্ব পালনকারী। আমার পিতার নাম আব্দুল মান্নান, যিনি প্রায় ১০০ বছর বয়সে ২০১৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মাতা চিয়ারবানু প্রায় ৮৫ বছর বয়সে ১৪ই ডিসেম্বর ২০১১-এ মৃত্যুবরণ করেন। আমার বাবা-চাচারা ৩ ভাই ও ১ বোন ছিলেন। আমরা ৯ ভাই ও ২ বোন। বর্তমানে আমরা ৫ ভাই ও ২ বোন বেঁচে আছি। আমি তিন সন্তানের জনক। একমাত্র বড় মেয়ে জারিন তাসনীম (২৩) আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীর বালিকা শাখার ১ম ব্যাচের ১ম ছাত্রী। সে ২০১৪ সালে দাখিল পরীক্ষার পর ৯ মাসে সম্পূর্ণ কুরআন হিফয করে। অতঃপর বগুড়ার চক লোকমান ফাতিমা (রাঃ) মহিলা মাদ্রাসা থেকে ২০১৭ সালে দাওরায়ে হাদীছ ফারেগ হয়। বর্তমানে সে সিলেট সরকারী কামিল মাদ্রাসায় অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী। সে বিবাহিতা এবং আতিফা (৫) ও নুসাইবা (২) নামক দুই কন্যার জননী। জামাতা আব্দুল আলিম ৩৩তম বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার। বর্তমানে সে সিলেট সরকারী কামিল মাদ্রাসায় কর্মরত। বড় ছেলে খালিদ (২১) বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত। ছোট ছেলে সা‘দ আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীর ১০ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত।
তাওহীদের ডাক : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
শামসুল আলম : আমি আমার নিজ গ্রাম ফুলসারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, চৌগাছা থেকে ১৯৮৩ সালে ১ম স্থান অধিকার করে ৫ম শ্রেণী পাশ করি। অতঃপর আমার বড় ভাই প্রায় ৫ কি.মি. দূরে চৌগাছা শাহাদত বহুমুখী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। ফুলসারা গ্রাম থেকে মাঝে মধ্যে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। বড় ভাই প্রধান শিক্ষক শফিউদ্দীন স্যারের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। সেদিন থেকে হেড স্যার আমার দিকে খুব খেয়াল রাখতেন। ৬/৭শ জন ছাত্র-ছাত্রীর সমন্বিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমি খুব কাছ থেকে স্যারকে পরিচালনা করতে দেখেছি।। শুনতাম স্যারের প্রায় সকল ছাত্র-ছাত্রীর নাম মনে থাকত। তিনি আর পৃথিবীতে নেই।
১৯৮৫ সালে আমি যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। অতঃপর সেখান থেকে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৯-৯০ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হই। ১৯৯২ সালে এল. এল. বি পরীক্ষায় ২য় স্থান এবং ১৯৯৩ সালে (পরীক্ষা হয় ১৯৯৫ সালে) এল. এল. এম (মাস্টার্স)-এ ২য় স্থান অধিকার করি। আমাদের সময় কেউ ১ম শ্রেণী পেত না বললেই চলে। পরীক্ষা শেষেই আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী মাদ্রাসায় শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হই। ১৯৯৯ রাজশাহী কলেজে বাংলা সার্টিফিকেট কোর্স করি। অতঃপর একই কলেজে ২০০৪ সালে ইসলামের ইতিহাসে মাস্টার্স পূর্বভাগ ও ২০০৬ সালে শেষভাগ সম্পন্ন করি।
তাওহীদের ডাক : বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আপনি কেন আইন বিষয় বেছে নিয়েছিলেন?
শামসুল আমল : আমার বাপ-দাদারা এক সময় অনেক সম্পদের মালিক ছিলেন। প্রায় শত বিঘার মত জমি ছিল। যে কারণে আশেপাশের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি অন্যায়ভাবে অনেক সম্পদ দখল করার চেষ্টা করত। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও হ’ত। বাপ-চাচারা বেশী লেখাপড়া জানতেন না। সঙ্গত কারণেই বড় ভাইদের কথা হ’ল আমাকে ভাল উকিল হ’তে হবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে সিনিয়র ভাইরা এবং হিতাকাঙ্খীদের নিকট শুনতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐ সময় সবচেয়ে কাংখিত বিষয় ছিল ‘আইন’। এই বিষয় পড়ে ওকালতি ছাড়াও বিসিএস জুডিশিয়াল তথা বিচারক হওয়া যাবে। ব্যারিস্টারি করে হাইকোর্টে ১০/১৫ বছর পর প্র্যাক্টিস করলে বিচারক হওয়া যাবে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও চাকুরী করা যাবে। সুতরাং ‘আইন’ বিষয়টি পড়লে বহুমুখী ভাল ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো বিবেচনা করেই বিষয়টি বেছে নিয়েছিলাম।
তাওহীদের ডাক : আপনি ‘আইন’ বিষয়ে পড়াশুনা করেও কর্মজীবনে কেন আইন পেশায় যান নি?
শামসুল আমল : আসলে শৈশবে বা প্রাথমিক ছাত্রজীবনে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা আমরা কখনও পাইনি। কিংবা সে সুযোগ আমার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রার্থিত সাবজেক্ট আইন। জুডিশিয়াল ক্যাডার, আইন পেশায় সুবর্ণ সুযোগ ছিল। ‘যুবসংঘ’ করতে এসে জানতে পারলাম আইন পেশা একটি অন্যায়ের সহযোগী পেশা। কেননা বর্তমানে দেশের আইন চলে বৃটিশ আইন মোতাবেক তথা মানব রচিত। অথচ কুরআনে রয়েছে, ‘যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করেনা তারা কাফির, যালিম ও ফাসিক (সূরা মায়েদাহ ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এছাড়া এদেশের জজ, উকিল, আদালত, সাক্ষী অর্থাৎ পুরা বিচার পদ্ধতিটাই ইসলামের সাথে প্রায়ই সাংঘর্ষিক। আবার আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় উকিলদেরকে দেখলে অধিকাংশ মানুষই নাক শিটকায়। কারণ ব্যাপক দূর্নীতি ঢুকে যাওয়ায় মক্কেল-উকিলদের মধ্যে অনাকাংখিত বাক-বিতন্ডার শেষ নেই।
তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অবধারিতভাবে কিছু না কিছু মিথ্যা বলতে হয়। মক্কেলদের পক্ষে আইনী লড়াইয়ে জিততে হ’লে নির্দিষ্ট অপরাধের বাইরেও ধারা পরিবর্তন করতে হয়। যেমন কেউ অন্য পক্ষ দ্বারা ইটে মাথা ফাটিয়ে আসলে সেটা বলা হয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে বা রড দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে জখম করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যার শামিল। ফৌজদারী আইনে মিথ্যার কিছু আশ্রয় না নিলে মামলায় শক্ত গ্রাউন্ড পাওয়া যায় না। মক্কেলরা ন্যায়-অন্যায় বুঝতে চায় না। তারা চায় মামলায় জিততে। অপরপক্ষে দেওয়ানী মামলায় তুলনামূলক কম মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু আইনের ফাঁকে অনেক অসহায় মানুষ তার সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে এবং এখনও ফেলছে।
যুগ যুগ ধরে মামলা চালিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করছে। এছাড়া এমনও কিছু আইন আছে যেমন- একজন পিতা তার মেয়েকে কিংবা কোন ছেলেকে ফাঁকি দিয়ে অন্য ছেলের নামে সম্পত্তি লিখে দিচ্ছে। যা ইসলামী আইনের বিরোধী। অথচ বৃটিশ আইনে তা বৈধ। এমনিভাবে নারী বিষয়ক, বিবাহ বণ্টননামা, ওয়ারিশদের ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা রাষ্ট্র তথা সব আদালতের মাধ্যমে বৈধ করা হয়েছে। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। এসবই ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। সেজন্য যেদিন থেকে ‘যুবসংঘ’-এর দাওয়াত গ্রহণ করেছি, সেদিন থেকে এই পেশাকে আমি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারিনি। একমাত্র আল্লাহর রাযী খুশীর জন্য এবং হালাল রূযী উপার্জনের কারণেই এ পেশাকে অপসন্দ করেছি।
তাওহীদের ডাক : আপনি কি জন্মগতভাবে আহলেহাদীছ? এমন কী বিষয় ছিল, যা আপনাকে আহলেহাদীছ হওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিল?
শামসুল আলম : না, আমি জন্মগতভাবে আহলেহাদীছ নই। আমার পরিবার মূলত মাযহাবপন্থী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে আহলেহাদীছ কী তা জানতাম না। আমি যখন ১ম বষের্র শেষ দিকের (১৯৯০) ছাত্র তখন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রেল স্টেশনের পার্শ্ববর্তী স্মৃতি ছাত্রাবাসে থাকতাম। আমার এক নিকটাত্মীয় ও পরম শ্রদ্ধাভাজন শফিক ভাই মাস্টার্স (বাংলা)-এর পরীক্ষার্থী ছিল। সে সূত্রে আমরা একত্রে ছিলাম। তিনি একদিন সম্ভবত আছর ছালাত শেষে বললেন, দেখ আলম! তোমরা যেভাবে ছালাত আদায় কর, তা সঠিক নয়। কেননা এটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত নয়। আমি বললাম, তাহ’লে কোন ছালাত? উনি খুব সুন্দর করে বললেন, ওটাকে মাযহাবী ছালাত বলে। সত্যের প্রতি আমার খুব দুর্বলতা ছিল। তাকে বললাম, এ আপনি কী বললেন? বড় ভাই আপনি কি শী‘আ না কাদিয়ানীদের কথা বলছেন? উনি বললেন, না ভাই ঠিকই বলেছি। তিনি কয়েকটি ছোট ছোট বই দিয়ে পড়তে বললেন।
বইগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। কিন্তু তাকে বললাম, ঐসব চটি বইয়ের কথা বিশ্বাস করি না। তিনি একদিন বিকালে আমাকে রাণীবাজার মাদ্রাসার ২য় তলায় নিয়ে যান। সেখানে দেখি একজন শ্যামলা মধ্যম দেহাবয়বের ভদ্রলোক বসে আছেন। শফিক ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, উনি ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার। তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ভাবলাম, তিনি তো অনেক বড় মাপের মানুষ। স্যারের সাথে অনেক কথা হ’ল। তিনি আমাকে কিছু বই দিলেন। পাশে বসা ছিল শেখ রফীকুল ইসলাম (সাতক্ষীরা) ও আমীনুল ইসলাম (রাজশাহী) ভাই। আমীনুল ইসলাম ভাই আর বেঁচে নেই। আমি বইগুলো পড়লাম। বইয়ে দেয়া টীকার সাথে বাংলা বুখারী-মুসলিমের হাদীছ মিলে গেল। তখন তাদের কথা আমার ঠিক মনে হ’তে লাগল। আমার এলাকার আলেমদের সাথেও কথা বললাম। কিন্তু সঠিক উত্তর পেলাম না। সবকিছু বুঝে আমি একদিন কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল শুরু করি অর্থাৎ আহলেহাদীছ হয়ে যাই। আলহামদুলিল্লাহ! আমি আহলেহাদীছ হওয়ার পর এলাকার মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনরা আমার বিরোধিতা করত। আমার বাবাকে বলত তোমার সন্তান শী‘আ হয়ে গেছে, কাদিয়ানী হয়ে গেছে ইত্যাদি। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার পিতা-মাতা, এক ভাইঝি, পরে তার ছেলে, এক ভাইপো ভাগ্নেসহ ধীরে ধীরে অনেকে এ পথে ফিরে আসে। যারা এক সময় আমার দাওয়াতের বিরোধিতা করত, তারা অনেকেই এখন আহলেহাদীছ।
তাওহীদের ডাক : সাংগঠনিক জীবনের পূর্বে আমীরে জামা‘আতের ব্যাপারে আপনার ধারণা কেমন ছিল?
শামসুল আলম : সাংগঠনিক জীবন বা আহলেহাদীছ হওয়ার পূর্বে আমীরে জামা‘আতের ব্যাপারে শুনেছি তিনি বিরাট জ্ঞানী মানুষ। তবে এর বেশী কিছু জানতাম না।
তাওহীদের ডাক :আপনার পিতার সাথে আমীরে জামা‘আতের কখনও সাক্ষাৎ হয়েছে কি?
শামসুল আলম : আমার পিতা ১৯৯৬ প্রথম সালে রাজশাহীতে আসেন। তখন আমি শিক্ষক হিসাবে মারকাযে থাকতাম। তার ইচ্ছা ছিল আমাদের এলাকায় যে মানুষটার নাম এত গুঞ্জরিত হয় সেই বিজ্ঞ শিক্ষক প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারকে দেখবেন। আমি স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করানোর পর বাবার মন্তব্য হ’ল, ‘সাতক্ষীরা মানে আমার এলাকার (যশোর) সন্তান হয়ে তিনি এত উঁচু মানের মানুষ যে রাজশাহী থেকে সারা দেশে সঠিক দ্বীনের প্রচার করে যাচ্ছেন! আমি অত্যন্ত খুশী। আল্লাহ যেন তাঁকে আরও বেশী বেশী সমাজের জন্য কাজ করার তাওফীক দান করেন’। এরপর তিনি কয়েকবার তাবলীগী ইজতেমায় এসেছেন এবং আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
তাওহীদের ডাক : আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় আহলেহাদীছ সংগঠনের পরিস্থিতি কেমন ছিল?
শামসুল আলম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির হিংস্র ছোবলে যখন মতিহারের সবুজ চত্বর রক্তাক্ত, গণতন্ত্রের নামে হিংসা-বিদ্বেষের ছড়াছড়ি এবং মাযহাবী সংকীর্ণতা নিয়ে দ্বীন প্রচারে সমাজ সয়লাব। ঠিক তখনই আমি একটা সুন্দর পথের সন্ধান পেলাম। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার সুযোগ পেলাম। আমি ভেবেছিলাম আহলেহাদীছদের ভিন্ন কোন সংগঠন নেই। কিন্তু পরে আমার ভুল ভাঙলো। জমঈয়তে আহলেহাদীছ নামক সংগঠনের প্রধান নেতা প্রফেসর ড. আব্দুল বারী এবং এর অঙ্গ সংগঠন শুববানে আহলেহাদীছ, যার নেতা আরবী বিভাগের শিক্ষক এ কে এম শামসুল আলম। অপরদিকে অত্র বিভাগেরই শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ‘যুবসংঘ’-এর প্রধান ব্যক্তিত্ব।
আমি প্রথমে ‘যুবসংঘ’-এর দাওয়াত পাই। তবুও এত সুন্দর একটা আদর্শের মধ্যে এমন বিভক্তি মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে আমি আমার সাথী ভাইদের বললাম, দু’দলকে এক করা যায় কিনা? সকলে সমস্বরে হ্যাঁ প্রস্তাব দেন। দায়িত্ব পড়ল আমার ও আব্দুর রব (মেহেরপুর)-এর উপর। পরে যুক্ত হ’ল শিমুল (কলারোয়া)। আমাকেই মূলত এ বিষয়ে বেশী কাজ করতে হয়েছে। যেহেতু আহলেহাদীছদের দু’জন প্রধান নেতা একই বিভাগের এবং আমরাও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এতে আহলেহাদীছদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব বলে মনে তীব্র আকাঙ্খা জাগে। এসব বিষয় নিয়ে প্রথমে আমীরে জামা‘আতের সাথে কথা বলি। তিনি আমাদেরকে সুন্দরভাবে কাগজপত্রসহ মৌলিক বিষয়গুলো অবগত করালেন। ফলে যুবসংঘকে জমঈয়ত থেকে পৃথক করে দেয়ার বিস্তারিত ইতিহাস জানতে পারলাম।
এরপর প্রফেসর শামসুল আলম স্যারের বিনোদপুর বাসায় যাই। এরপর খুলনায় প্রফেসর এইচ এম শামসুর রহমান (বিএল কলেজ, খুলনা)-এর নিকটে যাই। এরপর তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডীন এবং ড. বারী ছাহেবের জামাতা প্রফেসর ড. এরশাদুল বারী স্যারের নিকটে যাই। তিনি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন। উনার কাছ থেকেও অনেক তথ্য পেলাম। তিনিও আমাদেরকে এগিয়ে যেতে বললেন।
এ বিষয় নিয়ে নবাবপুর, ঢাকার জমঈয়তের কেন্দ্রীয় অফিসে কয়েকবার গিয়েছি। সেখানে জমঈয়তের কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক রফীকুল ইসলাম, মাওলানা রফীকুল ইসলাম মাদানী (সাতক্ষীরা) সহ দেশের বিভিন্ন বিশিষ্টজনের সাথে কথা বলি। ভাবি ড. আব্দুল বারী ছাহেবের সাথে কথা বলার আগে তাঁর অধস্তন দায়িত্বশীলদের কথা ও মতামত নেয়া দরকার। এভাবে দীর্ঘ এক থেকে দেড় বছর কেটে গেল। সবার মনেই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বাসনা দেখা গেল। সর্বশেষ ধাপ হিসাবে সম্ভবত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের প্রফেসর শামসুল আলম স্যারের দফতরে ড. গালিব স্যারসহ বসার সময়ক্ষণ নির্ধারণ হ’ল। উভয় পক্ষ বসার জন্য সব ঠিকঠাক। সকাল ১১টা বাজে। তারিখ ঠিক মনে নেই। তবে ১৯৯১ সাল হ’তে পারে। আমরা অনেক আশা ও ভরসা নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছি। কিন্তু হঠাৎ কোন একজন নেতা বললেন, ‘বসে লাভ হবে না। এর আগেও অনেক বসা হয়েছে।’ আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এরপর বেশ কিছু দিন কেটে গেল। আমরা হতোদ্যম না হয়ে দাওয়াতী কাজ অব্যাহত রাখলাম। ৩৫-৪০ জন ছাত্র নিয়ে রাবিতে দ্বীনের কাজ চলতে থাকে। এর মধ্যে আমি মনে মনে ঠিক করলাম কোন দিকে যাওয়া যায়। পরীক্ষা করলাম, অন্যান্য ছাত্রদের মনোভাব কী? সকলকে বললাম, এভাবে একটা নেতৃত্বের অধীনে না থেকে লক্ষ্যহীনভাবে আর কতদিন চলবে? সকলে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এ বিষয়ে আপনি যেটা করবেন সেটাই আমরা মেনে নিব। এর মধ্যে আমরা উভয় দলের নেতৃবৃন্দকে কাছ থেকে আমল-আখলাক, নেতৃত্বের যোগ্যতা, গতিশীলতা, ইসলামী লেবাস, তাক্বওয়া, জ্ঞানের গভীরতা, সংগঠনের কর্মীদের কর্মতৎপরতা ও আমাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় হলে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা সবকিছু পরখ করলাম। আমরা দেখলাম এগুলোর প্রায় সবটাই ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা আর দেরি না করে ড. গালিব স্যারের নেতৃত্বের অধীনে এসে সংগঠনে যুক্ত হয়ে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ! শুরু হ’ল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আর এক অধ্যায়। আর এক সংগ্রামী জীবন।
তাওহীদের ডাক : অন্যান্য ইসলামী সংগঠন ছেড়ে আপনি কেন ‘যুবসংঘে’র সাথে যুক্ত হলেন?
শামসুল আলম : আমাদের দেশ ও দেশের মানুষ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, কমিউনিজমের মত বস্ত্তবাদী সংগঠনে বিশ্বাসী। তাদের সকলের মূল টার্গেট রাষ্ট্র ক্ষমতা। শুধুমাত্র নির্বাচন না, যে কোন প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন হয়ে তারা সমাজ শাসনের নামে শোষণ করতে চায়। তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে বলেন, জনগণই সর্বময় ক্ষমতার মালিক। ১৯৭২ সালের মানবরচিত সংবিধানের বাইরে কারও কোন কথা বলার সুযোগ নেই। যদি ইসলামের বিরুদ্ধে কোন বিষয় থেকেও থাকে যেমন- সুদ, ঘুষ, পতিতাবৃত্তি, মাদকতা, নেতা নির্বাচন পদ্ধতি, আইনের শাসন, বিচারহীনতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, মূর্তি-ভাস্কর্য নির্মাণ, দিবস পালন প্রভৃতি যা ইসলাম সমর্থন করে না। একইভাবে ইসলামী দলগুলোও নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটাই গ্রহণ করেছে। সে হিসাবে তারাও সত্যপথের অনুসারী নয়।
তাছাড়া সকল ইসলামী রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল এদেশে মাযহাবী সংকীর্ণতায় আবদ্ধ। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কথা বললেই তারা মুরুববী, বুযুর্গ ও ইমামদের দোহাই দেয়। এসব কথা বলা মানেই রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছকে অমান্য করা। রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশ-নিষেধের বাইরে ইহকাল ও পরকালে কিভাবে মুক্তি সম্ভব? কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ’ (মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬)।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে যেমন সাংবাদিক হিসাবে, ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে, ছাত্রদের আবাসিক হলে, বিভাগের ভিতর কিংবা বাইরে সম্মানিত শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির নোংরা ও হিংস্রতাপূর্ণ ভয়াবহ অবস্থা আমাকে ভীষণ পীড়া দিত। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে ক্যাম্পাসে ব্যাপক সাড়া জাগানো একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠনের ক্ষমতা বিস্তার কেন্দ্রিক হিংসাত্মক মনোভাব দেখে তাদেরকে মোটেও আদর্শিক মনে হয় নি। অন্যান্য ইসলামী সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে শিরক-বিদ‘আতের সাথে আপোষকামীতা ছিল। পক্ষান্তরে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-কে একমাত্র আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ এবং সালাফে ছালেহীনদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জীবন-যাপনের প্রেরণাদানকারী সংগঠন বলে মনে হয়েছে। তাই বিভিন্ন আদর্শিক পার্থক্যের কারণেই এই জান্নাত পিয়াসী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হই। (ক্রমশঃ)